#অতঃপর_সন্ধি (০২)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
প্রচন্ড পেট ব্যথায় কুঁজো হয়ে শুয়ে আছে পুষ্পিতা। ভার্সিটি থেকে আসার পথে অতিরিক্ত ঝাল দিয়ে ফুচকা খেয়েছিল। সারা রাস্তা নাকের জলে চোখের জলে একসাথে করে বাসায় এসেছে। দরজা খুলে আফসানা হক মেয়ের এমন ভয়ার্ত মুখমন্ডল দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। বুকে আগলে নিয়ে শঙ্কিত, তটস্থ গলায় প্রশ্ন করেন,
‘কি হয়েছে মা? এভাবে কাঁদছিস কেন? রাস্তায় কেউ বাজে কথা বলেছে?’
পুষ্পিতা নাক টানতে টানতে জবাব দেয়,
‘ঝাল দিয়ে ফুচকা খেয়েছিলাম মা।তাই,,,,,,,,, ‘
বাকি কথা শেষ করতে পারলো না পুষ্পিতা তার আগেই হুঙ্কার দিয়ে উঠেন আফসানা হক।
‘ফাজিলের বাচ্চা, আমার সামনে আসবি না আর।সর সামনে থেকে।’
বিড়বিড় করতে করতে নিজের রুমে এসে ব্যাগটা ছুঁড়ে মা’রে পুষ্পিতা। কোথায় গিয়ে পড়েছে কে জানে। পোশাক না বদলে সেভাবেই শুয়ে পড়লো। এখনো সেভাবেই আছে।
‘পেটে ব্যথা কমেছে?
আফসানা হক প্রশ্ন করলেন পুষ্পিতাকে। নিভু নিভু চোখে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়ে সে। অর্থাৎ এখনো কমেনি। দাঁতে দাঁত পিষেন আফসানা হক।
‘ফাজিলের বাচ্চা, আর খাবি ফুচকা? কত নিষেধ করি বাইরের কিছু খাওয়ার দরকার নেই। আমার কথা শুনলে তো। দুইদিন পরে বিয়ে দিবো কিন্তু এখনো জানে না কোন খাবার কি পরিমাণে খেতে হবে।’
কাঁথার নিচ থেকে কুমিরের মতো মাথা বের করে সে। ভ্যাবলাকান্তের মতো হাসি দেয় আফসানা হককে রাগানোর জন্য।
‘সন্ধ্যায় আবারও ফারদিন কে নিয়ে যাবো ফুচকা খাওয়ার জন্য।’
বলতে দেরি আর আফসানা হকের পা থেকে জুতো খুলে পুষ্পিতার দিকে ছুঁড়ে মা’রতে দেরি হলো না।
‘আহ! মা লাগলো তো।’
আফসানা হক মৃদুস্বরে রোদন শুরু করলেন।
‘দুইটা আমাকে একবারে জ্বালিয়ে শেষ করে দিলো। ছোটোটা তো জ্বালায় জ্বালায় সাথে বড়টা আরো বেশি জ্বালায়। একশো বাচ্চাও এমনে জ্বালায় না। আধঘন্টা সময় দিলাম। গোসল শেষ করে যদি ভাত খেতে না আসিস খবর আছে। বাপের মতো খবিশ হয়েছে। সাতদিনে একবার গোসল করে। সাথে গন্ধের জন্য টিকা যায় না।’
‘আম্মু কি শুরু করছো? পাশের রুমে তোমার ছেলের টিচার এসেছে। তুমি আমার মান সম্মানের পিন্ডি চটকাচ্ছো কেন?’ বিরক্তি নিয়ে বলে পুষ্পিতা।
‘তোর আদৌও মান সম্মান আছে? আধঘন্টার মধ্যে গোসল শেষ না করলে আমার জুতা তোর গাল। একটা বারিও মাটিতে পড়বে না।’
পুষ্পিতা ধ্যাৎ বলে বিছানা ছাড়লো।
______________________
‘দেখ, এইভাবে সরল অংক করলে তো মিলবে না কখনো। আগে প্রথম বন্ধনীর কাজ করতে হবে তারপর দ্বিতীয় বন্ধনী।’
ফারদিনকে অংক করাতে ব্যস্ত মায়ান।মুখাবয়বে গম্ভীরতা বিদ্যমান। দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা।
‘আসবো বাবা।’
মেয়েলি গলার স্বর শুনে দরজার দিকে তাকাল মায়ান। মুখের গম্ভীরতা সরিয়ে নিঃশব্দে ওষ্ঠ জোড়া প্রসারিত করল। বিনীত স্বরে বলল,
‘অনুমতি নিচ্ছেন কেন আন্টি।’
প্রশ্নের জবাব না পড়ার টেবিলে কাছে এসে দাঁড়িয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন আফসানা হক।
‘রাতে আর জ্বর আসেনি তো বাবা?’
‘না আন্টি, আর আসেনি।’
আফসানা হক মায়াভরা কন্ঠে বললেন,
‘আজ আর পড়ানোর দরকার নেই।’
‘কিন্তু আন্টি এখনো তো একঘন্টাও হয়নি।’
‘তাতে কি? কাল কি খেয়েছো না খেয়েছো৷ আমি তো আর বাসায় ছিলাম না। আজ তোমার জন্য হালকা রান্না করেছি। চলো ডাইনিংএ।’
‘আন্টি,,,,,,’
‘কোনো কথা না। তাড়াতাড়ি এসো।’
গতকালের সেই কথাটার জন্য নিজের কাছে নিজেকেই ছোট লাগছে মায়ানের। জ্বরের ঘোরে এমন একটা কথা বলে ফেলবে বুঝতেই পারেনি। একেবারে জড়বস্তুর ন্যায় সেখানেই বসে রইলো সে। মেঝেতে ফাঁক হলে হয়তো টুকুস করে লাফ দিয়ে দিতো।
____________
মাথা নুইয়ে খেয়ে চলেছে মায়ান। ভয়ঙ্কর লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারছে সে। পাশে আফসানা হক খালি গ্লাসটায় পানি ঢেলে বললেন,
‘প্রতি শুক্রবার আমাদের বাসায় তোমার দাওয়াত। না শুনবো না। আসতে হবে মানে আসতেই হবে। প্রতিদিন তো বিকেলে আসো সেজন্য দুপুরের খাবারের কথা বলতে পারি না। শুক্রবার দিন নামাজ পড়ে সোজা আমাদের বাসায় চলে আসবে।’
এবারে লজ্জা যেন জেঁকে ধরলো মায়ানকে। প্লেটে আঙ্গুল নাড়াচাড়া করতে লাগে। আফসানা হক মায়ানের অবস্থা বুঝতে পারলেন। মায়ানকে একটু স্বাভাবিক করতেই বললেন,
‘তোমাকে এই কথাটা আরো আগেই বলে দিতাম। আসলে আমার ইঁচড়ে পাকা ছেলের টিচার তিন থেকে চার মাসের বেশি টিকে না। তুমি আমার ছেলের কাছে পাশ করছো।তাছাড়া আমার মেহমানদারি করতে ভালো লাগে। মনে করো, একজন মা একটুখানি ভালোবাসা দিচ্ছে তোমায়। তুমি পড়ানোর পর থেকে আমি ফারদিনের পার্থক্যটা দেখি তো। ও একটু একটু করে পড়ায় মনযোগী হচ্ছে।কোনো মায়ের ভালোবাসা নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দিবে না?’ পানি পূর্ণ গ্লাসটা মায়ানের মুখের সামনে ধরে পুনশ্চ বলল,
‘আসবে তো?’
টলমল চোখে তাকাল মায়ান।
‘তুমি ভেবোনা কালকের ইন্সিডেন্টের আমি এসব বলছি। আজকাল গার্ডিয়ানদের নিয়ে হোম টিউটরের অনেক অভিযোগ থাকে।’
তারপর হাসিমুখে বললেন,
‘তোমাকে না হয় সেই অভিযোগ করা থেকে অব্যহতি দিলাম।’
__________________
‘রাতে একটা কল করে আপনার শারীরিক অবস্থার কথা বললে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো?’
বাসা থেকে মাত্রই বের হয়েছে মায়ান। আকষ্মিক কথায় হকচকিয়ে গেল। এক পলক তাকাল পুষ্পিতার চোখের দিকে। চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি নামিয়ে ফেলে সে। জুতোজোড়া পায়ে দিয়ে কিছুটা কর্কশ গলায় বলে,
‘আন্টি কল করাতে আমি বলে দিয়েছি। তাই আলাদা করে কাউকে বলার প্রয়োজন মনে করিনি।’
এক আকাশ সমান অভিমান নিয়ে পুষ্পিতা তাকিয়ে আছে মায়ানের দিকে। মায়ানের দৃষ্টি অন্যদিকে। সিঁড়ির কাছে যেতেই বিকট শব্দে দরজা আঁটকে দিল। পা থেমে যায় মায়ানের। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো চাপা দীর্ঘশ্বাস। সে অভিমান বুঝে। অভিমানী চোখের ভাষা বুঝে। তবে নিম্নবিত্ত ছেলেদের ভালোবাসতে মানা। পা চালিয়ে রাস্তায় নেমে এলো সে। রিক্সা ডাকতে গিয়েও ডাকলো না। ওয়ালেটে একশো টাকা আছে। টিউশনির বেতন পেতে আরো তিনদিন। এই তিনদিন এই একশো টাকা দিয়েই চলতে হবে। মেসের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলো সে।
_________________
কপালে হাত ঠেকিয়ে শুয়ে আছে মায়ান। দরজা ভেরানো। আতিক রুমে ঢুকেই মায়ানের মাথার কাছে এসে দাঁড়ালো।
‘কিরে জ্বর কি আবার আসলো?’
কপাল থেকে হাত নামিয়ে আতিকের দিকে তাকাল মায়ান। বিষন্ন স্বরে বলল,
‘না।’
‘তাহলে এই অসময় শুয়ে আছিস যে?’
উঠে বসে সে।
‘আজ মেয়েটাকে কঠোর গলায় কতগুলো কথা বলেছি।’
আতিক গায়ের শার্ট খুলে স্ট্যান্ডে রাখল। মায়ানের দিকে মুখ করে বলল,
‘অস্বীকার করতে পারবি, মেয়েটাকে তোর ভালো লাগে না?’
বুক গলিয়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস।
‘গরীবদের ভালোবাসায় জড়াতে নেই। টাকা থাকেনা। মেয়ের বাপ মাও বিয়ে দিতে চায় না। পড়াশোনার জন্য শুধু আমিই শহরে।আমার পরিবার গ্রামে। নিজেদের একটুকরো জমিও নেই। মানুষের জমি বর্গা চাষ করে আব্বা। বছরে দুইবার ধান তুলে উঠানে। কোনো মেয়ে এসব করতে চাইবে না। আর শহরের মেয়েরা গ্রামে গিয়ে মানিয়ে চলতে পারে না।’
‘কেন ভাই তুই কি চাকরি বাকরি করবি না? আর তুই কি বিয়ে করবি মেয়েটাকে দিয়ে ধানের কাজ করানোর জন্য?’
‘অবশ্যই করবো৷ তবে আমার বাবা মায়ের পছন্দ গ্রামের সবকাজ জানা নিপুণা মেয়ে। শহরে বউ রাখার পারমিশন তারা কখনো দিবে না। তারাও শহরে এসে থাকবে না। সেজন্য মনের চাহিদা মনেই চাপা দিয়ে দিয়েছি। আমি মেয়েটার অব্যক্ত কথাগুলো চোখে স্পষ্ট দেখতে পাই।’
বিছানা ছেড়ে দাঁড়ায় মায়ান। চেয়ার টেনে বসে বইয়ের একটা পাতা উল্টালো। বইয়ের ভাঁজে থাকা কলমটা হাতে নিয়ে চেয়ে রইলো কলমটার দিকে। কন্ঠে মায়া ঢেলে আওড়াল,
‘মেয়েটার চাহনি মারাত্মক। ঘায়েল করতে সক্ষম। আমি ডুবেছি সেই মায়ায়। তবে বলতে বারণ। দারিদ্র্যতার যাতাকলে চাপা পড়ে থাকুক আমার অনুভূতি। পারিবারিক চাপ নিয়ে আছি। অন্য চাপ নেওয়ার সাহস নেই।’
আতিক মায়ানের কাঁধে হাত রাখতেই তপ্ত শ্বাস ফেলল সে। আতিক নমনীয় স্বরে বলল,
‘অনুভূতির কথা চেপে রাখতে নেই। যখন দিন বদলে যাবে একটু প্রতিষ্ঠিত হবি তখন বড্ড আফসোস হবে। বার বার মনে হবে, ‘ইশ! বলে দিলে হয়তো মেয়েটা আমার হতো। নিজেদের সুন্দর একটা পৃথিবী হতো।’ ভালো কথা বলছি হয় তুই বলে দে না হয় তাকে বলার সুযোগ দে। আফসোসের রাস্তা তৈরি করিস না।’
#অতঃপর_সন্ধি (০৩)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
‘না বললে থাকবে আফসোস। আর বললে থাকবে যন্ত্রণা। আমার উভয়সংকট দুস্ত।’
‘মেয়েদের অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে। এই ক্ষমতা অদৃশ্যমান। এরা পানির মতো। যেই পাত্রে রাখা হয় সেই আকার ধারণ করে। এরা হাজারো কষ্ট সয়ে স্বামীর ঘর করে। ভিন্ন পরিবেশে গেলে মানিয়ে নেওয়া হয়তো কষ্ট। তবে তারা মানিয়ে নেয়। মিশে যায় ভিন্ন পরিবেশের প্রতিটা মানুষের সাথে। তবে তার জন্য প্রয়োজন স্বামী নামক মানুষটার একটু সাপোর্ট। ওই মানুষটা থাকলে সবকিছু মানিয়ে নেওয়া সহজ হয়ে যায়। ভেবে দেখ কি করবি।’
__________________
জমকালো আয়োজন! আশেপাশে অনেক পরিচিত অপরিচিত মানুষ ঘুরাঘুরি করছে। কারো চোখে চোখ পড়লেই রেডিমেড হেসে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে পুষ্পিতা। প্রানপ্রিয় বান্ধবী সুমনা এহমাদের সাথে খোশগল্পে মগ্ন আফসানা হক।
‘মা? জারিন মনে হয় আসবে না। আমার একা একা একদম ভালো লাগছে না। আমি বাসায়,,,,,,,
আফসানা হক চোখ রাঙানি দিতে দেরি আর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে রোবটের মতো হয়ে যেতে দেরি হলো না।
‘জারিন আসেনি তো কি হয়েছে? তানজিফ তো আছে? যা ওর সাথে গিয়ে আড্ডা দে।’
‘আমার শত বিরক্তির কারণ তো ওই বেয়াদবটাই। তোমার বান্ধবীর গুণধর ছেলে আমাকে জ্বালিয়ে শেষ করলো।’৷ বিড়বিড় করে আওড়াল পুষ্পিতা।
‘কিছু বললি?’
‘আমার শাড়ি পড়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।’
‘তাহলে আমার মাথা না খেয়ে কোথাও চুপচাপ বসে থাক। বহুদিন পরে সবাই একটু একসাথে হয়েছি। আর জ্বালাতে আসবি বাসায় তোর উপর ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাবে।’
মুখ কালো করে সেখান চলে গেলো পুষ্পিতা। একটু নিরিবিলি পরিবেশ খুঁজতে লাগল। যদিও পাওয়া দুষ্কর। সব জায়গায় মানুষ গিজগিজ করছে।
‘মিসেস তানজিফ নওশাদ?’
পা চলা বন্ধ হয়ে গেলো পুষ্পিতার। থমকালো সে। চোখ বন্ধ করে নিলো বিহ্বলতায়।
‘তুই কিন্তু বলেছিস আমাকে আর জ্বালাবি না।’
মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে তানজিফ। চোখ দু’টি হাজারো ভালোবাসার কথা বলতে চায়।তানজিফের গভীর আসক্তি ভরা দৃষ্টিতে হকচকিয়ে গেলো পুষ্পিতা। ফাঁকা ঢুক গিলে অন্য দিকে তাকাল সে।
‘আমি তো তোর নাম ধরে ডাকিনি? আর তুই তো আমার বউও না। তাহলে এমন থমকে গেলি কেন? মিসেস তানজিফ নওশাদ হওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?’
‘আমি কিন্তু এখন আন্টির কাছে বিচার দিবো।’
আড়মোড়া ভাঙে তানজিফ। পুষ্পিতার কথাটাকে যেন ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলো।
‘তোকে বিরক্ত করবো না, তোর সামনে আসবো না এই কথা গুলো জাস্ট কালকের জন্য ছিলো।আলরেডি চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়ে বত্রিশ ঘন্টা হওয়ার পথে। তাই তানজিফ আবার আগের ফর্মে।
রাগে চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছে পুষ্পিতার। হাতে থাকা ছোট্ট পার্সটা চেপে ধরলো।
‘আমি তো কাউকে বিরক্ত করতে যাইনি। মহারানী নিজে তার সাম্রাজ্যে পা দিয়েছেন। রাজাকে একটু দুষ্টুমি করতেই হয়।’
কোথা থেকে দৌড়ে গিয়ে একটা গোলাপ নিয়ে আসলো। চারপাশে একটু নজর বুলালো। এইদিকে আপাতত কেউ নেই। একটু বাদে কেক কাটবে সবাই সেইদিকে। নমনীয়, আবেগী কন্ঠে বলল,
‘আমার ব্যক্তিগত ফুলটার জন্য আরেকটা ফুল।’
হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে পুষ্পিতা। দৃষ্টিতে প্রখরতা বিদ্যমান
‘উহুম, উহুম। কেউ না দেখলেও আমি দেখে ফেলেছি।’
‘তুই দেখলে সমস্যা নেই।’ চোখ টিপ দিয়ে বলল তানজিফ।
‘তুই কি ফুলটা নিবি না।’
হাত গুটিয়ে নিরুত্তর রইলো পুষ্পিতা।
‘আচ্ছা থাক হবে না। দু’টো ফুলই আমার থাক। একটা এখনের জন্য। আর জীবন্ত ফুলটা ভবিষ্যতের জন্য। বাই দ্য ওয়ে তোকে আজ পার্পেল জামদানীতে পুরো বউ বউ লাগছে। আর এই যে রাগ করে নাক ফুলিয়ে আছিস আমার বুকের এইখানটায় লাগছে।’
___________________
‘ হবু ননদের জন্মদিনের পার্টিতে এসে কেমন লাগছে মহারানী?’
কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় জারিনের দিকে পুষ্পিতা।
‘এভাবে তাকাস না প্লিজ। আমি মেয়ে হয়ে ঘায়েল হয়ে যাচ্ছি আর বেচারা তানজিফ যে নিজেকে কন্ট্রোল করে রেখেছে এটাই অনেক।’
দাঁতে দাঁত পিষে রুক্ষ স্বরে পুষ্পিতা আওড়াল,
‘আমি এইজন্য এখানে আসতে চাইনি।বাবার সাথে বাসায় থাকতে চেয়েছি।তার উপর মা আবার এই শাড়ি পড়িয়ে নিয়ে এসেছে।’
জুসের গ্লাসে আয়েসি ভঙ্গিতে চুমুক দিলো জারিন।
‘আমার মনে হয় জানিস? তারা দুই প্রাণপ্রিয় বান্ধবী বেয়াইন হওয়ার ধান্দায় আছে।’
‘বাজে বকা বন্ধ করবি?’
‘ছেলেটা তোর পিছনে এভাবে পড়ে আছে। তুই রাজি কেন হচ্ছিস না? তোর ভাইয়ের ওই এটিটিউডওয়ালা টিচারের জন্য?’
তানজিফ কারো সাথে খুব হেসে হেসে কথা বলছে।সেইদিকে তাকাল পুষ্পিতা। অপলক, অনিমেষ।
‘ফারদিনের টিচার তো এসেছে কয়েকমাস। তানজিফ আমাকে ভালোবাসার কথা বলেছে কলেজ লাইফে। বিশ্বাস কর আমি হাজার চেষ্টা করেও ওর প্রতি সিরিয়াস হতে পারছি না। ওর প্রতি আমার আবেগ, অনুভূতি কাজ করে না।’
মলিন, বিষন্ন স্বরে জারিন বলল,
‘ভালোবাসা কত অদ্ভুত তাই না? একজনকে আরেকজন চায়। ওই আরেকজনকে আবার অন্যজনকে চায়। তবে আমি হলফ করে বলতে পারি, তুই তানজিফকে ছ্যাচড়া বলিস আর যাই বলিস।ছেলেটা তোকে সত্যি ভালোবাসে।’
‘আপু, আপু তোমাকে ডাকছে।’
‘ কে ডাকছে তিতির?’ হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো পুষ্পিতা।
‘ওই ওই দিকে।’ এইটুকু বলেই চলে গেল তানজিফের বোন তিতির। সাদা গাউন টা সামলাতে তার বড্ড কষ্ট হচ্ছে।
‘তানজিফের বোনটা কিন্তু বেশ মিষ্টি।’
‘শুধু মিষ্টি না পাকনি বুড়িও বটে। হয়তো মা ডাকছে। আমি যাই ওইদিকে। তুই খেতে যা। আমি আসছি।
সবাই খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত। অনুষ্ঠান প্রায় শেষ পর্যায়ে। তিতির দেখানো জায়গাটায় এসে ঘুরঘুর করছে সে। আচমকা কারো বুকের সাথে ধাক্কা লাগতেই ভরকে গেলো পুষ্পিতা। পিছনে তানজিফকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
‘ওহ তুই ডেকেছিস?’
পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে তানজিফ। এবার মুখে আর দুষ্টুমির ছাপ নেই। গম্ভীরতা বিদ্যমান। দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা।
‘বেঁধে রাখা চুলগুলো ছেড়ে। তোর ঘাড়ের তিলটা দেখা যাচ্ছে। অনেকে কামুকী নজরে তাকাচ্ছে তোর দিকে। আমি চাই না কেউ আমার ব্যক্তিগত মানুষটার দিকে বাজে নজরে তাকাক।’
‘খুলবো না চুল। আর কে তোর ব্যক্তিগত মানুষ?’
‘তাহলে আমিই খুলে দেই চুলের কাটা? তখন ভালো লাগবে তো?’
_______________________
শুক্রবার দিন!
নামাজ শেষ করে নিজের রুম থেকে বের হতে গিয়েও হলো না পুষ্পিতা। কেননা সবার সাথে মায়ানও বসে আছে। চাপা রাগ কাজ করলো তার মাঝে। সে খাটে এসে মোবাইল নিয়ে শুয়ে পড়লো। ফেসবুক স্ক্রল করতে লাগল আপনমনে।
‘পুষ্পি এখনো নামাজ শেষ হয়নি? বাবা অপেক্ষা করছি তো তোর জন্য।’
আশহাব শেখের ডাকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে পুষ্পিতা।
‘বাবা, এখন খিদে নেই। পরে খাবো।’
ফিরতি আরো কিছু বলতে নিলে বাঁধ সাধেন আফসানা হক।
‘আর ডেকো না। অসময়ে পুড়ি খেয়েছে। এখন জোর করে খেলে বদহজম হবে।’
তপ্ত শ্বাস ফেলেন আশহাব শেখ।
‘মেয়েটা যে কি করে না।’
আফসানা হক মায়ানের প্লেটে মুরগির পিস দিয়ে বললেন,
‘খাওয়া শুরু করো বাবা।’
আফসানা হকের সাথে তাল মেলালেন আশহাব হক।
‘হ্যা, হ্যা, শুরু করো।’
‘আপনি খাবেন না আন্টি?’
‘না বাবা, পুষ্পিতার সাথে খাবো।’
পুষ্পিতা ধীরপায়ে হেঁটে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। পর্দাটা একটু ফাঁক করে মায়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো অনিমেষ। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে বেশ লাগছে।
____________________
‘আজকাল বাচ্চাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে টিভিতে দেখছো তো?’
বাধ্য ছেলের মতো নাড়ে ফারদিন।
‘সেজন্য আমাদের কি করতে হবে জানো?’
‘কি ভাইয়া?’
‘পরিবারের সবার ফোন নম্বর মুখস্থ রাখতে হবে।’
‘আমার সবার নম্বর মুখস্থ।’
‘দেখি এইখানটায় লিখো তো সবার নম্বর।’
_____
রাত আনুমানিক এগারোটা। চাইনিজ স্বামী স্ত্রীর খাবার ভিডিও দেখছে পুষ্পিতা। একটু পর পর তানজিফ মেসেজ দিচ্ছে মেসেঞ্জারে। সেসবের তোয়াক্কা করছে না সে।নোটিফিকেশন অফ করে রাখলো। একটা আননোন নম্বর থেকে মেসেজ আসায় তার ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল। বিরক্তি নিয়ে ব্যাক বাটনে ক্লিক করে ইনবক্সে গেলো। মেসেজ দেখে চোখ ছানাবড়া পুষ্পিতার।
‘আমাকে দেখে খেতে আসলেন না কেন? নাকি আপনার ভাগের খাবার গুলো আমাকে দেওয়া হয়েছিল?’
#চলবে