হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব -২৭+২৮

#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২৭
সকালে ব্রেকফাস্টের পালা শেষ হতেই নিহান সাহেব পরিবারের সবাইকে বসার ঘরে একঝোট হতে বললেন।বাড়ির প্রধান কর্তার আদেশ মোতাবেক সবাই শুরশুর করে হাজির হয় বসার ঘরে।নিহান সবাই আরেকবার সবার দিকে তাকিয়ে যাচাই-বাছাই করে নিলেন সবাই এসেছে কিনা।এইবার ইফতির দিকে একপলক তাকিয়ে গম্ভীরস্বরে বলে উঠেন,
-‘ইফতি আমি যা বলব মন দিয়ে শুনবে।’

হঠাৎ নিজের উদ্দেশ্যে এমন একটা কথা শুনে সজাগ হয়ে দাঁড়ায় ইফতি।সাবলীলভাবে বলে,
-‘ জি চাচ্চু বলো।’

গলা খাকারি দিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নেন নিহান সাহেব তারপর বলেন,
-‘ ইফতি তুমি বুঝদার হয়েছো। অফিসেও জয়েন করেছ বেশ কিছুদিন হয়েছে।তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এইবার তোমাকে বিয়ে করাবো।আরাবী মায়ের ছোটো বোন ফিহাকে তো চিনই?ফিহার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করতে চাইছি।এতে তোমার মতামত কি?’

নিহান সাহেবের মুখে হঠাৎ এরূপ কথা শুনে আশ্চর্য হয় সবাই।আরাবী তো বিষ্ময়ের সপ্তম চূড়ায়।একে একে সব বুঝতে পারলো আরাবী।কাল বোধহয় এর জন্যেই সাখাওয়াত পরিবারের সবাইকে ওর বাবা মা দাওয়াত করেছেন।আর এর পেছনে যে ওর মা আর বোন দায়ি তা বেশ ভালোই জানে।আরাবী এটা ভেবে কষ্ট পেলো যে ওর বাবা ওকে না জানিয়ে এভাবে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো।একবার কি ওকে এই বিষয়ে জানাতে পারতো নাহ? বাবা কিভাবে এমন একটা কাজ করতে পারল ওর বাবা? বাবার প্রতি বেশ অভিমান হলো আরাবীর।

ইফতি স্তব্ধ হয়ে রইলো কিয়ৎক্ষন এমন কথা শুনে।কিছু মুহূর্ত পরে সবটা বুঝতে পেরে নিজেকে সামলে নিয়ে ইফতি বেশ শান্ত গলায় বলে,
-‘ চাচ্চু আমি তোমাকে সম্মান করি।তোমার সব সিদ্ধান্ত আমি চোখ বন্ধ করে মেনে নেই। তবে চাচ্চু এইবার আমি মানতে পারছি না।আমাকে ক্ষমা করবে চাচ্চু।তবে আমি এই বিয়ে করতে পারবো নাহ।’

ইফতির মুখে সোজাসাপ্টা না শুনে নিহান সাহেব এইবার বেশ রুক্ষভাষী হয়ে বলেন,
-‘ তা কেন আমার সিদ্ধান্ত তুমি মানতে পারবে নাহ?কি এমন কারন তোমার?কোন সঠিক কারন আমাকে দেখাও তুমি।যে কেন তুমি এই বিয়ে কর‍তে পারবে নাহ।’

ইফতি একটুও ভয় পেলো না।কেন পাবে সে ভয়? ও তো ভালোবেসেছে।আর ভালোবাসলে কোনদিন ভয় পেতে হয় না।ইফতি জোড়ে শ্বাস নিলো।চোখ বন্ধ করে বলে দিলো,
-‘ কারন আমি একজনকে ভালোবাসি।আর তাকেই বিয়ে করতে চাই।’
-‘ কে সেই মেয়ে।যার জন্যে তুমি আমার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাচ্ছো।’
-‘ তাকে তুমি চেনো চাচ্চু!’
-‘ এতো ভণিতা ভালো লাগছে না ইফতি সোজাসুজিভাবে বলে দেও।কে মেয়েটা?’
-‘ ভাবির ফ্রেন্ড আলিফা।আলিফাকে আমি ভালোবাসি চাচ্চু।আর বিয়ে করলে আমি ওকেই করবো।’

ইফতির মুখে আলিফাকে ও ভালোবাসে শুনে অবাক মিহান সাহেব।খুশিতে লাফিয়ে উঠতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন।যাক ছেলে তার একেবারে মনমতো একটা জবাব দিয়েছে। ছেলের মুখে অন্যজনকে ভালোবাসে শুনে যেটুকু না ভয় পেয়েছিলো।এখন ছেলের সেই ভালোবাসার মানুষটা যে তারই পছন্দ করা মেয়ে শুনে তার থেকেও দ্বিগুন খুশি হয়েছে।যাক তার আর ছেলের কান টেনে বিয়ে করার কথা বলা লাগবে না।ছেলে তার এমনিতেই একপায়ে রাজি।

ইফতি এটুকু বলে সবার দিকে তাকালো। সবাই তার দিকেই তাকিয়ে।ইফতি ভ্রু-কুচকে বলে,
-‘ আশ্চর্য! এমনভাবে তাকানোর কি আছে?’

মিলি বেগম নিজের হা করে রাখা মুখ বন্ধ করলেন।এরপর বলেন,
-‘ কবে থেকে চলছে এসব?আর তুই আমায় বললিও নাহ?’
-‘ উফ মা কান্নাকাটি করো না তো?এখানে তো তোমার খুশি হওয়ার কথা।যদি ছেলের বিয়েই দিতে চাও।তাহলে সে যাকে ভালোবাসে তার সাথেই দেও।অন্যথায় তোমরা না চাইলেও আমি আলিফাকেই বিয়ে করব।’

নিহান সাহেব হালকা রাগিস্বরে বলে,
-‘ এইভাবে কথা বলছো কেন ইফতি? আমরা কি তোমার খারাপ চাইবো?’

মাথা নিচু করে নিলো ইফতি।ধীর আওয়াজে বলে,
-‘ সরি চাচ্চু।বাট তোমরা যদি আমাকে বিয়ে করাতেই চাও।তাহলে আমি আলিফাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো নাহ।বাকিটা তোমরা জানো।আমি এখন অফিসে গেলাম।আসি।’

কথা বলেই উঠে দাঁড়ালো ইফতি।তারপর গটগট পায়ে বেড়িয়ে গেলো।ইফতি চোখের আড়াল হতেই হেসে উঠেন নিহান সাহেব।সবার উদ্দেশ্যে বলেন,
-‘ ছেলের বিয়ের আয়োজন শুরু করো।আলিফার বাসার ঠিকানা দিও তো আমায় বউমা।প্রস্তাব নিয়ে যেতে হবে তো।’

মুচঁকি হেসে আরাবী বলে,
-‘ ঠিক আছে বাবা।’

হঠাৎ নিহান সাহেব চুপ করে গেলেন।হতাশ গলায় বলেন,
-‘ কিন্তু বউমা আমি জিহাদ ভাইকে কি জবাব দিবো।কিভাবে কি বলবো তাকে আমি। ‘

দীর্ঘশ্বাস ফেললো আরাবী।তারপর বলে,
-‘ ও আপনি চিন্তা করবেন নাহ বাবা।আপনি তো অফিসে যাবেন।সেখানে বাবার সাথে কথা বলে নিবেন আমার বাবা বুঝদার মানুষ। বুঝে যাবেন।সমস্যা নেই।আপনি চিন্তা করবেন না।আর রইলো বাকি কথা।আমি কাল আবার যাবো বাড়িতে।গিয়ে বাকিদের ভালোভাবে বুঝিয়ে বলব।’

আরাবীর কথায় যেন সস্তির নিশ্বাস নিলো জিহাদ সাহেব।তারপর তিনি আর মিহান সাহেব চলে গেলেন অফিসে।রুমে চলে আসে আরাবীকে নিয়ে জায়ান।আরাবী সোজা গিয়ে জায়ানের অফিসের ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছে।আরাবীর ছোট্টো মুখটা দেখে নিয়েই জায়ান বলে,
-‘ কি হয়েছে?মন খারাপ?’
-‘ উহু!’
-‘ আমি জানি মন খারাপ।এখন কারনটা বলো।’

থপ করে বিছানায় বসে পরলো আরাবী।ধরা গলায় বলে,
-‘ আমি জানি বাবা কাল ফিহার সাথে ইফতি ভাইয়ার বিয়ে নিয়েই কথা বলার জন্যে আপনাদের দাওয়াত করেছেন।আমার কষ্ট এই জায়গাতেই জায়ান।যে তিনি একবারও আমাকে এই বিষয়ে জানালেন নাহ।বিয়ের পর কি আমি এতোটাই পর হয়ে গেলাম তার কাছে।’

এগিয়ে আসে জায়ান।পাশে বসে আরাবীর।ওকে টেনে নেয় বুকের মাঝে।জায়ানের বুকে মুখ গুজে দেয় আরাবী।জায়ান বলে,
-‘ মন খারাপ করার কিছুই নেই এখানে আরাবী।হয়তো বাবা কোন কারনেই এমন করেছেন।অথবা তিনি চেয়েছেন সবটা ঠিকঠাক হওয়ার পরেই তোমার সাথে কথা বলতেন। অথবা চিন্তায় তিনি এই বিষয়ে ভুলেই গিয়েছেন।বয়স হয়েছে তার আরাবী।এটুকু বোঝার ক্ষমতা তো তোমার আছে তাই নাহ?’

আরাবী কিছু বলল না।জায়ান আবার বলে,
-‘ কাল যাবে সিয়র?’
-‘ হু!’
-‘ আচ্ছা,আমি গিয়ে দিয়ে আসব।’
-‘ নাহ,আপনিও আমার সাথে যাবেন। আমি বেশিক্ষন থাকব নাহ।বিকেলে গিয়ে সন্ধ্যায় চলে আসব।’
-‘ আচ্ছা যাবো।’

সরে আসলো আরাবী।জায়ান বিরক্ত হয়ে বলে,
-‘ আহ,সরলে কেন?’

ভ্রু-কুচকে আরাবী বলে,
-‘ অফিসে যাবেন নাহ?’

সটান হয়ে সুয়ে পরে জায়ান।তারপর হুট করে আরাবীকে টেনে ওর বুকের উপর সুইয়ে দিলো।হকচকিয়ে গেলো আরাবী।জায়ান দুষ্টু হেসে বলে,
-‘ যেতে ইচ্ছে করছে না।গতকাল শশুড়বাড়ি যাওয়ায় বউয়ের সাথে রোমান্স করতে পারেনি। তাই সেটা আজ পুষিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে।’

জায়ানের হাত ঠেলেঠুলে উঠে দাড়ালো আরাবী।তারপর বলে,
-‘ আপনার অস’ভ্য কথাবার্তা বন্ধ করুন।আর উঠুন। যান অফিসে যান।কোনরকম চালাকি করবেন নাহ।’

আরাবী জায়ানের হাত ধরে টানাটানি করছে।কিন্তু ওর মতো আরাবী কি আর জায়ানের মতো বিশালদেহি পুরুষকে উঠাতে পেরে।উহু পারে না।তাইতো একটুতেই হয়রান হয়ে গেলো আরাবী।জায়ান তা দেখে নিজেই উঠে দাড়ালো।দুহাতে চুলে বেকব্রাশ করে বিরক্ত কণ্ঠে বলে,
-‘ তোমার জন্যে দেখছি শান্তি নেই। কোথায় তুমি আরেকটু আদর সোহাগ দিয়ে বলবে,’থাক জান আজ অফিসে যাওয়ার দরকার নেই।আমার সাথেই থেকো।’ এটা তো বলবেই না।আর রইলো তুমি ডাক।সেটাও আমার এই ইহজনমে শোনা হবে নাহ।’

খিলখিল করে হেঁসে দিলো আরাবী জায়ানের এমন বাচ্চামো দেখে।আরাবীর হাসি দেখে জায়ানের ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে উঠে।জায়ান এগিয়ে গিয়ে আরাবীর দুগালে হাত রেখে আদুরে চুমু খেলো আরাবীর কপালে।সরে এসে তারপর বলে,
-‘ আসি লেইট হয়ে যাচ্ছে।থাকতে যেহেতু দিবে নাহ।তাই দেরি করে লাভ নেই।’
-‘ আচ্ছা সাবধানে যাবেন।’

জায়ান অফিস ব্যাগ নিয়ে চলে গেলো।আর তার যাওয়ার পানে মুঁচকি হেসে তাকিয়ে থাকলো আরাবী।
#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২৮
রেডি হয়ে আরাবী গাড়িতে উঠে বসলো।গন্তব্য আজ বাবাবাড়ি যাবে।নিহান সাহেব বিয়ের প্রস্তাবে নাকচ করে দিয়েছে।সেখানের পরিস্থিতি কেমন না কেমন।তাই সবাইকে সবটা ভালোভাবে বোঝানোর জন্যেই যাবে আরাবী।জায়ান এগিয়ে এসে আরাবীর সিটবেল্ট বেধে দিলো।তারপর নিজের জায়গায় সরে এসে বলে,
-‘ আমি বলেছিলাম আমি তোমার সাথে যাবো।তবে সরি।তা আর পারছি না।অফিসে কিছু জরুরি কাজ পরে গিয়েছে তাই আমায় যেতে হবে।তোমাকে পৌছে দিয়ে আমি অফিসে যাবো।চিন্তা করো না।আমি বিকেলে তোমাকে এসে নিয়ে যাবো।’

মুঁচকি হেসে আরাবী বলে,
-‘ আরে বাবা এতো কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন নেই।আপনার জরুরি বলেই আপনি যাবেন আমি জানি।সমস্যা নেই আপনি যান।বিকেলে আমাকে নেওয়ার জন্যে আসিয়েন।’

আরাবীর কথায় সস্থির নিঃশ্বাস ফেললো জায়ান।তারপর রওনা হলো মৃধা বাড়ির উদ্দেশ্যে।বাড়ির সামনে আরাবীকে নামিয়ে দিয়ে জায়ান চলে যায় অফিসে।আরাবী বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।দরজার সামনে গিয়ে কলিংবেল বাজাতেই ঘরের হেল্পিংহেন্ড সায়মা এসে দরজা খুলে দেয়।আরাবী ঘরে প্রবেশ করে দেখে জিহাদ সাহেব সোফায় বসে আছেন।আরাবী সোজা গিয়ে বাবার পাশে বসে।জিহাদ সাহেব মেয়েকে দেখে মলিন হাসেন।আরাবী সালাম দিয়ে বলে,
-‘ বাবা কেমন আছো?’
-‘ এইতো মা। ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?’
-‘ আলহামদুলিল্লাহ। আমি ভালো আছি।’

ওদের কথার মাঝে হঠাৎ ফিহার কণ্ঠ শোনা গেল,
-‘ ভালো তো তুই থাকবিই।আমার বিয়ে ভেঙে তো তোর আনন্দের শেষ নেই।’

অবাক হলো আরাবী।প্রশ্ন করল,
-‘ এসব কি বলছিস ফিহা?আমি কেন তোর বিয়ে ভাঙবো?’
-‘ একদম ন্যাকা সাজবি না তুই।’

লিপি বেগম ধমকে উঠলেন আরাবীকে।আরাবী বলে,
-‘ আম্মু এখানে ন্যাকা সাজার কিছুই নেই। আমি যা সত্য তাই বললাম।ইফতি ভাইয়া আলিফাকে ভালোবাসে।আর আলিফাও ইফতি ভাইয়াকে ভালোবাসে।আর জোড় করে কোনদিন কিছু হয় নাহ আম্মু।আর ইফতি ভাইয়া ফিহাকে ভালোবাসে না।সেখানে বিয়ে হলে ফিহা ভালো থাকবে না।’

এমন কথায় তেড়ে আসল ফিহা।রাগে ফুসতে ফুসতে বলে,
-‘ তোর জ্ঞান তোর কাছে রাখ।তুই নিজেই ওই বাড়িতে আমার বদনাম করেছিস।আর তা শুনেই তো তারা বিয়েতে রাজি হলো না।’
-‘ দেখ ফিহা তুই ভুল ভাবছিস।’
-‘ আমি কোন ভুল ভাবছি নাহ।আমি ঠিকই ভাবছি।সবাই ঠিকই বলে জানিস আরাবী।রাস্তা থেকে তুলে আনা কোন ব্যাক্তি কারো আপন হতে পারে না।তাকে যতোই আদর যত্ন করা হোক না কেন।আর তুই তার জলজ্যান্ত প্রমান।’

জিহাদ সাহেব সাথে সাথে ধমকে উঠলেন ফিহকে,
-‘ বে’য়াদপ মেয়ে।মুখে লাগাম টানো।কিসব বলছো তুমি তোমার ধারনা আছে?’

ফিহার এমন কথায় আরাবী থমকে গেলো।বুকের ভীতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো তার।কি বলছে কি ফিহা?রাস্তা থেকে তুলে আনা মানে?আরাবী কাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
-‘ রাস্তা থেকে তুলে আনা মানে?কি বলছিস তুই আরাবী?’
-‘ কিছু না মা।তুই ও কথায় ধ্যান দিস না।’ জিহাদ সাহেবের অস্থির গলা।

লিপি বেগম তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলেন,
-‘ আর কতোকাল তুমি লুকাবে ফাহিমের বাবা?আর কতো?রাস্তা থেকে এই মেয়েকে তুলে এনে।তুমি যেভাবে আদর যত্ন করেছো।কই নিজের মেয়েকে তো কোনদিন করোনি? কে এই মেয়ে?কে? হ্যা?না আছে নাম পরিচয়?না আছে বাবা মায়ের পরিচয়?না আছে বংশ পরিচয়।কুরিয়ে আনা মেয়ের জন্যে কিসের এতো দরদ তোমার হ্যা?যে তার জন্যে নিজের আপন মেয়েকে এতো অবহেলা করছো তুমি?’

মাথায় যেন বজ্রপাত হলো আরাবীর।হৃদপিণ্ডটা মনে হয় কেউ খামছে ধরেছে।অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে সেখানে।কি বলছে কি এসব তার আম্মু। ওর আব্বু আম্মু ওর আসল বাবা মা না?ওকে কুরিয়ে এনেছে?কি শুনছে এসব ও?ওর জন্ম পরিচয় নেই কোন?নাহ,এটা হতে পারে না।এটা সত্যি না।আরাবী একপা দুপা করে ওর বাবার সামনে গিয়ে দাড়ালো।না চাইতেও দুচোখ বেয়ে চোখের পানি ঝরছে আরাবীর।আরাবী শ্বাস টানলো লম্বা করে।তারপর নিজেকে শক্ত করলো।বেশ কঠিন স্বরে প্রশ্ন করে,
-‘ আব্বু?আম্মু কি বলছে এসব?আমি তোমার মেয়ে না।এইগুলো কি বলছে আম্মু?আব্বু,জবাব দেও।আমি কি তোমাদের মেয়ে না-কি নাহ?’
-‘ দেখ আরাবী মা আমার কথাটা শোন একবার।’

জিহাদ সাহেবকে থামিয়ে আরাবী আবার বলে,
-‘ শুধু এটুকু উত্তর দেও আব্বু।আমি তোমার মেয়ে নাকি নাহ?’

মাথা নিচু করে নিলেন জিহাদ সাহেব।ধুকরে কেঁদে উঠেন তিনি।কিভাবে সে বলবে যে হ্যা আরাবী তার জন্ম দেওয়া মেয়ে নাহ।তবে আরাবীকে কখনও হেলাফেলা নজরে দেখেননি তিনি। সর্বদা নিজের বড়মেয়ের স্থানে রেখেছেন।কখনও মনে আরাবীকে মনে করেন নি যে ও তার সন্তান নাহ।আরাবী আবারব একই প্রশ্ন করতেই থপ করে সোফায় বসে পরেন তিনি।পুরুষ মানুষ নাকি সহজে কাঁদেন নাহ।অথচ জিহাদ সাহেব আজ ভেঙেচুরে গুড়িয়ে গিয়েছেন।এভাবে নিজের সন্তানকে কষ্ট পেতে দেখতে হবে ভাবতেও পারেননি।জিহাদ সাহেব কান্নারত গলায় বলে উঠেন,
-‘ মানছি তুই আমার জন্মের সন্তান নাহ?তাই বলে কি আমি তোর বাবা নাহ?বল?জন্ম দিলেই কি বাবা মা হওয়া যায়?এইযে আমি তোকে ছোটো থেকে বড় করেছি এতে কি তোর কোনদিন মনে হয়েছে যে আমি তোর বাবা নাহ?মারে যতো যাই হোক।তুই আমার বড় মেয়ে।তুই আমার সন্তান।আমার আরাবী মা তুই।’

আরাবী বাবার পায়ের কাছে বসে পরে।বাবার হাটুর ভাঁজে মুখ লুকিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠে আরাবী।সে মানতে পারছে না কিছুতেই মানতে পারছে না।লিপি বেগম এখনও রাগি চোখে তাকিয়ে।ফিহা রাগে চিৎকার করে বলে,
-‘ আম্মু এই মেয়েকে বেড়িয়ে যেতে বলো এই বাড়ি থেকে।ওকে আমার সহ্য হচ্ছে না।এই বাড়িতে হয় এই মেয়ে থাকবে নয়তো আমি।বের করে দেও ওকে।’

লিপি বেগম ফিহার কথামতো তেড়ে গেলেন আরাবীর কাছে।আরাবীর চুল মুঠি করে ধরে ওকে টেনে দাড় করালো।ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো আরাবী। করুন গলায় বলে,
-‘ আম্মু ব্যাথা পাচ্ছি আমি।’
-‘ কে তোর আম্মু?আমি তোর আম্মু নই।আমাকে আম্মু বলে ডাকবি না। বেড়িয়ে যাহ এখান থেকে।তোর চেহারাও আমার দেখতে ইচ্ছে করছে না।’

জিহাদ সাহেব তাড়াতাড়ি এগিয়ে যান।লিপি বেগমের কাছ থেকে আরাবীকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকেন।লিপি বেগম ছেড়ে দেন আরাবীকে।জিহাদ সাহেব বলেন,
-‘ পাগল হয়ে গিয়েছো তুমি?কি করছো কি এসব তুমি?’

লিপি বেগম চিৎকার করে উঠলেন,
-‘ যা করেছি ভালো করেছি।একটা রাস্তার মেয়ের জন্যে আজ তুমি আমার সাথে এইভাবে কথা বলছ।ঠিক আছে আজ আমি দেখে নিবো।তুমি কাকে চাও আমাকে নাকি এই রাস্তার মেয়েকে।যদি এই মেয়েকে বেছে নেও।তাহলে আমি এই মুহূর্তে ফিহাকে নিয়ে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।’

-‘ ঠিক আছে তাই হবে চলে যাও তুমি।তোমার মতো মানুষকে যে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি ভেবেই নিজের উপরেই রাগ উঠছে।’

লিপি বেগম কান্না করে দিলেন জিহাদ সাহেবের কথায়। কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
-‘ আজ এই দিন দেখার বাকি ছিলো আমার। শেষে কিনা এই মেয়ের জন্যে তুমি আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলছো?ঠিক আছে তাই হবে।আমি শুধু বাড়ি ছেড়ে না এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো।থাকো তুমি এই মেয়েকে নিয়ে।’

লিপি বেগম দৌড়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।জিহাদ সাহেব নিজেও ভয় পেয়ে গেলেন।শতো হোক তিনি তার স্ত্রীকে ভালোবাসেন।নিজের ভালোবাসার মানুষটার মৃত্যু কামনা তিনি কখনই করবেন নাহ।আরাবী চিৎকার করে উঠলো।দরজা পিটাতে লাগলো।কান্না করতে করতে বলে,
-‘ আম্মু প্লিজ এমন করো না।আমি চলে যাবো আম্মু।তুমি বের হও।আমি আর কোনদিন এই বাড়িতে আসবো না কোনদিন নাহ।প্লিজ আম্মু বের হও তুমি।আমি হাত জোড় করে বলছি আম্মু।আমি জীবনে আমার চেহারা তোমাদের দেখাবো না।তুমি এমনটা করো না আম্মু।’

বার বার একই কথা বলছে আরাবী।ফিহাও কান্না করে লিপি বেগমকে বের হতে বলছেন।জিহাদ সাহেব চেয়েও কিছু করতে পারছে না।একদিকে তার ভালোবাসার মানুষ আত্ম’হত্যা করতে চাইছেন।আর একদিনে তার মেয়ে।আজ তিনি এমন এক কাঠগড়ায় দাঁড়ানো যে তিনি এদিকও যেতে পারছেন নাহ ওদিকেও যেতে পারছে না।আরাবী গিয়ে জিহাদ সাহেবের সামনে দাড়ালো। বাবার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ধুকড়ে কেঁদে উঠলো।বলল,
-‘ আব্বু তুমি আম্মুকে বের হতে বলো।আমি আর কোনদিন এখানে আসব নাহ।তুমি তার কথা মেনে নেও আব্বু।আমার আম্মুর যেন কিছু না হয় আব্বু প্লিজ।আব্বু তোমার পায়ে পরি।আব্বু আমি নাহলে মরে যাবো আব্বু আমার আম্মুর কিছু হলে।

আরাবী জিহাদ সাহেবের পা ধরতে নিলেই তিনি আরাবীকে থামিয়ে দেন।মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
-‘ তুই যা চাস তাই হবে মা।’

জিহাদ সাহেব মনের পাথর রেখে লিপি বেগমকে বলেন,
-‘ তুমি বের হয়ে আসো লিপি।আরাবী আর কোনদিন এই বাড়িতে আসবে না।তুমি যা চাও তাই হবে।বের হয়ে আসো।’

এই কথা শুনে সাথে সাথে বের হয়ে আসলেন লিপি বেগম।আরাবী তার সামনে গিয়ে কান্নারত গলায় বলে,
-‘ আমি আর এখানে আসব না আম্মু।তুমি ভালো থাকো আম্মু।’

তারপর জিহাদ সাহেবের কাছে এসে জিহাদ সাহেবকে জড়িয়ে ধরে সজোড়ে কেঁদে দেয় মেয়েটা।
-‘ তুমি আমার আব্বু।আমি জানি তুমি আবার আব্বু।আমি তোমার মেয়ে।সে যাই হয়ে যাক না কেন।তুমি আমাকে যেভাবেই এনে থাকো না কেন।আমি শুধু এটুকু জানি তুমি আমার আব্বু।’
-‘ মারে তুই আমার মেয়ে।আমার আরাবী তুই।কে কি বলল কানে নিবি না।তুই আমার মেয়ে ছিলি,আছিস আর সারাজীবন থাকবি।’

ফিহা গিয়ে আরাবীর হাত চেপে ধরে।টেনে আরাবীকে সরিয়ে আনে।রাগি গলায় বলে,
-‘ অনেক হয়েছে তোর মেলোড্রামা।যা বের হো এখান থেকে।আর কোনদিন এখানে আসবি নাহ।’

ফিহা টানতে টানতে আরাবীকে বাড়ির বাহিরে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো।দরজা বন্ধ করে দিলো ফিহা।আরাবী অশ্রুসিক্ত নয়নে দরজা বন্ধ অব্দি ওর বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো।যতোক্ষন দেখা গেলো তাকিয়েই রইলো।

#চলবে____________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here