#অতঃপর_প্রেমের_আগমন
#ইরিন_নাজ
#পর্ব_০৫
— কি গো আদ্রিশের মা! শেষ পর্যন্ত নিজের এতো বড় ডাক্তার ছেলের জন্য এই অল্প শিক্ষিত, মূর্খ মেয়ে ধরে নিয়ে এলে? আর কোনো মেয়ে মিলে নি নাকি? কোথায় আদ্রিশ বাবা, যেমন সুন্দর তেমন যোগ্যতা। আর কোথায় এই চুনোপুটি মেয়ে। এই মেয়ের কোনো যোগ্যতা আছে নাকি আদ্রিশ বাবার বউ হওয়ার?
প্রতিবেশী মহিলা আয়ানা কে উদ্দেশ্য করে খোঁ’চা দিয়ে বললো। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো আয়ানা। চোখ ভরে উঠলো তার। নাস্তা করার পরপরই কিছু প্রতিবেশী মহিলা এসেছিলো বউ দেখতে। তাদের নাকি বিকেল পর্যন্ত সহ্য হচ্ছিলো না। তাই এখনই বউ দেখতে চলে এসেছে। তাই আয়ানা আর মীরা কে পরিপাটি করে তাদের সামনে নিয়ে আসা হয় আর তাদের মধ্যে একজন উপরোক্ত কথাগুলো বলে।
আদ্রিশের মা অনু আলতো হেসে বলে,
— ভাবী আমার ছেলে বউয়ের যোগ্যতা আপনাকে যাচাই করতে হবে না। ওটা আমরা দেখে নিবো। তাই এই বিষয়ে আপনার মাথা না ঘামালেই ভালো হয়।
কিন্তু মহিলা দমবার পাত্র না। মুখ ঝা’ম’টা মে’রে বললো,
— মাথা ঘামাবো না কেনো ভাবী? আপনার ছেলে আদ্রিশের জন্য আমার ভাগ্নির প্রস্তাব দিলাম। আপনি রাজী হলেন না। আমার ভাগ্নি কোন অংশে কম ছিলো? দেখতে যেমন সুন্দরী, তেমনি শিক্ষিত। ডাক্তারি পাস করেছিল। রূপে গুনে অনন্যা আমার ভাগ্নি। আর এই মেয়ে! বয়স ও তো একেবারে অল্প মনে হচ্ছে। না আছে শিক্ষা আর না আছে যোগ্যতা। কি দেখে একে নিজের একমাত্র হীরের টু’ক’রো ছেলের বউ করলেন?
এতো অপমান আর সহ্য হচ্ছে না আয়ানার। জীবনে তো কম অপমান, খো’টা সহ্য করে নি। বাবার বাড়িতে কথা শুনতে শুনতে দিন গেছে তার এখন কি শশুর বাড়িতেও! তার জীবনে ঘটা কোনো কিছুর পিছনেই তো তার হাত নেই। সে তো চেয়েছিলো অনেক পড়ালেখা করতে। তার তো অনেক স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু সব যে মাটি চা’পা পড়ে গেলো।
প্রতিবেশী মহিলার সাথে তাল মিলিয়ে আরেকজন মহিলা মুখ বাঁকা করে বললো,
— হ্যা গো অনু, মিতালী তো ঠিকই বলছে। এমন অশিক্ষিত মেয়ে কে নিজের বাড়ির বউ করলে কিভাবে?
— আমার বউ শিক্ষিত হোক বা অশিক্ষিত, মূর্খ হোক বা অল্প শিক্ষিত তা নিয়ে আপনাদের না ভাবলেও চলবে। লাইফ টা আমার, বউ ও আমার। অথচ আপনাদের চিন্তা দেখি অনেক বেশি। আমরা আপনাদের প্রতিবেশী। প্রতিবেশীর উপকার করতে গিয়ে নিজেদের আবার ক্ষ’তি না করে ফেলেন। সবার জন্য এতো চিন্তা দেখাতে গেলে পড়ে দেখা যাবে ব্রেন স্ট্রো’ক করে ফেলেছেন। তাই নিজেদের মাথায় এতো চা’প দেয়া বন্ধ করুন। সেটাই আপনাদের জন্য ভালো হবে।
আদ্রিশের কড়া জবাবে দমে গেলো মহিলাগুলো। আদ্রিশের আগমনে আর জবাবে হাসি ফুটলো পরিবারের উপস্থিত সকলের মুখে।
লাল চোখে মহিলা গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে আদ্রিশ। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। একটু বাইরে যাবে ভেবেছিলো সে। তাই রেডি হতে রুমে গিয়েছিলো। কিন্তু নিচে এসে এমন কিছু শুনে নিজের মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে নি সে।
মিতালী নামক মহিলাটি আরও কিছু বলতে চাইলে হাত দেখিয়ে তাকে থামিয়ে দিলো আদ্রিশ। মহিলাও চুপ বনে গেলো। আদ্রিশের রাগ সম্পর্কে তাদের সবারই জানা আছে। এমনিতে চুপচাপ থাকলেও রেগে গেলে সবার পক্ষে ঠেকানো মুশকিল হয়ে যায়। আদ্রিশ পুনরায় শক্ত গলায় বললো,
— আমার বউ কে আমি শিক্ষিত বানিয়ে নিবো। আমার যোগ্য করে গড়ে তুলবো। তাই আপনারা আপনাদের চিন্তা কমিয়ে ফেলুন। বউ দেখতে এসেছেন, বউ দেখুন কিন্তু যাচাই করবেন না। কারণ সে আমার স্ত্রী আমার আর আমার পরিবারের মতামতে হয়েছে। আপনাদের মতামতে না। পরবর্তীতে যেনো কখনো আপনাদের আমাদের পারিবারিক বিষয়ে নাক না গলাতে দেখি। নাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।
কথা শেষ করে গটগট করে পা ফেলে বাইরে চলে গেলো আদ্রিশ। আদ্রিশের বলা কথায় মুখ কালো হয়ে গেলো মহিলা গুলোর। তারাও বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। মহিলাগুলো যেতেই আনিকা লাফিয়ে উঠে বললো,
— বাহ্ ব্রো তো আজকে ফাটিয়ে দিয়েছে। সেই জবাব দিয়েছে। মহিলাগুলোর মুখ একেবারে বন্ধ হয়ে গেলো। একেকটা শা’ক’চু’ন্নি মার্কা মহিলা। আমার তো ইচ্ছা করছিলো তাদের চুলগুলো টে’নে টে’নে ছি’রি। আসছে নিজের ভাগ্নি নিয়ে। তার ভাগ্নি কেমন পে’ত্নী মার্কা আমরা জানি না ভেবেছে। বাপের টাকায় প্রাইভেট এ পড়াশোনা করেছে। সে নাকি আবার মেধাবী। ছোট ছোট কাপড় পড়ে দুনিয়ার আটা ময়দা মুখে লেপে থাকে, সে নাকি আবার সুন্দরী। হুঁহ!
আনিকার এক্সপ্রেশন আর বলার ধরণে হেসে ফেললো সবাই। অনু আনিকার কান টে’নে ধরে বললো,
— বড়দের নিয়ে এভাবে কথা বলতে হয়? কাউকে নিয়েই এভাবে বলতে হয় না।
আনিকা ব্য’থা’য় চিল্লিয়ে বললো,
— বড় মা ছাড়ো আমার কান। ব্য’থা পাচ্ছি তো। আর আমি কি সেধে ওই মহিলা কে এসব বলতে গিয়েছি, সেই তো সবসময় এমন ধরণের কান্ড করে।
অনু কান ছেড়ে দিয়ে গালে হালকা চাপর দিয়ে বললো,
— তাও এভাবে বলবি না। বুঝেছিস?
আনিকা গাল ডলতে ডলতে মাথা নাড়ালো। আয়ানা, অনু আর আনিকার কাণ্ডে হেসে ফেললো। তার চোখে এখনো পানির ছাপ আছে কিন্তু ঠোঁটের কোণে লেগে আছে তৃপ্তির হাসি। আদ্রিশ যে তার পক্ষে কথা বলবে ভাবতেও পারে নি সে। আয়ানা মনে মনে ভাবতে লাগলো, ‘এই বাড়ির সবাই এতো টা ভালো কেনো! আর লোকটা কে আমি খারাপ ভেবেছিলাম। কিন্তু সে এতটাও খারাপ না।’
আয়ানার ভাবনার অবসান ঘটলো অনুর কথায়। সে আনিকা কে বললো,
— যা তো আনিকা, আয়ানা কে রুমে দিয়ে আয়। একটু রেস্ট নিক। তারপর আবার রিসেপশন এর জন্য তৈরি হতে হবে।
আনিকা সম্মতি জানিয়ে আয়ানা কে নিয়ে রুমে দিয়ে আসলো।
——–
আদ্রিশের রুমের বেলকনিতে এই প্রথম প্রবেশ করলো আয়ানা। একটা শীতল বাতাস ছুঁয়ে গেলো তার শরীরজুড়ে। বেলকনিতে এসে মন টা ভালো হয়ে গেলো আয়ানার। আদ্রিশের রুম যেমন পরিপাটি, তেমন বেলকনি ও। বিশাল বড় বেলকনি ; এক সাইডে দুইটা সোফা রাখা। হয়তো এখানে বসে কাজ করে সে। আর আরেক সাইডে একটা দোলনা টা’ঙা’নো। সামনে অনেকগুলো গাছ সাজানো। ফুল গাছ হয়তো। কিছু কিছু গাছে কলি এসেছে। শীঘ্রই হয়তো ফুল ফুটবে।
আয়ানা দোলনায় গিয়ে বসে পড়লো। তাকে রেস্ট নিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ এ-কাত ও-কাত করেও তার ঘুম আসলো না। তাই বেলকনিতে চলে এসেছে। দোলনায় বসে শীতল বাতাস উপভোগ করতে লাগলো সে। কিন্তু আয়ানার শান্তি বোধহয় সহ্য হলো না আদ্রিশের। পিছন থেকে এসে বললো,
— এই মেয়ে শোনো?
হঠাৎ করে আদ্রিশের আওয়াজে ভয়ে দাঁড়িয়ে গেলো আয়ানা। মনে মনে বলতে লাগলো, ‘দোলনায় বসার জন্য বকা দিবে নাকি?
আয়ানার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে আদ্রিশ বললো,
— পড়াশোনা কতদূর জানো? মানে বলতে চাচ্ছি কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?
আয়ানা অবাক হলো পড়াশোনার কথা জিজ্ঞেস করায়। মাথা নিচু রেখে নিম্ন স্বরে জবাব দিলো,
— এবার এইচএসসি দিয়েছি।
আদ্রিশ আয়ানার কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। শান্ত কণ্ঠে ফের জানতে চাইলো,
— ভবিষ্যতে কি হওয়ার ইচ্ছা আছে? কি নিয়ে পড়াশোনা করতে চাও?
আয়ানা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
— ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা আছে কিন্তু…..
আদ্রিশ কপাল কুঁচকে বললো,
— আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য থাকে। সেই লক্ষ্য পূরণের মাঝে কোনো ‘কিন্তু’ রাখা উচিত না। তাহলে কখনোই সেই লক্ষ্য পূরণ হবে না। চাই প্রবল ইচ্ছাশক্তি। এমন একটা কনফিডেন্স থাকা দরকার, ‘আমার জীবনে যতোই ঝ’ড় তু’ফা’ন আসুক না কেনো, আমি আমার লক্ষ্যে স্থির থাকবো।’ তাহলেই সফলতা আসবে।
আদ্রিশের কথাগুলো শুনে মুগ্ধ হলো আয়ানা। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আদ্রিশের দিকে। সে তো কখনো এভাবে ভেবে দেখে নি আর না তাকে কেউ এভাবে বুঝিয়েছে।
চলবে?
(