অতিরিক্ত চাওয়া পর্ব ৮

অতিরিক্ত চাওয়া { ২ }

— মাথা কাঁটা যাচ্ছে! এগুলো কি শুনছি চেয়ারম্যান সাহেব!
এটা কি মেনে নেওয়া যায়? ছিঃ ছিঃ! কোথায় আপনার ছেলে, আর কোথায় আমার মেয়ে? বেলী এখনও এগুলো বোঝে বলে আমার মনে হচ্ছে না! আপনার ছেলের ঠিক সময় বিয়ে হলে, বেলির সমান বাচ্চা হয়ে যেতো! এগুলো শুনতেও বড্ড অদ্ভুত লাগছে! লজ্জাজনক ব্যবধান!
— আনন্দ ঠিক বলেছে! এটা কেমন প্রেম-খেলা? মানইজ্জত তো কিছু থাকবে না গ্রামে! টাকা-পয়সা দেখলে তো হচ্ছে না! বয়সের ব্যাপারটা দেখে নিতে হবে তো! ভাগ্নি আমার মাত্র ১৬! আপনার ছেলে যে ভালোবাসার কথা বলছে, আদৌও বেলী বোঝে নাকি সন্দেহ! আর এমন তো না যে, ছেলে আপনার মেয়ে পাবে না! তার বয়সী যেকোনো মেয়েই পেয়ে যাবে!
দেখুন, আমিদ চৌধুরী আপনি এলাকার চেয়ারম্যান, সম্মান করি আপনাকে, আপনার পরিবার কে! আপনার ছেলেকে বোঝান! এইসব নষ্টামি এ-ই গ্রামে চলবে না! গ্রামের মানুষজন থু থু দেবে আমাদের মুখে!

জয়া চৌধুরী তৃষ্ণার চেহারার দিক তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন! ছেলেকে যে একদমই সে চিনতে পারছে না! ছেলের কষ্ট যে তাঁর সয্য হচ্ছে না! বুকটা যে কেঁপে উঠছে বারবার ! স্বামীর মুখেও অমাবস্যার ছায়া! ছেলেকে হারানোর কথা ভাবতেই যে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে!
— আনন্দ ভাই! আমার ছেলেটা পাগলের মতো ভালোবাসে আপনার মেয়েকে! বয়সটা দেখছেন? ওর ভালোবাসাটা দেখছেন না? সেই ১১ বয়সের বেলিকে ভালোবেসে আসছে! আমি তো মা! আমি তো সব বুঝি! আপনি একটু ভাবুন না!
শান্ত-মাথায় ভেবে জানান! আমার ছেলেটা যে পাগ…
— এগুলো আর বলবেন না! দয়া করে! মেয়ে আমার এখনো ছোট! এ-ই বয়সে এগুলো কি? আপনি ভাবছেন কিভাবে?
অঞ্জলি টিপটিপ চোখের পানি আটকানোর চেষ্টায়,
— বিশ্বাস করুন চাচা! ও বাঁচবে না বেলীকে ছাড়া! একটু বুঝুন! এখন তো বিয়ে দেবেন না! বেলী বড় হোক! যখন আপনার মনে হবে মেয়ে তৈরী হয়েছে সেদিন কথা হবে! তারপরও না করবেন না!

আমিদ হাত উঁচু করে চুপ থাকতে বলল! ছেলের লাল চোখ, কান্না-মাখা চেহরাটা আমিদের বুকে গিয়ে বিঁধছে! বুকে পাথর নিয়ে, মাথা নিচু করে সবার উদ্দেশ্যে বলল..
— তৃষ্ণারাজ চৌধুরী আর এ-ই কৃষ্ণপুর গ্রামে থাকতে পারবে না! [ তৃষ্ণার চোখের দিক তাকিয়ে ] এ-ই মেয়ের সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখলে আমার মৃত্যু দেখবে, তুমি নিশ্চিত থেকো!

জয়া আতঙ্কিত চোখে স্বামীর মুখের দিক তাকিয়ে! চোখেরজল গুলোর সীমানা নেই! অঞ্জলি চোখের কোণার জল পুছে বলল,
— বাবা আপনি তো জানেন সব? আমরা আমাদের তৃষ্ণা হারিয়ে ফেলবো বাবা! দয়া করে বাবা এটা করবেন না! আনন্দ চাচা.. প্লিজ চাচা আপনি তো শিক্ষক, আপনি তো সব বোঝেন! একটু ভাবুন চাচা…
— সম্ভব না মা! এ-ই বিষয়ে কথা বলবো না!

তৃষ্ণার হাত গুলো আনন্দের হাতের উপর চলে গেলো! তৃষ্ণার লাল চোখ থেকে এক ফোঁটা জল আনন্দের হাতে পড়লো! খুব তীব্র ভাঙ্গা গলার আওয়াজ তার..
— অ..অনেক ভালোবাসি ওকে চাচা! পা ধরতে বললে ধরবো আপনার! যা বলবেন করবো! যেমন মেয়ে-জামাই চান হব! দয়া করে চাচা এটা বলবেন না, আমার ভালবাসাটা বয়সের ব্যবধানে তুচ্ছ! অনেক ভালোবাসি..
— সম্ভব না..

আনন্দের হাতটি পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা বেলির কব্জি চেপে ধরলো! বেলির মুখের সুন্দর রঙটা ঢেকে আছে চোখের জলে! ফুলোফুলো চোখ গুলো তৃষ্ণার রোবট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শরীরের দিক আঁটকে! মেলে দেওয়া হাতটি তৃষ্ণার পথ চেয়ে ! আনন্দের হাতটি বেলির বাম হাত, টেনে নিয়ে যাচ্ছে অনেক দূরে.! আত্মা নেই শুধু শরীরটা সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো তৃষ্ণার! অস্ফুটস্বরে তার আওয়াজ..
–বেলি……

চোখ খুলতেই ঘেমে একাকার তৃষ্ণা! শীতকালীন ভোরেও তাঁর শরীর ঘামে ভেঁজা! কপালের বিন্দু- বিন্দু ঘাম গুলো বেঁয়ে ঘাড়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে! রাত্রি পেরিয়ে পৃথিবীতে মাত্র আলোর রেখা উঁকি দিচ্ছে! কাঠের জানালা দিয়ে আলো এসে পড়ছে, মাথা চেপে ধরে আধশোয়া হয়ে বসে থাকা তৃষ্ণার উপর! ছোট ঘরটায় চোখ বুলিয়ে বেলিকে দেখতে না পেয়ে দ্রুত, শক্ত বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো! এখনি বেলিকে তার দেখাটা খুব জরুরি! খুব জরুরি!

কিনারার এ-ই নির্জন হোটেলটি তৃষ্ণার পছন্দের! এখানের যাবতীয় জিনিসপত্র কাঠের দ্বারা তৈরি! পুরো হোটেলের কারুকার্য গুলোও কাঠের! মোট কথা সব কাঠের! রাত ৩ টার দিকে এখানে এসে পৌঁছেছে তারা ! বেলি তখনও ঘুম! তাই ঘুম না ভাঙা পর্যন্ত গাড়িতেই ছিলো!
তৃষ্ণার চেনাজানা নানান মানুষ রয়েছে এ-ই কিনারায় ! আয়েশা তাঁদের মধ্যে অন্যতম! এ-ই হোটেলের মালিক আয়েশা রাজিয়া ! জামাই মারা গিয়েছেন অনেক বছর হচ্ছে! ১৮ বয়সের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে একাই জীবন-যাপন করেন! এ-ই হোটেলটাই তাঁর বেঁচে থাকার সম্বল!
বেলির হাসি-হাসি মুখটা অমাবস্যার আঁধারে ঢেকে গেলো, তৃষ্ণার মুখ দেখে! এমন দেখাচ্ছে কেনো? সে আয়েশার সাথে বসে লিষ্ট দেখছিল! হঠাৎ উষ্কখুষ্ক তৃষ্ণাকে দেখে সে ব্যাকুল হয়ে উঠলো! অস্থিরতা নিয়ে সে দ্রুত তৃষ্ণার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো!
— কি হয়েছে?
তৃষ্ণা তখনও বেলির মুখের দিক চিন্তিত নজরে তাকিয়ে! তাঁর ডান হাতটি বেলির গালে স্পর্শ করলো! ততক্ষণাৎ বেলির ছোটছোট চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে গেলো! তৃষ্ণা তাঁর বু’ড়ো আঙুল দিয়ে বেলির গালে লেগে থাকা ময়লাটা সরিয়ে দিলো! চোখগুলো তাঁর স্থির হয়ে হয়ে আছে বেলির চোখে! বেলি অস্থিরতা নিয়ে বলল
— খারাপ লাগছে? মাথা ধরেছে? আমি কি টিপে দেবো?
— উঁহু! অনেক ভালো আছি! এমন ভালো আমি সারাজীবন থাকতে চাই বেলি!
— চোখগুলো লাল হয়ে আছে আপনার ! ঘুম হয়নি হয়তো! আমি কি মাথা টিপে দেবো?
তৃষ্ণার নজর তখনও বেলির মুখে,
— চলুন আমি মাথা টিপে দিচ্ছি!
বেলির ছোট হাতটি তৃষ্ণার হাত টেনে নিয়ে যাচ্ছে ৪ নাম্বার রুমের দিক ! তৃষ্ণাও বেলির কোমড়ে দুলানো চুলগুলো দেখতে দেখতে চলল!

কাঠের বিছানার পাশে বসে বেলি! তাঁর ঠিক পাশেই তৃষ্ণা ঘুমিয়ে! বেলির হাত কপাল ছুঁয়ে দিতেই, সে ঘুম! বেলির হাত কপাল থেকে চুলে পৌঁছে গেলো! চুলগুলো দুলিয়ে দুলিয়ে ধরতে লাগলো! সিল্ক চুলগুলো হাত দিতেই ছুটে যাচ্ছে! শীতকালীন ভোরের আলো এসে, তৃষ্ণার মুখে ছড়িয়ে উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে দিচ্ছে! খোচাখোচা দাড়ি গুলো চিকচিক করছে! ফরসা মুখে বাম চোখের নিচের তিলটিয় আরো সুন্দর দেখাচ্ছে! বেলির হাতটি তৃষ্ণার চোখের নিচের তিলটি ছুঁয়ে দিলো! লোকটির সব সুন্দর, ভয়ংকর সুন্দর!
কাঠের ছোট একটি টুল বিছানার পাশেই রাখা! সেখানে রাখা ফোনটি বারবার ভাইব্রেশন হচ্ছে! কল আসছে একটার পর একটা! অলরেডি ৫৬ টা কল ‘ শো ‘ হচ্ছে, প্লাস ২৩ টি মেসেজে’স ! কত ফেমাস লোকটা? বেলি আড়চোখে ঘুমানো তৃষ্ণার দিক তাকালো! তাঁকে তো রুম থেকে বেরোতে না করলো, তাহলে এখন কি করবে সে? ফোনটি হাতে নিয়ে তৃষ্ণার দিক এগিয়ে গেলো! তিন-চার বার ভেবে ডেকেই ফেলল,
— আপনার অনেকগুলো কল এসেছে! [ তৃষ্ণার শরীরে হালকা ধাক্কা দিয়ে, ] আপনার কল এসেছে! হয়তো জরুরী!
— ডোন্ট ডিস্টার্ব মি বেলি!
ঘুম জড়ানো কন্ঠ শুনে বেলি কিছুক্ষণ চুপ মেরে যায়! আচ্ছা বুক ধুকপুক কেনো করছে? পরক্ষণেই গোমড়া হয়ে গেলো,
— আমি কি করবো? শুধু বসে থাকব? কিছু করার তো নেই! আয়েশা আন্টির দিক যাই?
চোখ বুঝে উবুত হয়ে,
— রুম থেকে বেরোবে না! এক কাজ কর, গেঞ্জিটা খুলে দি, ধুতে থাক.!
— না..! এখানে আমি সাবান, পাউডার কোথায় পাবো?
তৃষ্ণার জবাব না পেয়ে আবারও বলল,
— মোবাইলের লকটা খুলে দিন না!
তৃষ্ণা শুয়ে থেকেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে লক খুলে দিলো! লক খুলে তাঁর মতো ঘুম সে! বেলি দ্রুত মোবাইলটা নিয়ে তৃষ্ণার পাশে বসলো! প্রথমেই নজরে পরলো, তৃষ্ণার একটি ছবি ! এটা তাঁর ফেইসবুক প্রোফাইল! বিমানের মোবাইল দিয়ে দেখেছিল!
বেলি গ্যালারি তে গিয়ে পিকচার্স দেখতে লাগলো! গ্রুপ পিকচার্সের একটা ফ্রেম করা! আবিদ, আয়ুশ , অভি তারপর আরো কিছু ভাইয়ারা, কিছু আপুরা! এখানের একটি মেয়েকে বেলি চিনে! তাঁর নাম কবিতা! তৃষ্ণার ক্লাসমেইট ছিলো! প্রায় আসে গ্রামে! আসলে তৃষ্ণার সাথেই লেগে থাকে! যে কেউ দেখলেই বুঝবে, মেয়েটি তৃষ্ণার জন্য ফিদা! আর এ-ই মেয়েকে নিয়ে বেলিদের স্কুলের সামনেই বেশি থাকতো! অবশ্য মেয়েটি অনেক স্টাইলিশ! হাতের নেইলের সৌন্দর্য থেকে ধরে, পায়ের নেইলস পর্যন্ত তাকিয়ে থাকার মতো! বেশ চমৎকার, বাট ক্যারেক্টর? ততটা তাকিয়ে থাকার মতো না! শুধু এ-ই মেয়েটি না! তৃষ্ণাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে সবগুলো মেয়ে দেখতে চমৎকার! আর তারা পাশের গ্রামে থাকে ! মানে তৃষ্ণার চাচাদের গ্রামে। আরেকটি লম্বা আপু আছে, বেলিকে দেখলে গাল টেনে লাল করে দিতো! তাঁর নাকি বেলিকে টেডিবিয়ার লাগে! অনেক মাস যাবত দেখা হচ্ছে না!
হঠাৎ বেলির চোখ যায় একদম নিচের ফোল্ডারটিতে! সে কিউরিওসিটি নিয়ে দ্রুত ক্লিক করলো! ব্যাস, বেলির মাথা ঘুরে উঠলো! বড় এক ঢোক গিলল! অনেক ছবি..! এতো ছবি কখন তুলল? এতো ছবি! স্কুল ড্রেসে, কামিজে..! একটি ২ মিনিটের ভিডিও প্ল্যা করতেই বেলি, লজ্জায় ফুসফুস করতে লাগলো! সেই যে তৃষ্ণার প্যান্ট, জুতো নদিতে ধুয়েছিল! সেটার ভিডিও.! টাম্মিকে ভিডিওতে দেখে বেলির মন খারাপ হয়ে গেলো! আবার পরক্ষণেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো! তৃষ্ণা তাঁর এতো এতো ছবি রেখেছে! বেলির মুখের লাজুক হাসিটা তৃষ্ণা মিস করে গেলো!

দুপুরের ১২ টা বেজে যাচ্ছে! বেলির কান্নার আওয়াজে তৃষ্ণা হুমড়ি খেয়ে উঠলো! আশেপাশে তাকিয়ে নিচে দেখতে পেলো, বেলি বসে বসে কাঁদছে! তাঁর তো এক মিনিটের জন্য রূহ কেঁপে উঠলো! তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে বেলির পাশে বসতেই বেলি একটু দূরে বসলো! দু-হাত দিয়ে বেলির মুখ নিজের হাতে নিয়ে তার দিক ফিরালো..
–কি হয়েছে?
বেলি সমানে কেঁদেই যাচ্ছে,
–কেউ কিছু বলেছে?
বেলি মাথা নাড়ালো,
— তাহলে?
বেলি কেঁদেই আচ্ছে, রাগে এক ধমক দিতে গিয়েও তৃষ্ণা থেমে গেলো! নিচে তাকিয়ে সে ভ্রু-কুচকে ফেলল,
— কখন হয়েছে? [ বেলি মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলল, ] থাপ্পড় দিবো বিয়াদপ!
— অ..অনেকক্ষণ হয়েছে!
— বুদ্ধি নেই তোর মাথায়? আমায় ডাকিস নি কেনো? মুর্খ কোথাকার! সাদা কামিজটা একদম খেয়ে দিলি!
বেলিকে টেনে তুলল,
— ওয়াশ-রুম এ গিয়ে, বি-ভ্যাল টা ইউস কর আপাতত!
— এটা আমার স্কুল ড্রেস!
— তো? এটা আর চলবে না! প্যাড কোনটা ইউ’স করিস?
— হুইস্পার…
— আমি নিয়ে আসি! গেইট লক করে দে! আমার আওয়াজ ছাড়া খুলবি না!
বেলি মাথা দুলালো! তৃষ্ণা কিছুটা গিয়ে আবারও ফিরে এলো! বেলির মুখটা হাতে নিয়ে চোখের পানি পুছে দিলো,
— এটা বলতে লজ্জার কি ছিলো ?
বেলি আড়চোখে তাকালো! তৃষ্ণা টুপ করে বেলির কপালে চুমু খেয়ে নিলো! এবং তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে গেলো! যাওয়ার আগে গেইট টা লক করে দিলো বাহির থেকে! বেলি লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো! কপাল ছুঁয়ে দ্রুত ওয়াশ-রুম ছুটলো…

চলবে..

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here