“অঙ্গনে হৃদরঙ্গন”
পর্ব- ১২
(নূর নাফিসা)
.
.
হুজুর ও সাথের লোকটা মিষ্টিমুখ করেই বিদায় নিয়েছে। শ্রাবণ নিজের রুমে এসে শাড়িটা খুলে দেখছে। ভীষণ পছন্দ হয়েছে তার। ইচ্ছে করছে পরে ফেলতে। কিন্তু লজ্জা লাগছে পরতে। ভাবতেই পারেনি তারও একদিন সংসার সাজবে, একটা মনের মানুষ হবে, কারো স্ত্রী হওয়ার পরিচয় জন্মাবে! সৃষ্টিকর্তা সবারই একটা গতি ঠিক করে দেয়। কে কার হবে, কোথায় কার মিল হবে সবটাই পূর্ব থেকেই নির্ধারিত। এই নির্ধারিত বিষয়কে পরিবর্তন করার সাধ্য পৃথিবীর বুকে কারো নেই। বাবা মাকে নিয়ে গেছে তো কি হয়েছে, স্বামী এনে দিয়ে একটা পরিবার তো ঠিকই ফিরিয়ে দিয়েছে। ভাবতে ভাবতে চোখ জলে ভরে উঠলো শ্রাবণের। সে আবারও শাড়িটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সেটা পুনরায় প্যাকেটে রেখে চোখ মুছে বেরিয়ে এলো সাদাফকে খাবার দেওয়ার জন্য। খাবারের বাটি প্লেট নিয়ে সাদাফের রুমে আসতেই দেখলো সাদাফ তোশক মেঝেতে ফেলে ঝাড়ছে। শ্রাবণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো। সাদাফ তাকে দেখে তোশক খাটে তুলতে তুলতে বললো,
“এটা এখানেই বিছিয়ে ফেলি, কি বলো? থাকতে পারবে না এখানে?”
শ্রাবণ নিশ্চুপ মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সাদফ ঝটপট তোশকটা বিছিয়ে দিতেই শ্রাবণ খাটে প্লেট রাখলো। সাদাফ বেড কভারের প্যাকেটটা বের করলো বিছিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু প্লেট রাখায় সেটা খাটের একপাশে রেখে দিলো। শ্রাবণ তরিতরকারির বাটি এনে রাখার পর পানির বোতল ভরে নিয়ে এলো। গ্লাসে পানি ঢেলেও প্রস্তুত রাখলো। সাদাফ হাতমুখ ধুয়ে এসে বললো,
“খেয়েছো তুমি?”
“উহু। আপনি খান। পরে খেয়ে নিবো।”
“পরে খাবে কেন! এখন খাও। ওষুধ খেতে হবে না!”
শ্রাবণ নিজের জন্যও খাবার নিয়ে এলো। মিষ্টির প্যাকেটটা চেয়ার থেকে তুলে খাটের এক কোণে রেখে সে চেয়ারে বসে খেতে লাগলো। খাওয়ার পর ওষুধের প্যাকেট নিয়ে হাজির হলো সাদাফের সামনে। কখন কোন ওষুধ খেতে হবে জানা নেই তার। সাদাফ আবার দেখিয়ে দিতে লাগলো। কিন্তু শ্রাবণ বাঁধা দিয়ে বললো,
“আমার এতো জেনে কি হবে! প্রতি বেলায় আপনি দিলেই হবে।”
“প্রতি বেলায় কি আমি থাকবো?”
“না থাকলে না খেয়েই থাকবো।”
সাদাফ তার হাতে ওষুধ ধরিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো। কোথায় যাচ্ছে কিছুই বলে যায়নি, শ্রাবণও জিজ্ঞাসা করেনি কিছু। খাবারের বাটি প্লেট গুছিয়ে রেখে এসে ঘর ঝাড়ু দিলো। বিছানায় কভার বিছিয়ে বালিশ দুটোতেও কভার লাগিয়ে গুছিয়ে ফেললো৷ মনের সাথে ঘরেও যেন নতুনত্ব নেমে এসেছে। সেজেছে রঙ্গিন সাজে। মিষ্টির প্যাকেটে চোখ পড়তেই এবার সে-ও মিষ্টিমুখ করলো। মিষ্টি তার ভীষণ প্রিয়। তাই একটা খাওয়ার পর টুপ করেই আরেকটা মুখে পুরে দিলো। আরও খেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু মাত্রই ভাত খেয়েছে তাই পেটে এতোটা প্রেশার দিলো না৷ মিষ্টি তো তার ঘরেই থাকবে, উড়ে তো আর চলে যাচ্ছে না! সেই ভেবে রেখে দিলো পরে খাবে বলে। হাত ধুতে যাচ্ছে এমন সময় আবার সাদাফ ফিরে এলো। তাকে বাথরুমে যেতে দেখে বললো,
“রুমে এসো।”
শ্রাবণ হাত ধুয়ে রুমে আসলে বরফের প্যাকেটটা তার হাতে দিয়ে বললো,
“ঠিকমতো লাগাও। দেখি, কমেছে কি না?”
সে ধরতে গেলেই শ্রাবণ একটু পেছনে সরে নিজেই কাঁধ থেকে জামা হালকা নামিয়ে দেখালো ক্ষত জায়গা। সাদাফ আর এগিয়ে গেলো না। দূর থেকেই দেখে বললো,
“এটা লাগাও এখন। ফোলা আরেকটু কমলে কাল পরশু থেকে গরম পানির ছ্যাঁকা দিলে তারাতাড়ি সেড়ে যাবে।”
বলতে বলতে সাদাফ বিছানার দিকে অগ্রসর হলো। শ্রাবণ বরফ নিয়ে খাট থেকে একটু দূরে চেয়ারে বসলো। একে তো ঠান্ডার দিন, তারউপর ব্যাথার স্থানে এই বরফ স্পর্শ করতেই শরীরে কম্পন ধরে গেছে৷ আলতো আলতো ছোঁয়া দিয়ে তুলে আনছে। সাদাফ বালিশ দুটো নেড়েচেড়ে দেখে শুতে যাচ্ছিলো, শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলো। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে দেখলো তার কান্ড। তার এই ছুঁইছুঁই কর্মকাণ্ড একদম ভালো লাগছে না তার কাছে। সে পুনরায় সোজা হয়ে ডাকলো তাকে,
“এদিকে এসো।”
“হুম?”
“এখানে আসতে বলেছি।”
“না, আমিই পারবো।”
“এসো বলছি!”
শ্রাবণ ঢোক গিলে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালো। বড্ড অস্বস্তি নিয়ে এগিয়ে গেলো ধীর পায়ে। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসা মাত্রই হৃদপিণ্ড ধুকপুক করতে লাগলো! সাদাফ তার হাত থেকে বরফের টুকরোটা নিয়ে নিজেই ধীরে ধীরে কাঁধে লাগিয়ে দিতে লাগলো। তার স্পর্শ পড়া মাত্রই শ্রাবণ প্রচন্ডভাবে কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। এদিকে তার কাপুনি দেখে সাদাফ আচমকা হাত সরিয়ে নিয়ে বললো,
“ব্যাথা পেয়েছো?”
শ্রাবণ যেন ভয়ানক লজ্জায় পড়ে গেলো! এ যে ব্যাথা নয়, শিহরণের কম্পন সেটা বলবে কি করে তাকে! সে মাথা নত রেখে চুপ করে রইলো। সাদাফ আবার ধীরে ধীরে লাগিয়ে দিচ্ছে। বরফ লাগাতে লাগাতে এক পর্যায়ে যেন তার নির্ঘুম চোখে অন্যরকম ঘোর নেমে এলো। মাথাটা নেমে এসেছে শ্রাবণের মাথার উপর। দুহাতে জড়িয়ে গেছে শ্রাবণ। সাদাফ মাদকতা জড়ানো কণ্ঠে বললো,
“রাতে আমার ঘুম হয়নি। এখন একটু ঘুমাতে দিবে?”
শ্রাবণ অস্বস্তিতে হালকা নেড়েচেড়ে উঠে নিজেকে ছুটিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে তার হাত দুটো ধরে বললো,
“আপনি ঘুমান। আমি চলে যাচ্ছি।”
“উহু, তোমার পাশে ঘুম নামে চোখে। তুমিও ঘুমাও এখন আমার সাথে।”
অস্বস্তির জোয়ারে যেন ভেসে যাচ্ছে শ্রাবণ। তবুও দরজা আটকে দিয়ে এসে ঘুমাতে বাধ্য তার সাথে। বরফের পানিতে ভেজা জামাটাও চেঞ্জ করার সুযোগ হয়নি তার। শুকাতে হলো শরীরের উষ্ণতায়। কয়েক ঘন্টা আগে ঘুম থেকে উঠেও আবার ঘুমাতে হলো এসময়ে। শাড়িটা পরা হলো গোসলের পর। বহুদিন আগে থেকে তার টুকটুকে লাল শাড়ি পরার ভীষণ ইচ্ছে ছিলো। অবশেষে আজ তা পূর্ণ হলো। সাদাফের লজ্জাটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে একবার তার সম্মুখীন হওয়ার পরেই। তবে ঘর থেকে বের হওয়ার লজ্জা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যদি পড়ে যায় কোনো লোক চোখে! হঠাৎ এমন লাল টুকটুকে শাড়িতে দেখলে লোকে কি বলবে কে জানে! যার জন্য সাদাফের রুম থেকে বাথরুম কিংবা রান্নাঘরেও যেতে হয়েছে তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে। শুধু একজনের কাছেই কোনো লুকোচুরি নেই। এক পলক দেখার পরেই কেটে গেছে সব অস্বাভাবিকতা, আর এখন উল্টো তাকে দেখা দিতেই মন চাইছে বারবার।
সারাদিন বাড়িতে কাটিয়ে বিকেলে সাদাফ বেরিয়েছে। যাওয়ার সময় রাতের রান্না করতে নিষেধ করে গেলো শ্রাবণকে। শ্রাবণেরও একা সময় কাটছে না বাড়িতে। তবে বেশিক্ষণ একা থাকতে হয়নি তাকে। সন্ধ্যার পরপর রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে ফিরেছে সাদাফ। বিয়ের দিন পোলাও কোরমা না খেলে কি চলে! তাইতো এই আয়োজন। নিজেদের বিয়ে নিজেরাই উপভোগ করলো। শ্রাবণ বেশ খুশি। যদিও তার শরীরের অবস্থা তেমন ভালো নয়। তবে মনে দুঃখ নেই। মনটা ভীষণ ভালো। কিন্তু সাদাফের পরিবর্তন যেন আকস্মিক ব্যতিক্রম হয়ে গেলো। আগের দিন কেটেছে যেমনতেমন, যৌবনকালে পদার্পণের পর এতোটা আবেগী পাগলামো সে কখনোই করেনি। মনের অজান্তেই কতটা মায়ায় জড়িয়ে গেলে সে শ্রাবণকে এভাবে চেয়ে বসতে পারে সে নিজেও ধারণা করতে পারবে না।
আজ সারাদিনে বেশ কয়েকবার বরফ এনে লাগিয়ে দিয়েছে সাদাফ। পরদিন বিকেল থেকে আবার গরম পানির ছ্যাঁকা দিতে শুরু করলো। গত দিন তো ঘর থেকেই বের হয়নি লজ্জায়। আজ শাড়ি পাল্টানোর পর ঘরে বাইরে দু’দিকেই কাজকর্ম করছে শ্রাবণ। সন্ধ্যায় ফ্রিজ থেকে মাছ আনতে গেলে পাশের ঘরের ভাড়াটিয়ার চোখে মাথার ছোট ব্যান্ডেজটা পড়তেই জিজ্ঞেস করে উঠলো,
“কি গো, মাথায় কি হলো?”
“ওই, অসাবধানতায় চলাফেরা করতে গিয়ে কেটে গেছে।”
“গর্ত হয়ে গেছে বুঝি অনেক?”
“না, অল্প একটুই চামড়া কেটেছে মাত্র।”
“এটুকুর জন্য আবার ব্যান্ডেজ লাগাতে হয়!”
“রক্ত ঝরছিলো তাই লাগিয়ে দিয়েছে ডাক্তার।”
ভাড়াটিয়া একটু রসিকতা করে বললো,
“সাদাফ ভাই বেশি বেশি মাছ মাংস খাওয়াচ্ছে বলে বুঝি শরীরে রক্ত বেড়ে গেছে? তা আজকাল ওইঘর থেকেই তোমাকে সকাল দুপুর বের হতে দেখা যায় দেখছি। ঘর কি বদলে গেছে, নাকি মন?”
শ্রাবণ চাইছিলো না জবাব দিতে। কিন্তু না দিলেও হয়তো আরও খারাপ মন্তব্য করে বসতে পারে। তাই বললো,
“দুটোই বদলেছে। আগের সম্পর্ক পরিবর্তন হয়ে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে।”
“হু, সেটাতো আগেই সন্দেহ করেছি। দুইঘরে দুটি মন কি টিকবে কখনো! তোমাদের ভাইবোন হতেই কতক্ষণ আর স্বামী স্ত্রী হতেই কতক্ষণ! বিয়ে শাদি ছাড়াই সব হয়ে যেতে…”
“বিয়ে শাদি ছাড়া নয়, আল্লাহর কালাম সাক্ষী রেখেই সম্পর্ক গড়েছে। বাকি প্যাকেটগুলোও দিয়ে দিন।”
ভাড়াটিয়ার উপহাস সহ্য হচ্ছিলো না শ্রাবণের। তার কথার মাঝখানে কথা আটকে জবাব দিয়ে তাদের ফ্রিজ থেকে সবই নিয়ে এলো। রাখা ছিলো তিন প্যাকেট, আনতে গিয়েছিলো এক প্যাকেট। মহিলার উপর বিরক্ত হয়ে সবটাই নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো। এর সাথে আর কখনোই কোনো কথা থাকবে না তার। পাজি একটা মহিলা। তার হনহনিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রতি সেই মহিলাও ভেঙচি কেটে মনে মনে হয়তো বকলো।