অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~১৬
‘প্রাণ, যদি শোনো। আমি একজন খুনী, তাহলে তুমি কী আমায় ঘৃণা করবে!’
কথাটা ভীষণভাবে আকুতিভরা টলটলে শোনালো প্রানেশার কানে৷ প্রানেশা সুফিয়ানের ঠিক বাম পাশে হাঁটুতে মাথা দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে ছিলো। খুনের কথা শুনে প্রানেশার হয়তো এই মূহুর্তে আতংকিত হয়ে চেচামেচি করে ওঠার কথা অথচ সুফিয়ানের মায়া চোখের উপর তেমন কিছু বলতে পারলো না। শরীরের অর্ধাংশ বোধ হয় কেঁপে উঠলো। মাথা নাড়িয়ে বললো-
‘নাহ’
সুফিয়ান দুর্বধ্যে হাসলো। প্রানেশার ভেতরের হাসফাস টের পেলো। নির্লিপ্ততা নিয়ে মাথার নিচে দুই হাত ভাজ করে বালির উপর শুয়ে পড়লো৷ প্রানেশার তখন মনে হলো ” এটি সবচেয়ে সুন্দর চিত্র। রংতুলি হাতে থাকলে নিশ্চিত কাঁচা হাতেই একটা পেইন্ট করে ফেলা যেতো৷ এই যে সারা রাত ধরে ঘটা করে প্রবল বৃষ্টি হলো এখন এই ঠান্ডা বাতাসের মাঝে সূর্যর হালকা আলো, কেমন একটা মোমবাতির সোনালী আভার মতোন চিকচিক করছে৷ চিকচিকে সোনালী আভাটা নিজের রং দিয়ে সুফিয়ানকে সাজিয়ে দিতে চাচ্ছে। যদি এমন একটা থমথমে পরিবেশ না হতো, তবে এই মূহুর্তে আমি রোম্যান্টিক বনে যেতাম ” পরমুহূর্তেই ভাবলো ”ধুরর,যতসব উদ্ভট চিন্তা ”
সুফিয়ান সোনালী আকাশটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো আজ সব সত্যি উন্মুক্ত করে দেবে। তারপর যা হওয়ার হোক৷ প্রানেশা যেমন রিয়েক্টই করুক, কিন্তু ছেড়ে চলে যেতে দেবেনা। প্রানেশার দিকে তাকিয়ে বললো-
‘প্রাণ, রেয়ান তোমাকে কখনো ভালোবাসেনি ‘
প্রানেশা বিস্মিত ভঙ্গিতে বললো –
‘কী বলছেন এসব!’
‘আমি মিথ্যা বলিনা প্রাণ, আর একটা কথা কী জানো!তুমিও রেয়ানকে ভালোবাসোনি ‘
প্রানেশা এক মুহূর্তের জন্য থমকালো। চমকে উঠলো। অস্বীকার করে বললো –
‘আপনি কী করে জানবেন! আমি সত্যিই ভালোবাসতাম ‘
‘হাঃ হাঃ, তুমি খুব বোকা প্রাণ! এখন শোনো তুমি যা এতোদিন জানতে বা দেখতে সেসব কিছু তোমায় দেখানো হয়েছে। এক কথায় তোমার সাথে মাইন্ড কনট্রোল করা হয়েছে ‘
‘মানে! ‘
‘মানে হলো, তোমার জীবনের প্রথম পুরুষ আমিই ছিলাম আর শেষ পুরুষও আমিই থাকবো ‘
প্রানেশা কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারলো না। সুফিয়ানের কাছে হামাগুড়ির মতোন দুই হাত এগিয়ে এলো৷ সুফিয়ান আড়চোখে একবার দেখে নিলো প্রানেশাকে। সুফিয়ান নিজের একটা হাত সামনে বাড়িয়ে দিলো। প্রানেশা সেই বাহুতে নির্দ্বিধায় মাথা এলিয়ে শুয়ে পড়লো। মাথার উপরে রংবেরঙের দুই একটা বিদেশি পাখি উড়ে বেরাচ্ছে। সূর্যর মতিগতি বোঝা বড় দায়। এই আলো ছড়িয়ে রাজার মতো আকাশকে দখল করছে তো আরেকবার মেঘের ভেলায় মুখ লুকোচ্ছে। সুফিয়ান প্রানেশার গায়ের উপরের ওরনা দিয়ে হাতে পেচিয়ে অযথাই নাড়াচাড়া করতে থাকলো। প্রানেশার উৎসুক দৃষ্টির দিকে তাক করে মনে করলো সেই সময়ের কথা-
‘এবারের প্রথম বিজয়ীর স্থান দখল করেছে ‘সুফিয়ান তেহজিব’ ‘
হাস্যজ্জল মুখভঙ্গিতে স্টুডেন্টদের মাঝে থেকে গিটার কাঁধে স্টেজে উঠে এলো সুফিয়ান। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রতিযোগিতা প্রতিবারের মতো এবারও প্রথম স্থান দখল করে নিলো সে। ট্রফি হাতে নেমে আসতেই বন্ধুরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বন্ধুদের চোখের মণি সুফিয়ান। বাহ্যিক ব্যবহার, কথাবার্তায় মুখভর্তি হাসি, সকলকে সম্মান এসব গুণ সবার চোখে তাকে উঁচু করেছে বহু গুনে৷ বন্ধুদের মাঝে দুইজনকে অনবরত খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে সুফিয়ান। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ফায়েজ সুফিয়ানের চিন্তিত মুখভঙ্গি দেখে বললো-
‘কী মামা! প্রত্যেক বারের মতো এইবারও ছক্কা হাঁকাইলা। এখন কারে খুঁজো? ‘
সুফিয়ান হেসে বললো –
‘ ইভানান আর রেয়ান ‘
ফায়েজ ভ্রু কুচকে বললো-
‘ইভানান মনে হয় কিছুক্ষণের মাঝেই আইবো। এবারে ওর পেইন্টিংএ সবার নজর পড়সে। ‘ স্টেজের দিকে তাকিয়ে বললো-
‘আরে ঐ যে দেখ! ‘
সুফিয়ান তাকাতেই দেখলো গ্রিন ফুল হাতা শার্টের হাতা গুটিয়ে ক্লাসিকাল ড্রেসআপে নেমে আসছে তার চাচাতো ভাই ইভানান৷ ছোট বেলা থেকেই দুজনের গভীর বন্ধুত্ব। একজন আরেকজনের প্রাণ। দুইজনের মধ্যে যদি কম্পিটিশন করা হয়, তাহলে বিচারক হিমশিম খেয়ে যাবে। সুফিয়ানের যেমন খাঁড়া নাক, গভীর কালো ঘোর লাগানো চোখ, পেটানো জিম করা বডি, গলায় মধুর সুর। ঠিক তেমনই ইভানানও কোনো অংশে কম নয়,তার আছে নীল সাগরের মতোন দুটি নয়ন, খাড়া কাটা কাটা চুল, ঠোঁটের উপরের খাঁজে একটা তিল সঙ্গে জাদুকরী হাতের আর্ট ৷ কারো সাথে যেন কারো তুলনা করা মুশকিল। শুধু একটা দিকই ইভানানের খারাপ, তা হলো চরিত্রদোষ। সুফিয়ান যেমন কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে ঠিক মতো দেখেনা, সেখানে ইভানান দশ পনেরো বার রুম ডেট করেছে । সুফিয়ানের দিকে এগিয়ে এসে ইভানান শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো-
‘ভাই! কেমন আছিস ‘
‘এমন ভাবে বলছিস যেনো কয় যুগ পর দেখা হলো!দুইদিন আগেই তো বড় মার সঙ্গে দেখা করে এলাম’
‘তা ঠিক আছে, কিন্ত তোকে দুইদিন না দেখলে সব পানশে পানশে লাগেরে বেটা!’
সুফিয়ান প্রতুত্তরে হাসলো। ফায়েজ সুফিয়ান আর রেয়ানের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। গালে হাত দিয়ে দুইজনের দিকে সন্দেহ নজরে তাকিয়ে বললো-
‘কী ব্যাপার বলতো! তোরা দুইদিন আলাদা থাকতে পারোস না। এই! তোদের দুইজনের আবার সমস্যা টমস্যা নেই তো!’
সুফিয়ান আর ইভানান ইচ্ছেমতোন কিল ঘুষি মারলো ফায়েজের পিঠে৷ তারপর তিনজন একসাথে হেসে উঠলো৷ তাদের ফ্রেন্ড সার্কেল অনেক বড় হলেও তিনজন সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কারণ বন্ধুত্বের শুরুটা স্কুল জীবনের। তিনজন যখন হাসি ঠাট্টায় মত্ত তখন হঠাৎ করে একটা ছেলে এসে সামনে দাঁড়ালো। হাতে এইচ. জি ওয়েলসের ‘ইনভিসিবল ম্যান’ বইটি৷ ঢোলা একটা প্যান্ট, চিকন কোমড়ের থেকে খুলবে খুলবে ভাব। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। ভোঁতা নাক, গোলগাল মুখের সামনে থেকে বই সরাতেই সুফিয়ান আর ইভানানের দিকে তাকিয়ে বোকা হেঁসে বললো –
‘ কংগ্রাচুলেশনস, সুফি ভাই, ইভ ভাই ‘
সুফিয়ান হেসে ছেলেটার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো৷ ভাইটা তার বড্ড সহজ সরল। প্যাচগোছ বোঝে না। কেউ তার উপর জোড়দাঁড়ি করলেও বুঝি রাগ করবেনা। চুপচাপ মেনে নেবে৷ সারাদিন বই হাতে ঘুরে বেড়ায়। বইটা হাত থেকে নিয়ে ইভানান বললো-
‘হুহ! তুই কীরে রেয়ান! এই সারাদিন শুধু বই হাতে ঘুরে বেড়াস। এমন করলে চলবে, একটু কথাবার্তাও বল’
রেয়ান তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হাসলো৷ সুফিয়ান আর ইভানানের সম্পূর্ণ বিপরীতে রেয়ান। চেহারা একবারে খারাপ না হলেও সুন্দর বলা যাবেনা। ছোট বেলা থেকেই সহজ সরল বোকাসোকা। যে যা বোঝায় তা-ই বোঝে। কিন্তু খুব বেশি একটা কথা বলে না। একা একা থাকে, বই পড়ে ৷ স্মার্টনেসের ধারের কাছেও নেই। পিছনে থেকে জয় এলো আড্ডায় সামিল হতে। জয় খুবই ঠোঁট কাটা স্বভাবের। কোন পরিস্থিতিতে কী কথা বলতে হয় তা বোঝে না, ত্যাড়ামি করে। কারো পিঠপিছে কিছু বলেনা, একদম স্রেইট ফরওয়ার্ড। রেয়ানের হাতে সবসময়কার মতোন বই দেখে তাচ্ছিল্য হাসলো, গায়ের ঢোলা টিশার্ট একবার ফাজলামো করে টেনে দিয়ে রেয়ানের কাঁধে হাত রেখে তীর্যক ব্যাঙ্গ করে বললো –
‘রেয়ান, কিছু মনে করিস না। বড় ভাই হিসেবে বলি শোন। এই যে এমনিতেই মুখের গড়ন বেশি ভালো না। তার উপর আবার এমন মেয়েদের মতোন এই চশমা ঢোলা জামা কাপড় পড়িস। এমন হলে তো বউ পাবি না! আমরা সবাই বিয়ে করবো কিন্তু তোকে বিয়ে দেয়া লাগবে!’ বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। প্রথমের কথা গুলোতে তেমন কিছু না বললেও পরের কথাটা ঠিক বুঝতে পারলো না রেয়ান। বোকার মতো করে জিজ্ঞেস করলো ‘ আমাকে বিয়ে দিতে হবে মানে!’
জয় আবারও হাসলো। রেয়ানের মাথায় চাটি মেরে বললো- ‘গাধারে! এর মানে হচ্ছে আমরা বিয়ে করে বউ ঘরে আনবো। আর তোকে ঘরজামাই করে বউয়ের বাড়ি পাঠাতে হবে ‘
সবাই হাসত হাসতে গড়াগড়ি খেলেও সুফিয়ান কড়া কন্ঠে বললো –
‘জয়! আমি বলেছি না, এভাবে রেয়ুর সাথে কথা বলবি না। সবার নিজের একটা আলাদা ব্যাক্তিত্ব থাকে। রেয়ু যদি এভাবে কম্ফোর্ট ফিল করে তাহলে আমাদের এতো সমস্যা কোথায়! ‘
সুফিয়ান থাকতে চাইলেও সবাই টেনে নিয়ে গেলো ক্যান্টিনে। রেয়ান সবসময়ই এমন তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সঙ্গে অভ্যস্ত । কিন্তু আজকের অপমানে ভেতরটা তেঁতো হয়ে উঠলো। সবকিছু চুপ করে সয়ে নিয়ে লাইব্রেরিতে যেতে নিলে দুইজনের ফিসফিস কানে এলো –
‘দেখসোস, কেমনে বোকা পাইয়া মদন বানায় রাখে ওরে! ‘
অপরপক্ষ থেকে একটা মেয়েলি ধ্বনি বললো-
‘ তা আর বলতে! আহারে বেচারা। সুফিয়ান আর ইভানান দুইজন তরতর বেগে উপরে উঠছে আর ওকে বোকা পেয়ে অবিচার করে যাচ্ছে ‘
রেয়ান কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়েছিলো। ভেতরের এতদিনকার আত্মবিশ্বাস নড়েচড়ে গেলো। চোখে বোধ হয় পানি জমছে৷ নাহ, সবাই ঠিকই বলে তার স্বভাবে মেয়েলিপনা আছে৷ তা-ই বোধহয় কেউ তাকে দুই পয়সার মূল্য দেয়না৷
_____________
‘জানো প্রাণ, আমরা সবাই মুভি দেখার সময় শুধু একজন ভিলেনকে দোষারোপ করি। তাকে গালমন্দ করি কিন্তু একবারও চিন্তা করিনা, সেই মানুষটার ভিলেন হওয়ার পেছনে থাকতে পারে এক বিস্তৃত ঘটনা। থাকতে পারে এক কষ্টদায়ক অতীত। শুধু প্রেম জীবনে প্রত্যাখ্যান পেয়েই যে কেউ ভেঙে গুড়িয়ে যাবে তা কিন্তু নয়, আশেপাশের মানুষের কটু মন্তব্যই যথেষ্ট একজনকে ডিপ্রেশনে ঠেলে দিতে। মানুষ যদি তার মুখের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারতো তাহলে, কারো নিজের জীবনের প্রতি এতো অনীহা জাগতো না! ‘
চলবে……
আজ যেমন বড় দিয়েছি তেমনি মন্তব্য চাই 😪😪