অঙ্গারের নেশা, পর্ব:১৭

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~১৭

সেসময়টা ছিলো খুব প্রাণবন্ত, জীবন্ত । আমরা সবাই মিলে ট্যুরে যাওয়ার প্ল্যান করলাম। ফায়েজ বললো সিঙ্গাপুরের কথা, জয় বললো লন্ডন, কিন্তু আমি আর ইভানান ঠিক করলাম দেশের ভেতরে কোথাও ঘুরার। ফায়েজ বললো ওর নানা বাড়িটা খুব সুন্দর। সেখানে পুরনো জমিদার বাড়ি, একটা লেক, একটা পার্ক আর জিন বাড়ি নামের একটা প্রাসাদের মতো বড় একটা বাড়ি আছে। ‘কোকিলপাড়া ‘ যাওয়ার জন্য সবার ভেতরে ভেতরে চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। রেয়ানকে সবসময়ের মতোই আমার সঙ্গে যেতে বললে রেয়ান স্বাভাবিক ভাবে বললো –
‘তোমরা যাও সামনে আমার পরীক্ষা ‘

কিছুতেই রাজী হলো না রেয়ান। আমরা সবাই ব্যাগ প্যাক করে রওনা হলাম ‘কোকিলপাড়া ‘। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফুলের সারি। এরকম গ্রাম আমি শুধু মাত্র কল্পনাতেই দেখেছি, কিন্তু বাস্তবে প্রথম। আমি তখনও জানতাম না, এই সুন্দর গ্রামে এসে আমি দেখা পাবো আমার প্রাণভোমরার।

ওখানে বেশ যত্ন করেই রাখা হলো আমাদের। যেদিন আমরা ফিরে আসবো সেই দিন জয় বললো-

‘শুনেছি এখানে নাকি একটা বড় নদী আছে, চল ঘুরে আসি’

আমি বললাম -‘না দেরি হয়ে যাবে, দরকার নেই ‘

ইভানান শেষমেষ আমাকে রাজী করিয়ে নিয়ে গেলো। আমরা সবাই সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত। বৃষ্টি নামলো সেদিন আমরা ঠিক করলাম আজ যাবো না। এত সুন্দর পরিবেশ ফেলে আমারও যেতে মন সায় দিলো না। চিত্রকররা বৃষ্টি দেখলে নাকি নিজেকে কখনো আটকে রাখতে পারে না। এটা ইভানানের মতামত । ও পাশের একটা টিনের ঘরে নদীর পাড়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে কবিতা টাইপের কিছু একটা লিখছিলো কলম নিয়ে। আর আমি বৃষ্টির মধ্যে সবার অনুরোধে গলা উঠিয়ে গান ধরলাম গিটার নিয়ে। আমি ছিলাম আমার গানে আর ইভানান ছিলো তার কলম নিয়ে লেখার কার্যে।

জয় হঠাৎ করেই চিৎকার করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিলো। সুফিয়ানের ধ্যান ভাংলো। চোখ সরিয়ে সেদিকে তাকাতেই দেখলো একটা মেয়ে ভেসে উঠেছে কিনারায়। কিছু মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিল সুফিয়ান৷ হাঁকডাকে ইভানানও কলম হাতে নিয়েই দৌড়ে এলো। সুফিয়ান কাঁধের গিটার রেখে কোনো কিছু না ভেবেই পাড়ে নেমে গেলো। সুফিয়ান হাত গুটিয়ে চার ধাপ সিঁড়ি নেমে পাঁজাকোলে উঠিয়ে নিলো৷ সুফিয়ান তখনও কিছু ভালো করে খেয়াল করেনি। উঠিয়ে কোলের উপর নিয়েই সিঁড়ির উপর বসে পড়লো৷ চুলে মুখ ঢেকে আছে ৷ কোমড় পর্যন্ত চুল গুলো হাত দিয়ে সরিয়ে মুখ দৃশ্যমান হতেই সুফিয়ান থমকে গিয়েছিলো৷ নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে গেলো। পেটে কেমন মোচড় দেয়ার ন্যায় ব্যাথা করে উঠলো৷ ভেজা ঠান্ডা মুখটা দেখে সুফিয়ানের ভেতরটা এক পশলা বৃষ্টির মতোন এসে ভিজিয়ে দিলো৷ অজান্তেই গাল ছুঁয়ে বললো -‘ এলোকেশী ভোমর’

সবার আড়ালে একইসঙ্গে চোখ পড়েছিলো আরও একজনের। সে ইভানান৷ তার নজর পড়লো সেই মেয়েটির গলার নিচের বিউটি বোনে, ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে যাওয়া লাল টকটকে ঠোঁট, আর মসৃণ ফর্সা পা টায়। এই পর্যন্ত সব মেয়েকে সে শুধু একদিনের জন্যই ব্যবহার করেছে। আজ প্রথম মনে হলো এই মেয়েটাকে তার একদিনের জন্য নয় সারাজীবনের সঙ্গীনী বানাতে হবে৷ দুইজনই পুরুষ, একজন চিন্তা করলো পবিত্রতা নিয়ে, আর আরেকজন সুন্দর যৌবনা শরীরে মগ্ন হয়ে ৷ একটি অজানা মেয়ে দুইজনের বুকের ভিতরে জায়গা করে নিলো। একজনের ‘প্রাণভোমরা’ হয়ে তো আরেকজনের ‘স্রোতস্বিনী’ হয়ে৷

জয় তার স্বাভাবিক স্বভাবমতোন বললো-
‘মইরা গেলো নাকি!’

সুফিয়ান সাথে সাথে হুংকার দিয়ে বললো-

‘জাস্ট শাট আপ! সবসময় এক্সট্রা ওর্ডিনারি ভাবতে কে বলে তোকে? ‘

ইভানানও রক্তশক্ষু নিয়ে তাকালো। জয় বুঝতে পারলো কথাটা বলা এই মুহূর্তে ঠিক হয়নি৷ সুফিয়ান নিজের গেঞ্জির উপরের টিশার্ট টা খুলে মেয়েটার বাহুতে জড়িয়ে দিলো৷ শ্বাস পরখ করতেই বুঝতে পারলো শুধু অজ্ঞান হয়েছে৷ গলার কাছে পড়ে থাকা ব্যাগে একটা আইডি কার্ডে দেখলো কলেজের একটা কার্ড ৷ নাম -প্রানেশা ইয়াসরার, বয়স-১৭, ঠিকানা সহ বোঝাই যাচ্ছে বয়স কম,হবে সতেরো আঠারো৷ ফায়েজ বললো-
‘ যাক বাবা এবার অন্তত সমস্যা হবে না। চল পাশের হসপিটালে ভর্তি করিয়ে দেই, প্যারেন্টস নাম্বার তো আছেই কার্ডে ‘

সুফিয়ান যত্নশীল হাতে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলো। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে৷ কাঁদা মাটি হয়ে গেছে রাস্তায়৷ সুফিয়ান সবাইকে উঠতে বলে নিজেও উঠে পরলো। সুফিয়ানের পাশেই উঠে বসলো ইভানান। জয়, ফায়েজ আর ইকরাম সামনের সিটে৷ সুফিয়ান নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো মেয়েটির দিকে। মনে মনে আওরালো-‘ আল্লাহ খুব যত্ন করে বানিয়েছে তোমায়’

কিছুক্ষণের মধ্যেই হসপিটালে এসে পড়লো৷ তেমন কিছু হয়নি বলে ডাক্তাররা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কেবিনে শিফট করে দিলো। দুর্বল শরীরে প্রানেশার জ্ঞান ফিরলো না৷ সুফিয়ান কেবিনে সারা রাত বসে রইলো। ইভানান রইলো ঠিকই তবে এমনভাবে যে কেউ বুঝতেই পারলো না। সুফিয়ান যেমন খোলামেলা স্বভাবের তেমনই ইভানান সব কাজে একটা গোপনীয়তা বজায় রাখতে পছন্দ করে।ভোরের দিকে যখন সবাই চলে যাওয়ার তাগিদ দিলো সুফিয়ান না করে দিলো কিন্তু মিসেস অদিতির শরীর খারাপ শুনেই মন খারাপ হয়ে গেলো৷ নিজের মাকে খুব ভালোবাসে সুফিয়ান৷ যেতে ইচ্ছে না করলেও মায়ের টানে যেতেই হবে ভেবে, কার্ডের নাম্বারটা সেভ করে নিলো। বেডে অজ্ঞান হয়ে শুয়ে থাকা প্রানেশার হাতটা মুঠোয় নিয়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে মায়া কন্ঠে বললো –

‘আমার প্রাণেশ্বরী! এই একদিনে যে গভীর মায়ায় আমায় জড়ালে এই মায়া কাটাতে আমার আরও সহস্র শতাব্দীর প্রয়োজন। তুমি কী কখনো অঙ্গার দেখেছো!
অঙ্গার মানে বোঝো? সিগারেট যেমন ধোঁয়া দিয়ে বুকের ভেতরটা জ্বালিয়ে দিতে দিতে অঙ্গারের মতো কালো করে দেয় কিন্তু তারপরও মানুষ সেই নেশায় মত্ত হয়ে গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়ে । ঠিক তেমনই আমিও জড়িয়ে পড়েছি তোমার নেশায়। আমি অঙ্গার আর তুমি এই ‘অঙ্গারের নেশা’

সুফিয়ান বের হতেই পাশে থাকা ইভানান সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো –

‘শুরুটা নাহয় তুই-ই করলি, শেষটুকু বরং নিয়তি বোঝাপড়া করুক। প্রানেশা আমাদের নেশা তা ঠিক কিন্তু তার অঙ্গার কে হবে তা রহস্য থাকুক ‘

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here