অতৃপ্তির মাঝে তৃপ্তিময় সে পর্ব -২৩+২৪

#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব -২৩
___________________
৫১.
–“আদ্রিন ফোন করেছে?বা কোনো খবর পেয়েছিস উনার?”
তৃপ্তির কণ্ঠে কাতরতা,দুর্বলতা।হাসপাতালের বদ্ধ কক্ষের স্যাভলনের কড়া সুবাসে আজ দুদিন ধরে আবদ্ধ সে।বাম হাত ভারী।ক্যানেলার কারণে সেই হাত যেনো লোহার নিচে চাপা।ফোলা আঁখি মেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে আলেয়ার পানে চেয়ে।
আলেয়া নিরুত্তর।কি বা জবাব দিবে?নিউজের চ্যানেলে আদ্রিনের নিখোঁজের খবর টপে।অথচ আদ্রিনের মেহবুবা কিছুই জানেনা। জানবেই বা কিভাবে?কেউ তাকে জানায়নি।বিশেষ করে অরিত্রনের কড়া নিষেধাজ্ঞা এই বিষয়ে।আলেয়া নিজেও কিছু বললো না।তার বান্ধবীর শরীর ভালো নেই। জ্বরের প্রকোপে হাসপাতালে ভর্তি।সাথে প্রেসার একেবারে লো।এই অবস্থায় দুঃসংবাদ মেয়েটার জীবনে ঠিক মরুতে হারিয়ে যাওয়ার মতো।তাই সবদিক বিবেচনা করে চুপ হয়ে আছে সকলে।
আলেয়া তৃপ্তির মাথায় হাত বুলায়,
–“উনি মালয়েশিয়ায়।হুট করেই ব্যবসার জন্যে ছুটলেন।তুই অসুস্থ অবস্থায় উনার সাথে কথা বললে উনি ঠিক চিন্তা করবেন তোর জন্যে।তাই উনাকে চিন্তায় না ফেললে ভালো হয়।দেশে এসে এরপর নাহয় দুজনে মিটমাট করবি ভালোবাসার।”

জ্বরে নেতিয়ে যাওয়া তৃপ্তির অধর প্রসারিত হয়।হাসছে সে।তবে আগের মতো প্রাণৌচ্ছ্বল নয় সেই হাসি।কেমন যেনো থমথমে।
–“হুহ।এতদিনে এই খবর জোগাড় করেছিস?আমার মন বলছিলো খারাপ কিছু হবে।কিন্তু এখন দেখি,মনের ভাবনা ভুল।এই বদ্ধ রুমে আর কয়দিন থাকবো বল তো!”
–“বেশি না।পরশু বাড়ি ফিরবি।”
–“তাই যেনো হয়।”
তৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস। এই দুদিন চাতক পাখির মতো সে আদ্রিনের প্রহর গুণেছে।মুখে স্বীকার করলেও তার হৃদয় এখনো আদ্রিনের মালেশিয়া যাওয়ার ব্যাপারটা মানছে না।যে দেশেই যাক না কেনো,ছেলেটা তাকে ঠিকই ফোন করতো।দিনে তিন চারবার না হলেও একটি বার ফোন করতো বা একটিবার মেসেজ দিতো সে।সমীকরণে বড্ড অমিল আজ।

দুইদিন ধরে মোবাইল হাতে নেয়নি তৃপ্তি।গায়ে শক্তি’ই ছিলো না।ধরবে কিভাবে!নিজ জান নিয়ে টানাটানি,
মোবাইল ধরার ফুরসৎ কই?

ধীরে চলছে আঙ্গুল।মোবাইলে তেমন একটা চার্জ নেই।তাও আদ্রিনের খোঁজে মেয়েটার মন উশখুশ করছে।তার মোবাইল হাতে নেওয়া লক্ষ্য করে চামেলী বিচলিত হয়।সাতপাঁচ না ভেবে এক প্রকার ছোঁ মেরে মোবাইল নেয়,
–“অসুস্থ তুই।রেস্ট কর।মোবাইলে কাজ কি?”

–“দাও না।রেখে দিবো।আদ্রিনকে একটা মেসেজ দিবো শুধু।”
তৃপ্তির কণ্ঠে আকুলতা।

চামেলী কিঞ্চিৎ ঘাবড়িয়ে।ফেসবুক সহ সকল সোশ্যাল মিডিয়াতে আদ্রিনের নিখোঁজের খবর ছড়িয়ে আছে।
–“ছেলেটা কাজে হয়তো।ফ্রি হলে নিজেই যোগাযোগ করবে।তুই ঘুমিয়ে পড় দেখি।”
চামেলী তৃপ্তির চুলে বিলি কাটে।

কড়া ঔষধের ডোজে বেশিক্ষণ টিকলো না তৃপ্তি।ভারী চোখ জোড়া বুঁজে গেলো মুহূর্তেই।
.
পরদিন এলো প্রিয় আর তার বাবা।তৃপ্তির ক্লান্তিভাব কমলো কিছুটা।বালিশে হেলান দিয়ে বসে রইলো সে।প্রিয় তার গা ঘেঁষে বসেছে।রুপম দেখা করেই সাথে সাথে চলে গেলো।আজকাল রুপম বাবার সাথে দোকান সামলাচ্ছে।নে’শার বি’ষাক্ত অভ্যাসটাও বদলাচ্ছে ছেলেটা।
অরিত্রন চট্টোপাধ্যায় মেয়ের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে।মেয়েটা শুকিয়ে গেলো কি এই তিনদিনে?অরিত্রনের ধারণা আদ্রিন নিখোঁজ নয়।এই কেবল ইনায়ার কাজ।ছেলেকে তৃপ্তি হতে দূরে রাখতে।এই বিষয়ে অবশ্য অখুশি অরিত্রন এমনটাও নয়।আদ্রিন তৃপ্তি হতে দূরে থাকায় মঙ্গল।ছেলেটা যদি এতো ভালোবাসতো তার মেয়েকে তাহলে ঠিকই ছুটে আসতো তৃপ্তির নিকট।কিন্তু এমনটা কিছুই তো হয়নি।তাই সিদ্ধান্ত নিলো,বন্ধু মেহরাবের দেওয়া প্রস্তাব নিয়ে ভাববে।আজই তার ছেলে মেহেরকে নিয়ে আসতে বলবে তৃপ্তিকে দেখে যেতে।যদিও আনুষ্ঠানিক কিছু নয়,তারপরও দেখা করুক তারা। তৃপ্তিও চিনুক,জানুক মেহেরকে।

–“এখন কেমন লাগছে তৃপ্তি?”
অরিত্রনের প্রশ্নে বাবার পানে চায় তৃপ্তি,
–“আছি।”
ছোট্ট জবাব দিয়ে আবারও ভাবলেশহীন মেয়েটা।কিছুতেই আদ্রিনের খেয়াল মস্তিষ্ক হতে মুচছে না।মন যেখানে আদ্রিনেই খু’ন,সেখানে মস্তিষ্ক কিভাবে সেই খু’নে দখলদারি করবে?

–“মেডিসিন নাও ঠিকভাবে।আগামীকাল তোমাকে ডিসচার্জ করবে।”
তৃপ্তি বাবার কথায় নিশ্চুপ।অরিত্রন আবারও বলে,
–“বিকালের দিকে মেহমান আসবে কিছু।খানিকটা পরিপাটি হও।”
তৃপ্তি পাল্টা প্রশ্নের সুযোগ পেলো না।অরিত্রন চললো।

প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চামেলীর দিকে তাকালে,মাথা নাড়ে সে,
–“আমি জানিনা কিছুই।দাদার কোনো বন্ধু হবে।এতো চিন্তা করছিস কেনো?”
–“এমনিতেই।আদ্রিনকে খুব মনে পড়ছে লাভি।সে ভালো আছে?”
চামেলী কথা ঘুরায়। তাড়া লাগায় ওষুধ খেতে,
–“আহা,দেখি ঔষধটুকু খেয়ে শেষ কর।”

তৃপ্তি ভাবনায় মশগুল।এখন পাশে মোবাইল দেখছে না।রিয়ানাকে কল দিয়ে আদ্রিনের খোঁজ পাওয়া যাবে সহজেই। তবে হদতন্ত তৃপ্তি।মোবাইল নেই।ক্যানেলার কারণে নড়াচড়া অসম্ভব।
–“আমার মোবাইল কই?”
–“অর্কের কাছে। চার্জে দেওয়ার জন্যে নিয়ে গেলো।মোবাইল বন্ধ ছিলো তোর।সে আসার সময় নিয়ে আসবে আবার।”
–“ওহ।দাদা কবে আসলো?”
–“তখন ঘুম ছিলি তুই।”

নিশ্চুপ তৃপ্তির মনে ব্যাকুলতা বাড়ে।কেবিনে টিভি আছে।অরিত্রন জানায় টিভি নষ্ট।এছাড়াও টিভি দেখার চাহিদা নেই তার।ক্লান্ত নজরে সে কেবিন জুড়ে বারংবার পর্যবেক্ষণ করছে। স্যাভলনের সুবাসে ভরপুর এই কক্ষ এখন তার নিকট অসহ্যকর ঠেকছে।

চামেলী বাহিরে গেলো কিছু কাজে।প্রিয় কেবিনে এটা সেটা করছে।এক পর্যায়ে টিভির নিকট গেলে দুর্বল গলায় হাঁক ছাড়ে তৃপ্তি,
–“কারেন্ট ধরে না।আমার কাছে আসো।টিভি নষ্ট।”

প্রিয় কথা শুনলো না।অবাধ্য বাচ্চার মতো টিভি চালু করলো।প্রথমেই ভেসে এলো নিউজ চ্যানেল,পরপর ভেসে এলো দুপুর বারোটার সংবাদের সুর। যার প্রধান সংবাদ চলছিলো… “জনপ্রিয় নেত্রী ইনায়ার ছেলে আহানান শেখ আদ্রিন নিখোঁজের তিনদিন হতে চললো।এখনো হাদীস মিলেনি তার।”
অবুঝ প্রিয় এতো সেতো না বুঝে রিমোট খুঁজে চ্যানেল চেঞ্জ করে।
তৃপ্তির পায়ের নিচে যেনো মাটি নেই।অস্ফুট স্বরে জোরেই চিৎকার করে,
–“আমার আদ্রিন!”
পরক্ষণে মূর্ছা যায় সে।
৫২.
মেজাজ সপ্তম আকাশে আদ্রিনের।তার তীব্র রাগে রুমের আসবাব পত্রের অবস্থা করুণ।তন্ময়ের মাথা নিচু।তৃপ্তির অবস্থার কথা মাত্রই জেনেছে আদ্রিন।সে এবং তন্ময় দুইদিন একেবারে সকল কিছুর আড়ালে ছিলো।স্বয়ং ইনায়া যে ছিলো এইখানে।যদিও বাহিরে যেতো, তখন তার বিশ্বস্ত কর্মীকে রেখে যেতো এইখানে। যার দরুণ আদ্রিন এবং তন্ময় কেবল নাটক করে গেলো।কিন্তু,আজ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে প্রধানের হাতে আদ্রিনকে ছেড়ে বিশ্বস্ত কর্মী সহ বিদায় নিলো আচমকা।সঙ্গে সঙ্গে তৃপ্তির খোঁজ লাগায় আদ্রিন।খোঁজ পেয়েই মাত্রারিক্ত রাগে ভস্ম হচ্ছে সবকিছু।

তিরিক্ষি মেজাজে আদ্রিন প্রশ্ন করে প্রধানকে,
–“আম্মি কবে আসবে বলেছে?”
–“আর আসবে না বললো।যা বুঝার ম্যাডাম বুঝেছে,এমনটা ইঙ্গিত দিলো আমাকে।”
প্রধান বলে।

–“তন্ময়,বেশভূষা চেঞ্জ করো।তৃপ্তির কেবিনের সামনে থাকো অন্য পেশেন্টের আত্মীয় হিসেবে।আপডেট চাই সবকিছুর।”
কপালে আঙ্গুল ঘষে নির্দেশ দেয় আদ্রিন।

তন্ময় মাথা নাড়ায়।দ্রুত সে প্রধানের দেখানো কক্ষে যায়।

অন্যদিকে বিছানায় বসে ছক কষছে আদ্রিন।তৃপ্তির সাথে দেখা করার চাহিদা তার সর্বাঙ্গে।মেয়েটাকে দেখেনি তিনদিন।অথচ মনে হচ্ছে তিনটা বছর কেটে গেলো!এক পর্যায়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে।বিরবিরিয়ে বলে,
–“কবে রাত আসবে? আই ওয়ানা সি ইউ,কিস ইউ;মেহেবুবা।”

তন্ময় হাসপাতালে পৌঁছে।ঠিক যেনো বৃদ্ধ লোক সে।তৃপ্তির কেবিন নাম্বার ২০১।এর সামনে দুই ধারে সিট পাতানো।সেখানে বসা আছে হরেক কেবিনের আত্মীয়রা।তন্ময় সুযোগ বুঝে একটা সিটে বসে পড়ে।
একটা জিনিসে টনক নড়ে তার।২০১নাম্বার কেবিন হতে ভেসে আসছে সুর।কান্নার সুর।তৃপ্তির কণ্ঠ।একাধারে সেই সুরের তীব্রতা বাড়ছে,
–“আদ্রিন,আপনি কোথায়?”
.
–“এইসব কি তৃপ্তি?যে ছেলে মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে তোমার সাথে চালাকি করছে নিখোঁজ হওয়ার।তার জন্যে শরীরের এমন দুরবস্থা করছো?ডাক্তার মাত্রই বললো প্রেসার আবারও লো তোমার।তিনদিনে নিয়ন্ত্রণে এসেছিল সব।”
অরিত্রন চিন্তিত সুরে বলে।
–“আদ্রিনকে এনে দাও,বাবা।উনাকে আমি দেখতে চাই।”
তৃপ্তির কান্না মাখা কণ্ঠ।
–“আসবে না সে।মায়ের মতো নাট্যকার।মেহের আর ওর বাবা এসেছে নিচে।আমি নিয়ে আসছি এদের।কোনো রকম বেয়াদপি করবে না।”
অরিত্রন বেরিয়ে যায়। সাথে নিয়ে যায় অর্কের দেওয়া তৃপ্তির মুঠোফোন।

তৃপ্তি মাথা ঘামায় না এইসবে।তার মস্তিষ্ক কেবল আদ্রিনের চিন্তায় ব্যস্ত।

তন্ময় বিচলিত অরিত্রনকে দেখে ‌কেবিন হতে বেরুতে।আবারও মিনিট দশেক পর দেখে ফিরতে।সাথে আরো দুজন লোক। একজন ছেলে জোয়ান।অরিত্রন আর বাকি দুজন কেবিনের সামনে থামে।অরিত্রন সাধুবেশে বললো,
–“কিছু মনে করবে না।অপেক্ষা করিয়েছি তোমাদের।আসলে আমার মেয়েটার শরীর আবারও হুট করে খারাপ হলো।”
–“সমস্যা নেই।আমি আসতে নিষেধ করেছি মেহেরকে।কিন্তু মেহের নারাজ।সে তৃপ্তিকে দেখতে চাইছিলো।অসুস্থ অবস্থায় কদর করাটা বেশি জরুরি।”
একগাল হাসে ভদ্রলোক।তৃপ্তির বাবাও হাসে।লাজুক ভঙ্গিতে জোয়ান ছেলেটা দাঁড়িয়ে।

–“তৃপ্তি রিয়েক্ট করতে পারে তোমাদের দেখে।অসুস্থ সে,কিছু বুঝবে না এখন।”
অরিত্রনের কথায় মেহের বলে,
–“ইটস ওকে, আঙ্কেল।”
অতঃপর তিনজন ভেতরে যায়।

তন্ময়ের নড়চড় নেই।এক প্রকার ছেলে পক্ষ দেখতে এসেছে তৃপ্তিকে।সময় নষ্ট করে না।রোবটের ভঙ্গিতে সে ফোন করে আদ্রিনকে।একে একে সবটা জানায়।

ফোন রেখে পুনরায় সে দরজার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।মিনিট দুয়েক পরে ধীরে হেঁটে কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়ায়।ভেতরের কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।চিল্লিয়ে বললে হয়তো তার বসার জায়গা থেকে শোনা যেতো।যতটুক কথা তার কানে এলো, সে বুঝলো; নার্সের কড়া ইনজেকশনে তৃপ্তি ঘুমিয়ে।আর বাকি সকল বেশ হাসিখুশি।বিয়েটা হয়তো পাকা করছে।
সিটে গিয়ে আবারও বসে তন্ময়।সব খবর ওপারে চালান করা হয়েছে।অনাগত ঝড়ের আভাস পাচ্ছে তন্ময়। এইবার সব ধ্বংস করবে স্বয়ং তার স্যার।আদ্রিন।
৫৩.
রাতের আঁধারে সোডিয়াম আলোতে আলোকিত রাস্তাঘাট। বিশ তলা বিশিষ্ট হাসপাতালের বাহিরের দিকে লাইটে ঝলমলে।বেশিরভাগ কেবিনের লাইট জ্বলছে।আবার কিছু কেবিনের লাইট বন্ধ।জানালা কিছু খোলা আবার কিছু জানালায় তিমির ছেয়ে।আদ্রিন গাড়ি থেকে নামে।কালো রঙের শার্টের বটে থাকা হাত ঠিক করে।ফুল স্লিভ শার্ট তার।মুখের ভাবভঙ্গি ভিন্ন।বাতাসের গতিতে তার পদচারণ।
এখন মধ্যরাত।তাই মানুষের আনাগোনা কিঞ্চিৎ কম।তবে মানুষের উপস্থিতি আছে।হলুদ রঙ্গা লাইটের আস্তরণ ভেদ করে আদ্রিন ভেতরে যায়।মুখে মাস্ক,মাথায় ক্যাপ।এইভাবেই সকলে তার নিখোঁজের খবর জানে।তিনদিন ধরে সে টপ নিউজে আছে।

‌তন্ময়কে তার আসার সংবাদ জানালে,তন্ময় তার ঠিক করা নার্সকে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করার নির্দেশ দেয়।
নার্স প্রথমে রাজী হয়নি।কিন্তু,তন্ময় জানায়; তৃপ্তির বিয়ে দিচ্ছে তার পরিবার জোর করে।তাই তৃপ্তির প্রেমিক তার প্রিয়তমাকে উদ্ধার করতে এসেছে।নার্স সায় দেয় তন্ময়ের কথা।ঠিকই মেয়েটা দেখেছে,তৃপ্তিকে তার বাবা বকেছে, জোর করেছে অত্র ছেলের সাথে সাক্ষাতে।এর কারণেই তো মেয়েটার অবস্থা আরো বেগতিক হলো, ইনজেকশনের দরকার পড়লো!নার্সের মন গলে।তন্ময়কে সে বলে,
–“ঠিকাছে।সাহায্য করবো আমি। তবে দায়ভার সব আপনাদের নিতে হবে।”
–“আপনার চাকরির গ্যারান্টি আমার স্যারের কাছে।আপনি নির্ভয়ে সাহায্য করুন।স্যারের ভালোবাসা তার হাতে তুলে দিলে আপনাকে আরো ভালো পুরস্কার দিবে স্যার।”
তন্ময় জবাব দেয়।

আদ্রিন সরাসরি তৃপ্তির ডাক্তারের সাথে কথা বলে।নিজের পরিচয় দেয়। নার্সের সাহায্যের জন্যে অর্ডার করে।ডাক্তার ব্যাপারটা বুঝেও প্রথমে মানেনি। পরে আদ্রিন হুঁশ খুয়ে রিভলভার তাক করলেই রাজি হয় ডাক্তার।ইনায়ার ছেলের চেহারা দেখে আবার পায়ে ধরে ক্ষমা চায়।যে ছেলে নিখোঁজ তিনদিন ধরে সে ছেলে এইখানে হাসপাতালে কিভাবে এলো,ডাক্তার বুঝলো না।আর না করলো কোনো প্রশ্ন।
ডাক্তার নিশ্চুপ থাকায় আদ্রিন কেবল ঠান্ডা হুমকি দেয়,
–“আমি শুধু আমার মেহেবুবাকে নিতে চাই আমার রাজ্যে।ডোন্ট ফোর্স মি টু অ্যাটাক ইউ!আর এই ব্যাপারে একদম চুপ।মুখ খুললে আমি বেশামাল হবো।সামলাতে পারবেন না।”
ডাক্তার তার কথায় তাল মেলায়।কথার খেলাফ করলে সামনের বিপদ রেখা আরো প্রখর হবে একশত পার্সেন্ট।

নার্স কেবিনে গিয়ে চামেলীর উদ্দেশ্যে বলে,
–“ম্যাডাম,আপনাকে স্যার ডেকেছে।”
–“এতরাতে?”
–“জ্বী।”
চামেলী উঠে পড়ে নার্সের কথায়।

ততক্ষণে ডিসচার্জ পেপারে সাইন করেছে আদ্রিন।চামেলী বের হতেই আদ্রিন কেবিনে যায়।নিভু সাদা রঙের আলো কেবিনে।বুকটা কেমন অস্থির।মেয়েটা সাদা কম্বলের নিচে।মুখমন্ডল তার ফোলা।হাতের ক্যানেলে স্যালাইন শেষ হবার পথে।ধীরপায়ে আদ্রিন যায় তৃপ্তির নিকট।আরেকটু কাছাকাছি যায় সে মেয়েটার।চোখের একপাশে অশ্রুজলের ছাপ এখনো বিদ্যমান।বুড়ো আংগুল ছুঁয়ে দেয় সেথায়।আঁখি জোড়া নড়লো,কিন্তু খুললো না।অধর জোড়া কাঁপলো।অস্ফুট স্বরে সে ডাকলো তৃপ্তিকে কয়েকবার। হুঁশ নেই তার।

নার্স আসে।নতুন স্যালাইন লাগায়।আদ্রিন গায়ের চাদর সরায় তৃপ্তির। মোটা আস্তরণ করতেই শীতে কেমন গুটিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা।আদ্রিন দ্রুত তাকে কোলে তুলে নেয়।উষ্ণতা পেয়ে মেয়েটা শান্ত।নার্স স্যালাইন ধরে আদ্রিনের পিছে হাঁটছে।

তন্ময় গেইটের সামনে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায়।

আদ্রিনদের আসতে দেখে ড্রাইভিং সিট থেকে বেরিয়ে এলো।পেছনের দরজা খুলতেই তৃপ্তিকে কোলে নেওয়া অবস্থায় বসে পড়ে আদ্রিন।তন্ময় সেলাইন সেট করে গাড়িতে। প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র নেয়।

গাড়ি চলতে আরম্ভ করতেই আদ্রিন ফোন করে চামেলীকে,
–“তৃপ্তি আমার কাছে।অরিত্রন চট্টোপাধ্যায় তার ব্যাবহারের জন্যে ভুগবে।সত্যি ভুগবে।নার্স,ডাক্তার কারো দোষ নেই।আমার হবু ফ্যামিলিকে আমি নিয়ে যাচ্ছি।এটাই কেবল আমার দোষ।”
চামেলী নির্বাক।কিছুই বলেনি সে আদ্রিনকে।এতটুক বুঝলো,এই আদ্রিন নামের ছেলেটা বেশ কঠিন ব্যক্তিক্ত্বের।না জানে এখন সে কি করে অরিত্রন চট্টোপাধ্যায়কে।সামনে কি বিরাট যুদ্ধ হবে?অরিত্রন চট্টোপাধ্যায়কেই বা কি জবাব দিবে সে?আপাতত চুপ করে থাকাটাই কি শ্রেয় নয়?
——
শহর থেকে দূরে ছুটছে গাড়ি। সিম খুলে ফেলে দিয়েছে আদ্রিন।কেমন গ্রামীণ পরিবেশ।চারিদিকে কেবল গাছপালা।চাঁদের আলোয় রাতটাও সুন্দর।ঘড়ির কাঁটা সাড়ে তিনটা পার করেছে।তৃপ্তির জন্যে এসি বন্ধ।কিন্তু ঘামে চুপসে আছে আদ্রিন।ঘাড়ের দুদিকে সমান্তরালে ঘাম ঝরছে তার। হসপিটালের পোশাকটা বেশ ঢোলা এবং পাতলা।তৃপ্তি সোজা হয়ে তার কোলে শুতেই বুকের আকর্ষণীয় অংশ দৃশ্যমান হয়।মেজাজ বিগড়ে যায় তার।দামী হাসপাতালে কি আরো ভালো মানের কাপড় দেওয়া উচিত নয়?
আদ্রিন চেয়ে থাকে তার মুখশ্রীর পানে।চুলগুলো বুকের উপর রাখে।নার্স বলেছিল কড়া ঔষধে ঘুম সে।যেকোনো মুহূর্তে ভাঙতে পারে।তৃপ্তির শুভ্র গলায় হাত বুলায় সে।শরীর এখনো গরম।

অরিত্রন চট্টোপাধ্যায়ের কথা মনে আসতেই হাত গুটিয়ে নেয় আদ্রিন।পরক্ষণে তৃপ্তিকে সাবধানে চেপে ধরে নিজ বক্ষ মাঝারে।ক্যানেল লাগানো হাতটা সযত্নে ধরা আছে।

তন্ময়ের বন্ধুর বাড়িতে তারা।সেমি পাকা ঘর।নির্দিষ্ট এক রুম আদ্রিন এবং তৃপ্তির জন্যে বরাদ্দ করেছে সেই বাড়ির মানুষ।তন্ময় আগেই সবটা জানিয়েছে তাদের।
হালকা খাবার শেষে সকলে যারযার রুমে যায়।
আদ্রিন শার্ট খুলে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে।এসির অভাবে ছেলেটা গরমে অতিষ্ট।ফ্যানের স্পিড কম তৃপ্তির কারণে।
মাথায় তার পরিকল্পনা,ঠিক কি করবে সে অরিত্রনকে।তাকে দেখে রাখতে বলেছিলো তৃপ্তিকে,অন্যের সাথে বিয়ে দিতে নয়।কপালের রগ দৃশ্যমান হয় তার।জানালার গ্রিল শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে পুনরায়।

–“আহ,লাভি!”
দুঃখ ভরা কণ্ঠ তৃপ্তির।

হতদন্ত পায়ে ছুটে যায় আদ্রিন,
–“তৃপ?কি হলো?”
–“লাভি, ঐ ছেলে আমার এইখানে কেনো? সরতে বলো প্লিজ।আমি কোনো ছেলের সামনে থাকবো না।”
বড্ড দুর্বল তৃপ্তির কণ্ঠ।
–“এই মেয়ে,আমি আদ্রিন।চোখ খুলো জান।”
আদ্রিনের কথা নিজ কানে অবিশ্বাস্য ঠেকলো তৃপ্তির।আঁখি জোড়া মেলতেই উদোম শরীরের চিন্তিত মুখ দেখে কেঁদে দিলো মেয়েটা,
–“আপনি কোথায় ছিলেন?জানেন,কেউ আমাকে কিছুই বলেনি আপনার নিখোঁজের ব্যাপারে।আর বাবা,বাবা তো আমার জন্যে অন্য ছেলে…আমি ম’রে যাবো আপনাকে ছাড়া।”

আদ্রিন ঝুঁকে জড়িয়ে ধরে তৃপ্তিকে। হাত ছুঁয়ে যায় জামার আড়ালে।অধর স্পর্শ করে তৃপ্তির মোলায়েম গলায়, গালে,ললাটে।
–“কাঁদে না, তৃপ।তুমি অসুস্থ।ডাক্তার বলেছে কান্না করলে বা স্ট্রেস নিলে আবারও সমস্যা হবে তোমার।এই মেয়ে,আমি আছি তো। কাঁদে না মেহেবুবা।আমি ফেলনা নয়।কেউ আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবে।”

আদ্রিনের ভারী শরীরে নিচে অদ্ভুত অনুভূতি হয় তৃপ্তির।তার উদোম পিঠে হাত রাখতেই আলাদা শিহরণ জাগে তনুয়।চুপটি করে কান্না দমানোর চেষ্টায় সে।

–“তোমার বাবা কাজটা ঠিক করেনি।আমি উনাকে ভদ্র ভাষায় বুঝিয়েছিলাম।কিন্তু উনি বুঝেনি।অভদ্র আদ্রিনকে দেখাটা উনার জন্যে এখন জরুরি,ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট।”
আদ্রিনের কণ্ঠস্বর অন্যরকম।ঠিক যেনো ধাঁধায় মুড়ানো।
–“আপনি…আপনি কি করবেন?বাবার ভুল হয়েছে।আর করবে না উনি এমনটা।”
তৃপ্তির চিন্তিত কণ্ঠ।

–“আমি আর সুযোগ দিলে তবেই তো করবে?তোমার থেকে আলাদা করতে চেয়েছে আমাকে। তাও ছেলেপক্ষ এনে।তোমার বাবা আমার কথার খেলাফ করেছে।আর এর কোনো ক্ষমা নেই।আমার আম্মি আর তোমার বাবা দুইজনই অপরাধী।কি করা যায় এদের সাথে বলো তো?”
আদ্রিন তৃপ্তির গলায় মুখ গুঁজে জবাব দেয়।
–“প্লিজ,আপনি বাবার সাথে কিছুই করবেন না।আপনার আম্মির সাথে আপনি কথা বলুন। আমার বাবাকে এইসবের মাঝে আনবেন না।আপনি কি পাগল হচ্ছেন?”

আদ্রিন মাথা তুলে তৃপ্তির গলা হতে,
–“আমি পাগল।সেটা তুমি আগে থেকেই জানো।তোমার বাবার জানা উচিত, আদ্রিন কথার খেলাফ মানুষদের সাথে কি করে।আমার ভয়ংকর রূপটা কেনো যে আমার হবু শ্বশুর মশায় আর তোমার হবু শাশুড়ি দেখার আশা করেছেন!কিজানি?”
#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব -২৪
_____________________
৫৪.
–“আমার বাবাকে কিছু করবেন না দয়া করে। ভোর হতে চললো।আপনি এমন রাগী বেশে কোথায় যাচ্ছেন?প্লিজ,আমার কথাটা বুঝুন।আমার বাবার কোনো ক্ষতি যেনো না হয়,আদ্রিন।”
একপ্রকার বিলাপ করছে তৃপ্তি।
আদ্রিন ভাবলেশহীন তৃপ্তির হাতে বিদ্যমান ক্যানেলা খুলছে।পূর্বের মতো একাধারে আবারও নানান প্রলাপ বকতে শুরু করে সে।যদিও সত্যি আদ্রিন বের হতে নিচ্ছিলো,তৃপ্তির ক্যানেলা খুলে।তবে,তৃপ্তি জেগে যায়।বাহিরে এখন ঝাপসা আলো।নির্ঘুম রাত অতিবাহিত করার দরুণ আদ্রিনের আঁখি র’ক্তিম।তার ভেতরকার আ’ক্রো’শ কিছুতেই কমছে না।সে বের হচ্ছিলোই অরিত্রনকে শাস্তি দিতে।অথচ তার মেয়েই আদ্রিনকে অনুরোধ করছে,আকুতি করছে।

তৃপ্তির গালে আদ্রিন হাত রাখতেই সে হাত চেপে ধরে আদ্রিনের। অসহায় দৃষ্টিতে তার পানে চায়।
আদ্রিনের মুখভঙ্গি অন্যরকম,অনেকটা অচেনা।

–“আমার কিছুই করার নেই।আমার আর তোমার মাঝে যে আসবে তাকে আমি ছাড়বো না। আম্মি আর তোমার বাবা পাপ করেছে আমাদের মাঝে এসে।”
গুরুগম্ভীর স্বর আদ্রিনের।

–“এইসব কেমন কথা?আমাদের বাবা মা উনারা।মনোমালিন্যের কারণে আমাদের সম্পর্ক তাদের কাছে মানানসই নয়।কিন্তু,আমরা চাইলে সব ঠিক করতে পারি।”
তৃপ্তির করুণ সুর।
–“আমি পারবো না আর মানাতে।অনেক সহ্য করেছি।তোমাকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার পাপ করেছে তোমার বাবা।এর শাস্তি আমি দিবো উনাকে।”
দুইহাত পেছনে ঠেকে বিছানায় বসলো আদ্রিন।

–“আপনি কেনো পাগলামি করছেন?”
তৃপ্তির কম্পিত শব্দ।

আদ্রিন তার পানে করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।কেমন হিং’স্রতা সেই দৃষ্টিতে।যেনো তাণ্ডব চালাতে বেশ দক্ষ তার এমন চাহনী।
–“পাগলামি’ই শ্রেয়।ধরো,আমি আসিনি কালকে।আর তোমার অজ্ঞান থাকা অবস্থায় তোমার বাবা তোমাকে অন্যজনের সাথে বিয়ে দিলো।তখন কি হতো?বেশ খুশি হতে?কিন্তু তখন আবার আমার নাম খুনীর খাতায় লিখতে হতো।তোমাকে পাওয়ার জন্যে।”
আদ্রিন তার পরনে শার্ট পুনরায় খুলে।তার মন হুট করেই অন্যদিকে ধাবিত হয়।

–“পাগল।আপনি সত্যিই পাগল।এই মুহূর্তে আমার আপনাকে পাগল ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না।আমার বাবা আমার অনুমতি ছাড়া কিছুই করতো না। কখনোই না।”
ধীরে ধীরে তৃপ্তির মন শক্ত হচ্ছে যেনো।

–“আমার বিষয় না এইসব।তোমাকে আমি দুটো অপশন দিচ্ছি।এক. হয় তোমার বাবার শাস্তি পেতে হবে,তাও ভয়ংকর।দুই. এইযে আজ সকাল নয়টায় কাজী অফিস খুলবে।তখন তোমাকে বিয়ে করবো আমি।এখন বলো।কোনটা পছন্দ তোমার?”

খাটে গা এলিয়ে দেয় আদ্রিন।তার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে,অপশন দুটো তার জন্যে কিছুই না,একেবারে নগণ্য।

তৃপ্তির শঙ্কিত।কি বলে এই লোক ! বিয়ে ছেলেখেলা?

–“একটা অপশনও আমার পছন্দ হয়নি।আপনি কিসব বলছেন?বাবার অনুমতি ছাড়া বিয়ে?আমি পারবো না।”
আঁখি ভারী হয় তৃপ্তির।কি করবে কিছুই আয়ত্বে আসছে না।
–“বাবার ক্ষতি চাও না,এর মানে সেকেন্ড অপশন তোমার জন্যে পারফেক্ট।ওকে,আজকেই আমার বউ হতে তৈরি হও।”
–“জীবনেও না।আপনি কিভাবে পারছেন আমাকে এত ক’ষ্ট দিতে?”
অশ্রুর বাঁধ ভাঙলো তৃপ্তির। এতে আদ্রিনের আরো জিদ চাপে,
–“কাঁদছিস কেনো?বিয়ে করতে মন চায় না আমাকে?ওহহ!আমি পাগল,আমি পাগলামি করি,তাই আমাকে অসহ্য লাগে তোর?”
কাঁধের দিকে চিনচিন ব্যথার আবির্ভাব ঘটে তৃপ্তির,
–“ব্যথা পাচ্ছি,আদ্রিন।”

সাথে সাথে হাত সরিয়ে নেয় আদ্রিন।মেয়েটার মুখ ফোলা।আঁখি নেতিয়ে। কেমন অসহায় দেখাচ্ছে সাথে মায়াময়।নিজ চুলের গোছা শক্ত হাতে চেপে ধরে সে।দু’বার চিৎকার দিয়ে সজোরে হাত দ্বারা আঘাত করে সে দেওয়ালে।

–“থামুন প্লিজ।”
তৃপ্তির কণ্ঠে হাহাকার।

–“থামবো। তোকে বিয়ে করে।অনেক সহ্য করেছি,সবটা সহ্য করেছি,অনেক সময় দিয়েছি।আর না।আমি পারবো না আর কিছু টলেরেট করতে।”
আদ্রিন হুড়মুড়িয়ে বেরুতে নিলে তৃপ্তি অসহায় কণ্ঠে বলে,
–“আমার বাবাকে অনেক বছর পর ফিরে পেয়েছি।মায়ের শোকে বাবা এমনিও জর্জরিত।বাবাকে না বুঝে আমি এতো বছর কষ্ট দিয়েছি।আমি যদি বাবাকে না জানিয়ে বিয়ে করি,বাবা খুব কষ্ট পাবে আদ্রিন।অসুস্থ বাবাকে আমি আর কিভাবে কষ্ট দিই? পাপ হবে আমার।আমার বাবা বলেছিল,আন্টি আমাদের বাসায় এলে বাবা রাজি হবে।আপনি আন্টিকে রাজি করাবেন প্লিজ?”

আদ্রিন থামে।প্রিয়তমার ব্যথিত সুরে তার হৃদয় ছারখার। তবে,ভেতরকার হিং’স্র সত্তা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না তার।একটাই কথা তার মস্তিষ্কে ভাসছে,অরিত্রন চট্টোপাধ্যায় তার সাথে বেঈমানি করেছে। এর ক্ষমা নেই।পেছন না ফিরে আদ্রিন আওড়ায়,
–“আমাকে তোমার বাবা ধোঁকা দিয়েছে। ধোঁকার শাস্তির মাফ নেই আমার কাছে।”
কঠোর আদ্রিনকে দেখে তৃপ্তির অবাকের শেষ নেই।ছেলেটা সত্যি উন্মাদ।নাহলে সে কতবড় কান্ড ঘটাতে যাচ্ছে তার কি কোনো খবর নেই?
আদ্রিন ফের চলে যাওয়ার জন্যে উদ্যত হতেই তৃপ্তি বেশ জোর গলায় বললো,
–“মায়ের থেকে ধোঁকা পাওয়ার পর,আমার থেকে ধোঁকা পেলে;আমার বাবা বাঁচবে না।আমি বাবার সাথে হাসিখুশি ভাবে সারাজীবন থাকতে চাই।আমার বাবার সাথে সুখী হতে আমাকে সাহায্য করবেন,আদ্রিন?”
থমকালো আদ্রিন। ঘাড় বাঁকিয়ে পেছন ফিরে।দুহাতে মুখ ঢেকে তৃপ্তি হুহু করে কাঁদছে।

তার কান্নার ঝঙ্কারে আদ্রিনের উম্মাদনা যেনো তলিয়ে যাচ্ছে অতল গহ্বরে।দ্রুত পা ফেলে তৃপ্তিকে নিজ বাহুডোরে আটকে নেয় সে,
–“ঠিকাছে।করবো না কিছু।এইভাবে কান্না করো না।তুমি সিক,জান।”

অথচ তৃপ্তি থামে না। প্রিয়তমের বাহুডোরে আটকে একে একে বলতে থাকে,
–“যেদিন হাসপাতালে প্রথম ভর্তি হয়েছি,সেদিন বাবা আমার পাশে ছিল সারারাত।একে একে মায়ের দেওয়া ধোঁকার কথা বলছিলো বাবা।ভেবেছিল আমি ঘুম।কিন্তু, আমি ঘুম ছিলাম না।শুরু থেকে শেষ সবটা শুনেছি।”
কিছুক্ষণ ফোঁপায় সে।আদ্রিন সযত্নে শুনছে সবটা,তার পিঠে আলতো স্পর্শ করে ভরসার যোগান দিচ্ছে।

আবারো তৃপ্তি বলতে আরম্ভ করে,
–“বাবা,মায়ের জন্যে ধর্ম ত্যাগ করে।কিন্তু মা,সেই সেক্রিফাইসের দাম দেয়নি।মা মারা যাওয়ার চার বছর আগে থেকে তার অন্য লোকের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠে।ইনায়া আন্টি,মা সবাই একসাথেই বিভিন্ন ক্লাবে যেতো।তাই ইনায়া আন্টি সব জানতো।এই কারণেই আমাকে পছন্দ করে না আন্টি। বাবাও জেনে যায় সব,কিন্তু তাও মাকে ছাড়েনি বাবা।অনেক সময়ে এইসবের উন্নতি না হলে নিজ ধর্ম ত্যাগের কারণে এমন অশান্তি হচ্ছে ভেবে, বাবা আবারও হিন্দু ধর্মে ফিরে যায়।বাবা চেয়েছিল তার সংসারে কেবল শান্তি থাকুক।কিন্তু,মা এর সুযোগ কাজে লাগায়,আর আলাদা হয়ে যায় আমাদের নিয়ে।তবে বাবা দমেনি।আমাদের সাথেই ছিলো সর্বক্ষণ।মা,একসময় নানান লোকের সাথে ইনভলভ হয়ে পড়ে।এক পর্যায়ে ক্লাবে উপস্থিত কিছু লোক মায়ের নোংরা ভিডিও ধারণ করে,সেটা বাবাকে এবং মিডিয়ায় ছাড়বে বলে মাকে নির্যাতন করে প্রচুর।অনেক টাকাও নেয়।এরপর মা গায়েব হয়ে যায় হুট করেই।বাবা খোঁজ নেয়,তার কাছে যায়।এতকিছুর পরেও বাবার ভালোবাসা দেখে মা নিজেকে সামলাতে পারেনি।কিছুদিন বাবার সাথে আগের মতো থাকে ঐ ঠিকানায়।অতঃপর একদিন রাতে মা সুইসাইড করে নিজের পাপের জন্যে অনুশোচনায় ভুগে।বাবাকে দেওয়া ধোঁকা মায়ের সহ্য হচ্ছিলো না।পুলিশ সুইসাইড নোট এবং পোস্টমর্টেম করে ঘটনার সত্যতা জানে। বাবাকে আর বিরক্ত করেনি তাই পুলিশ।অথচ আমি বাবাকে কষ্ট দিয়েছি।বারবার অপমান করেছি।আমি ভালো মেয়ে না আদ্রিন।এখন যদি আপনি বাবাকে কষ্ট দেন আমি সহ্য করতে পারবোনা সেটা।আর না পারবো বিনা অনুমতিতে বিয়ে করে বাবাকে কষ্ট দেওয়া।আপনি আমাকে বুঝবেন প্লিজ।সেদিন বাবা আমাকে অর্ধেক কাহিনী বললে,পরে আমি দিদা থেকে সব কাহিনী জেনেছি।আমার বাবা খুব কষ্টে আছে।”

আদ্রিনের বুকে বিরাট পাথর।সে কি করতে যাচ্ছিলো?কষ্টে জর্জরিত মানুষটাকে আরো কষ্ট দিয়ে নিঃশেষ করতে যাচ্ছিলো!তৃপ্তি শান্ত নেই।কেমন আহাজারি করছে সে।আদ্রিন তার কোমর চেপে নিজ উরুতে বসায় তৃপ্তিকে।
মুখে লেপ্টে থাকা চুল সরিয়ে ভেজা গালে অধর ছোঁয়ায় সে,
–“আচ্ছা বুঝেছি।ভয় পায় না।আমি কিছুই করবো না।ঘুমাও এখন।আমি বাসায় যায়।আজ সন্ধ্যায় আমি মাকে নিয়ে আসবো। রাতও হতে পারে।তোমার ঘুম শেষে তন্ময় তোমাকে দিয়ে আসবে বাসায়।”
তৃপ্তি কথা বলে না।কিন্তু,আবারও ঝাপটে ধরে আদ্রিনকে।শক্ত করে লেপ্টে যায় তার বিপরীতে থাকা চওড়া বুকের মানুষটার সাথে,
–“আপনি দিয়ে আসুন আমাকে বাসায়।এইখানে থাকবো না।আমি আপনার সাথে যাবো।”

হিং’স্র ছেলেটা এখন হাসছে।কি অমায়িক লাগছে তাকে!অথচ খানিক পূর্বে সে মানুষ খু’ন করার রূপ ধারণ করেছিলো।

তৃপ্তি হাত মুখ ধুয়ে নেয়।ওড়না গলায় মেলে আদ্রিনের ধারে যায়।অবাক চোখে তাকিয়ে আদ্রিন তৃপ্তির পানে।মেয়েটার মুখশ্রী তাকে টানছে। মেয়েটার মুখে শত মায়া।নাকের দাগটাও কেমন আকর্ষণীয়। ঘোর লেগে যায় আদ্রিনের।অতঃপর মেয়েটাকে নিজের পানে টেনে নেয়,পরপর অধর ছুঁয়ে দেয় মেয়েটার গলার ভাঁজে,
কম্পিত আঁখিতে,লজ্জিত দু’গালে,
–“বিয়ের তারিখ পড়বে দ্রুত।আর কন্ট্রোল হয় না,তৃপ।অপেক্ষা করবে আমার।আসবো আজ বিয়ের তারিখ ফাইনাল করতে।”

৫৫.
তৃপ্তিকে বাড়ি পৌঁছিয়ে গাড়িতেই ঘুমায় আদ্রিন।বাসায় পৌঁছে জানে,মা নেই বাড়িতে।আদ্রিনকে দেখে বাড়ির সবাই ইনায়াকে ফোন করে।তৎক্ষণাৎ ইনায়া প্রেসের সামনে এসে ছেলে আসার সুখবর জানানোর মিথ্যা নাটক করে।এবং পরক্ষণে বাড়ির উদ্দেশ্য বেরুয়।ছেলের সাথে অনেক হিসাব বাকি তার।মায়ের সাথে বাটপারির সকল উত্তর দিতে হবে আজ তাকে।
ইনায়া আসে দুপুর বেলা।আদ্রিন তখনো ঘুমে।রিয়ানা এবং সাফাও আছে।আদ্রিন এসেছে জেনে তারা আর অপেক্ষা করলো না।
রাগান্বিত ইনায়া সজোরে আঘাত করে দরজায়। আদ্রিনের হেরফের নেই।সে মায়ের কণ্ঠ শুনে আবারও গায়ে কম্বল টেনে নেয়।সে নিজের সময় বুঝে বের হবে কামরা হতে।তবে, তার পরিকল্পনায় বিপাক ঘটে রিয়ানার বুলিতে।তার ডাকডাকিতে উঠে দরজা খুলে।রিয়ানা হাসিমুখে বলে,
–“সবার সাথে খাবি।আয়।”
–“আম্মি আছে?”
দু হাত উপরে তুলে ঝিমানো দূর করে,আদ্রিন।রিয়ানা ভাইয়ের পেটানো শরীরের দিকে নজর বুলিয়ে হাসে,
–“দিনদিন শরীরটাকে এমন শক্তিশালী বানাচ্ছিস কেনো?লড়াই করবি?”
–“হুম,করবো।কথার উত্তর দাও না কেনো?”
আদ্রিন বিরক্ত দেখায়।

–“আছে।সবাই আছে ডাইনিংয়ে।মানা করবি না।সাফা তোর জন্যে না খেয়ে বসে আছে।”
–“কেনো?সাফা আমার হাতে খায়?”
পাল্টা প্রশ্ন শুনে হতবাক রিয়ানা,
–“নাহ।তোর চেহারা দেখে খাবে।আয় না ভাই।”
–“আসছি।”
সাদা রঙের টিশার্ট গায়ে চেপে রুম থেকে বেরোয় আদ্রিন।শান্তভাবে খাওয়া শেষ করে সকলের সাথে।ইনায়া কিছু বলতে নিলে তার শাশুড়ি কথাটা সেখানেই দমিয়ে ফেলে।

নিয়ম মতো সকলেই বসার ঘরে বসে।কাজের লোকেরা ফলমূল আর সেগুলোর সাথে ছুরি রেখে যাচ্ছে সকলের সামনে। যার যতটুক দরকার কেটে খাচ্ছে।
অনেক্ষণ চুপ থেকে আদ্রিন মুখ খুললো,
–“আমি চাই তৃপ্তির বাসায় প্রস্তাব পাঠানো হোক।ওকে আমি বিয়ে করতে চাই।তাও দ্রুত।”

–“সব কিছুতেই তুমি জোর দেখাও। জোর দেখিয়ে আমার প্ল্যানে পানি ঢেলেছো।তাহলে এইবার ওকে জোর দেখিয়েই বিয়ে করে নাও।”
ইনায়ার কপট রাগ দেখে আদ্রিনের মেজাজ বিগড়ে যায়।
ফল কাটার ছুরি শক্তভাবে চেপে ধরে সে,
–“আমি কি পারবো না পারবো তা আমার মাঝেই থাক।যেটা বলেছি তা আমি রিপিট করবো না আর।”
–“মা,ভাই যখন রাজি বিয়েতে তাতে আপত্তি কিসের?চলো সবাই মিলে যায়।”
রিয়ানার কথায় দৃষ্টি গভীর করে ইনায়া,
–“বেঁচে থাকতে আমি যাবো না ঐ মেয়ের কাছে।যে মেয়ের জাত…”

–“জাত,অজাত এইসব বলে লাভ কি?এইযে তুমি আমাকে ছোট থেকেই ইগনোর করে গেছো,আমি কাউকে বলেছি?না তোমার কুকর্মের কথা তোমার মিডিয়ায় বলেছি? আই জাস্ট ওয়ান্ট,তৃপ্তি।”

ইনায়া কিছু বলে না।রাগ দেখিয়ে চলে যাচ্ছে।সাফা তখন বায়না করে ইনায়াকে বলে,
–“নানু, দেওয়াল থেকে সিনারিটা দাও আমাকে।”

ইনায়া তা দিতে উদ্যত হয়।আদ্রিন ইনায়ার কাছে যাচ্ছে,পেছনে রিয়ানা।
নিজেকে ধাতস্থ করে পুনরায় ইনায়াকে সে বলে,
–“সন্ধ্যায় যেনো আমরা ঐ বাড়িতে যায়।”
–“আমি ম’রে গেলেও যাবো না সেই বাড়িতে। ঐ মেয়েকে আমি কখনো মেনে নিবো না।কখনোই না।”
–“আম্মি,আমি ঐ মেয়ে ছাড়া কিছুতেই ভালো থাকবো না।সে শুধু আমার। আই লাভ হার,অ্যান্ড আই ওয়ান্ট হার এট এনি কস্ট।”(আমি তাকে ভালোবাসি এবং যেকোনো মূল্যে আমি তাকে চায়)।”
আদ্রিনের এই চিৎকার ভ’য়াবহ।সকলে উপস্থিত হয় সেথায়।

ইনায়া সজোরে ধাক্কা দেয় ছেলেকে,
–“তার মায়ের মতো সে যখন অন্য ছেলের জন্যে তোমাকে ছেড়ে যাবে,তখন বুঝবে মা ঠিক ছিলো। ওই মেয়ে তার মায়ের মতো দুশ্চরিত্রা না হলে,বিয়ের আগে তোমাকে নিয়ে রাত কা’টাতো না। বান্ধবীর বাসার নাম দিয়ে তোমার সাথে রাত কা’টিয়েছে সে,তাই না?বাচ্চা বাঁ’ধিয়ে এখন বিয়ের জন্যে প্রেসার দিচ্ছে? কার না কার বাচ্চা এটা,খোঁজ নিয়ে দেখো।”

ইনায়ার প্রত্যেকটা বুলি তী’রের মতো আদ্রিনের বুকে আঘাত করলো যেনো।পেছনে উপস্থিত সকলে তৃপ্তির ব্যাপারে ইনায়ার কথা শুনে কানাকানি,হা হুতাশ করছে।মেজাজের তি’ক্ততায় আদ্রিন তার হিং’স্র রূপে ফিরে।হাতে থাকা ছুরির কথা সে ভুলে যায়। সম্মুখে আঘাত করতেই তার গর্জন শোনা গেলো,
–“সে বিশুদ্ধ,পবিত্র।আমি ছাড়া ওর জীবনে কেউ নেই।অধিকার ছাড়া তাকে আমি কিভাবে ক’লঙ্কিত করবো?সে আমার র’ক্ষিতা না আম্মি,আমার ভালোবাসা।আমার সারাজীবন সে।”

পেছনে উপস্থিত সকলে আদ্রিনের হিং’স্রতা দেখে তার বুলিকে সর্ব সত্যি মানতে একমিনিট বিলম্ব করেনি।

পরক্ষণে ভেসে এলো একে একে সকলের কণ্ঠ।কেমন আহাজারি ছিলো সেই কণ্ঠে!
–“আদ্রিন কি করছো এটা?”
পরপর ভেসে এলো রিয়ানার আর্তনাদ,
–“হায় আল্লাহ্!রক্ত বের হচ্ছে ভাই!রক্তের স্রোত।”

চলবে…..
কপি করা বারণ।সকলের সুন্দর মতামতের আশায়।
ছবি কালেকশন: ইনস্টাগ্রাম।
চলবে…..
কপি করা বারণ।রিচেক করা হয়নি।বানান ভুল থাকতে পারে।
আদ্রিন কি করবে আল্লাহ্’ই জানেন!!
ছবি কালেকশন: ইনস্টাগ্রাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here