#হৃদয়_নিবাসে_তুই
#পর্ব_২২
লেখনীতেঃ ভূমি
বিছানার উপর প্র্যাগনেন্সি রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা পজেটিভ।অদ্রিজা বার কয়েক শ্বাস ফেলল সেই রিপোর্টটার দিকে তাকিয়েই।নিজের ভেতর কেমন অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছে তার।অনুভূতিটা সুখের কি দুঃখের জানা নেই তার।তবে হাত পা কাঁপছে সেও মা হবে কথাটা ভেবেই।হাত পা ঘেমে উঠেছে ইতোমধ্যেই। হৃদয়ের স্পন্দটা দ্রুত বাড়ছে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে। অদ্রিজা জোরে জোরে শ্বাস ফেলে রিপোর্টটা হাতে নিল ।ডান হাতটা মুহুর্তেই গিয়ে নিজের পেটের উপর স্থির হলো।বিশ্বাসই হলো না তার ভেতরে একটা প্রাণ আছে।যে ক্রমশ বেড়ে উঠছে তার ভেতরে।অদ্রিজা হাসল।অবিশ্বাস্য চাহনিতে অত্রিয়ার দিকে তাকাল।খুশিতে চকচক করা চোখ মুখ নিয়েই সন্দেহী কন্ঠে বলল,
‘ এই রিপোর্টটা সত্যিই অত্রি?আমিও মা হবো?আমি কনসিভ করেছি সত্যি?সত্যি অত্রি?’
অত্রিয়া টলমলে চোখে তাকিয়ে রইল বোনের দিকে।সেদিনের পর দেড় মাস হলো সে তার বোনকে এটুকুও হাসতে দেখেনি।সারাক্ষন একটা রুমে নিজেকে বন্দি করে রেখেছিল।খাওয়া দাওয়া হতে নিজের জীবনের সবকিছুই অগোছাল করে তুলেছিল।বেশ কয়েকদিন যাবৎ অদ্রিজার শরীররটা খারাপ যাচ্ছিল।প্রথমে মানসিক অবস্থার জন্য হচ্ছে ভাবলেও খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম রোজ চলতে লাগল।খাওয়া খেয়ে বমি করা যেন তার রোজ অভ্যেস হয়ে দাঁড়াল।চোখজোড়ার নিচে কালো কালি জমেছে বেশ করে।মোমের মতো ফর্সা ধবধবে তুলতুলে মুখটা কেমন শুকিয়ে গিয়েছে।চোখেমুখে কেমন শুকনো, অসহায় ভাব।আগের মতো আর গোছাল থাকে না অদ্রিজা।অগোছাল জীবনযাপন নিয়েই পড়ে থাকে রুমের ভেতর।রুমের দরজা খুলে বাইরে আসতেও তার শত সংকোচ।আর মায়ের সাথে তো সব সম্পর্ক বোধ হয় সেদিনই শেষ হয়ে গিয়েছিল তার।আজও মনে পড়ে গালে মায়ের সেই চড়ের কথা।আয়নায় দাঁড়িয়ে মুখ দেখতে গেলেই চোখের উপর যেন এখনও ভেসে উঠে সে আঙ্গুলের লালচে দাগগুলো।অদ্রিজা মৃদু শ্বাস ফেলে হাসল।অত্রিয়ার দিকে তাকিয়েই আবারও প্রশ্ন ছুড়ল সে,
‘ বল না, সত্যিই আমি মা হচ্ছি অত্রি?রিপোর্টটা ঠিক তো?’
অত্রিয়া এবার কেঁদেই দিল বোনের পাগলামো মাখা প্রশ্ন শুনে।দু পা এগিয়েই দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল অদ্রিজাকে। পরক্ষনে গালে হাত রেখেই বলে উঠল,
‘ হ্যাঁ আপু।রিপোর্টটা একদমই ঠিক।তুই মা হচ্ছিস। আমি মামনি হচ্ছি আপু।’
অদ্রিজা চাপা হাসল।নিচের পেটের উপর দুই হাত রাখতেই প্রশান্তিতে ছেঁয়ে গেল নিজের ভেতরটা।নিজের ভেতরের ছোট্ট প্রাণটাকে অনুভব করেই যেন শিহরন বইল নিজের ভেতরে।সঙ্গে সঙ্গে মন ও মস্তিষ্কে ভেসে উঠল সেই মানুষটারই প্রতিচ্ছবি যে মানুষটা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।যে মানুষটা বড্ড্ নিকৃষ্টভাবে তার অনুভূতির এটুকুও মূল্য দেয় নি।অদ্রিজা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।চোখজোড়া বন্ধ করেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটাল।রক্তিম তো বলেছিল সেই রাতটাকে ভুলে যেতে।সত্যিই কি এত সহজ সেই রাতটাকে ভুলে যাওয়া?এত সহজ?সেই রাতের ফলস্বরূপই তো তার ভেতর আজ রক্তিমের অংশ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। অদ্রিজা মুখ চেপে হাসল।যে মানুষটা এত অহংকার, এত দাম্ভিকতা নিয়ে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল সে মানুষটার সব থেকে দুর্বল কিছু আজ তার মাঝে উপস্থিত।কিন্তু না!সে বলবে না।সেও আজ নিষ্ঠুর হবে।সেই নিষ্ঠুর মানুষটার মতোই নিষ্ঠুর হয়ে লুকিয়ে যাবে খবরটা। কোনদিনও জানতে দেবে না সে বাবা হতে চলেছে।ছোট্ট তুলতুলে শরীরের কেউ তাকে মা হিসেবে চিনলেও কোনদিন রক্তিমকে বাবা হিসেবে চিনবে না।চিনবে না!কথাগুলো ভেবেই অত্রিয়ার দিকে তাকাল অদ্রিজা।মৃদু হেসেই বলল,
‘ আমি মা হতে চলেছি এটা সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছে না অত্রি।আমার কেমন একটা ফিল হচ্ছে।আনন্দ নাকি ভয় কিছুই বুঝতে পারছি না।আমার হাত পা হালকা কাঁপছে, নিঃশ্বাস ঘন হচ্ছে।কেমন এক দমবন্ধকর ফিল হচ্ছে।সে আমায় আধো গলায় মা বলে ডাকবে ভাবতেই আনন্দে হাত পা কাঁপছে।আবার ভয় হচ্ছে এই ভেবে তার ছোট্টো বাচ্চা কন্ঠ যখন বলবে তার বাবার নাম কি?তখন?আমি রক্তিমের পরিচয়টা দিতে পারব তো!’
অত্রিয়া ঠোঁট টেনে হাসল।মনে পড়ল রায়মানের কথা।রায়মান নামক জঘন্য লোকটার প্রতি প্রথমে যেমন মিষ্টি অনভূতি জম্মেছিল, এক অন্যরকম ভালোলাগা তৈরি হয়েছিল এখন ঠিক ততোটাই তেঁতো বিদ্ঘুটে অনুভূতি আর তীব্র ঘৃণা কাজ করে।রায়মান নামক জঘন্য মানুষটাকে এখন আর সহ্য হয় না তার। সেই লোকটার জন্যই আজ দেড়মাস তার বোন হাসতে ভুলে গেছে, তার জন্যই তো রক্তিমের সাথে অদ্রিজার সম্পর্কটা ভেঙ্গে গেল।এইযে অদ্রিজার প্র্যাগনেন্সিতে এই মুহুর্তে অদ্রিজা শঙ্কিত, এর জন্যও রায়মান দায়ী।বড্ড নিষ্ঠুর মানুষ রায়মান।একটা সময় সেই মানুষটিকেই ভালো লাগত কথাটা ভেবে তাচ্ছিল্যমাখা হাসল অত্রিয়া।খাটের এক কোণে অদ্রিজার পাশে বসেই হাত বুলিয়ে দিল অদ্রিজার অগোছাল চুলে।পাশ থেকে চিরুনিটা নিয়ে অদ্রিজার অগোছাল চুলগুলো আঁচড়িয়ে দিতে দিতেই মিষ্টি হেসে বলল,
‘ তুই শুধু শুধু এসব নিয়ে ভাববি না তো আপু।এখন থেকে তুই কেবল হাসবি। যতোটা সম্ভব খুশি থাকবি তুই।হাসবি, খেলবি, লাফাবি যা ইচ্ছে তাই করবি।আমি তোকে খুশি দেখতে চাই আপু।তোর মন খারাপ হলে তোর ভেতরের ছোট্ট প্রাণটারও যে মন খারাপ থাকবে সেই খেয়াল কি আছে তোর?একদমই মন খারাপ করবি না।একটা রুমে নিজেকে আটকে রাখবি না।বুঝলি?তোর ভেতরের প্রাণটাকে সবটা উপলব্ধি করতে দে।প্রকৃতি, বাইরের পরিবেশ সবটা।তাকে এভাবে একঘরে আটকে রাখার অধিকার তোর নেই আপু।’
অদ্রিজা হালকা হাসল।চোখজোড়া সরু করে দরজার আড়ালে তার মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই দৃষ্টি সুচালো হলো।কঠিন কন্ঠে বলে উঠল সঙ্গে সঙ্গে,
‘ অত্রি?উনাকে সরে যেতে বল ওখান থেকে।প্লিজ!’
.
অফিস থেকে অগোছাল রক্তিম বাসায় ফিরেই ব্লেইজারটা ছুড়ে রাখল সোফার এক কোণে।ট্রাই টা ঢিলে করে কপালে ঝুকে পড়া অগোছাল চুল গুলো এক হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে দিল সে।চোখজোড়া প্রচন্ডরকম লাল। সেই লাল টকটকে চোখজোড়া দিয়েই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুইটহার্টকে একবার দেখে নিল সে।মুচকি হেসেই দুই হাত দিয়ে সুইটহার্টকে জড়িয়েই তপ্তশ্বাস ফেলল সে।ফিসফিসিয়ে গাঢ় গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ সুইটহার্ট, আমরা কালকের ফ্লাইটে দেশের বাইরে শিফট হচ্ছি।তুমি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত তো?ছেলেমেয়ে সবাইকে রেখে যেতে মন চাইছে তো তোমার?যদি না চাও তবে তুমি থাকতে পারো সুইটহার্ট।আমি একাই যাব না হয়।’
সুইটহার্ট শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।দুই হাত দিয়ে সেও আগলে ধরল রক্তিমকে।মৃদু হেসেই বলল,
‘ ধুরর!তোমায় ছাড়া আমি কি করে থাকব জান।জানকে ছাড়া কি বাঁচা যায় দাদুভাই?তুমি তো আমার কলিজা।তোমায় ছাড়া কি করে থাকব আমি?’
রক্তিম হালকা হাসল।সুইটহার্টকে ছেড়ে দিয়ে পাশ ফিরে তাকাল।দুইহাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরেই চোখ বন্ধ করল সে।বার কয়েক শ্বাস ফেলেই ব্যাথিত নয়নে তাকাল সুইটহার্টের দিকে।বলল,
‘ সৃষ্টিকর্তা আমার ভাগ্যের সবটুকু ভালোবাসা এভাবে কেড়ে নিয়ে মোটেই ভালো করেনি সুইটহার্ট।আমার ভাগ্যে কি এটুকু ভালোবাসা ও লেখা যেত না সুইটহার্ট?সেই ছোটবেলা থেকেই সৃষ্টিকর্তা আমার প্রতি অন্যায় করে এসেছেন। না আমি বাবার ভালোবাসা পেয়েছি, আর নাহ তো মায়ের।আর এখন যখন নিজের প্রিয় কাউকে ভালোবাসলাম,খুব করে চাইলাম?তখনও সৃষ্টিকর্তা আমার ভাগ্যে তাকে রাখেননি।কেন বলোতো?’
সুইটহার্ট গভীর ভাবে তাকাল রক্তিমের দিকে। ছোট ছোট চোখজোড়া সঙ্গে সঙ্গেই যেন টলমলে হয়ে উঠল।রক্তিমের মাথার চুলে হাত বুলিয়েই বলল সে,
‘ জান মন খারাপ করে না।তুমি তো স্ট্রং তাই না?আমি জানি আমার স্ট্রং ম্যান অলটাইম হাসে। তাই না জান?একদম মন খারাপ করবে না।সৃষ্টিকর্তার প্রতি কেবল তোমার নয়, আমার ও দাবি থাকবে দাদুভাই।কেন তিনি এমনটা করলেন?কেন?আমার সুস্থতার বিনিময়ে হলেও তো উনি তোমায় সুস্থ সবল রাখতে পারতেন।কেন এমনটা করল?’
রক্তিমের কঠিন, ঘন পাঁপড়িতে ঢাকা চোখজোড়া আরো কিছুটা লাল হলো।মুখের চাহনিও আরো অনেকটা সংকুচিত হলো।হাত জোড়া দিয়ে শক্তভাবে নিজের মাথার চুলগুলো চেপে ধরেই তীব্র যন্ত্রনা নিয়ে মৃদু গলায় বলে উঠল রক্তিম,
‘ আমি বোধ হয় আর বেশিদিন থাকব না অদ্রি। খুব বেশিদিন আর তোমায় দেখা হবে না অদ্রি।আমায় ক্ষমা করে দিও অদ্রি।তোমার জীবনটা আমি নষ্ট করে দিয়েছি।আমি ক্ষমাপ্রার্থী অদ্রি।আদৌ কি ক্ষমা আমার যোগ্য?তোমার ভালোবাসাকে এভাবে তীব্র আঘাত দিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে ও ক্ষমাটা আমার প্রাপ্য নয় অদ্রি।তবুও চাইছি।আমি যে অসহায় অদ্রি।আমার অনিশ্চিত জীবনে তোমায় জড়াতে যে পারব না আমি। পারব না!’
সুইটহার্টের চোখজোড়া বেয়ে এবার গড়িয়ে পড়ল পানি।রক্তিমের দিকে সে অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন তিনি।আর রক্তিম যন্ত্রনায় চুলগুলো আরো শক্তভাবে টেনে ধরল।জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলেই তীব্র বেদনায় মুখচোখ লাল হয়ে উঠল।চোয়াল হয়ে উঠল শক্ত।নিজের ওপর চরমভাবে রাগ হচ্ছে তার।চরমভাবে!#হৃদয়_নিবাসে_তুই
#পর্ব_২৩
লেখনীতেঃ ভূমি
‘ তুই মা হয়ে যাচ্ছিস আর আমায় জানালি না দ্রিজা?মানছি তোর প্রাক্তনরে আমি ভালোবাসি তাই বলে তুই আমার থেকে ফুফি হওয়ার খবরটাও চেপে যাবি?এই অধিকার কিন্তু তোর নেই দ্রিজা।একদমই নেই!’
অদ্রিজা রুমের ভেতর থেকেই মাথা তুলে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করল।মুখে চকচকে হাসি স্পষ্ট।আজ অনেকদিন পর এই চাঞ্চল্যমাখা হাসিটা তার চোখে পড়েছে বটে। কিন্তু হাসিটা এটুকুও পরিবর্তিত হয়নি।আগের মতোই প্রাণবন্ত সতেজ। মেয়েটার উজ্জ্বল ফর্সা গায়ে রং।পরনে লাল রংয়ের ফতুয়া আর জিন্স।ছোট্ট পিচ্চি এই মেয়েটার সাথে আগে অল্প কয়েক সেকেন্ড মিশলেও মুহুর্তেই মুখে হাসি ফুটত।আর সেই মেয়েটির সাথেই আজ দেড় মাস হলো তার দেখা সাক্ষাৎ কিছু ঘটেনি।মাঝে মাঝে নিজেকে ভীষণ একা, একাকীত্বে ভোগা হতাশ মানবী মনে হয়েছিল তার।দেড় মাস কি কম সময়?এই দেড় মাস সম্পূর্ণভাবে সে বাসায় থেকেছে।বের হয় নি।কারো সাথে কথা বলে নি, হাসে নি।নিশ্চুপ, হাসিহীন মুখ নিয়ে পড়ে ছিল একটা রুমে।অথচ তার একটা বন্ধুও নেই যে তার মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করবে।একবার ও তো এই দেড় মাসে কেউ খোঁজ নিল না।তাই তো নিজেকে ভীষণ বন্ধুহীন মনে হয়েছে।অবশেষে বুঝি বন্ধুহীন শব্দটা উঠতে চলেছে তার পাশ থেকে।এই যে তার সামনে যে ছোটখাটো মেয়েটা মুখে একরাশ হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে?সে তার বন্ধু।বেশ কাছের বন্ধু।অদ্রিজা ভ্রু কুঁচকাল।কাছের বন্ধুকে এতদিন পর দেখে যেমন অনন্দানুভূতি কাজ করছে ভেতরটায় ঠিক তেমনই অজানা আতঙ্ক কাজ করছে।তার প্র্যাগনেন্সির খবরটা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়।তার পরিবারের লোক ছাড়া আর কেউ জানে ও না কথাটা।নেহা কিভাবে জানল তবে?বিষয়টা রক্তিম যাতে না জানে তার জন্যই তো কাউকে জানায়নি সে।তবুও নেহা কিভাবে জানল?অনেক ভেবেও বুঝল না অদ্রিজা।নেহা কয়েক পা এগিয়ে এসেই খিলখিলিয়ে হাসল।অদ্রিজার গাল হাত জোড়া দিয়ে টেনে দিয়েই ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ ভালোভাবে খাচ্ছিস না তুই?কেমন শুকিয়ে গেছিস।চোখের নিচে বেশ কালি পড়েছে।আমি কিন্তু এসব মানছি না।আমার ভাইয়ের ভবিষ্যৎ ছেলে বা মেয়ের এহেন ক্ষতি আমি হতে দিতে পারি না।তোর জন্য তো নয়ই!দরকার হলে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে চব্বিশ ঘন্টাই তোকে জোর করে খাওয়ানো হবে।আমার ভাইয়ের ভবিষ্যৎ ছেলে মেয়ের সুস্থতার দিকটাও তো আমায় দেখতে হবে।’
অদ্রিজা কিছুটা বিরক্ত হলো নেহার কথা শুনে।কপাল কুঁচকে সেভাবেই বসে রইল খাটের মাঝখানে।মাথার উপর ঘুরে চলেছে ইলেক্ট্রিক পাখা।তাপমাত্রার খেলায় পেরে না উঠে সেই ইলেক্ট্রিক পাখাটিও বেশ একটা বাতাস দিচ্ছে বলে মনে হলো না অদ্রিজার।দুপুরের তরতাজা রোদের উত্তাপে জানালা দিয়েও ঢুকে এল একঝাঁক উত্তপ্ততা।পরনের কামিজটা শরীরের ভাজে ভাজে ঘামে ভিজে উঠতেই সে বিরক্তিটা দ্বিগুণ হলো।মুখ চোখ কুঁচকে নেহার দিকে সেই বিরক্তমিশ্রিত চাহনি ফেলতেই নেহা বুঝে উঠল।চোখ মিনমিনে করে অদ্রিজার দিকে অসহায় মুখ করে তাকাল।তারপর কোমলে স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘ দ্রিজা?আমি আসাতে খুশি হস নি তুই?অনেক বেশি বিরক্ত?তোর প্রাক্তন আসলে নিশ্চয় অনেক বেশি খুশি হতিস?তাই না?’
অদ্রিজার নজর ক্ষ্রিপ্ত হলো।নেহাকে দেখামাত্রই মনের ভেতর যে কোমল আনন্দটা নড়েচড়ে হৈ চৈ করছিল সেটাই এখন প্রবল বিরক্তিতে পরিণত হলো।দাঁতে দাঁত চেপেই স্পষ্ট ভাবে উত্তর দিয়ে বসল সে,
‘ প্রথমত দিহান আমার প্রাক্তন নয় নেহা।তোকে দেখামাত্রই ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলাম কিন্তু এই মুহুর্তে আসলেই বিরক্ত লাগছে।আর হ্যাঁ, তোকে কে বলেছে আমি মা হচ্ছি?কিসব আজাইরা কথা বলছিস?’
‘ আ’ম স্যরি।আমি জানতাম ও তোর প্রাক্তন!’
অদ্রিজা আবারও তীব্র বিরক্তি নিয়ে কপাল কুচকাল।ছোট্ট, চঞ্চল এই মেয়েটার প্রতি এই প্রথম এত বেশি বিরক্ত হচ্ছে সে।এই প্রথম এত বেশি রাগ হচ্ছে।দাঁতে দাঁত চেপে আবারও দৃঢ় গলায় বলে বসল,
‘ কি সমস্যা কি তোদের নেহা?দিহান আমার কেউই নয়।তুই চাইলে দিহানকে জিজ্ঞেস করতে পারিস। দিহানের সাথে আমার লাস্ট কথা অনেকদিন আগে হয়েছে। যেইদিন রক্তিমের বাসা থেকে একেবারের মতোই তার থেকে হার মেনে চলে এসেছিলাম সেদিনই।তাও দিহানের কাছে জানতে পেরেছিলাম তোর রক্তিম ভাইয়া আমার আর দিহানের সম্পর্ক তৈরির সম্পর্কে কথা বলেছিল দিহানের সাথে।কতটা নিচ হলে মানুষ তার স্ত্রীকে অন্য একটা পুরুষের হাতে তুলে দিতে চায় ভাবতে পারিস তুই?আমার আর দিহানের মাঝে কোনদিনই কোন সম্পর্ক ছিল না নেহা।প্লিজ এরপর থেকে প্রাক্তন বলবি না।ভাই বলে প্রেমিক, বোন বলছে প্রাক্তন!হাও সুইট!তোরা ভাই বোনগুলো আসলেই ডেঞ্জারাস নেহা।তোর ঐ রক্তিম ভাইয়া আমার সাথে প্রতারণা করেছে,খুব খারাপ করেছে।খুব!আর তুই?তুই তো দিহানকে ভালোবাসতি নেহা।আমি তোর উপর বেশ বিশ্বাস রেখে দিহানকে বলেছিলাম, “নেহাকে আঁকড়ে ধরো।ওকে পাশে রাখো সবটা সময়।ও তোমায় আগলে রাখবে। কখনো কোন দুঃখ দিবে না।ভালোবাসবে ভীষণ করে।”অথচ তুই ফিরিয়ে দিলি ওকে?ভালোবাসতি তো ওকে।তাহলে?’
নেহা ছোট্ট শ্বাস ফেলল।অদ্রিজার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে বাসায় ঢুকতেই অত্রিয়া বলে দিয়েছিল।কথায় কথায় ইদানিং রাগ করে, মাথা গরম হয়।তাই অদ্রিজার বলা এতগুলো কথায়ও মিষ্টি হাসল সে।হালকা শ্বাস নিয়েই মৃদু গলায় বলল,
‘ ও আমায় তোকে ভুলার মেডিসিন হিসেবে পাশে চেয়েছিল দ্রিজা।ভালোবাসা হিসেবে নয়।এনিওয়েজ, তুই কি চাস? আমি দিহানকে আগলে রাখি, ভালোবাসি, আঁকড়ে ধরি?ওকে।ফুপ্পি হওয়ার গিফ্ট হিসেবে তোর এই ইচ্ছেটা পূরণ করা হবে । এমনিতেও অবশ্য দিহানের সাথে সেদিনের পর আমি কথা বলিনি।পুরোপুরি এড়িয়ে চলেছি।অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে ওকে এড়িয়ে চলতে।সেই কষ্টটা না হয় তোর ইচ্ছেপূরণের উদ্দেশ্যে দূর হয়ে যাক।’
অদ্রিজা এবার মুচকি হাসল।এদের ভাই বোনের আত্নসম্মান বেশ প্রখর।ভালোবাসলেও কত অবলীলায় ফিরিয়ে দিতে পারে এরা। অদ্ভুত!আচ্ছা রক্তিম ও কি তাকে ভালোবাসে?নেহার মতোই অত্নসম্মানকে জেতাতে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে?আনমনে প্রশ্নটা করেই তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল অদ্রিজা। নেহার দিকে তাকিয়েই ঠোঁট চেপে বলে উঠল,
‘ তোকে কে বলল আমি মা হতে যাচ্ছি?অত্রি?’
নেহা ছোট্ট শ্বাস ফেলেই ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ তুই কেমন বদলে গেলি দ্রিজা।কেমন জেরা করছিস। এমনভাবে কথা বলছিস যেন আমি জানলে সব ক্ষয়ে যাবে।আমি তো কেবল একটা চিঠি পোঁছে দিতেই এতদিন পর এসেছি তোর বাসায়।ভেবেছিলাম আমায় দেখে খুশি হবি।কিন্তু তুই খুশি হলি না।আর তোর প্র্যাগনেন্সির খবরটাও এই বাসায় ঢুকেই জেনেছি।অত্রিয়াকে যখন জিজ্ঞেস করলাম তুই কেমন আছিস তখন ওই বলল সব।’
অদ্রিজা সুপ্তশ্বাস ফেলল।চোখ বন্ধ করে অনুভব করল এত তিক্ত অনুভূতি।রক্তিমকে জড়িত কোনকিছুই তার সহ্য হচ্ছে না স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে।বিরক্ত লাগছে।এই যে নেহা রক্তিমের মামাত বোন, এই সম্পর্কটার কারণেই নেহাকে পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে মন চাইছে তার।কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।কথা বললেও কথাগুলো না চাইতেও বেশ তিক্ত হয়ে যাচ্ছে।এমন কেন হচ্ছে?যতই রক্তিমকে ভুলতে চাইছে ততই যেন রাগ, ঘৃণা, কষ্ট, কান্না সবকিছুতেই সেই মানুষটা মিশে যাচ্ছে।কি অদ্ভুত?অদ্রিজা হতাশ হয়ে ছোটছোট চোখে এদিক ওদিক তাকাতেই কানে এল মোবাইলের আওয়াজ।চোখ ফিরিয়ে চাইতেই নেহার মোবাইলটা বেঁজে উঠতে দেখল সে।কেউ ভিডিও কল দিয়েছে চোখে পড়তেই মৃদুশ্বাস ফেলে নেহার দিকে তাকাল।নেহা এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে কলটা রিসিভড করল। উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে বসল,
‘ রক্তিম ভাইয়া?কেমন আছো?দাদীমা কেমন আছে?পৌঁছে গিয়েছো সেখানে?’
অদ্রিজা ভ্রু কুঁচকে এক নজর নেহার মোবাইলের স্ক্রিনে তাকাল।মোবাইলের মসৃন তলে রক্তিমের ক্লান্ত মুখখানা স্পষ্ট ভেসে উঠেছে।তার থেকে বেশ কিছুটা দূরেই সুইটহার্ট দাঁড়ানো।অদ্রিজা আড়চোখে এক নজর দেখে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে নজর সরাল।নেহার থেকে বেশ কিছুটা সামনে থাকায় তাকে দেখা গেল না। রক্তিমও বুঝে উঠল মোবাইলের এপাশে তার কাঙ্খিত প্রিয় রমণীটা বসা। সে মোবাইলের ওপাশ থেকে রাশভারী গম্ভীর গলায় শুধাল দ্রুত,
‘ হ্যাঁ এয়ারপোর্ট থেকে আরো প্রায় ছয়ঘন্টা আগে এসে পৌঁছেছি।এতক্ষন হালকা ঘুমিয়েছিলাম তাই তোমাদের জানাতে দেরি হয়ে গেল লিটল ওয়াইফ।’
অদ্রিজা বুঝল না। এয়ারপোর্ট থেকে ফিরেছে মানে?বুঝে না উঠেই নেহার দিকে ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকাল।নেহা মুচকি হাসল।চঞ্চলতাময় কন্ঠটা আরো কিছুটা চঞ্চল আর সুচালো করেই বলে উঠল,
‘ একটা নিউজ শুনবে ভাইয়া?আই নো তুমি এই নিউজটা শুনে বেশ খুশি হবে।শুনবে?’
নেহার কথাটা শুনে রক্তিমের প্রতিক্রিয়াটা কি হলো তা না দেখলেও ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকাল অদ্রিজা।সুচালো চাহনিতে নেহার দিকে তাকিয়ে থাকার মাঝেই নেহা খিলখিলিয়ে হেসে বলে উঠল,
‘ দ্রিজার শরীরের ভেতর একটা….. ‘
নেহাকে বাকি কথাটা বলতে দিল না অদ্রিজা।হাত দিয়ে ছোঁ মেরে কেড়ে নিল নেহার হাতের মোবাইলটা।বেশ বিরক্ত নিয়েই নেহার দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলে উঠল,
‘ কি শুরু করেছিস নেহা?কিছু না জেনে শুনেই আন্দাজে কথা বলছিস কেন?অত্রি ছোট মানুষ।সবে ষোল পেরিয়ে সতেরোয় পা দিবে কদিন পর।ওর বাচ্চামো মাখা আবোল তাবোল কথাগুলোকে তুই বিশ্বাসই বা করছিস কেন?আজব!ওর কথা সিরিয়াসলি নিচ্ছিস কেন তুই?’
অদ্রিজার রাগ, বিরক্তি সবটা বুঝেই নেহা চুপ হয়ে গেল মুহুর্তেই।মুখেচোখে থমথমে ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সে। অদ্রিজা বুঝতে পারল বেশ খারাপ ভাবে কথা বলে ফেলেছে সে।জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে হাত দিয়ে ধরে রাখা মোবাইলটার দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল সেই মানুষটার নেশাক্ত ঘোর লাগানো চাহনি। সেই চাহনি অন্যবার আক্রমন করলে হয়তো সে লজ্জ্বায় নুঁইয়ে যেত, মাথা নিচু করে লালাভ গাল নিয়ে হয়তো দাঁড়িয়ে থাকত। কিন্তু এখন সে লজ্জ্বা আর স্থান পেল না তার অনুভূতিতে।তীব্র রাগে জ্বলজ্বল করেই একপ্রকার ঝংকার তুলে মোবাইলটা বিছানায় রেখে দিল।তবুও সেই চাহনিকে থামাতে পারল না।আটকাল না তার প্রতি সেই নিরন্তর চেয়ে থাকা।ওপাশের মানুষটা ঠিক সেভাবেই তাকে দেখতে লাগল, পরখ করতে লাগল।অদ্রিজা রাগে হাঁসফাঁস করতেই রক্তিম মৃদু স্বরে বলে উঠল,
‘ লিটল ওয়াইফ?তুমি উনার সাথে কি করছো?চিঠিটা দিয়েছো?’
নেহা খুব দ্রুত মোবাইলটা হাতে নিয়ে উত্তর দিল,
‘ না,দিতেই এসেছিলাম।দেওয়ার আগেই তুমি কল করলে।’
ওপাশ থেকে বোধ হয় রক্তিম হাসল।নেহা অদ্রিজার রাগটা বুঝতে পেরেই দ্রুত কল রাখল।ব্যাগ থেকে দ্রুত বের করল একটা লাল রাঙ্গা ভাজ করা কাগজ।অদ্রিজার দিকে এক হাত দিয়ে এগিয়ে দিয়েই মিষ্টি হেসে বলল,
‘ রক্তিম ভাইয়ার চিঠি দ্রিজা।ভাইয়া যাওয়ার আগে দিয়েছিল।আমাকে পড়তে নিষেধ করেছিল।পড়িনি।ভাজটা যেভাবে দিয়েছিল সেভাবেই আছে।আমার দায়িত্ব ছিল চিঠিটা পৌঁছে দেওয়া।’
অদ্রিজা সরু চাহনিতে তাকাল।যাওয়ার আগে বলতে কি বুঝাল বুঝে না উঠলেও প্রশ্ন করল না।নিষ্পলক চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থেকেই কাঁপা হাতে এগিয়ে নিল চিঠিটা। খাটের এককোণে রেখে দিয়েই লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,
‘ নেহা?একটা কথা বলব?’
‘ বল না।’
‘ আমি জানি রক্তিম আমায় ইচ্ছে করেই দূরে সরিয়ে দিয়েছে।ইচ্ছে করেই আমায় বারংবার কষ্ট দিয়েছে।ইচ্ছে করেই আমার সামনে বারবার খারাপ সাঁজার চেষ্টা চালিয়েছে।আমি জানি, তুই এইসব কিছুর পেছনে থাকা কারণটা জানিস। কিন্তু তাও বলবি না তাই তো?কারণ রক্তিমের কাছে তুই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তাই না?প্রমিজ করেছিস উনাকে?ঠিক আছে। বলতে হবে না।তবে আজ আমায়ও একটা প্রমিজ করতে হবে নেহা।করবি?যেভাবে সততার সাথে রক্তিমকে দেওয়া প্রমিজটা রক্ষা করছিস সেভাবে আমাকে দেওয়া প্রমিজটাও রক্ষা করবি তো?’
নেহা হালকা হাসল।বলল,
‘ বল কি প্রমিজ?’
অদ্রিজা মৃদু হেসেই বলল,
‘ আমি মা হচ্ছি।বিষয়টা কাউকে বলতে পারবি না। রক্তিম কে তো কোনদিনই জানাতে পারবি না।প্রমিজ কর।কোনদিন কাউকে জানাবি না এই কথাটা।রক্তিমকে তো নয়ই।প্রমিজ কর।’
নেহা অনেকক্ষন চুপ থাকল।প্রমিজটা করা উচিত কি অনুচিত তা বুঝে না উঠেই মনের সাথে অনেকক্ষন যুক্তি করল।অবশেষে মুখে হাসি ফুটিয়েই বলল,
‘ হ্যাঁ।প্রমিজ।’
#চলবে…..
#