হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব -৩১+৩২

হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩১
-‘ আরাবী আমার আসল মেয়ে নাহ। দত্তক নিয়েছি আমি ওকে।ও আমার পালক মেয়ে।’

জিহাদ সাহেবের এই মুখে এই কথা শুনে যেন সবাই আকাশ থেকে পরলো। বিষ্মিত দৃষ্টিতে সবাই তাকিয়ে।কিন্তু সবার মাঝে জায়ানের কোন রূপ কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না।জায়ান পুরো নির্বিকার। ও শান্ত গলায় বলে,
-‘ সবটা জানতে চাই আমি বাবা।আমাকে সবটা বলুন।’

জিহাদ সাহেব বেশ অবাক হলেন।কি আশ্চর্য ব্যাপার।এমন একটা ভয়ানক সত্যি কথা তিনি বলে দিলেন।অথচ জায়ান তা শুনেও শান্ত হয়ে আছে।ঠিক কিভাবে? তবে তিনি আর মাথা ঘামালেন নাহ।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলা শুরু করলেন,
-‘ অফিস ছুটির পর বাসায় ফিরছিলাম।হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশে ময়লার স্তুপে পাশে কাউকে বাচ্চা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়েছিলাম।তার থেকে বেশি অবাক হয়েছিলাম যখন দেখলাম লোকটা বাচ্চাটাকে সেখানের ময়লার মাঝে রেখে চলে যাচ্ছিলো।আমি দ্রুত মোটর সাইকেল টান দিয়ে লোকটার কাছে যাই।গিয়েই জিজ্ঞেস করি কেন এমন করলেন তিনি।কেন এই নবজাতক বাচ্চাটাকে এভাবে ফেলে রেখে গিয়েছেন।লোকটা বলে তিনি কিছুই জানেন নাহ।তাকে শুধু টাকা দেওয়া হয়েছে এই কাজের জন্য ব্যস।আমি আর কিছু বললাম না লোকটাকে।সেখান থেকে ফিরে এসে বাচ্চাটার কাছে এসে দাড়ালাম।বাচ্চাটাকে দ্রুত কোলে তুলে নিলাম।কি নিস্পাপ তার চাহনী।কি নিস্পাপ মুখশ্রী।এমন মায়াবী পুতুল বাচ্চাকে কেউ কি করে এভাবে ফেলে আসার কথা বলতে পারে। সেদিন তীব্র শীত ছিলো।বাচ্চাটার গায়ে পাতলা একটা কাথা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।অথচ বাচ্চাটা কি সুন্দর তার ফোঁকলা দাঁতে আমাকে দেখে হাসছিলো।ওর নরম ছোটো ছোটো হাত দুটো দিয়ে আবার হাতের আঙুল মুঠোয় পুরে নিয়েছিলো।মায়াময়ী ডাগর ডাগর চোখ দিয়ে আমাকে দেখছিলো।আমার অন্তর নারা দিয়ে উঠলো।অনেক আগে থেকেই মেয়ে সন্তানের অনেক শখ আমার।কিন্তু ফাহিম হবার পর কিছুতেই লিপি কনসিভ করছিলো না।তাই বাচ্চাটাকে দেখে তৎক্ষনাত সিদ্ধান্ত নিলাম।আজ থেকে ও আমার মেয়ের পরিচয়ে বড় হবে।আমি হবো ওর বাবা।আর ওই বাচ্চাটাই আমার মেয়ে আমার আরাবী।সেদিন রাতে আরাবীকে বাসায় নিয়ে আসলাম ।লিপি দেখে সেদিন কিছুই বলল না।ওকে সবটা বলার পর ও নিজেও আরাবীকে আদর স্নেহ করতো।ফাহিম তো বোনকে পেয়ে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে এমন অবস্থা হয়েছিলো ওর।আমি আইনতভাবে আরাবীকে নিজেদের সন্তান হিসেবে দত্তক নিলাম।সবটা ভালোই চলছিলো।বিপত্ত ঘটলো ফিহা জন্ম হওয়ার পর থেকে।কিভাবে যেন লিপির মনে হিংসা সৃষ্টি হতে লাগলো।ফিহা হবার পর থেকে যেন আরাবী ওর দুচোখের বি’ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।কোনদিন ভালোভাবে দুটো কথা বলতো না আমার মেয়েটার সাথে।মেয়েটা আমার মায়ের ভালোবাসার জন্যে কাঙালের মতো করতো।আমি সব বুঝতাম কিন্তু কি করবো বলো?ভয় হতো পাছে না আবার লিপি রেগে গিয়ে আরাবীকে সব সত্যি বলে দেয়। কিন্তু দেখো আমি যেই ভয়ে এতোদিন চুপ ছিলাম। এতো কিছু মেয়েটাকে সহ্য করতে দিলাম।আজ তাই হলো।আমার মেয়েটা সব জেনে গিয়েছে আজ।এই কারনেই তো এতোটা মানষিক কষ্ট পেয়েছে।আজ আমার এই গাফিলতির কারনেই আমার মেয়েটার এই অবস্থা।আমি ব্যর্থ আজ বাবা হিসেবে।’

হু হু করে কেঁদে দিলেন জিহাদ সাহেব।মেয়ের জন্যে তার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে।জিহাদ সাহেব চোখ মুছে জায়ানের কাছে গেলো।তারপর জায়ানের হাত দুটো ধরে কাতর গলায় বলে,
-‘ আমি ওর জন্মদাতা না ঠিকই। কিন্তু ও আমার মেয়ে।আমি ওর বাবা। বিশ্বাস করো বাবা।আরাবীকে আমি কতোটা ভালোবাসি তা বলে বুঝাতো পারবো না।মেয়েটা আমার কলিজার টুকরো। যতো যাই হয়ে যাক না কেন।দুনিয়া একদিনে আর আমার মেয়ে একদিকে। আমার মেয়েকে কোনকিছুই আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না।সে যতোই যা হয়ে যাক।কিন্তু বাবা তুমি আরাবীর এসব সত্যি জানার পর আরাবীকে অবহেলা করো না বাবা।তাহলে আমার মেয়েটা পুরোপুরি মরে যাবে বাবা। ওকে অবহেলা করো না।’

জায়ান ওর লাল হয়ে আসা চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো।ওর নিজেরই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে সবটা জানার পর।না জানি আরাবীর কেমন লেগেছে। জায়ান চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-‘ জায়ান সাখাওয়াত সেদিন আপনার মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে যাওয়ার সময়েই বলেছিলাম আপনার মেয়েকে আমি কোনদিন কষ্ট দিবো না।সবসময় আগলে রাখবো।আর আজও আমি জায়ান সাখাওয়াত আবারও আপনার কাছে ওয়াদা করলাম আপনার মেয়েকে আমি কোনদিন কষ্ট দিবো না।নিজের শেষ নিশ্বাস অব্দি ওকে আগলে রাখবো। যতো ঝড়ঝাপ্টা আসুক জায়ান সাখাওয়াত তার স্ত্রীর পাশে সর্বদা ঢাল হয়ে দাঁড়াবে।’

জিহাদ সাহেবের বুকে যেন পানি আসে।অবশেষে তিনি পেরেছেন তার মেয়ের জন্যে উত্তম জীবনসঙ্গী এনে দিতে। নিহান সাহেব এগিয়ে এসে জিহাদ সাহেবের কাধে হাত রেখে বলেন,
-‘ আরাবী শুধু আপনার মেয়ে না ভাই।আরাবী আমারও মেয়ে।আপনি চিন্তা করবেন না।আরাবীকে আমার পরিবার নিজেদের সবটা দিয়ে ভালোবাসবে।’

সাথি বেগম বলেন,
-‘ আরাবী মায়ের ভালোবাসা আগে পায়নি তো কি হয়েছে?এখন তো পায়? আমি ওর মা।ও আমার মেয়ে ভাই।’

মিলি বেগম বলেন,
-‘ আমিও তো আরাবীর মা।’

মিহান সাহেব বলেন,
-‘ আরেহ আমিও তো আরাবীর আরেকটা বাবা।’

ইফতি বলে,
-‘ আমি ভাবির ভাই আছি না।’

-‘ আমিও তো ভাবির বোন।’ এগিয়ে এসে বলে নূর।

জিহাদ সাহেব আর ফাহিম খুশিতে বাকহারা হয়ে যান। আরাবীর কঁপালে যে আল্লাহ্ এতো ভালো একটা পরিবার লিখে রেখেছেন কোনদিন ভাবতেও পারেননি তিনি।সত্যি আল্লাহ্ মহান।তিনি সব পারেন।ফাহিম চোখের কোণের জলটুকু মুছে নিয়ে ম্লান গলায় বলে,
-‘ বোনটার আমার ভাগ্য অনেক ভালো।তাই তো সে আপনাদের মতো পরিবার পেয়েছে।যারা ওকে এতোটা ভালোবাসে।’

নূর ভরশা দিয়ে বলল,
-‘ ভাবিকে আমরা সবাই অনেক অনেক ভালোবাসা দিবো। যাতে ভাবির একটুও মন খারাপ না হয় কোনদিন।’

ফাহিম কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলে,
-‘ ধন্যবাদ।’

জিহাদ সাহেব লিপি বেগমের দিকে তাকালেন। যে আপাততো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।জিহাদ সাহেব তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
-‘ যাকে তুমি এতোটা অবহেলা আর তুচ্ছ করেছ।দেখো সেই আজ এই গোটা পরিবারের কাছে তাদের চোখের মনি।আফফোস লিপি তুমি বুঝলে না।তুমি আরাবীকে সামান্য ভালোবাসাটুক কোনদিন দেও নি।অথচ মেয়েটা আমার তোমাকে সবটা দিয়ে ভালোবেসেছে।মনে পরে লিপি একবার তোমার জ্বর হয়েছিলো।আমি বাসায় ছিলাম না সেদিন।ফাহিম গিয়েছিলো ট্যুরে।মেয়েটা আমার সারারাত জেগে তোমার সেবা করল।একফোটা বিশ্রাম নেয়নি।বারবার আমায় ফোন দিয়ে বলেছে বাবা আম্মুর কিছু হবে না তো?আম্মু ঠিক হয়ে যাবে তো।অথচ তোমার নিজের উদর থেকে জন্ম নেওয়া মেয়ে।তোমাকে এতোটা অসুস্থ দেখেও পরে পরে ঘুমোচ্ছিলো।ভিডিও কলে ছিলাম সেদিন।সবটা দেখেছি তো আমি।তোমার একটুখানি হাত কেটে গেলে তোমার আগে আরাবীর চোখের পানি ঝরে।আর আজ নাকি তুমি তার সাথে এমন ব্যবহার করলে লিপি।তোমার একটুখানিও কি বিবেকবোধ নেই? ঠিক কি দিয়ে তৈরি তুমি লিপি?’

লিপি বেগমের চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু ঝরছে।তার বিবেক তাকে জাগিয়ে তুলেছে।সত্যিই তো ছোটো থেকে মেয়েটাকে সব সময় তুচ্ছতাচ্ছিল্যই করে এসেছে সে।অথচ আরাবী সর্বদা নিস্বার্থভাবে ভালোবেসেছে।আজ তার সাথেই এমন জঘ’ন্য ব্যবহার করলেন তিনি।অপরাধবোধে বুক ভাড় হয়ে আসল তার। তার মন শুধু এটুকুই ভাবলো ঠিক কিভাবে তিনি মুখ দেখাবেন আরাবীকে?ঠিক কি কিভাবে? তিনি মুখোমুখি হবেন আরাবীর?বড্ড অন্যায় করে ফেলেছেন মেয়েটার সাথে।
#হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৩২
অশান্ত মনে বসে জায়ান।নিজেকে সামলানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছে ও।কিন্তু সময়ের কাটা যতো আগোচ্ছে জায়ানের ধৈর্য্যের বাধ যেন ভেঙে যাচ্ছে।চোখজোড়া ক্রমশ লাল হয়ে আসছে ওর।মূলত কাঁদতে না পারার জন্য।করুণ চোখে বার বার আরাবীকে রাখা কেভিনের দিকে তাকাচ্ছে।মেয়েটার জ্ঞান ফিরছে না কেন?কেন এতোটা সময় নিচ্ছে মেয়েটা?কেন জায়ানের এতো হৃদয়ের দহন জ্বালা বাড়াচ্ছে।বুকটা বড্ড শূন্য শূন্য লাগছে জায়ানের।কখন মেয়েটা চোখ খুলবে।কখন সে একটু মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে নিবে সেই আশায় কাতর হয়ে বসে।পুরো কাল রাত থেকে নির্ঘুম বসে আছে জায়ান।একফোটাও নড়েনি এখান থেকে।ফাহিম জায়ানের এমন অবস্থা দেখে এগিয়ে এসে জায়ানের পাশে বসল।অত্যন্ত ধীরে বলে,
-‘ এভাবে করলে চলবে? সামলান নিজেকে ভাইয়া।আরাবী যদি জেগে আপনাকে এই অবস্থায় দেখে ঠিক কতোটা কষ্ট পাবে আমার বোনটা আপনি জানেন?’

জায়ান সেইভাবেই বসে থেকে ঠান্ডা গলায় বলে,
-‘ আমার এই অবস্থার জন্যে তো ও নিজেই দায়ি ফাহিম।ও তো জানে যে ওর গায়ে একফোটা আচঁড় লাগলে আমি সহ্য করতে পারি নাহ।সেই আমি কিভাবে ওর এমন অবস্থা মেনে নিবো? আমি তো মরে যাইনি ফাহিম?অন্ততপক্ষে আমার জন্যে হলেও তো ওকে ঠিক থাকতে হবে।ওকে সুস্থ্য থাকতে হবে।কিন্তু ও কি করলো?সামান্য একটা বিষয়ে ডিপ্রেশড হয়ে এমন একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেললো।’

ফাহিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-‘ আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন।আপনি চিন্তা করবেন না ভাইয়া।আরাবী ঠিক হয়ে যাবে।ভালোই হয়েছে আরাবী সব জেনে গিয়েছে।কতোদিন আর ওর কাছে সব লুকিয়ে রাখতাম আমরা? আমার মায়ের এসব ব্যবহার আর কতোদিন সহ্য করবে ও?তার থেকে ভালো হয়েছে সব জেনে গিয়েছে।এখন থেকে আর কাঙালের মতো আশায় থাকবে মা মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য।’

ফাহিম উঠে চলে গেলো।হাসপাতালে এখন শুধু জায়ান,ফাহিম,নূর,ইফতি আর আলিফা আছে।বড়দের সবাইকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।বয়স্ক মানুষ তারা।রাত জেগে থাকলে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে।তাই তাদের জোড় করে পাঠিয়ে দিয়েছে ওরা।জায়ান উদগ্রীব হয়ে বসে আছে।ডাক্তার সেই কখন আরাবীর কেভিনে গিয়েছে।এখনও বের হচ্ছে না কেন?আর কতোক্ষন সে এইভাবে বসে থাকবে? কাল থেকে আরাবীকে একটু চোখের দেখা দেখতে পায়নি জায়ান।ওর বুকের ভীতরটা যেন মরুভূমির ন্যায় হয়ে গিয়েছে।আরাবীকে একটু দেখতে পেলেই যেন এক পশলা শীতল বৃষ্টির আবির্ভাব হবে।সেই আশায় বসে ও। ওর অপেক্ষার অবষান ঘটলো।আরাবীর কেভিন থেকে বের হয়ে আসল ডাক্তার।জায়ান দ্রুত পায়ে ডাক্তারের কাছে গেলো।অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-‘ আমার ওয়াইফ কেমন আছে ডক্টর?’

ডাক্তার চোখের চশমাটা ঠিক করে নিয়ে বলেন,
-‘ জ্ঞান ফিরেছে উনার।ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে। তিনি ঘুমাচ্ছেন।তিনি এখন ঠিক আছেন।তবে পুরোপুরি সুস্থ্য হতে তার সময় লাগবে।তবে হ্যা তাকে যথা সম্ভব স্ট্রেস ফ্রী রাখতে হবে।নাহলে পরবর্তীতে কিন্তু আরো ভয়ানক কিছু হতে পারে।অতিরিক্ত মানষিক চাপে বার বার অজ্ঞান হয়ে যায় মানুষ।আর এর কারনেই মারা’ত্মক ক্ষতি হয়ে যায় শরীরের।তাই প্লিজ উনার খেয়াল রাখবেন।’

জায়ান চোখ বুজে শ্বাস ফেললো।ডাক্তারের এক একটা কথা যেন কাটার মতো বিধ’ছে জায়ানের বুকে।জায়ান ধীর আওয়াজে বলে,
-‘ আমি কি ভীতরে যেতে পারি ডক্টর?’
-‘ হ্যা অবশ্যই।’

জায়ান অনুমতি পাওয়ার সাথে সাথে কেভিনে প্রবেশ করলো।কেভিনে প্রবেশ করেই জায়ানের চোখ দুটো শীতল হয়ে আসলো।কি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার।কালই তো কতোটা হাসিখুশি দেখছিলো জায়ান।আর আজ নাকি আরাবীকে এই অবস্থায় দেখবে কখনও ভাবেনি ও।জায়ান ধীর পায়ে আরাবীর বেডের পাশে টুলের উপর বসলো।আরাবীর নিস্তেজ হাতদুটো নিজের হাতের ভাজে নিয়ে চুমু খেলো।মায়া ভরা চোখে তাকালো আরাবীর দিকে।আরাবীর মাথায় ব্যান্ডেজ করা।হাতে পায়ে প্লাস্টার করা।মুখটা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে আছে।জায়ানের বুকে যেন কেউ ছু’রি চালিয়ে দিচ্ছে এমন মনে হচ্ছে ওর।জায়ান উঠে গিয়ে আরাবীর কপালে চুমু দিলো।তারপর ব্যাকুল কণ্ঠে বলে,
-‘ তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে যাও জান।তোমাকে এইভাবে দেখতে একদম ভালো লাগছে না।একদমই নাহ।’

________________
পিটপিট করে চোখজোড়া খুলে তাকালো আরাবী।ঝাপ্সা চোখজোড়া স্পষ্ট হতেই চারিদিকে চোখ বুলায়।সব দেখে যা বুঝলো সে এখন হাসপাতালে আছে।নড়াচড়ার চেষ্টা করতে গিয়ে আরাবী টের পেলো ওর সারাশরীরে অসহনীয় ব্যাথা।এরপরেই আস্তে আস্তে গতকালকের সবকিছু মনে পরে গেলো।যাক আল্লাহ্ তায়ালা ওকে জীবিত ফিরিয়ে দিয়েছেন।লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করল আরাবী।এক হাতে প্লাস্টার করা।অন্যহাত নাড়াতে গিয়ে অনুভব করলো তার হাতটা কারো শক্ত বাধনে আবদ্ধ।ব্যাথা পেলেও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় আরাবী। তাকাতেই জায়ানকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পায় আরাবী।লোকটা ঘুমিয়ে আছে।কি সুন্দরই না দেখাচ্ছে লোকটাকে। একটাদিন দেখেনি জায়ানকে ও।এতেই যেন মনে হচ্ছে কতোদিন ধরে দেখে না ও লোকটাকে।ঘুমন্ত অবস্থায় লোকটাকে যেন আরো সুন্দর লাগে।আরাবীর অনেক ইচ্ছে করলো জায়ানের মুখটা একটুখানি ছুঁয়ে দেখার।যা ভাবা সেই কাজ।জায়ানের হাতের ভাঁজে থাকা হাতটা ছাড়াতে চেষ্টা করলো।কিন্তু জায়ান এতো জোরে ধরেছে যে আরাবীর অনেক জোড় লাগাতে হলো।ওর এমন টানাটানিতে জায়ানের ঘুম ভেঙে গেলো।ঘুম ভাঙতেই আরাবীকে জাগ্রত অবস্থায় পুরো ঘুম যেন ছুটে গেলো জায়ানের।জায়ান অস্থির গলায় বলে,
-‘ আরাবী?তুমি ঠিক আছো?এখন কেমন লাগছে তোমার?কোথায় ব্যাথা হচ্ছে আমায় বলো?ডক্টরকে ডাকবো আমি?পানি খাবে?ক্ষিদে পেয়েছে?’

জায়ানের এমন অস্থির আচরণ আর একের পর এক প্রশ্নে আরাবী কি বলবে ভেবে পেলো না। ও নিষ্পলকভাবে জায়ানের দিকে তাকিয়ে।লোকটার অবস্থা পুরাই বাজে।একদিনেই কি হাল করেছে নিজের।এলোমেলো চুল,চোখজোড়া লাল হয়ে আছে,ঠোটজোড়া বড্ড শুষ্ক দেখাচ্ছে।পরিহিত জামা কাপড়ের অবস্থাও বাঁজে।গোছানো ধাঁচের মানুষটাকে এমন অগোছালোভাবে দেখে আরাবীর বুকের হাহাকার আরও বেড়ে গেলো।এইযে লোকটা তাকে এতো ভালোবাসে।যখন জানতে পারবে আরাবী অনাত।তার কোন পরিচয় নেই। কে ও? কে ওর বাবা মা কোন কিছুর ঠিক নেই।তখন কি করবে লোকটা? দূরে ছুরে ফেলে দিবে নাকি এইভাবেই ওকে ভালোবাসবে?জানে না আরাবী। কিচ্ছু জানে না। কি করবে ও?কিভাবে জায়ানকে এই সত্যিটা বলবে?এইগুলা ভাবতেই আরাবী কেঁদে দিলো।এদিকে হঠাৎ করে আরাবীকে কাঁদতে দেখে ভড়কে যায় জায়ান।আরাবীর কাছে এসে বলে,
-‘ কি হয়েছে কাঁদছো কেন?কোথায় কষ্ট হচ্ছে আমায় বলো?’

আরাবী কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-‘ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।ভীষণ কষ্ট।জানেন কেন?কারন আমি আমার বাবার আসল সন্তান নই।তিনি কুরিয়ে পেয়েছেন আমায়।আমার নিজের কোন পরিচয় নেই।না আছে বাবা মায়ের পরিচয়।আমি কি কারো জায়েজ সন্তান না না-জায়েজ তাও জানি না।কে আমি?কি আমার পরিচয়।আমি কিছু জানি নাহ।আমার বাবা আমার আসল বাবা না।আমার মা আমার আসল মা নাহ। আমার ভাই আমার বোন।কেউ আমার নাহ।শুনছেন আপনি?’

একনাগাড়ে বলে থামলো আরাবী। তারপর ক্রমশ অস্থির হয়ে বলতে শুরু করে,
-‘ আপনি এখন আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন?ছেরে দিবেন আমায়? আমায় কি আর আগের মতো ভালোবাসবেন নাহ? বলুন নাহ? আপনি এমন করবেন না প্লিজ।আমি তাহলে বাঁচতে পারবো না।মরে যাবো আমি।আম আমায়….!’
-‘ হুসসসস! অনেক হয়েছে।আর নাহ।চুপ করো।’

আরাবীর ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে দিয়ে ওকে থামিয়ে দিলো জায়ান।তারপর হালকা আবেশে ছুঁয়ে দিলো আরাবীর ঠোঁট। আরাবী চোখ বন্ধ করে নিলো।ওর চোখের কোণ ঘেঁষে জল গড়িয়ে পরল।জায়ান তার গম্ভীর গভীর পুরুষালি গলায় বলে,
-‘ তুমি যেই হও।যেমনই হও না কেন?আমি শুধু এটুকুই জানি তুমি আমার কাঠগোলাপ।স্নিগ্ধ শুভ্র এক কাঠগোলাপ। যাকে ভালোবাসি আমি।আর আজীবন ভালোবেসে যাবো।আমার এই ভালোবাসা কোনদিন কমবে না।এক বিন্দুও কমবে না।বরং দিন দিন আরো তীব্র হবে।তুমি জানো তুমি আমার কে?’

আরাবী অশ্রুসিক্ত চোখে জায়ানের দিকে তাকিয়ে ছিলো।সেইভাবেই না বোধক মাথা নাড়ালো।জায়ান হালকা হেসে আরাবীর কপালে চুমু দিলো।তারপর অত্যন্ত প্রেমময়ী কণ্ঠে বলে উঠে,
-‘ আমার হৃদয়ের বাগানে ভালোবাসার বৃষ্টিতে সিক্ত হওয়া এক শুভ্র কাঠগোলাপ তুমি।যার নাম দিয়েছি আমি আমার #হৃদয়াসিক্ত_কাঠগোলাপ।’

#চলবে_________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here