হৈমন্তীকা
১৯.
হৈমন্তীর হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা মাটিতে পরে গেছে। আলু, টমেটো, শসা একে একে ছড়িয়ে পরছে রাস্তায়। হৈমন্তী দ্রুত সেগুলো কুড়িয়ে নিতে লাগল। রৌদ্রজ্জ্বল সকালে বাজারে এসে এহেন অপ্রীতিকর ঘটনায় ভীষণ বেজার সে। ঘমার্ক্ত হয়ে আছে তার সারা শরীর। বিরক্ত মস্তিষ্ক। হঠাৎ নিজের হাতের পাশাপাশি বলিষ্ঠ একজোড়া হাত দেখতে পেল সে। তার সঙ্গে সঙ্গে হাত জোড়ার মালিকও সাহায্য করছে তাকে। হৈমন্তীর ভ্রু কুঁচকে এলো। কপালে ভাঁজ ফেলে পাশ ফিরে তাকাতেই তুষারকে দেখতে পেল সে। আঁতকে উঠল। হাত থেমে গেল আপনা-আপনি।
তুষারের কপালে সাদা কাপড়ের বিশাল বড় ব্যান্ডেজ করা। ঠোঁটের কোণ, ডান গালটা বড্ড লালাভ হয়ে আছে। বাম গালে সুক্ষ্ম, তাজা আঁচড়টি দৃশ্যমান। তুষার স্বাভাবিক ভাবে সব ভরে নিলো ব্যাগে। একহাতে ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— “বসে আছেন কেন হৈমন্তীকা? উঠুন।”
হৈমন্তীর সম্বিৎ যেন এক্ষুণি ফিরলো। দ্রুত উঠে দাঁড়ালো সে। বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে এলোমেলো গলায় প্রশ্ন ছুড়লো,
— “আপনার এই অবস্থা কিভাবে তুষার? কাল রাত অব্দি তো ঠিক ছিলেন।”
তুষার জবাবহীন। হৈমন্তীর আতঙ্কিত, ব্যথাতুর নেত্রজোড়া মুগ্ধ হয়ে দেখল কিছুক্ষণ। অল্প হেসে কথাটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে বললো,
— “চলুন হৈমন্তীকা। রোদে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। গরম লাগছে ভীষণ।”
–
ফুটপাতের এককোণে, গাছের ছায়াতলে তুষারের বাইক দাঁড় করানো। পাশেই বাদাম বিক্রেতা একঝুড়ি বাদাম নিয়ে আসন পেতে বসে আছেন। বাইক থেকে ঠান্ডা পানির বোতলটা নিলো তুষার। বাদাম বিক্রেতাকে বললো, “মামা? বিশ টাকার বাদাম দিন তো!”
বলে ঢকঢক করে পান করলো পুরো অর্ধেক ঠান্ডা পানি। বাকিটুকু তেরছা ভাবে ঢেলে দিলো নিজ মুখে। কোনোরুপ অনুমতি ছাড়াই হৈমন্তীর ওরনা টেনে ভেঁজা মুখশ্রী মুছতে লাগল। হৈমন্তী তেঁতে উঠলো এতে। ধমকের সুরে বললো,
— “কি করছেন তুষার? রাস্তায় আছেন ভুলে গেছেন?”
তুষার এবারও প্রশ্নে জবাব দিলো না। নিজ কাজে বহাল রইলো। তার এহেন নির্লিপ্ততায় প্রচন্ড বিরক্ত হৈমন্তী। একটানে ওড়না ছাড়িয়ে রোষপূর্ণ গলায় জিজ্ঞেস করলো,
— “আপনি কিন্তু এখনো বলেন নি তুষার! কার সঙ্গে মারপিট করে এসেছেন?”
— “কাল রাতে কয়েকটা ছেলে একটা মেয়েকে মলেস্ট করতে চেয়েছিল। আমি আটকাতে গেলে মা নিয়ে বাজে কথা বলে… আমি সহ্য করতে পারিনি হৈমন্তীকা।”
তুষারের কণ্ঠ ভীষণ শান্ত, নির্বিকার। হৈমন্তী বিস্ময়ে পিটপিট চোখে তাকালো। তার গলা কাঁপছে। এ ছেলে এমন কেন? অস্পষ্ট স্বরে সে বললো,
— “তাই বলে মারপিট করবেন? কিভাবে আঘাত পেয়েছেন, দেখেছেন?”
বিস্তর হাসলো তুষার। হৈমন্তীর পরে যাওয়া ঘোমটাটি কপাল অব্দি ভালোভাবে টেনে দিলো। আলতো করে ছুঁলো তার শুভ্র গাল। স্নিগ্ধ স্বরে আওড়ালো, “আপনি আমাকে ঠিক কতটুকু ভালোবাসেন, তা আপনি নিজেও জানেন না হৈমন্তীকা।”
হৈমন্তী থেমে থেমে নিশ্বাস ফেলল। ক্ষীণ স্বরে দিরক্তি করলো,
— “আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”
— “ভুল! আপনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসে।”
তুষারের আত্মবিশ্বাস সমেত কথাটি শুনে দ্বিধায় পরে গেল হৈমন্তী। সে সত্যিই তুষারের প্রতি একধরণের অদ্ভুদ অনুভূতি অনুভব করে। যার নাম সে জানে না। শুধু জানে, তুষার আশেপাশে থাকলে অস্থিরতা আষ্ঠেপষ্ঠে জেঁকে বসে তার মাঝে। প্রবল ভয়ংকর অনুভূতিতে মিইয়ে যায়। সে কি সত্যিই তুষারকে ভালোবাসে? মনে মনে প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গিয়েও থেমে যায় আবার। বাস্তবতা থামিয়ে দেয়। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করে,
— “আমার বাজারের ব্যাগ কোথায় তুষার?”
তুষার ঠাট্টার সুরে জবাব দেয়,
— “ভয় নেই হৈমন্তীকা। আমি খেয়ে ফেলবো না আপনার বাজারের ব্যাগ।”
ততক্ষণে বাদাম বিক্রেতা বাদাম এগিয়ে দিয়েছে তাদের দিকে। তুষার পকেট হাতরে মানিব্যাগ বের করলো। বাদামের দাম মিটিয়ে হৈমন্তীর সামান্য দূরত্বে, বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। বাদামের ঠোংগাটি হৈমন্তীর দিকে বাড়িয়ে নিঃসংকোচ, সিক্ত আবদার করে উঠলো, “মায়ের সঙ্গে রাগ করে এসেছি হৈমন্তীকা। সকাল থেকে কিছুই খাই নি। বাদামগুলো একটু খাইয়ে দিবেন আমায়?”
হৈমন্তীর মন যেন মুহুর্তেই পাথরে পরিণত হলো। বাদাম নিলো না সে। বাইক থেকে নেমে কঠিন গলায় বললো,
— “আমার বাজারের ব্যাগটা দিন তুষার। আমি চলে যাবো।”
তুষারের শীতল চাহনি, “এখনি চলে যাবেন?”
— “হ্যাঁ।”
— “চলুন, আমি পৌঁছে দেব।”
_____
ড্রইংরুমে অস্থির মনে বসে আছেন হেনা। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তুষার তার সঙ্গে কাল রাত থেকে কথা বলছে না। রুমে দরজা আটকে ছিল। আজকে আবার সকাল সকালই কোথায় যেন চলে গেছে। তাকে বলেও নি। চিন্তিত হেনা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সরব কলিংবেলের আওয়াজ পেতেই চমকে উঠলেন তিনি। দ্রুত গিয়ে দরজা খুললেন। তুষার গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। হেনা ছেলের মুখপানে গভীর মায়াময় দৃষ্টিতে চেয়ে বিচলিত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
— “এই শরীর নিয়ে সকাল সকাল কোথায় গিয়েছিলি তুষার? রাত থেকে কিছু মুখেও নিস নি। ক্ষুধা লেগেছে? নাস্তা বারবো?”
— “না, খাবো না।”
ছোট্ট করে উত্তরে দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলো তুষার। ছেলের এহেন আচরণে ভীষণ কষ্ট পেলেন হেনা। মর্মান্তিক হলো মন। করুণ গলায় বলে উঠলেন,
— “রাত থেকে কি শুরু করেছিস তুষার? ঠিকভাবে কথা বলছিস না। খাচ্ছিস না। কেন এমন করছিস?”
তুষার সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো। তীব্র ক্ষোপ নিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
— “তুমি জানো না কেন?”
— “না বললে কিভাবে জানবো? আমার দোষটা তো বল!”
— “তুমি বাবার সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করেছ মা। কালকে ইচ্ছে করে তুমি আমাকে অফিসে পাঠিয়েছিলে। অথচ অফিসে কোনো কাজই ছিল না। ট্রাকের ব্যাপারেও মিথ্যে বলেছ। মুখে না বললেও আমি জানি, তুমিও চাও হৈমন্তীকা যেন আমার জীবন থেকে চলে যায়। কিন্তু তোমাদের এই আশা কখনো পূরণ হবে না মা। আমি বিয়ে করলে হৈমন্তীকাকেই করবো।”
কথাগুলো বলে আর দাঁড়ালো না তুষার। দ্রুত পা চালিয়ে গেল নিজ রুমে। হেনা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মস্তিষ্ক কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে উনার। মনে মনে আফসোস করেন, মেয়েটার বয়স আরেকটু কম হলে কি হতো?
_____
নাওয়াজের বাসা থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। রাকিব আহসান আসরাফ সাহেবের সঙ্গে বন্ধুত্বের পাশাপাশি আত্মীয়তার সম্পর্কও গড়ে তুলতে চান। আসরাফ সাহেবও এক পায়ে রাজী। কিন্তু বেঁকে বসল হৈমন্তী। সে কিছুতেই এখন বিয়ে করবে না। আসরাফ সাহেব এতে মন খারাপ করলেও দিরক্তি করেন নি। রুষ্ট মনে মেনে নিয়েছেন সব। পরে নাহয় এ নিয়ে ভাববেন।
তখন সায়াহ্ন। ঘড়ির কাটায় ছ’টা বিশ বাজছে।
হৈমন্তী মাত্র নাস্তা বানিয়ে রুমে ঢুকেছে। ঘেমে নেয়ে একাকার সে। বিছানার পাশে ছোট্ট টি-টেবিল থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে পান করতেই হঠাৎ দরজায় কেউ টোকা দিয়ে উঠল। হৈমন্তী ভাবলো, হয়তো হেমন্ত এসেছে। তাই অনুমতি দিয়ে বললো, “আয়।”
পরপরই দরজা ঢেলে ভেতরে আসার শব্দ পেল সে। আবারও বললো,
— “আজকে এত ম্যানার্স দেখাচ্ছিস যে হেমন্ত? একেবারে অনুমতি নিয়ে ঢুকলি। ব্যাপার কি?”
ওপাশ থেকে জবাব এলো না। খানিক বাদ পর পুরুষালি গলায় কেউ অল্প শব্দে কেঁশে উঠল। নম্র গলায় বললো,
— “এটা আমি হৈমন্তী। নাওয়াজ।”
হৈমন্তী ভড়কে গেল। পাশ ফিরে নাওয়াজকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পরল। হৈমন্তীর পোশাক-আশাক ঠিক নেই। গরমে পুরোনো এক সুতির কালো জামা আর টিয়া রঙের পায়জামা পরেছে সে। ওড়নার এককোণা কাল রাতে বাজেভাবে ছিঁড়ে গিয়েছিল। যা এখনো পালটানো হয় নি। কপালে সম্ভবত ময়দার ক্ষীণ আবরণ লেগে আছে। হৈমন্তীর অপ্রস্তুত ভাব বাড়লো। এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো সে। তা দেখে মিটিমিটি হাসলো নাওয়াজ। বললো,
— “ডোন্ট বি পেনিক হৈমন্তী। বি ইজি!”
হৈমন্তী শান্ত হতে পারলো না। তবে সামান্য সামলে নিলো নিজেকে। জড়তার সঙ্গে বললো,
— “না আসলে… আপনি কিছু বলবেন নাওয়াজ ভাইয়া?”
এবার যেন একটু গম্ভীর হলো নাওয়াজ। তবে তার কণ্ঠ একদম স্বাভাবিক,
— “তুমি কি বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছ হৈমন্তী?”
হৈমন্তী কিছু সময়ের জন্য থমকালো। অতঃপর অকপটে বললো, “হ্যাঁ।”
— “কারণ?”
— “তেমন কোনো কারণ নেই। আমি আসলে এখন বিয়ে করতে চাই না।”
এ কথার পিঠে নাওয়াজ দূর্বোধ্য হাসলো,
— “সত্যি কি তাই হৈমন্তী? আমার তো মনে হয় তুমি ওই ছেলেটার জন্য বিয়ে করতে চাইছ না।”
হৈমন্তী হকচকিয়ে যায়। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে,
— “কো–কোন ছেলেটা?”
— “তুষার তৈমুর।”
হৈমন্তীকা
২০.
পরিস্থিতি ভীষণ গুমোট। ঘনকালো পাঁপড়ির নিকষকৃষ্ণ আখিঁজোড়ায় ভয়, আতঙ্ক আর বিস্ময়ের ভীড়। নাওয়াজকে প্রচন্ড অদ্ভুদ লাগছে তার। ভীতি কাজ করছে। পলক ফেলে তার দিকে আরেকটু মনোযোগী হলো হৈমন্তী। নাওয়াজ গম্ভীর স্বরে বললো,
— “তোমার আমাকেই বিয়ে করতে হবে হৈমন্তী। তুষারকে হয়তো তুমি পছন্দ করো, হয়তো না। হয়তো বিয়ে করতে চাও। কিন্তু বিশ্বাস করো, সেটা আমি হতে দেব না। যাই-ই হোক না কেন।”
হৈমন্তীর চোখ বড় বড় হয়ে গেল। বিমূঢ়তায় স্তব্ধ হয়ে গেল সে। ভীতি কাজ করতে লাগলো আরও প্রবল ভাবে। হৈমন্তীর এহেন অভিব্যক্তি দেখে শরীর দুলিয়ে হাসলো নাওয়াজ। ক্ষীণ উচ্চশব্দে। তারপর হাসি একটু কমিয়ে বললো,
— “আমাকে ভয় পাচ্ছো হৈমন্তী?”
হৈমন্তী জবাব দিলো না। সে আগের ন্যায়ই চেয়ে আছে। এমতাবস্থায় নাওয়াজকে কোনো স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হচ্ছে না তার। অদ্ভুদ, বদ্ধ পাগল লাগছে। নাওয়াজ নিজের মুচকি হাসি বহাল রেখে আবার বললো,
— “ভয় নেই হৈমন্তী। আমি মজা করছিলাম শুধু। তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে এমন কিছুই করবো না আমি যাতে তুমি কষ্ট পাও। তুমি যাকে চাও বিয়ে করবে, ভালোবাসবে। সেটা একান্তই তোমার ব্যক্তি স্বাধীনতা। যা হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমার নেই।”
এতটুকু শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো হৈমন্তী। নিমিষেই ভেতর থেকে যেন এক বিশাল বড় পাথর নেমে গেল। এতক্ষণ নাওয়াজকে নিয়ে কতকিছুই না ভাবছিল সে! কৃতজ্ঞা কিংবা এমনিই হৈমন্তী কিছু বলতে চাইলেই তাকে থামিয়ে দিলো নাওয়াজ। ন্যায়নীতি নম্র স্বরে বললো,
— “তবে আমি এটাও জানি আঙ্কেল কখনোই ওই ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবেন না। তাই আশা তো ছাড়তে পারছি না। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো হৈমন্তী।”
বলে আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না সে। গতিপথ বাড়িয়ে বড় বড় পা ফেলে চলে গেল রুম থেকে। হৈমন্তী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। জীবনটা ভীষণ জটিল মনে হচ্ছে তার। ঠিক যেমন ধাঁধাগুলো হয়।
_____
বর্ষা স্নাত সকাল। নতুন ফ্ল্যাটে আসার পর থেকেই এযাবত আর ভার্সিটি যাওয়া হয় নি হৈমন্তীর। বৃষ্টি হওয়ায় আজকেও যাবে না বলে মনস্থির করে রেখেছে সে। আসরাফ সাহেবও অফিসে যান নি আজকে। মেয়ের হাতের গরম গরম পরোটা চিবুচ্ছিলেন, হঠাৎ-ই কলিংবেল বেজে উঠলো সশব্দে। টুংটাং টুংটাং। হেমন্ত নাস্তার টেবিল থেকে উঠতে নিলে আসরাফ সাহেব মানা করে বলে উঠলেন,
— “তুই নাস্তা খা। আমি দেখছি কে এসেছে।”
সদর দরজার কাছে এগিয়ে গেলেন আসরাফ সাহেব। দরজা খুলতেই ক্ষীণ পরিচিত এক ছেলেকে দেখতে পেলেন। ছেলেটার চেহারায় চেনা চেনা ভাব থাকলেও ঠিক কে, তা ঠাওর করতে পারলেন না। ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন ছুড়লেন,
— “কে তুমি?”
বাম হাতের শাহাদাত আঙুলের সাহায্যে ছেলেটা তার নাকের ডগায় হেলে পরা চশমাটা ঠিক করলো। নম্র গলায় আওড়ালো,
— “আমি হৈমন্তীকার ফ্রেন্ড আঙ্কেল। ওর সাথে দেখা করতে এসেছি।”
আসরাফ সাহেবের ভ্রু যুগল যেন আরেকটু কুঁচকালো। আবারো প্রশ্ন করে উঠলেন,
— “এই হৈমন্তীকাটা কে?”
— “আসলে আমি হৈমন্তীর কথা বলছিলাম আঙ্কেল। ওকে আমি হৈমন্তীকা বলেই ডাকি। আপনি যদি ওকে একটু ডাকতেন?”
ছেলেটার কণ্ঠস্বর ভীষণ স্বাভাবিক। চাহনি ভীষণ শান্ত। এই ভীষণ জিনিসটাই পছন্দ হলো না আসরাফ সাহেবের। উনার মুখের ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হলো না এক বিন্দুও। তবুও অতি সন্তপর্ণে ভেতরকার সন্দেহটা চেপে গেলেন তিনি। গম্ভীর স্বরে বললেন,
— “ভেতরে আসো।”
অতঃপর হৈমন্তীকে ডাকলেন।
ওপাশ থেকে ‘জি’ শব্দ উচ্চারণ করেই দ্রুত ওড়না গায়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। বাবার পাশে সুঠাম দেহের ছেলেটিকে দেখে ক্ষণিকের জন্য থমকে গেল। চিনতে কয়েক সেকেন্ড লেগে গেল তার। নিজ বাবার পাশে তুষারের দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক বিশ্বাস হলো না হৈমন্তীর। দৃষ্টি আরো মনোযোগী হলো। তবুও ফলাফল একই। তুষার হৈমন্তীর চমকে যাওয়া মুখশ্রী দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো,
— “হাই, হৈমন্তীকা।”
হৈমন্তী জবাবহীন। বড় বড় চোখে চেয়ে আছে সে। আসরাফ সাহেব এবার একটু কেঁশে উঠলেন। বললেন,
— “তোরা কথা বল, আমি আমার রুমে যাচ্ছি। আর তুমি। তোমার নাম জানা হয়নি আমার। কি নাম তোমার?”
— “তৈমুর।”
— “তৈমুর?”
আসরাফ সাহেব যেন একটু অবাকই হলেন। সঙ্গে সন্দেহটাও বেড়ে গেল তীব্র মাত্রায়। প্রতিউত্তরে তুষার মাথা নাড়ালো শুধু। কি ভেবে আর কিছু প্রশ্ন না আসরাফ সাহেব। প্রশ্ন করাটা অহেতুক মনে হলো তার। ধীর পায়ে চলে গেলেন রুমে।
হেমন্ত নাস্তার টেবিল থেকে উঠে এলো। হাসি-মুখে একটু জোড়েই বললো,
— “তুষার ভাইয়া তুমি এখানে?”
— “আস্তে কথা বলো। নয়তো তোমার বাবা যদি জানে আমিই তুষার, তাহলে ঘাড় থাক্কা দিয়ে বের করে দেবেন।”
হেমন্তের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো সে। শুনে খিলখিল করে হাসলো হেমন্ত। তুষার আবার বললো,
— “তুমি নাস্তা করো যাও। আমি তোমার বোনের সঙ্গে কথা বলবো।”
হেমন্ত জ্ঞানী ভাব দেখিয়ে বললো,
— “আচ্ছা, আচ্ছা। এমনিতেও তোমরা তোমাদের প্রাইভেট টাইমে কি করো তা কে দেখতে চায়?”
হৈমন্তী কড়া চোখে তাকাতেই হেমন্ত চুপ হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলে গেল সেখান থেকে। তুষারের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো হৈমন্তী। ক্ষীপ্ত স্বরে প্রশ্ন করলো,
— “আপনি এখানে কি করছেন? ভয় করলো না এখানে আসতে? ভাগ্যিস মা বাসায় নেই। নয়তো বাবাকে কিছু বলে দিলে কি হতো ভেবেছেন?”
তুষার হাসলো। বিস্তর, প্রাণ খোলা হাসি, “আমি তো জানি হবু শ্বাশুড়ি মা বাসায় নেই। তাই তো এসেছি।”
হৈমন্তী ছোট ছোট চোখে তাকালো। আশ্চর্য গলায় জিজ্ঞেস করলো, “আপনি আমার ওপর নজর রাখছেন?”
— “সেটা তো সবসময়ই রাখি হৈমন্তীকা।”
হৈমন্তী ধাতস্ত হলো। কেন যেন রাগ করতে পারলো না। তুষার তার চশমা ঠিক করতে নিলে বিরক্ত গলায় বললো,
— “হুট করে চশমা পরেছেন কেন? এত ঢং কোথা থেকে আসে আপনার?”
— “কিন্তু আমি তো পারু থেকে শুনেছি, এই চশমা পড়া ঢংগি ছেলেদেরই আপনার পছন্দ।”
হৈমন্তী ধমক দিলো, “আমাকে নাম ধরে ডাকেন বুঝলাম। কিন্তু পারুকে নাম ধরে ডাকছেন কেন? ও যে আপনার বড় ভুলে গেছেন?”
— “উনি আমার হবু শালী হন হৈমন্তীকা। হবু শালীকে কেউ আপু ডাকে?”
নিষ্পাপ স্বরে আওড়ালো সে। হৈমন্তীর কটমট গলা, “পাগল কোথাকার।”
ওপাশ থেকে শান্ত উত্তর, “ধন্যবাদ, হৈমন্তীকা।”
_________________
চলবে~