অচিত্তাকর্ষক পর্ব -১৬

#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|১৬|

জুভান সেদিন রাতে আর বাসায় ফিরল না। স্মৃতি তাকে কয়েকবার কল দিয়েছিল তবে জুভান তার কলও রিসিভ করেনি। বাড়ির পরিবেশ ও খুব একটা ভালো নেই। মারিয়াম আহমেদ খুব কান্নাকাটি করেছেন। রাতে খাননি তিনি। মজুমদার সাহেবেরও মন মেজাজ ভালো নেই। মেয়েকে নিয়ে তিনিও খুব চিন্তিত। স্মৃতি সমস্ত কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। খারাপ লাগলেও এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না তার কাছে। এইটুকু কঠোর তাকে হতেই হতো।

এখন গভীর রাত। চারদিকের নিস্তব্ধতা যেন তাই বলছে। বাইরে সোঁ সোঁ বাতাস বইছে। দূরে শোনা যাচ্ছে কুকুরের আর্তনাদ। স্মৃতি বারান্দায় দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ আগেই জুভান বেরিয়েছে। এত রাতে সে কোথায় গিয়েছে সেটা স্মৃতির অজানা। আজকাল জুভান প্রয়োজন ব্যতিত তার সাথে খুব একটা কথা বলছে না। স্মৃতির মন বলছে একটা সূক্ষ্ম সন্দেহের তীর তার উপরও আছে। তবে সে যতটা পারছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখছে। আর সময়ে সময়ে নিজের চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে আসল সত্যটা জানার।

ফোনের সিমটা চেঞ্জ করে সে আবার ঐ নাম্বারে কল করল। দুবারের মাথায় সেটা রিসিভও হলো। স্মৃতি তার স্বর খানিকটা বদলে খুব শীতল গলায় বলল,

‘হ্যালো! জিহাদ বলছেন?’

ওপাশের লোকটি বলল,

‘জ্বি। তবে আপনাকে তো চিনলাম না।’

স্মৃতি আহ্লাদিত কন্ঠে বলল,

‘কী করে চিনবে? আমি তো এখন পর হয়ে গেছি, তাই না? বউ বাচ্চা নিয়ে তুমি নিশ্চয়ই খুব ভালো আছো?’

জিহাদ এবার বিরক্ত হয়ে বলল,

‘কে আপনি? আপনাকে তো আমি চিনতে পারছি না।’

স্মৃতি একটা নাম শুনেছিল। নামটার সাথে জিহাদ হয়তো কোনোভাবে জড়িত। তাই সে আন্দাজেই সেই নামে ঢিল ছুঁড়ে বলল,

‘আমি ইতি।’

“ইতি” নামটা শুনেই জিহাদ চমকাল। ভার্সিটিতে থাকা অবস্থায় সে একটা মেয়েকে পছন্দ করতো, তার নামও ইতি ছিল। তবে কি এই সেই ইতি? জিহাদ প্রশ্ন করল,

‘তুমি কি সেই ই..’

‘যাক, চিনতে পেরেছ তবে।’

এত বড়ো বাটপাড়ি স্মৃতি কখনো করেনি। তবে পরিস্থিতি মানুষকে দিয়ে অনেক কিছুই করায়। আর এখানে সবথেকে বড়ো কথা হলো, তার হুট করেই বলে দেওয়া “ইতি” নামটি তাকে বড্ড সাহায্য করেছে। এবার ধরা না পড়লেই হলো।

জিহাদ উৎফুল্ল হয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘আমার নাম্বার কী করে পেলে?’

‘পেয়েছি, অনেক খুঁজে। তা তোমার কী খবর? এখনও দেখছি আমাকে ভুলোনি।’

‘তোমাকে ভুলা কি চারটে খানি কথা। আমার প্রথম পছন্দ তুমি, এরপর থেকে তো আর কাউকে চোখেই পড়ল না। সেই মনের কোণে তুমিই পড়ে রইলে। এখন কোথায় আছো তুমি? বিয়ে করে নিয়েছ, নিশ্চয়ই?’

‘না, বিয়ে করিনি।’

‘কেন?’

‘এমনি। তুমি এখন কোথায় আছো?’

‘আমি ঢাকায় আছি। এখানের একটা কম্পানিতে কাজ করছি।’

‘আচ্ছা, তাহলে তো ভালোই আছো। তবে আমি খুব সমস্যাই আছি জানোতো?’

‘কী সমস্যা?’

‘আসলে, আমি একটা চাকরি খুঁজছিলাম। অনেক ইন্টারভিউ দিয়েছি, তবে কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। তেমন টাকাও নেই আমার কাছে যে অন্য কোনো ব্যবস্থা করব। আর চাকরি ছাড়া চলতেও খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি কি আমায় একটু সাহায্য করবে, প্লিজ? তোমার কম্পানিতে আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারবে?’

‘আচ্ছা এই ব্যাপার? তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। ভেবে নাও তোমার চাকরি হয়ে গিয়েছে। আমি কালই আমার বসের সাথে কথা বলব, তুমি এই নিয়ে কোনো চিন্তা করো না।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। তুমি জানো না তুমি আমার কত বড়ো উপকার করেছ। আমি তোমার কাছে আজীবন ঋণী থাকব।’

‘আরে ধুর, এটা তো কিছুই না। তোমার সাহায্যের জন্য আমি সবকিছুই করতে পারব। আচ্ছা শোনো না, কাল ফ্রি আছো? দেখা করতে পারবে?’

স্মৃতি অনেক ভেবে চিন্তে বলল,

‘আচ্ছা, আমি কাল জানাব তোমায়। এখন রাখি। অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়ো। শুভ রাত্রি।’

‘ঠিক আছে, শুভ রাত্রি।’

নিঃস্ব মানুষগুলোর নতুন করে আর কিছু হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে না। আর যাদের হারানোর ভয় নেই তারা প্রচন্ড সাহসী। এই মুহূর্তে স্মৃতির মনেও প্রচন্ড সাহস জন্মেছে। তার নেওয়া পদক্ষেপগুলো হয়তো তাকে নিঃশেষও করে দিতে পারে তবে সে এখন আর পিছপা হবে না। একবার যখন এই গোলকধাঁধায় নেমেছে তবে এর শেষ দেখে তবেই ক্ষান্ত হবে সে।
.
.
ভোরের আলোয় মিটমিট করে স্মৃতি চেয়ে দেখল তার পাশে জুভান। গায়ে জড়ানো তার শার্ট আর পেন্ট। বাইরে থেকে এসে কাপড় না ছেড়েই সে ঘুমিয়ে পড়েছে। সচরাচর সে এমনটা করেন না। তবে আজ কেন? স্মৃতি তার ঘুমঘুম চোখগুলো ভালোভাবে মেলে ধরল। জুভানের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে তার গায়ে হাত দিতেই দেখল, শরীর তার খুব গরম। কপালে আর গলায় হাত ছুঁইয়ে বুঝতে পারল তার জ্বর হয়েছে। এই অসময়ে জ্বর? স্মৃতি চিন্তিত হয়ে উঠে বসল। দু একবার আস্তে আস্তে ডাকল তাকে। তবে তার কোনো সাড়া পেল না। জুভানের বিষন্ন জ্বর আক্রান্ত মুখশ্রী দেখে ভীষণ মায়া হলো তার। উঠে গিয়ে ওয়াশরুম থেকে পানি আর একটা ছোট তোয়ালে নিয়ে এল। তার পাশে বসে তার কপালে জলপট্টি দিতে লাগল। গায়ের উষ্ণতা এখন অনেক বেশি। বাইরে সবেই সূর্য উঠেছে। হালকা ধোঁয়াটে চারদিক। জুভানের জ্বর তখনও কমার নাম নিচ্ছে না। স্মৃতি কী করবে বুঝতে পারছে না। জ্বরের ঘোরে সে যেন কিছু বলছে। ঠোঁট নড়লেও কথা বোঝা যাচ্ছে না। স্মৃতি তার দিকে কিছুটা এগিয়ে গেল। কানের কাছে মুখ নিয়ে শোনার চেষ্টা করতে লাগল যে সে কী বলছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে তার মুখ থেকে অস্পষ্ট স্বরে সে কেবল তার নামটাই শুনতে পেল। নিজের নাম শুনে আরো কৌতুহল জাগল তার। জুভান কিছু একটা বলছে, আর সেটা এখন তাকে অবশ্যই শুনতে হবে। স্মৃতি আরো সতর্ক হয়ে কান পাতে। এবার সে কিছুটা শুনে। জুভান বলছে,

“স্মৃতি, এমন করো না। আমি ভালোবাসি তোমায়।”

স্মৃতি জোরে নিশ্বাস নেয়। এই কথাটা শুনে কষ্ট হয় তার। যদি এই লোকটাই তার বাবার হত্যকারী হয়, তবে সে কী করে এই লোকটাকে শাস্তি দিবে? কীভাবে অগ্রাহ্য করবে এই ভালোবাসা? এত কঠিন কাজ কী করে করবে সে?

সকালের দিকে জুভানের জ্বর অনেকটাই ছেড়ে দেয়। স্মৃতি তখন নাস্তা বানিয়ে এসে দেখে জুভান তৈরি হচ্ছে। স্মৃতি তা দেখে তাকে জিজ্ঞেস করে,

‘আপনার জ্বর কমেছে?’

জুভান জবাবে বলে,

‘হ্যাঁ।’

স্মৃতি তখন পুনারায় প্রশ্ন করে,

‘জারার কোনো খোঁজ পেয়েছেন?’

জুভান কঠিন গলায় এবার জবাব দেয়। বলে যে,

‘পাইনি। তবে খুব শীঘ্রই পেয়ে যাব। আর যে মানুষটা এসবের পেছনে দায়ী তাকে আমি নিজ হাতে টুকরো টুকরো করব।’

জুভানের চোখ মুখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। স্মৃতি আর কিছু বলে না। মৃদু সুরে জুভানকে নিচে আসতে বলে সেও নিচে নেমে যায়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here