অতিরিক্ত চাওয়া পর্ব ৭

অতিরিক্ত চাওয়া { ২ }

— খাচ্ছিস না যে? কি থাপ্পড় খেতে ইচ্ছে হচ্ছে ?
তৃষ্ণার আওয়াজে বেলি মিনমিন করে বলল…
— অসভ্য।
কখন থেকে কেঁদে চলেছে বেলী! কাঁদতে কাঁদতে বেলীর মুখটা ফুলে উঠেছে! চোখের পানির সীমানা নেই! বারবার নাক টানছে আর চোখের পানি পুছে দিচ্ছে! কিন্তু, পানি পুছে লাভ তো হচ্ছে না! সে-ই একই ভাবে চোখের পানি গাল গড়িয়ে পড়ছে! আঁড়চোখে তৃষ্ণার দিক তাকাচ্ছে, যিনি আপাতত ড্রাইভ করতে ব্যস্ত! বেলী যে কান্না করছে, সেদিকে কোনো গুরুত্ব নেই! কি পাষাণ লোক! কাঁদার মাঝেও বেলী মনেমনে এটাই বলছে, মায়া মহব্বত নেই লোকটার।
তার সামনে রাখা খাবারের দিক চোখ বোলাচ্ছে, কিন্তু ধরছে না! খাবারের দিক চোখ পড়তেই আবারও কেঁদে উঠলো! হ্যাঁ, বেলি মানছে যে ভুল করেছে! তার উচিৎ ছিলো তৃষ্ণার সাথে দেখা করা! কিন্তু করে নি, তাই বলে এমন শাস্তি? তার পরিবার হয়তো চিন্তায় শেষ! বাড়িতে কিভাবে যাবে? সে কি জবাব দেবে তাদের? তাকে তো মেরে বালি চাপা দিয়ে দেবে! প্রতিবেশী শুনলে তো মান-ইজ্জত শেষ!
গলা শুঁকিয়ে কাঠ কাঠ ! পানি খাওয়াটা খুব জরুরি! তাও সে খাবে না! অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে অন্ধকারের পরিবেশ দেখতে লাগলো! শীতের প্রভাব টা বেশ ভালোভাবে নাড়িয়ে দিচ্ছে! কাঁদার মাঝেও বেলির মনে হলো, তৃষ্ণা জ্যাকেট না দিলে, সে কনকনে ঠান্ডায় বরফ হয়ে যেতো! যেই পাতলা গেঞ্জি স্কুল ড্রেসের উপর পড়েছিল! অবশ্য, বেলি কিভাবে জানবে যে, তাকে বাড়িতে ফিরতে দেওয়া হবে না?

সিগারেটের গন্ধে নাক কুঁচকে রইলো বেলী! একসময় কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি ফুরিয়ে গেলো! শুধু নাক টানার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে গাড়িতে! সিগারেটের গন্ধে, বেলি ভাংগা আওয়াজে বলল..
— বাচ্চাদের সামনে এইসব খাওয়া বারন !
তৃষ্ণা ভ্রু-উঁচু করে বলল..
— বাচ্চা কে? এইসব মানে?
— এ-ই যে আমি! যাকে আপনি মানষিক নির্যাতন করছেন! ১৮ এ-র নিচে সবাই বাচ্চা! আর এইসব বলতে আপনি যেটা খাচ্ছেন!
— তুই বাচ্চা?
— অবশ্যই! আপনার কি মনে হয়?
— ২ বাচ্চার মা!
— নাউজুবিল্লাহ! আপনার চোখে সমস্যা জেনে রাখুন!
— জেনে নিলাম! [ বাঁকা হেসে ] একটু আগে কি বললি? তোকে নির্যাতন করছি?
বেলী মিনমিন করে বলল,
— মানষিক বলেছি! সেটা শুনেন নি?
বেলি আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো তৃষ্ণা মুচকি হাসতে হাসতে, সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ফেলে দিলো! বেলি বুক ভরে শ্বাস নিলো! এতোক্ষণ সিগারেটের গন্ধে শ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়েছিলো!
— এখনও হাত গুটিয়ে?
বেলি কান্নারত গলায় বলল..
— রাত্রির ১২ টা ২১! ৬ টার পর থেকে বাহিরে থাকা বারন! আর, আমি সকাল থেকে রাত্রির ১ টা পর্যন্ত বাহিরে! বাড়ির সবাই হয়তো কান্নাকাটি করছে! আর, আমি গেলে নিশ্চিত মারবে! মেরে পুকুরে ফেলে দেবে!
তৃষ্ণা সেলফোন টিপতে টিপ্তে বলল,
— কিছু বললাম?
কিড়মিড়িয়ে বেলী বলল..
— হ্যাঁ! বলেছেন, এখনও হাত গুটিয়ে ? তার আগে বলেছিলেন, খাবার খাচ্ছিস না যে? থাপ্পড় খাবি ? , আর আপনাকে যে আমি ৫-৬ ঘন্টা যাবত বলে যাচ্ছি, বাড়িতে যাবো, বাড়িতে যাবো ! আপনি শুনেছেন? না শুনেননি! অথচ আপনি যা বলবেন শুনতে হবে, যা করতে বলবেন করতে হবে? কেনো?
— কারণ, আমি বলেছি তাই!
বেলি ধীর গলায় বলল..
— ঠেকা।
তৃষ্ণার ভ্রু-উঁচু করা দেখে, বলল…
— ক্ষিদে নেই! সত্যি!

বেলি আড়চোখে তাকালো, তৃষ্ণা ততক্ষণে বিরিয়ানির বাটির ঢাকনা খুলে, চামিচ দিয়ে নাড়তে ব্যাস্ত! ভালোভাবে মিক্স করে বেলির মুখের সামনে চামিচ ধরলো! বেলি একবার চামিচের দিক আরেকবার তৃষ্ণার দিক তাকাচ্ছে! প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে! কিছু না ভেবেই খেয়ে নিলো!
— কে রেঁধেছে?
তৃষ্ণা জবাব না দিয়ে, চামিচ ভর্তি করে বেলির মুখে ধরলো! বেলিও খেয়ে নিলো..
— বলুন না?
— ভাবী …
বেলি খাবার মুখে কেঁশে উঠলো! তৃষ্ণা দ্রুত বোতল এগিয়ে দিলো! পানি খাওয়াচ্ছে আর পিঠে হাত বোলাচ্ছে…
— ওকে?
— হু..! ভাবি? সোলাইমান ভাইয়ার বউ? আপনার বড় ভাইয়ার বউ?
বিরক্তি লুক নিয়ে বেলির দিক ভ্রু-উঁচু করে তাকালো তৃষ্ণা! বেলি মাথা নাড়িয়ে সামনে ধরা চামিচে বিরিয়ানি, মুখে নিয়ে চিঁবুতে চিঁবুতে
বলল..
— ভাবি রেঁধেছে! ওয়াও! আমিও শিখবো, কিভাবে রেঁধেছে৷ আমি তাকে দেখেছিলাম ওপারে একবার! কি সুন্দর দেখতে! কি ফরসা! কত স্টাইলিশ! আর কি সুন্দর ভাবে কথা বলে!
— আর আমি?
— আপনিও তো অনেককক…
— হ্যাঁ অনেক?
বেলি চুপ মেরে যায়! কথার তালে তালে মাথাটাও গেছে!
— অনেক কি?
— অসভ্য!
— ধন্যবাদ!
বেলি লাল নাক নিয়েও হেসে ফেলল!
— ভাবির সাথে কথা বলবি?
— সত্যি? কিন্তু এখন তো অনেক রাত! [ তৃষ্ণা আবার খাওয়াতে নিলে, ] আর খাবো না!
তৃষ্ণা সেই চামিচ দিয়েই বাকি গুলো খেতে খেতে মোবাইল টিপতে লাগে! বেলি আঁড়চোখে তাকিয়ে থাকে!
— ভাবি বলেছিলেন তোর সাথে কথা বলবে!

কল লাগিয়ে লাউডস্পিকার ওন করে দিলো তৃষ্ণা! ২ বার রিং হতেই চেঁচামেচির আওয়াজ..
— আরে আমি আগে বলি..
— তুমি চুপ থাকো! ভাইয়া আমি আগে কথা বলবো..
— দু’জন চুপ আমি বলবো আগে..।
বেলি ছোটছোট চোখ করে ফোনের দিক তাকিয়ে, যেটা সামনে রাখা! তৃষ্ণা বিরিয়ানি খেতে খেতে শান্ত আওয়াজে বলল..
— কল কেঁটে দিচ্ছি…
ততক্ষণাৎ চিল্লাচিল্লি ওফ হয়ে গেলো! একদম শান্ত পরিবেশ! ফোন থেকে মিষ্টি একটি আওয়াজ এলো..
— হ্যালো বেলি? আমি তৃষ্ণার ভাবীঅঞ্জলি!
বেলি বড় এক হাসি দিয়ে তৃষ্ণার দিক তাকালো..
— জ্বি! আসসালামু আলাইকুম ভাবী!
— আলাইকুম আসসালাম! কেমন আছো?
— জ্বি ভালো। আপনি?
— অনেক ভালো! এটা বলো বিরিয়ানি কেমন লাগলো?
— অনেকককক ভালো! টেস্ট এখনো মুখে লেগে!
আমাকেও শিখাবেন?
— অবশ্যই! শিখতে তো এভাবেও হবে ভবিষ্যতে!
আচ্ছা তো দিন কেমন কাটলো? সয়তানটা তোমায় জ্বালায়নি তো?
বেলি লজ্জা পেয়ে যায়! বাগান বাড়িতে ঘটে যাওয়া কাহিনি মনে পড়তেই,
— উঁহু !
— শোনো.! এ-ই তিন দিন একদম ফাটিয়ে এনজয় করবে! ফ্যামিলি টেনশন একদম করবে না!
বেলি কনফিউজড হয়ে পড়ে , তৃষ্ণা বিরক্তি প্রকাশ করে বলল..
— রাঁধুনি বেগম, আপনায় খুলে কি কেউ বলতে বলেছে?
— চুপ থাক তুই বিয়াদপ! তুমি শোনো বেলি, ও তোমাকে স্ট্রেসে রাখতে চাচ্ছে! তুমি ফ্যামিলি টেনশন করিয়ো না! তাদের তোমার সোলাইমান ভাইয়া বলে এসেছে, তুমি আমাদের বাড়ি ৩-৪ দিন বেড়াতে এসেছো! তারাও মেনে নিয়েছে! তাই নো টেনশন ওনলি ফুর্তি!
বেলি চোখ ছোটছোট করে বলল..
— আমি বুঝিনি?
ওপাশ থেকে আরেকটি মেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো..
— আমিও কথা বলবো! আমি ছোট ভাবীরর সাথে কথা বলবো! দাও, দাও ভাবী আমায় দাও..
বেলি তৃষ্ণার দিক তাকালো! তৃষ্ণা বিরিয়ানি খেতে ব্যাস্ত! বেলির মাথায় কিছুই ঢুকছে না..
— হ্যালো বেলি আপু ? আমি তৃষা ! তৃষ ভাইয়ার ছোট বোন! আমি কিন্তু সিক্স এ পড়ি! তোমাকে দেখেছি! আমার না অনেক ভালো লাগে তোমায়! ভাইকে কতোবার বললাম যে বাড়িতে আনো! অথচ, সে তোমায় নিয়ে একা চলে গেলো! পাষাণ মনের একটা! তুমি শুনো না! আমার সাথে দেখা করবে? জানো তোমার একটা কালো ডিজাইনের কামিজ আছে না? আমি সেইম তেমন বানিয়েছি! তোমার সাথে দেখা করতে গেলে পড়বো! তুমিও ওটাই পড়বে!
আমাদের মানাবে তাই না?
বেলি মুখটা হালকা হা করে রইলো! ফোনের ওপাশ থেকে অঞ্জলি ভাবীরর হালকা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে..
— ধীরে বল! শ্বাস নে পাজি..!
আবারও তৃষার আওয়াজ..
— শুনেছো?
বেলি হেসে উত্তর দিলো..
— হ্যাঁ তৃষা, শুনেছি! হ্যাঁ পড়বো! খুব জলদি দেখা করবো!
— আচ্ছা আমরা আবার কথা বলবো! আবিদ ভাই ফোন কেঁড়ে নিচ্ছে! অসহ্যকর …
তৎক্ষণাৎ আবিদের আওয়াজ..
— হেই দেয়ার, পিচ্চি!
— তোমার সবাই কি একসাথে?
— হ্যাঁ! তা কি শাস্তি পেলে? আগেরবার তো প্যান্ট, জুতো ধুয়েছিলে! এবার? এবার কিন্তু পুরো ১ মাস কাহিনি করেছো! ১ মাসের শাস্তি তিন দিনে পাবে! আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে…
বেলি খুকখুক করে কেশে উঠলো..
— মানে?
আবিদ আর বলতে পারলো না, তৃষ্ণা শান্ত আওয়াজে বলল..
— রাত হয়েছে! গুড নাইট এভ্রিওয়ান!
তৃষা চেঁচিয়ে বলছে..
— পিচ্চি ভাবী গুড নাইট! আমরা কিন্তু খুব জলদি দেখা করবো! তোমার জন্য আমি ড্রইং ও করেছি, আরো…
আর শোনা গেলো না! কারন, তৃষ্ণা ততক্ষণে কল কেঁটে দিয়েছে! বেলি কনফিউজড হয়ে আছে! তৃষ্ণার দিক তাকিয়ে বলল..
— আব্বু, আম্মু কেউ কিছু বলবে না! ইয়েহহহহ
–কেনো বলবে না?
–কারণ, ভাইয়া নাকি পার্মিট এনেছে! ভাবি বলল শুনলেন না?
তৃষ্ণার জবাব না পেয়ে বেলি মুখ বেঁকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো! গাড়ি চলতে শুরু করলো! অন্ধকারের পৃথিবীটা বেশ সুন্দর! ৩ দিন সে তৃষ্ণার সাথে থাকবে? তার স্বপ্নের ৩ দিন!
— আমরা কোথায় যাচ্ছি?
–তোকে বেঁচে দিতে!
— আমাকে আবার কে কিনবে?
— আমি [ বেলি তৃষ্ণার দিক তাকাতেই, ] আমার কাপড় ধোয়ানোর জন্য!
বেলি ঠোঁট ফুলিয়ে রইলো ! অন্ধকারের আবছায়া না থাকলে, হয়তো দেখতো তৃষ্ণার ঠোঁটে লেগে থাকা হাসি! গাড়ি চলেছে আপন গতিতে! এলাকার বর্ডার পেরিয়ে গিয়েছে মাত্র! শীতকালীন রাত্রি , লং ড্রাইভ আর কি চাই?
শীতল আবহাওয়ায়, অন্ধাকার পরিবেশে, মুগ্ধ বেলি তৃষ্ণার ঘাড়েই ঘুমিয়ে পড়েছে! আরামে ঘুমন্ত বেলী তো জানলোই না সে একজনের বুকে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। তার স্কুল ড্রেসের বিভেল সরে যাওয়াতে, অন্যএকজনের যে মাত্রারিক্ত সমস্যা হচ্ছে। সাধ্যমতো চেষ্টা করছে নিজেকে সামলানোর। তাও তৃষ্ণার বুক কাঁপছে অনবরত। ..

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here