অতঃপর সন্ধি পর্ব -০১

#অতঃপর_সন্ধি (০১)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

‘আজ আন্টিকে নাস্তায় চা-বিস্কুট না দিয়ে আমাকে ভাত দিতে বলবে ফারদিন?’

টিউটরের মুখ নিঃসৃত কম্পয়মান কথা শুনে কলম থেমে গেল ফারদিনের।ভ্রু যুগল কুঁচকে নেত্রপাত করল টিউটরের অভিমুখে। মস্তিষ্ক তখনো সারমর্ম বুঝেনি। এক লাইনের বাক্যটা বুঝতেই খাতায় করতে থাকা সরল অংকটা অসমাপ্ত রেখে একছুটে ভেতরে চলে গেল।

অগোছালো চুল, গায়ে জড়ানো কুঁচকানো শার্ট। দূর্বলতায় চোখজোড়া মুঁদে আসছে। শরীরের তাপমাত্রা ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে যেন। চেয়ারে বসে থাকা দায় হয়ে পড়েছে মায়ানের। জ্বরের কারণে বাদে বাদে কেঁপে ওঠছে শরীর । ফারদিনকে কথাগুলো বলার সময় বলে তো দিয়েছে। এখন ভীষণ লজ্জা করছে তার । আদৌও কি ভাতের কথা বলা ঠিক হয়েছে? বড্ড দ্বিধায় পড়ে গেল। এইদিকে খুদাও বেড়েছে ভীষণ।

____________

‘দেখ তানজিফ তুই যদি ভেবে থাকিস এইভাবে আমার পিছে পড়ে থাকলে আমি তোকে ভালোবাসবো তাহলে ভুল ভাবছিস।’

‘আপু ভাত দাও।’

ফারদিনের আওয়াজ পেয়ে ভড়কে গেল পুষ্পিতা। দ্রুত কান থেকে মোবাইল নামিয়ে বালিশের তলায় রেখে দিল। ফাইভে পড়ুয়া ইঁচড়ে পাকা ছেলেটা কিছু টের পায় তাহলে তিল থেকে তাল করবে। ঝেড়ে কেশে কন্ঠস্বর স্বাভাবিক করল সে।

‘একটু আগেই তো খাবার খেয়েছিস। টিচার এসেছে বাহানা না করে পড়তে যা। জ্বালাবি না একদম। না হলে আম্মু আসলে বিচার দিবো।’

দৃষ্টি সূঁচালো করলো ফারদিন।

‘তোমার কি মনে হয় আমি তোমার মতো রা’ক্ষ’স? টিচারের জন্য খাবার।’

‘মিথ্যে বলবি না একদম।’

ফারদিন নাক ফুলালো।

‘আমি মিথ্যে বলছি না একদম।’

চাপা রাগ দেখালো পুষ্পিতা।

‘আমি কিন্তু এখন গিয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করবো।’

‘ওকে আসো।’

বলে দেরি না করে আবারও চলে গেলো ফারদিন। ফারদিন প্রস্থান করতে পুষ্পিতা বালিশের তলা থেকে মোবাইল বের করে। তানজিফ এখনো লাইনে। ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হলো পুষ্পিতার।

‘তুই এখনো কল কাটিসনি?’

ওপাশ থেকে শোনা গেলো মৃদু পুরুষালি গলার আওয়াজ।

‘তুই তো আমাকে বিদায় দিস নি?’

চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার প্রয়াস চালালো পুষ্পিতা। ঘন ঘন নিশ্বাস নিলো। তারপরও রাগ কমলো না।

‘হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়েছিস তো তাই বিদায়ের অপেক্ষায় ছিলি। নাম্বারে কল দিলে আর থাকতি না। চাল ফোন রাখ।’

ওপাশের উত্তরের আশা না করে তাড়াতাড়ি কল কে’টে দিল পুষ্পিতা।

‘সেই কলেজ লাইফ থেকে জীবনটা আমার তামা তামা করে দিল। কবে এই প্যারা থেকে মুক্ত হবো আল্লাহ জানে।’ বিড়বিড় করতে করতে ফারদিনের রুমের দিকে অগ্রসর হলো সে।

দরজায় ঠকঠক শব্দ হতে ফারদিন আর মায়ান মাথা উঁচিয়ে নেত্রপাত করলো দরজা বরাবর। মাথায় ওড়না চাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুষ্পিতা। পুষ্পিতার আসার কারন বুঝতে পেরে ঘোরতর ত্রপায় মাথা নুইয়ে ফেলে মায়ান।

পরিপাটি, ফিটফাট আর ছিমছাম গড়নের ছেলেটাকে হঠাৎ করে অগোছালো আর চক্ষু জোড়া লাল দেখে আঁতকে ওঠে পুষ্পিতা। বিলম্ব না করে প্রশ্ন করে বসল।

‘আপনি কি অসুস্থ?’

কিয়ৎক্ষণ স্থির আর নিশ্চুপ থেকে মাথা ঝাঁকায় মায়ান। অসুস্থতার বিষয়টা বোধগম্য হতে ব্যতিব্যস্ত স্বরে পুনশ্চ প্রশ্ন করলো,

‘মেডিসিন নিয়েছেন?’

পীড়িত চক্ষে ক্ষণিকের জন্য পুনর্বার পুষ্পিতার অভিমুখে চাহনি নিক্ষেপ করে মায়ান। চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি নত করে ফেলে। তপ্ত শ্বাস ফেলে মৃদু স্বরে আওড়ালো,

‘না।’

এবারে পুষ্পিতার কন্ঠে শোনা গেল হাজারো আকুলতা। কাতর স্বরে বলল,

‘আপনি এতো কেয়ারলেস কেন? নিজের যত্ন নিতে জানেন না একদম।’

আরো কয়েকটা লাইন কন্ঠনালী দিয়ে বের করতে গিয়েও করল না পুষ্পিতা। তার আগেই ফারদিনের তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণ চাহনি নজরে পড়ল তার। নিজেকে সংযত করে নিলো সে। ব্যগ্র কন্ঠে পুনশ্চ বলল,

‘আমাকে বিশ মিনিট সময় দিন। আসলে আম্মু বাসায় নেই তো। আজ পড়ানোর দরকার নেই। আপনি তো অসুস্থ।’

সেখানে আর দাঁড়িয়ে রইলো না পুষ্পিতা। দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে।

চেয়ারের অগ্রভাগে মাথা এলিয়ে চোখ বুঁজে রইলো মায়ান।

‘টিচার?’

ফারদিনের ডাকে চোখ মেলে তাকায় সে। চোখ খুলে রাখা দায়।

‘তোমাকে না বলেছি আমাকে টিচার বলবে না। ভাইয়া বলে ডাকবে।’

মিষ্টি হাসলো ফারদিন। অধরে হাসিটা বজায় রেখে বলল,

‘আপনি আমার বেডে শুয়ে রেস্ট নেন। এভাবে থাকলে ঘাড় ব্যথা করবে আপনার।’

________________

‘ফারদিন খাবার রেডি।’

চেয়ারের একটা কোণা শক্ত হাতে ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো পুষ্পিতা। মিনিট সাতেক বাদে ফারদিন আর মায়ান এলো ডাইনিং এ। মায়ান চোখে মুখে পানির ছাট দিয়ে এসেছে। সম্মুখের চুলগুলো আধভেজা। কপাল আর ভ্রুর উপর পড়ে থাকা আধভেজা চুলের কারনে মায়ানের চোখমুখের মায়া যেন আরো কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকায় পুষ্পিতা। এই মায়ায় ডুবেছে সে আরো আগে।আরো ডুবলে হয়তো তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। হারিয়ে যাবে অতল গহীনে।

টেবিলের উপর সাজানো এক প্লেট গরম ভাত, মাছ ভুনা, ঘন ডাল, একটা ডিম ভাজা আর শুঁকনো মরিচের ভর্তা।

পুষ্পিতা কয়েক পা পিছিয়ে দাঁড়ায়। মায়ান চেয়ারে বসে তার পাশে দাঁড়ায় ফারদিন। সে এক পিস মাছ মায়ানের প্লেটে তুলে দিতেই পুষ্পিতা নত স্বরে বলল,

‘আম্মু আমার ওর জন্য মাছ আর ডাল করে দিয়ে গিয়েছিল। আমি ডিমটা ঠিকঠাক ভাজতে পারি। আর ভর্তা শর্টকাটে ইউটিউব দেখে পিষনিতে বানিয়েছি। অন্যকিছু রান্না করলে আপনি মুখেও নিতে পারতেন না। তাছাড়া সময়ও পাইনি। কষ্ট করে এগুলো দিয়ে খেয়ে নিন।’

‘আরে না না সমস্যা নেই। মেসে তো শুধু মাছ আর ডাল দেয়। তাও মাঝে মাঝে মুখে তোলা যায় না। জ্বরের জন্য এখন ওগুলো বি’ষ মনে হচ্ছে।

এক লোকমা মুখে দিয়ে মুখ বিকৃতি করে ফেলে মায়ান।

‘এভাবে আছেন কেন ভাইয়া?’

ফারদিনের কথায় মাথা উঁচু করে মায়ানের অভিমুখে চাহনি নিক্ষেপ করে পুষ্পিতা। মায়ান কোনো রকমে মুখের খাবারটা গিলে নেয়।

‘জ্বরের জন্য খাবার নিম পাতার মতো তিতা মনে হচ্ছে।’

‘তাহলে ভর্তা দিয়ে খান।’ মায়ানের কথা শেষ করার আগেই বলল পুষ্পিতা।

শুকনো হেসে মাথা ঝাঁকায় মায়ান। আবারও মনযোগ দেয় খাবারে। এবারে এক লোকমার পর আরেক লোকমা মুখে তুলতে নাজেহাল অবস্থা হয়ে গেলো তার। ঝালে চোখের জলে আর নাকের জলে একাকার। পুষ্পিতা দৈবাৎ এক গ্লাস পানি মায়ানের মুখের সামনে তুলে ধরে। দিশা না পেয়ে তাড়াতাড়ি পানিটা শেষ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।

‘বেশি ঝাল হয়েছে? আসলে আমি এসব আন্দাজ করতে পারি না। কতটুকু লাগবে। বেশি ঝাল লাগলে এটা আর খাওয়ার দরকার নেই। অন্যগুলো দিয়ে খান।’

‘না না ঠিক আছে। ঝাল হলেও এটাই বেশ লাগছে।’

প্রখর, বিদ্রূপপূর্ণ চাহনি নিক্ষেপ করে ফারদিন। ব্যঙ্গ করে বলল,

‘ তুমি তো অখাদ্য খাইয়ে মানুষ মে’রে ফেলবে।’

পুষ্পিতা কিছু বলার আগে মায়ান ধমকে উঠে। কন্ঠে সামান্য তেজ নিয়ে বলল,

‘বড় বোনের সাথে এভাবে কথা বলে কেউ? স্যরি বলো।’

_______________________

লিফট বাটনে চাপ দেওয়ার আগেই লিফটম্যান বলল,

‘ছাত্রছাত্রীরা এহন লিফট দিয়া যাইতো পারবো না। আজকের জন্য বড় স্যার নিষেধ কইরা গেছে।’

কথা শুনে কাঁদো কাঁদো চেহারা হয়ে গেলো পুষ্পিতার। পাশে থাকা জারিন উত্তেজিত, আক্রোশপূর্ণ গলায় বলল,

‘স্যার যে মাঝে মাঝে এমন কেন করে সেটাই বুঝি না। লিফট তো না মনে হয় স্বর্ণের খনি।’

পুষ্পিতার কন্ঠে অসহায়ত্ব ফুটে উঠলো।

‘সিঁড়ি বেয়ে এখন চার তলায় উঠবো? আমি তো অল্প বয়সে পঙ্গু হয়ে যাবো রে। ফাজিল পোলাপান গুলো প্রত্যেক ফ্লোরে বাটন চেপে রাখে আর রেগে যায় স্যার রা। বেগ পোহাতে হয় আমাদের মতো অসহায়দের।’

অকস্মাৎ কারো মুখে নিজের নাম শুনে চোখমুখের অসহায়ত্ব সরে গিয়ে কঠোরতা দেখা দিল। না শোনার ভান করে জারিনের হাতটা ধরে সিঁড়িতে পা রাখতেই তানজিফ দৌড়ে পুষ্পিতার পিছনে দাঁড়ায়।

হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

‘ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না?’

ঘুরে দাঁড়ায় পুষ্পিতা আর জারিন।

‘না শুনতে পাইনি।আমি বয়রা। কে কি বললো কিছুই আমার কান অবদি আসে না।’

তানজিফ একটু লাজুক ভঙ্গিতে বলল,

‘তুই বয়রা হলেও আমার সমস্যা নেই। তুই কানা হলেও আমার সমস্যা নেই। আমি তোকেই বিয়ে করবো।’

এবারে পুষ্পিতার রাগ যেন আসমান ছুলো। আশেপাশে তাকালো। যে যার ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়ে ব্যস্ত।

‘এই তোর লজ্জা সরম নেই? এতোবার রিজেক্ট করার পরও আমার পিছনে এভাবে ছ্যাচড়ার মতো পড়ে আছিস কেন? ‘না’ এই শব্দটার মানে বুঝিস না? শুধু তোর জন্য ভার্সিটি আসতেও ইচ্ছে করে না।’ চাপা রাগ আর ক্রোধ পুষ্পিতার কন্ঠে।

জারিন পুষ্পিতার হাতটা শক্ত করে ধরে।ফিসফিসিয়ে বলল,

‘তুই এসব কি বলছিস? নিজেকে সামলা।রাগে, ক্ষোভে অযাচিত কিছু বলিস না প্লিজ। পরে কিন্তু আফসোস করবি। কথার আ’ঘা’ত কিন্তু সবচেয়ে বড় আ’ঘা’ত।’

জারিনকে হাত দিয়ে থামায় পুষ্পিতা।

‘তোদের কাছে ও কঠিন ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে যেটা বলেছি সেটাই। ওর এসব কর্মকান্ড আমাকে আকৃষ্ট করার বদলে বিরক্ত করছে। ও এই সহজ কথাটা কেন বুঝে না?’

বিষন্ন, ক্লেশিত চোখে পুষ্পিতার দিকে চেয়ে রইলো তানজিফ।

‘আমি তোকে বিরক্ত করি? আমি ছ্যাচড়া? যা আমি আর তোকে বিরক্ত করবো না। ইভেন তোর সামনেও আসবো না।’ বেদনার্ত কন্ঠে বলে উঠলো তানজিফ।

‘তুই আর আমার সামনে আসিসও না। তোর উপস্থিতি আমার অসহ্য লাগে।’

‘ পুষ্পিতা মুখে লাগাম দে প্লিজ। আশেপাশে সবাই দেখছে।’

তানজিফ আর কিছু না গটগটিয়ে উপরে চলে গেল।

‘যেগুলোকে আজ বিরক্তি হিসেবে ধরে নিচ্ছিস। সেগুলো তোর বিষন্ন মুখে আবার হাসির কারন না হয়ে দাঁড়ায়। এই বিরক্তিকর কাজ গুলোকে না আবার মিস করিস।’

‘এমন দিন আমার না আসুক।’

#চলবে

নয়া গল্প নিয়ে ফিরে এলাম। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here