হৈমন্তীকা পর্ব ৩৫

হৈমন্তীকা

৩৫.
বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুপঝুপ শব্দ তীব্র কোলাহল সৃষ্টি করছে কর্ণকুহুরে। বাতাসে এক আলাদাই মিষ্টি, মিষ্টি ঘ্রাণ। ঠান্ডা মৌসুমে সামান্য উষ্ণতার আভাস পেতেই আরও চেপে শুলো হৈমন্তী। প্রশস্ত বুকে লেপ্টে থেকে বুকে মুখ গুঁজলো। পরপরই ভারিক্কি আওয়াজে ফোনের অসহনীয় রিংটোন কানে বাজলো তার। না চাইতেও ঘুম ভেঙ্গে গেল। পিটপিট নয়নে চোখ মেলল সে। নিজেকে আবিষ্কার করলো অন্ধকারে ভরপুর বদ্ধ কাঁথার নিচে। মাথা অব্দি কাঁথা টেনে দেওয়া তার। মুখ থেকে কাঁথা সরালো হৈমন্তী। বালিশের নিচ হাতড়ে ফোন বের করলো। তখনো বিরক্তিকর এলার্ম বেজেই চলছে। স্ক্রীনে গুটিগুটি অক্ষরে এর শিরোনাম লিখা,
—“ঘুম থেকে উঠে পর তুষার। বউকে জাগাতে হবে, খাওয়াতে হবে। কত কাজ তোর! এখন কি তুই আর যুবসমাজের অবিবাহিত ছাত্র আছিস?”

চার বাক্যের এটুকু লিখা পড়ে আনমনেই হাসলো হৈমন্তী। তুষারের ঘুমন্ত মুখপানে তাকালো। কথায় কথায় তাকে শাসন করা ছেলেটা ভেতরে ভেতরে এখনো বাচ্চা রয়ে গেছে। যা শুধু হৈমন্তীর কাছেই প্রকাশ পায়। একান্তই তার সামনে। হাত বাড়িয়ে তুষারের গাল আলতো স্পর্শ করলো সে। ছোট্ট ছোট্ট দাঁড়ি ক্ষীণ বিঁধছে আঙুলের ডগায়। সে হাত সরিয়ে নিলো। কপালে পরে থাকা এলোমেলো চুলগুলো উপরে ঠেলে দিতেই হঠাৎ জেগে উঠলো তুষার। আধবোজা চোখে কিছুপলক চেয়ে রইলো হৈমন্তীর দিকে। কাছে টেনে নিলো। অতি সন্তপর্ণে গলায় মুখ গুঁজে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো,
—“আরেকটু ঘুমান হৈমন্তীকা। এখনো এলার্ম বাজে নি।”

হৈমন্তী সরতে চাইলো,
—“এলার্ম বেজেছে। আমি বন্ধ করে দিয়েছি। উঠুন। একটু পর মাগরিবের আযান দিবে।”
তুষার ছাড়লো না। জড়িয়ে ধরার শক্তি আরও দৃঢ় করে বললো,
—“আরেকটু ঘুমান। ঘুম শেষ হয় নি আমার।”
—“কেন? আপনার না অনেক কাজ? বউকে জাগাতে হবে, খাওয়াতে হবে। আপনি কি আর যুবসমাজের অবিবাহিত ছাত্র আছেন? তাড়াতাড়ি উঠুন। কাজ রেখে ঘুমাচ্ছেন কেন?”

তুষার নেত্র মেলল। তীক্ষ্ণ চাহনি নিয়ে তাকালো। কপালের ভাঁজ গাঢ় হতেই সশব্দে হেসে দিলো হৈমন্তী। খিলখিল শব্দ কানে প্রবল ঝংকার তুললো যেন। তুষার পলক ফেলছে না। নিমেষহীন দেখছে। চোখের গভীর, অশান্ত দৃষ্টি নজরে আসতেই হাসি থামিয়ে দিলো সে। ক্ষীণ লজ্জায় জড়োসড়ো হলো। তুষার যেন প্রশ্রয় পেল এতে। নিমগ্ন চেয়ে ভয়ংকর গলায় প্রশ্ন করলো,
—“আমি যদি আপনাকে একটু ছুঁয়ে দেই, আপনি কি রাগ করবেন হৈমন্তীকা?”

হৈমন্তীর গাল রক্তিম আভায় ফুটে উঠলো। চোখ তুলে তাকানোর সাহস হলো না। থুতনি গলার সঙ্গে একদম লাগিয়ে নতজানু হয়ে রইল সে। তুষার দূর্বোধ্য হাসলো। এগিয়ে এলো। কপাল থেকে চুল সরিয়ে গভীর ভাবে অধর ছোঁয়ালো। কোমল স্বরে বললো,
—“আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি হৈমন্তীকা। আপনি শাড়ি ঠিক করে নিন।”

হৈমন্তী এবারও কিছু বলে না। আগের ন্যায়ই চুপচাপ শুয়ে থাকে। ওয়াশরুমের দরজা লাগানোর শব্দ কানে যেতেই তুষারের শেষাক্ত কথা মনে পরে যায় তার। তড়িৎ গতিতে নিজের দিকে তাকাতেই চোখ বড় বড় হয়ে যায় হৈমন্তীর। পরনের শাড়ি ঠিক নেই। বিছানার অপর পাশটায় পুরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শাড়ির আঁচল। অস্বস্থিতে মুখ চুপসে গেল হৈমন্তীর। মনে মনে বিড়বিড়িয়ে উঠলো, “পাজি ছেলে।”

_____

আফতাব সাহেব প্রচন্ড ক্রোধে ফুঁসছেন। চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছেন তুষারের দিকে। চোয়াল শক্ত উনার। সরব উঁচু গলায় চিৎকার করে উঠলেন,
—“তোমার সাহস কি করে হয় আমার কথার বিরুদ্ধে গিয়ে ওই মেয়েকে বিয়ে করার? আবার নাকি এ বাড়িতেও নিয়ে এসেছো। কোথায় ওই মেয়ে? ডাকো ওকে। নির্লজ্জার সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে ওই পরিবার। এত বেজাত পরিবার আমি দু’টো দেখিনি।”

হেনা কাতর চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন। দৃষ্টি ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন আবার। নরম সুরে অনুরোধ করলেন,
—“আস্তে বলো। মেয়েটা শুনতে পাবে।”
আফতাব সাহেব হুংকার ছাড়লেন,
—“শুনুক। ওই মেয়ের জানা উচিত ওরা কতটা নির্লজ্জ, বেহায়া, লোভী।”

তুষারের মুখশ্রী কেমন ভয়ংকর লাল দেখালো। চোখে-মুখে অনঢ় শক্ত আবরণ। কঠিন গলায় সে বললো,
—“মুখ সামলে বাবা। আমার স্ত্রী হয় উনি।”
আফতাব সাহেব তেঁতে উঠলেন,
—“মানি না আমি। বিয়ে করেছ এখন তালাক দেবে। ওই মেয়েকে নিজের বউমা কক্ষনো মানবো না আমি।”

তুষার গলার আওয়াজ বাড়লো। সেও প্রবল তেজের সঙ্গে উত্তর দিলো,
—“মানতে হবে না। আমিও চাই না উনি তোমার বউমা হোক। হৈমন্তীকাকে নিয়ে আমি এখনই চলে যাবো এখান থেকে।”

ছেলের চলে যাবার কথা শুনে অল্প ভড়কালেন আফতাব সাহেব। যত যাই হোক, নিজের ছেলের চলে যাওয়া কখনোই সহ্য করবেন না তিনি। উনার রাগ মিশ্রিত মুখশ্রী ক্ষীণ স্বাভাবিক হলো। তবে তখনো গম্ভীরতা, কঠোরতা সুস্পষ্ট। থমথমে গলায় তিনি বললেন,
—“তোমাকে চলে যাওয়ার কথা একবারও বলেছি আমি?”
—“তোমার কথা দিয়ে তো তা-ই বোঝাচ্ছ। যেখানে হৈমন্তীকার থাকতে কষ্ট হয়, সেখানে অবশ্যই আমি থাকবো না।”

মাঝখান দিয়ে হেনা থামাতে চাইলেন তুষারকে, “থাম না তুষার। বাবার সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? রুমে যা।”
তুষারের দু’কান সেকথা শুনলোই না যেন। উত্তরের অপেক্ষায় বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। আফতাব সাহেব বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। হেনার উদ্দেশ্যে তীব্র ক্ষোভ নিয়ে চেঁচালেন,
—“তোমার ছেলে পাগল হয়ে গেছে হেনা। ওই মেয়ে পাগল করে দিয়েছে তোমার ছেলেকে।”

তুষার প্রতিউত্তরে কিছু বলতে নিলেই তার হাত চেপে ধরলেন হেনা। অনুনয়ের সুরে কথা বাড়াতে মানা করলেন।

_____

দরজা খোলার শব্দ পেতেই সেদিকে দৌঁড়ে এগোলো হৈমন্তী। তাকে রুমে আটকে রেখেছিল তুষার। তবুও কিছুক্ষণ আগের হওয়া ঝড়ের একেকটা কথা শুনতে পেয়েছিল সে।
তুষারের এলোমেলো, রাগে অস্বাভাবিক চেহারা দেখে থমকে দাঁড়ালো হৈমন্তী। আঁখিজোড়া জলে পরিপূর্ণ তার। তুষারকে দেখতেই তা গড়গড় করে গাল বেয়ে নিচে নেমে পরল। ফুঁফিয়ে উঠল সে। পা গুলো যেন শিরশির করে কাঁপছে। শরীর দুলছে। কম্পয়মান কণ্ঠে হৈমন্তী জিজ্ঞেস করে উঠল,
—“কেন বিয়ে করেছেন আমায় তুষায়? কেন ভালোবাসেন?”

তুষার উত্তর দেয় না। শক্ত চোখে তাকিয়ে তাকে। হৈমন্তী নিজ থেকেই আবার বলা শুরু করে,
—“বলুন, কেন বিয়ে করেছেন? কেন ভালোবেসেছেন? আমি তো লোভী। আমার পরিবার লোভী। আমাকে আমার বাবার কাছে দিয়ে আসুন তুষার। আমি এখানে থাকবো না। আমি আপনাকে ভালোবাসি না। একদমই ভালোবাসি না।”

তুষার আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। দ্রুত হৈমন্তীর কাছাকাছি এসে তাকে কোলে তুলে নিলো। হৈমন্তী পা ছোড়াছুড়ি করছে। বারবার আঘাত করছে বুকে। নামিয়ে দিতে বলছে। তুষার পরোয়া করলো না। ধীর স্থির হয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে নাকে নাক ছুঁলো। চোখ বুজে বললো,
—“আপনি আমাকে ভালোবাসেন হৈমন্তীকা।”
সঙ্গে সঙ্গে হৈমন্তীর কান্না ভেঁজা গলা,
—“মিথ্যে কথা।”

তুষার হাসলো। বিস্তর হাসি। সিক্ত চোখের পাতায় অধর ছুঁইয়ে বললো,
—“কাঁদবেন না হৈমন্তীকা। আমার ভালো লাগে না।”

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here