অচিত্তাকর্ষক পর্ব -১৫

#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|১৫|

জুভানের ফোনে একটা আননোন নাম্বার থেকে লাগাতার কিছু কল আসে। জুভান ব্যস্ত ছিল বিধেয় কলটা রিসিভ করতে পারে না। পরে সে সেই নাম্বারটা দেখে আবার কল ব্যাক করে। কলটা রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে একটা অপরিচিত কন্ঠ শোনা যায়। জুভান তাকে চিনতে না পেরে জিজ্ঞেস করে,

‘কে বলছেন?’

ওপাশের লোকটি জবাবে বলল,

‘আমি হসপিটাল থেকে বলছি, এখানে একজন মেয়েকে আমি কিছুক্ষণ আগে এডমিট করেছি। আর আমি উনার ফোন থেকেই আপনার নাম্বারটা পেয়েছি। আপনি একটু দয়া করে হসপিটালে চলে আসুন।’

জুভান বুঝল না লোকটা কোন মেয়ের কথা বলছে। সে লোকটাকে জিজ্ঞেস করল,

‘কোন হসপিটাল?’

লোকটা তাকে হসপিটালের ঠিকানা দিল। জুভানও তখন সেই হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। পথিমধ্যে সে কী ভেবে স্মৃতির নাম্বারে কল করল। সেই কলটা রিসিভ করল অন্য কেউ। জুভান তার সাথে কথা বলে জানতে পারল সেই মেয়েটা আর কেউ না স্মৃতি’ই। কথাটা শোনা মাত্রই সে যেন প্রচন্ড অস্থির হয়ে উঠল। স্মৃতির এক্সিডেন্ট কথাটা সে সহ্য করতে পারছে না। দ্রুত গাড়ি চালিয়ে সে হসপিটালে যায়।

রিসিপশনে কথা বলে সে দুতালায় যায়, স্মৃতির কেবিনে। গিয়ে দেখে বেডে চোখ বুজে স্মৃতি শুয়ে আছে। তার মাথায় ব্যান্ডেজ করা। জ্ঞান আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। জুভান তার কাছে ছুটে গেল। স্মৃতি স্মৃতি বলে ডাকল তাকে। সেখানের নার্স বলল,

‘এখনও উনার জ্ঞান ফেরেনি। কিছুটা সময় লাগবে।’

জুভান উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

‘ওর এই অবস্থা কী করে হলো?’

নার্স জবাব দিল,

‘আমরা ঠিক বলতে পারবো না। একজন লোক উনাকে নিয়ে এসেছেন। উনার মাথা থেকে তখন রক্ত পড়ছিল। আমরা সেটা ড্রেসিং করে দেই। ঐ লোকটা বলেছিলেন, তিনি নাকি উনাকে রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছেন, পরে হসপিটালে নিয়ে আসেন।’

‘আচ্ছা, সেই লোকটা এখন কোথায়?’

‘উনি তো চলে গিয়েছেন। আপনাকেও কলটা উনিই করেছিলেন।’

জুভান বুঝতে পারছে না এতকিছু কীভাবে হলো। সবকিছু বুঝতে গেলে আগে স্মৃতির জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করতে হবে। তাই সে স্মৃতির পাশে ঠাঁই বসে রইল। প্রায় ত্রিশ মিনিট বাদে স্মৃতির জ্ঞান ফিরে। প্রথমে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। হতভম্ব হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে। হঠাৎ জুভানের মুখটা দেখে সে কেঁদে উঠে। খুব শব্দ করে জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। স্মৃতির এমন কান্না দেখে জুভান বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। স্মৃতির গালে হাত রেখে বলে,

‘কোথায় কষ্ট হচ্ছে স্মৃতি? বলো আমাকে। ডাক্তার ডাকবো? বলো, কী সমস্যা হচ্ছে?’

স্মৃতি তার কান্না জারি রেখে ফোঁপাতে ফোঁপাতেই বলল,

‘ওরা জারা কে নিয়ে গিয়েছে, জুভান।’

জুভানের কপালে ভাঁজ পড়ে। সে অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

‘কারা জারা কে নিয়ে গিয়েছে? কী বলছো এসব?’

স্মৃতি এবার কান্না থামাল। নাক টেনে বলল,

‘আমি আর জারা একটু আগে শপিং এ বেরিয়েছিলাম। আমরা নিউ মার্কেটের পেছনের দিকটাই ছিলাম। তবে জারা আমার থেকে একটু দূরে একটা দোকানে চুরি দেখছিল, তখনই একটা বড়ো গাড়ি আসে। কয়েকজন ছেলে সেখান থেকে বের হয়ে এসেই জারা কে ধরে গাড়িতে উঠাতে লাগে। আমি সেটা দেখে দৌড়ে তাদের কাছে যাই। অনেক ভাবে তাদের আটকানোর চেষ্টা করি। কিন্তু অতগুলো ছেলের সাথে পারছিলাম না বলে অনেক চিৎকার চেঁচামেচিও করি। কিন্তু দুপুর হওয়াতে ঐদিকে খুব একটা মানুষ ছিল না। যে কয়জন ছিল তারাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল কেবল কেউ এগিয়ে আসেনি। একপর্যায়ে আমাকে থামাতে না পেরে একজন আমাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। আমি মাথায় প্রচন্ড আঘাত পাই তখন। পরে আর উঠার শক্তি পাইনি। ঝাপসা চোখে তখন কেবল গাড়িটা কে সেখান থেকে সাঁ সাঁ করে ছুটে যেতে দেখি। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই।’

কথা শেষ করে স্মৃতি আবারও কাঁদতে আরম্ভ করে। জুভান কী করবে বুঝতে পারছে না। তার বোনকে কেউ বা কারা তুলে নিয়ে গিয়েছে, সে এই কথাটা মানতে পারছে না। পাগল পাগল লাগছে তার। মাথা ফাঁকা লাগছে। কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না। সে কম্পিত কন্ঠে স্মৃতি কে জিজ্ঞেস করল,

‘গাড়ির নাম্বার দেখেছিলে?’

স্মৃতি কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,

‘না, দেখতে পারিনি।’

জুভান অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় হাঁসফাঁস করতে থাকে। সে কেবিন থেকে বাইরে বেরিয়ে কাউকে একটা কল দেয়। তাকে বলে,

‘জারা কে কেউ বা কারা তুলে নিয়ে গিয়েছে। ওর ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। তুই ওর ফোনের বর্তমান লোকেশন টা ট্রেক করতে পারিস কিনা দেখ। আর আমি এখন নিউ মার্কেট যাবো, সেখান থেকেই নাকি ওকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। তুই লোকেশনটা বের করতে পারলে আমাকে জানাবি, ঠিক আছে?’

ওপাশের লোকটি বোধ হয় সম্মতি জানাল। জুভান কল কেটে দিয়ে আবার কেবিনে গেল। সে তারপর ডাক্তারের সাথে কথা বলে স্মৃতিকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে পড়ল। হসপিটাল থেকে জুভান সোজা গেল সেই মার্কেটের কাছে। সেখানে গিয়ে স্মৃতিকে জিজ্ঞেস করল, ঠিক কোন জায়গা থেকে জারাকে তুলে নেওয়া হয়েছে। স্মৃতির আঙ্গুল দিয়ে রাস্তার একপাশ দেখাল। স্মৃতিকে গাড়িতে বসিয়ে রেখেই জুভান সেই জায়গাটাই গিয়ে আশেপাশের লোকদের জিজ্ঞেস করতে লাগল, একটু আগে এমন কোনো ঘটনা ঘটতে তারা দেখেছে কিনা। দোকানদার সহ আশেপাশের সবার জবাবই “না” ছিল। কেউই কিছু দেখেনি। জুভান আবার গাড়িতে ফিরে এল। স্মৃতিকে নিয়ে এবার সে বাড়িতে গেল। গিয়েই দেখল তার মা, আহাজারি করে কেঁদে যাচ্ছে। এতক্ষণে এই খবর ছড়িয়ে গিয়েছে। স্মৃতিকে দেখা মাত্রই মারিয়াম আহমেদ প্রচন্ড ক্ষেপে গেলেন। তিনি কান্না ফেলে তেড়ে এলেন তার দিকে। চেঁচিয়ে উঠে বললেন,

‘তুই নিশ্চয়ই আমার মেয়ের সাথে কিছু করেছিস। সব তোর দোষ। তোর জন্য আমার মেয়েকে ওরা নিয়ে গিয়েছে। খুঁজে এনে দে, আমার মেয়েকে খুঁজে এনে দে।’

এই বলে তিনি বিলাপ ছাড়তে লাগলেন। স্মৃতিও তখন কেঁদে উঠে। শাশুড়ি মা’কে অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে যে সে কিছু করেনি। কিন্তু তার শাশুড়ি মা আর বোঝে না। তিনি তার মতোই চেঁচিয়ে যান। জুভান স্মৃতিকে নিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। স্মৃতিকে রেস্ট করতে বলে সে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তার এতটা স্বাভাবিক আচরণ মোটেও মানাচ্ছে না। বোন কে হারিয়ে কোথায় তার পাগল পাগল অবস্থা থাকবে তা না সে এখনও এতটা স্বাভাবিক কী করে সেটাই স্মৃতি বুঝতে পারছে না।

জুভান চলে যাওয়ার পর স্মৃতি তার ভাইকে কল লাগায়।

‘ঐদিকে সব ঠিকঠাক তো?’

‘হ্যাঁ আপু, সব একদম ঠিকঠাক। তুমি কোনো চিন্তা করো না। তুমি এখন শুধু তোমার অভিনয়টা ঠিকঠাক মতো চালিয়ে যাও তাহলেই হবে।’

‘আচ্ছা, এইদিক আমি সামলে নিব। তুই কিন্তু বেশিক্ষণ ঐখানে থাকিস না, সন্ধ্যার আগেই বেরিয়ে পড়িস। আর শোন, ওর যেন কোনো অসুবিধা না হয়, বুঝেছিস?’

‘আচ্ছা আপু। তুমি যা বলবে তাই হবে।’

কল কেটে দিয়ে স্মৃতি এবার কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়। আর মনে মনে ভাবে, এইতো সবে শুরু। তার সাথে হওয়া প্রতিটা অন্যায়ের সে একে একে প্রতিশোধ নিবে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here