অচিত্তাকর্ষক পর্ব -১৪

#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|১৪|

জুভান চোখ মুখ কুঁচকে বিরক্ত গলায় তখন বলল,

‘আহা স্মৃতি, বারবার তুমি একই ভুল করছো। জিহান আলীনগরের জমির কথা বলছে কিন্তু ঐ জমি তো তোমাদের না। তুমি না বললে, তোমাদের জমিটা রানীরবাজারের ঐদিকে তাহলে আলীনগরের জমিটা কী করে তোমাদের হবে বলো? আমি তো কালই বলেছি, ঐ জমির মালিকের নামের সাথে কেবল তোমার বাবার নামের মিল আছে আর তাছাড়া আর কোনো মিল নেই। তাও তুমি ব্যাপারটা বারবার গুলিয়ে ফেলছ কেন বলতো?’

স্মৃতি শক্ত হয়ে চেয়ে থাকে জুভানের দিকে। রাগে ক্ষোভে ফেটে যাচ্ছিল ভেতরে ভেতরে। জুভান আবার বলল,

‘ঠিক আছে, তুমি যদি চাও ঐ আলীনগরের জমিটা না হয় আমি তোমার বাবার নামে লিখে দিব।’

এবার আর স্মৃতি তার নিজের রাগ চেপে রাখতে পারছিল না বলে সে দৌড়ে নিজের রুমে চলে যায়। এতসব ঘটনা বাড়ির মানুষগুলোর বোধগম্য হলো না কিছুই। তারা অতিরিক্ত বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। জুভান সবাইকে সবটা বুঝিয়ে বলল। জিহাদকেও সে পরে চলে যেতে বলল।

স্মৃতি রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়। জোর করে তাদের জমি কেড়ে নিয়ে এখন আবার দয়া দেখাচ্ছে। এখন তো তার মনে হচ্ছে এই সবকিছুর পেছনে জুভানেরই হাত রয়েছে। জুভানই হয়তো এইসব কিছুর জন্য দায়ী। সে’ই হয়তো প্রথমে জোর করে তার বাবার কাছ জমি কেড়ে নিতে চেয়েছিল, পরে তার বাবা রাজি না হওয়ায় জমির লোভে শেষ পর্যন্ত সে’ই হয়তো তাকে মেরে ফেলেছিল।

স্মৃতি খুব কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে সে তার ভাইকে কল লাগায়। বোনের কান্নার শব্দ পেয়ে ভাইও তার অস্থির হয়ে উঠে।

‘কী হয়েছে, আপু? কাঁদছ কেন?’

স্মৃতি জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বলল,

‘আমি এখন শিউর ভাই, জুভানই এসবের জন্য দায়ী। উনার কাছে আমি আমাদের জমির ফাইল দেখেছি।’

স্মৃতির ভাই তার কথা শুনে চমকে উঠে বলে,

‘এসব কী বলছো আপু? দুলাভাই এসবের জন্য দায়ী?’

‘হ্যাঁ, আজ উনি বাসায় জিহাদকে নিয়ে এসেছিলেন। জিহাদ লোকটা প্রচন্ড চালাক। উনি মিথ্যে বলেছেন। বলেছেন যে, এই জমিটা নাকি উনারা টাকা দিয়ে কিনেছেন কিন্তু সত্যিটা হলো বাবাকে উনারা এই জমির জন্য এক টাকাও দেননি। কিন্তু এই লোকগুলো এখন এটা কোনোভাবেই স্বীকার করতে চায়ছে না। এখন আমি কী করবো ভাই? এই লোকগুলোকে যে আমার আর সহ্য হচ্ছে না।’
.
.

মজুমদার সাহেব বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন যেন। তিনি সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর গম্ভীর সুরে বললেন,

‘তোমার কী মনে হচ্ছে, স্মৃতি আমাদের মিথ্যে বলেছে?’

জুভান কাটকাট গলায় বলে,

‘জ্বি বাবা। ও আমাদের মিথ্যে বলেছে। এই আশরাফুল ইসলাম’ই স্মৃতির বাবা। যাকে আমরা…’

‘আহ, থামো। পুরোনো কথা এখন আর তুলো না। এখন এই মেয়েকে নিয়ে কী করবে সেটাই ভাবো। আমার তো প্রথম থেকেই এর হাব ভাব সুবিধার মনে হতো না। কোনো একটা প্যাঁচ যে মনে ছিল সেটা আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম কিন্তু তোমাকে বলে তো লাভ নেই, বউয়ের প্রেমে তো অন্ধ হয়ে গিয়েছিলে। এখন বুঝেছো তো, তোমার বউ কত দূরন্ত। তোমাকে সে মিথ্যে বলে সাত পাঁচ বুঝিয়ে দিয়েছে, কত বড়ো কলিজা হলে সে এমন কাজ করতে পারে ভেবেছ একবারও।’

জুভান চোখ মুখ খিঁচে শক্ত করল। আপাতত রাগকে আয়ত্তে আনতে হবে তার। সে ফিচেল গলায় বলল,

‘আমাকে ঠকানোর শাস্তি তো ও পাবেই, বাবা। তার আগে ওর নকল মা বাবার একটা ব্যবস্থা করতে হবে।’

মজুমদার সাহেব আবারও সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন,

‘তোমার বাংলোতে নিয়ে গিয়ে কেটে ফেলো, তাহলেই তো হলো।’

কথাটা বলেই তিনি এক কুৎসিত হাসি দিলেন। জুভানও তার সাথে তাল মিলিয়ে বলল,

‘হ্যাঁ, আমার কুকুরা কিছুদিন যাবত বেশ ক্ষুধার্ত। ওদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।’

রাত এগারোটার দিকে জুভান গিয়ে রুমের দরজায় নক করল। স্মৃতি এসে দরজা খুলে দিল। জুভান ভেতরে ঢুকে স্বাভাবিক ভাবেই হেসে বলল,

‘কী ব্যাপার, এখনও মন খারাপ?’

স্মৃতি মাথা নাড়িয়ে না করল। জুভান তার কোমর জড়িয়ে তাকে কাছে টেনে নিল।

স্মৃতি দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শক্ত করে রেখেছে। জুভান তার কানের কাছে মুখ নিয়ে মিহি কন্ঠে বলে,

‘আমাকে এখনও বিশ্বাস করতে পারছো না বুঝি?’

স্মৃতি জবাব দেয় না। জুভান পুনরায় বলে,

‘আমি তো তোমাকে অনেক বিশ্বাস করি। এই যে বছরের পর বছর বাবার নাম করে আমার কাছ থেকে এত টাকা নিয়েছ, আমি কি কখনও জিজ্ঞেস করেছি সেসব টাকা আদৌ তুমি তোমার বাবার পেছনে খরচ করছো কিনা? না আমি সেসবের হিসেব কোনোদিন চেয়েছি তোমার কাছে? যখন যত টাকা বলেছ, দিয়েছি। এই যে দেশে আসার পর এতবার বলার পরেও তুমি বাচ্চা নিতে রাজি হওনি, আমি কি তার কারণ একবারও জানতে চেয়েছি। চাইনি, তোমাকে বিশ্বাস করে সময় দিয়েছি। জমি নিয়ে যে এখন এত ঝামেলা করছো, তাও তো তোমায় আমি কিছুই বলিনি। আমায় তুমি এখন অবিশ্বাস করছো, কিন্তু তুমি আদৌ আমার বিশ্বাসের যোগ্য তো? তুমি উল্টো আমায় ঠকাচ্ছো না তো, স্মৃতি?’

স্মৃতি কথা খুঁজে পায়না। কিছু বলতে চেয়েও গুছিয়ে বলে উঠতে পারছে না সে। তবে জুভান যে তাকে সন্দেহ করছে এইটুকু সে বুঝে গিয়েছে। হয়তো তার হাতে আর বেশি সময় নেই। তার প্রতীক্ষিত সেই দিনটা বোধ হয় এবার চলে এসেছে। এবার তার রুখে দাঁড়ানোর পালা।
স্মৃতি তার কোমরের উপর থেকে জুভানের হাত জোড়া সরিয়ে দিয়ে সে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। জুভানের অক্ষিকোণের রক্তিমা আভা যেন দূর থেকেই সে টের পায়। তবে সে নিস্তব্ধ নিশ্চুপ। কিছু বলতে পারছেও না আবার বলতে চায়ছেও না। জুভান কঠিন গলায় তখন বলল,

‘আমার থেকে দূরে যেতে চাইলেই তুমি দূরে যেতে পারবে না, স্মৃতি। তাই সেই সাহসটাও ভুলে দেখিও না। জানো তো, অতিরিক্ত সাহস কিন্তু মাঝে মধ্যে বিপদ ডেকে আনে।’

এই বলে সে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। স্মৃতি আজ আর তার পায়ে গিয়ে শু’ল না। সে রুমের লাইট অফ করে দিয়ে ডিভানে বসে রইল। সেই রাতে আর কেউ খাবার খেল না। ডিভানে বসেই পুরো রাত কাটাল স্মৃতি। সকালে ঘুম ভাঙতেই সে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করল। তারমানে জুভান তাকে এখানে রেখে গিয়েছে। স্মৃতি এতে বিরক্ত হয়ে ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে নিজে নামল সে। ড্রয়িং রুমের দরজার কাছে যেতেই ভেতরে কিছু লোককে দেখতে পেল। জুভান আর তার বাবাও ছিলেন সেখানে। কী নিয়ে যেন খুব গভীর আলোচনা করছেন উনারা। স্মৃতি রান্নাঘরে চলে গেল। সবার জন্য নাস্তা বানাল। বাইরের লোকেরা চলে যাওয়ার পর সবাই একসাথে বসে নাস্তা করল। তারপর জুভান আর তার বাবা বেরিয়ে গেল অফিসে।

দুপুরের রান্নাবান্না তাড়াতাড়ি শেষে স্মৃতি জারার রুমে গিয়ে তাকে বলল,

‘শপিং এ যাবে?’

জারা খুশি হয়ে বিনাবাক্যে রাজি হয়ে গেল। সে গিয়ে তার মায়ের কাছ থেকে ইনিয়ে বিনিয়ে অনুমতিও নিয়ে নিল। তবে শপিং এ বের হবার আগে স্মৃতি কল করে তার ভাইকে সেই লোকেশনে আসতে বলে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here