#হৃদয়ের_সম্পর্ক (সমাপ্তি পর্ব ২০)
#গল্পের_পাখি (শেফা)
·
·
·
কথাটা শুনে আমাকে নিজের বুকের মধ্যে ভরে নিলো। কিছুক্ষণ আমাকে ওর হৃদপিণ্ডের স্পন্দন গুনতে দিলো। আর বললো তোমাকে কাঁদলে এতো মায়াবী লাগে কেন বলো তো ? তারপর আমার চুলের মাঝে আঙ্গুল ঢুকিয়ে আমার ঠোঁটটা ওর মুখের সামনে ধরলো। অতঃপর আমার ঠোঁটের নদীতে ডুব দিলো।
.
আমার জীবনের ভালোবাসার মধুর রাতের মধ্যে, এ রাতটাও নিজের জায়গা করে নিলো। সকালে আয়নার সামনে যেতেই দেখলাম আমার পুরো ঘার, গলা, বুক লাল লাল দাগ হয়ে আছে। আমি আমাকে দেখে আঁতকে উঠলাম। সাথে সাথে সব ভালোবাসা রাগে পরিনত হলো। তবে এ রাগের মাঝেও ভালোবাসা ভরপুর।
.
পাঁচ বছর পর……..
.
রান্না করছি সকালের। তার সাথে সালাদ কাটছিলাম। বেখেয়ালিতে ডান হাতের অনামিকা আঙ্গুলটা খেঁচ করে কেটে গেলো। প্রথমে কাটা জায়গায় রক্তটা দৃশ্যমান হলো। অতঃপর গড়িয়ে পরতে লাগলো। সহ্য করতে না পেরে, চোখটা বন্ধ করে বেশ জোড়েই একটা চিৎকার দিলাম। সাথে সাথে দৌড়ে আসলো আরিয়ান আয়াত আর মা। আরিয়ান আর মা তো সেই লেভেলের বকা দিতে লাগলো। কিন্তু এই সব কিছুকে উপেক্ষা করে আমার কলিজা আমার হাত ধরে নিয়ে বেসিনের মাঝে ধরে পানি ছেড়ে দিলো। ওর চোখে পানি। তবে চোখের ভ্রু দুটো আমার প্রতি রাগ প্রকাশ করছে। আচ্ছা, ভালোবাসা বুঝি এমনই হয় ? আমার নিজের পেটেরও একটা মেয়ে হয়েছে। নাম রাখা হয়েছে আদিবা। যদিও সে যথেষ্ট ছোটো, মাত্র সাড়ে চার বছর বয়স। কিন্তু আমার প্রতি তার এতো মায়া নেই, যতটা আয়াতের কাছে পাই। আয়াতের যখন চার বছর বয়স ছিল তখন ওকে কাছে পেয়েছি। আর তখন থেকেই সে আমাকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ভালোবাসে। আমার চোখে এক ফোটা পানি দেখলে নিজের চোখ থেকে দুই ফোটা পানি ফেলে। এতো কেন আমাকে ভালোবাসে ছেলেটা ? উত্তরটা আমিই বলছি, কারন আমি আয়াতের “মা”। আজ ওর নয় বছর বয়স। সে এখন স্কুলে যায়। তবে যাওয়ার আগে আমাকে এমন ভাবে দেখে যেন এটাই ওর শেষ দেখা আমাকে। চোখ ভরে আমাকে দেখে। তবু ওর মন ভরে না। খাবার খাওয়ার সময় প্রথম লোকমা আমার মুখে তুলে দিবে। জানি না এতটা ভালোবাসা আদিবার কাছে পাবো কিনা।
.
আয়াতের জন্য আমি পেয়েছি আরিয়ানকে, আর মা নামক একটা বান্ধবীকে। নিজের বাবাকে হাড়িয়ে পেয়েছি নতুন এক বাবা। এতো সুখ কেন আমার তাই ভেবে পাই না।
.
সবাইকে নাস্তা দিলাম। আরিয়ান তো খাবেই না, আমার উপর রাগ করে। কেন হাত কাটলো এর উপযুক্ত উত্তর না পাওয়া পযন্ত তার রাগ কমবে না। ডাইনিং টেবিলের কাছেই দাঁড়িয়ে আছি। উপর থেকে আরিয়ানের চিল্লান আসসে, “আমার রুমাল কই, আর ওয়ালেট ? ওটার কি পাখা গজালো ? লাল রঙের ফাইলটা তো টেবিলেই রেখেছিলাম রাতে।”
.
মনে মনে হাসতে হাসতে রুমে যাচ্ছি। বিয়ের এতোগুলো বছর হয়ে গেল তবু আরিয়ান ওগোছালো। আগেও সে নিজের জিনিস গুছিয়ে রাখতো না, আর এখনো রাখে না। অথচ তার কাঙ্খিত জিনিস তার চোখের সামনেই থাকে, তবুও খুঁজে পায় না। আচ্ছা এটা কি সে ইচ্ছা করে ? প্রতিদিন তার কাজে যাওয়ার আগে আমাকে তার চোখের সামনে রাখতে ? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে আমি কখনোই চাইবো না সে গোছালো হোক। এমন ওগোছালোই থাকুক আমার মৃত্যু পর্যন্ত। তবে এটা ভেবে চোখটা পানিতেও ভরে ওঠে যে, তার সবকিছু ওগোছালো হলেও, আমাকে সে খুব গুছিয়ে রাখে। হ্যা, আমার দ্বিতীয় প্রেম… সে আমার দ্বিতীয় প্রেম। তবে আমি তার প্রথম…..
.
রুমে ঢুকেই আলমারি খুলে একদম সামনের তাক-এ ভাজ করা আটটা সাদা রুমাল থেকে একটা নিলাম, তারপর টেবিলে রাখা ল্যাপটপের নিচ থেকে লাল ফাইল এবং ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ওয়ালেট নিয়ে ওর সামনে ধরলাম। রাগে গজরাতে গজরাতে আমার হাত থেকে ছোঁ মেরে জিনিস গুলো কেড়ে নিলো। এগিয়ে এসে গালে মধুময় চুম্বন দিতে গিয়েও পা পিছিয়ে নিলো। রাগি কন্ঠে আমার মুখের উপর মারাত্মক হাস্যকর একটি কথা ছুড়ে মারলো, “আমি রেগে আছি”। আমিও তার হাস্যকর কথার জবাবে ফিক করে হেসে দিলাম। রেগে চলে গেলো দরজা পার হতে। হি হি, অতঃপর পিছন ঘুরে আবারও আমাকে তার রাগি চোখের মনিতে বন্দী করে নিলো। আমি দৌড়ে গিয়ে ওর বুকে নিজেকে সঁপে দিলাম। চুমুতে ওর পুরো মুখ ভরিয়ে দিতে লাগলাম। আর ওর রাগ গুলোও জ্বলন্ত মোমের মতো গলতে লাগলো।
.
সন্ধ্যায় আরিয়ান ডিউটি থেকে ফিরে আসতেই মা সুর তুললেন, তার নাতি নাতনি নিয়ে সে আর বাবা আগামীকাল ঘুরতে যাবে, বাবার বন্ধুর বাড়িতে। সাথে সর্তও জুড়ে দিলেন পাখি আর আরিয়ান বাড়িতেই থাকবে। কাল কোনো ডিউটি মিউটি হবে না। দরকার হয় ছুটি নিয়ে নিবে। আরিয়ান কখনো তার কাজে অবহেলা করে না। তবে মিচকা শয়তানের মতো আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলো আর মা কে হ্যা বলে দিলো। আদিবা তো তার তুতলামি কথাতে ঘর মাথায় তুললো, ” তি মজা তি মজা আমলা ঘুলতে যাবউ, ঘুলতে যাবউ।” আদিবা খুব ছোট থেকেই ওর দাদুন দীদার সাথে ঘুমাতো। কিন্তু আয়াতকে কিছুতেই নিতে পারতো না তাদের সাথে ঘুমানোর জন্য। আয়াত আমাদের সাথেই ঘুমাতো। তবে এখন তার রুম আলাদা করা হয়েছে। আমি মন মত সাজিয়ে দিয়েছি। মাঝে মাঝে সে আদিবাকে নিয়েও ঘুমায়। মা বললো ওনারা কাল সারা দিন থেকে পরশু দিন আসবে। আয়াতও খুশি, তবে উঠে এসে আমার পাশে বসলো। এখন আয়াতের আধো আধো বুলি গুলো স্পষ্ট হয়ে গেছে।
.
আমার দু’গালে হাত রেখে বললো,
— মাম্মাম তুমি কি কান্না করবে আমি তোমাকে আর পাপায়কে একা রেখে যাবো বলে ?
— না আমার কলিজা, আমি খুব খুশি হয়েছি তোমরা ঘুরতে যাবে বলে। আর এটা তো প্রথম না, এমন প্রায়ই ঘুরতে যাও তোমরা।
— কিন্তু আমি খুশি না তোমাকে একা রেখে যেতে।
— ওওওওও আমার আয়ু সোনা, তোমরা যাও ঘুরে আসো। আমি মন খারাপ করবো না।
.
তারপর আমার গলা জরিয়ে ধরে আমার গালে চুমু দিলো। আরিয়ান উঠে এসে আমার পাশে বসলো। আর আয়াতকে বললো,
— মাই ব্রেভ বয়, তুমি যাও ঘুরতে এবং তোমার আপুনির খেয়াল রাখবে কেমন।
— ওকে পাপায়। আর তুমিও কিন্তু আমার মাম্মামের খেয়াল রাখবে।
— অফকোর্স মাই বয়।
অতঃপর আরিয়ানের গালেও একটা চুমু দিলো। আর আরিয়ান চুমু খেলো আয়াতের দুই হাতের তালুতে। আমাদের এতো আদর দেখে আদিবাও আরিয়ানের কোলে ঝাপিয়ে পরলো। আর ওর পাপায় এর পুরো মুখ নিজের লালাতে ভোরে দিলো। তবে আমি যেটা নিয়ে ভয় পেয়ে এবোরোশান করাতে চেয়েছিলাম, সেটা একদমই অযৌক্তিক এটা আরিয়ান প্রমান করে দিয়েছে। দুজনায় যেন ওর জান। আর আমার কাছে তো মনে হয় আমি আয়াতকেই বেশি ভালোবাসি।
.
এখনো মনে পরে আরিয়ানের পাগলামি গুলো। আদিবা হওয়ার সময় যখন আমাকে ওটিতে নিয়ে যাচ্ছিলো, আরিয়ান তখন নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে আমার সাথে ওটিতে ঢুকে গিয়েছিলো। আর প্রতিটা মুহূর্ত আমার হাত ধরে আমাকে সমানে সাহস দিয়ে গেছে। তবে ওর নিজের সাহসে যে ভাটা পড়েছে তা ওর কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম আমাকে জানিয়ে দিচ্ছিলো। আমার ওতো কষ্টের মাঝেও দেখেছি ওর চোখের কোনা ভেজা।
.
সকালে আদিবাকে তৈরী করে দিলো আরিয়ান। টেলকম পাওডার মাখিয়ে একদম সাদা করে দিয়েছে সাথে আবার সাদা রঙের ফ্রক। কপালে ছোট্ট একটা কালো নজর টিপ। আয়নায় নিজেকে দেখে আদিবা বলছে, “পাপায় আমাতে অনেককক সুন্দল লাগতে তাই না বলো?”। আর আরিয়ান ও পাগলের মতো উত্তর দিচ্ছে, “ইয়েস মায় প্রিন্সেস।” ওদের অবস্থা দেখে আমি হাসতে হাসতে শেষ। গেলাম আয়াতের কাছে। আমাকে বললো তাকে তৈরী হতে সাহায্য করতে। আদিবার সাথে ম্যাচিং করে ওকেও সাদা সার্ট পড়িয়ে দিলাম, ব্লু জিন্স। আর ওর সোনালী চুল গুলো অগোছালো করে দিলাম। ব্যাস, আদিবা যদি আরিয়ানের প্রিন্সেস হয়ে থাকে তবে আমার আয়াতও কোনো প্রিন্সের থেকে কম নয়।
.
নিচে নেমে আসলাম সবাই মিলে। মা যাওয়ার আগে তার রুপার চাবির গোছা আমার হাতে দিলো। এটা সব সময়ই তিনি করে থাকেন। কোথাও যাওয়ার সময় আমাকে বাড়ির দ্বায়িত্ব দিয়ে যায়। আমাকে অবশ্য এই দায়িত্ব পারমানেন্টলি দিতে চেয়েছে বহুবার। আমিই নিতে চাই নি। আয়াতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর মন খারাপ। চোখটা ছলছল করছে। আচ্ছা ও কি যেতে চাচ্ছে না ? আমারও মন টানছে না। তবুও বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেলাম। ওনারা অনেক খুশি। গাড়িতে উঠার আগে মা আমার কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
—“আরো একবার তোমাদের মধুচন্দ্রিমার সুযোগ করে দিলাম, হানিমুন ইউ নো।”
আমিও তাকে চোখ মেরে উত্তর দিলাম, —“ধন্যবাদ মহারানী ভিক্টোরিয়া, আপনি তো এখন বুড়িয়া হয়ে গেছেন। সময় তো এখন আমারই।”
আমার কথা শুনে মা মুখ ভেংচি কেটে বললো,
— হুহ্ আমার দিন এখনো ফুরোয়নি।
.
অতঃপর আমি আর আরিয়ান ওদের সবাইকে বিদায় জানালাম। বাড়িতে ঢুকার পরই শুরু হলো আরিয়ানের জ্বালাতন। এক মূহুর্তের জন্যও আমার শরীরকে আলাদা হতে দিচ্ছে না ওর শরীর থেকে। কোনো রকমে রান্না করলাম।সারাক্ষন আমাকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে ছিলো। পাগলে মতো ভালোবাসে আমাকে। আর আমিও ওকে ছাড়া নিঃশ্বাস নিতে পারি না। হ্যা, সে একটু বদরাগী। তবে আমি ওর এ রাগকে সঙ্গি করে নিয়েছি।
.
এই পরিবারে শুধু আদিবা ছাড়া কারোর সাথেই আমার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। তবুও আদিবা তার পাপায়ের পাগল। আমার নয়। কিন্তু আয়াত ? ওর সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই, তবু সে আমার পাগল। এটাকেই কি বলে হৃদয়ের সম্পর্ক ?
—(সমাপ্ত)—