অতৃপ্তির মাঝে তৃপ্তিময় সে পর্ব -০৩

#অতৃপ্তির_মাঝে_তৃপ্তিময়_সে
#লেখিকা- সালসাবিল সারা
পর্ব -৩
__________
(৮)
–“বাবা আমার মাকে খু’ন করেছে,ইহকালে এটা বিশ্বাস করবো না।আমি জানি,বাবা মাকে ভালোবাসতো অনেক।কিন্তু,বাবার ধর্ম ছাড়ার কারণে মা সংসার ছাড়তে বাধ্য হয়।বাবা তো মাকে আগলিয়ে রাখবে বলেই বিয়ে করেছিলো।তাহলে কেনো এমনটা করলো?না বাবা মাকে দুঃখ দেওয়ার মতো কাজ করতো,না মাকে সেই বাড়ি ছাড়তে হতো।মা বাবাকে ভালোবাসলেও,মায়েরও রাগ ছিলো,বাবার সেই কাজে।মাকে দেওয়া ওয়াদা বাবার রক্ষা করা উচিত ছিলো।তবে,তুমি তো জানো,তাদের মাঝে ছাড়াছাড়ি হয়নি।বাবা এইখানে প্রায়শই আসতো। মা যদি এমন রেগে থাকতো,তবে বাবাকে তো বাসায় আসতে দেওয়ার কথায় ছিলো না।মাঝে সব চাপা রহস্য।তাছাড়া,মায়ের জীবনের অনিয়ম,খাপছাড়া ভাব,সেই তিনমাসের কাহিনী,হঠাৎ মায়ের মৃত্যু সবটার রহস্য বাবা জানে।কেনো সে আমাকে বলছে না?বাবা যতদিন এইসব আমাকে বলবে না,ততদিন আমি বাবাকে ঘৃনা করে যাবো,মায়ের বিশ্বাস ভাঙার কারণে।না বাবা এমনটা করতো,না আজ আমাদের পরিবারে এমন ফাটল হতো।আগে আমরা কতো সুখী ছিলাম,চামেলী।”
তৃপ্তির বাজখাই কণ্ঠের প্রশ্নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে চামেলী।মেয়েটাকে চেয়েও শান্ত করতে পারছে না সে।

মেয়েটা উত্তেজিত।থেকে থেকে জিদ চাপে তার ঘাড়ে।ঠিকই তো ছিলো তৃপ্তি খানিক পূর্বেও।হঠাৎই,তার ভাইয়ের সাথে কথা কা’টাকা’টি হয় তার বাবাকে নিয়ে। রূপমের মতে, তার বাবার সাথে সম্পর্ক ঠিক করে নেওয়া উচিত তৃপ্তির।তবে,তৃপ্তি অনড়।বাবা সত্য না বলা অব্দি কিছুতেই মেয়েটা ক্ষমা করবে না তার বাবাকে।অরিত্রন চট্টোপাধ্যায় তার মায়ের মন খারাপের দোষী।ভালোবেসে মাঝ পথে রং বদলিয়ে ফেলার মতো কাজ করেছিল তার বাবা।এইসব কথার ছলেই বাঘে মহিষের ন্যায় যুদ্ধ বাজে দুই ভাইবোনের।তৃপ্তি কথার ছলে বড় ভাইয়ের গায়ে দু ঘা লাগাতেও ভুল করেনি। এতে ক্ষিপ্ত রূপম বোনের চুল টেনে বাহিরে চলে যায়।দিদা ঔষধের চাপে নিদ্রায় শায়িত।প্রিয় তার সমেত তন্দ্রায় কুপোকাত।চামেলী নীরব দর্শকের ন‌্যায় তৃপ্তিকে শান্ত করতে ব্যাস্ত।তবে মেয়েটা শান্ত হলে তো?

–“এইসব মেইজ থেকে বেরিয়ে আয়।বাবাকে সম্মান দে।তোর বাবা জানাতে পারলে হয়তো আমাদের বলতো।”
চামেলীর শান্তনা দেওয়ার আহ্বান।
–“এতো এলোমেলো কেনো আমাদের জীবন?বাকি সবার মতো কেনো আমাদের জীবন না?মা বাবা নিয়ে কেনো আমার হাস্যোজ্বল পরিবার নষ্ট হলো?”
রক্তিম হয়ে উঠে তৃপ্তির নাক মুখ।কান্নার পূর্বাভাস।তাও মেয়েটা কেমন কঠোর।চামেলীর সম্মুখে অশ্রুজলকে বেশ ঠেকিয়ে ফেললো তৃপ্তি।পরক্ষণে মিনমিনে সুরে বলল,
–“বাবার উচিত হয়নি মাকে ভালোবাসা।ভালোবাসলে আগলিয়ে রাখতে হয়,লাভি।”
তার মাথায় হাত রাখলো চামেলী সন্তর্পণে,
–“ঘুমিয়ে পড়,কালকে ভার্সিটি আছে।আমি সময়ে ডেকে দিবো।”
মাথা নাড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো তৃপ্তি।

চামেলী ব্যালকনির দরজা বন্ধ করে কক্ষের দরজাটাও বন্ধ করলো কক্ষ ত্যাগ করে।দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দিদার সমেত দৃষ্টি মিললো চামেলীর।দিদার আঁখি অশ্রুজল।না চামেলী কিছু বললো না দিদা কিছু ব্যক্ত করলো। নাতিনের মনে এতো ক্ষোভ বাবাকে নিয়ে,শুনে তার মনটা নুইয়ে পড়লো মুহূর্তেই।তন্দ্রা ছুটে যাওয়ার পর তৃপ্তিকে দেখতে যাওয়ার কথা থাকলেও,তৃপ্তিকে দেখতে গেলো না দিদা আর,আঁচলে মুখ গুঁজে দিদা ভাবলো,
–“তোর বাবার ধর্ম পরিবর্তনের কারণটাই ছিলো তার ভালোবাসা রক্ষার্থে।সব যদি তোরে বলতে পারতাম রে তৃপ্তি!”
অতঃপর ব্যথিত হৃদয়ে দিদা পুনরায় নিজের কক্ষে ফিরলো।

তৃপ্তি শুয়ে।মাথায় নানান ভাবনা।নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে তখন আদ্রিনের ফোনটা কে’টে যায়।অতঃপর আদ্রিনের বলা শেষ কথা কর্ণ গুহরে এলো না তৃপ্তির।ঘরে এসে তাকে ফোন দিবে ভাবলেও সেই ভাবনা বাতিল হয় রূপমের সমেত কথা কা’টাকা’টির দরুণ।আগামী সপ্তাহে তার বাবার সাথে একটা দাওয়াতে যাওয়া নিয়েই কথার সূত্রপাত।তৃপ্তি প্রথমে যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিলেও,ভাইয়ের জন্যে এখন তার মন কেমন করছে।মুখে “সরি” সে বলবে না কস্মিককালে।তাই দাওয়াতে গিয়েই সে তার ভাইয়ের মনোকামনা পূরণ করলেও,বাবাকে সে এতো সহজে ক্ষমা করবে না।
অযত্নে পড়ে থাকা মোবাইল তুলে নিলো হাতে।আদ্রিনের মেসেজে খানিক চমকিত তৃপ্তি।

–“কাল ফ্রি আছো?”

আদ্রিনের এহেন মেসেজ উত্তর কি দিবে সেই ভাবনায় বর্তমানে মশগুল মেয়েটা।আদ্রিনের ব্যক্তিত্বের মাঝে নিজ থেকে ফোন,মেসেজ আশা করাটা দুষ্কর।কারণ,পূর্ব থেকেই ছেলেটা তির্যক মেজাজি আর শক্ত ব্যক্তিত্বের।মেয়েদের সাথে ইতরামি করা তার বিধীতে নেই।আদ্রিনের পরিবার সম্পর্কে কিছু না শুনলেও,তৃপ্তি তার দাদাদের থেকে প্রায়শই শুনতো,আদ্রিনকে কোনো মেয়ে দ্বারা বশ করা অসম্ভব।এছাড়াও,অন্যান্য রাজ’নৈতিক পরিবারের ছেলেদের মেয়ে নিয়ে কান্ড তামাশা হলেও,আদ্রিনের ব্যাপারে কোনো রেকর্ড ছিল না এমন।তাহলে সেই আদ্রিন কিভাবে নিজ হতে এতো খবরাখবর নিচ্ছে তৃপ্তির?কেবল কি সেই কফি ট্রিটের জন্যে?নাকি অন্যকিছু?কয়েক মুহূর্তের জন্যে ঘোরে ডুবেছে মেয়েটা।তাকে নাকচ করার মনমানসিকতা নেই তৃপ্তির।করবেই বা কিভাবে?কিশোরী কালে মন দেওয়া মানুষটাকে নাকচ করা কি এতো সহজ?তাছাড়া,গতকালের ঘটনায় যতটুক সে আদ্রিনকে বুঝেছে;আদ্রিন বেশ কড়া, সংরক্ষণশীল এবং একরোখা মানুষ।যে কেবল মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে,বিপদে ফেলতে নয়।

মোবাইলের ডিসপ্লেতে আঙ্গুলের নৃত্যে সে টাইপ করলো,
–“লাঞ্চ টাইমে ফ্রি।দুইটা থেকে চারটা।”

মেসেজ পাঠিয়ে মেয়েটি জ্বল’ন্ত লাইটের পানে তাকালো।মা বিদায়ের পর হতে একা আঁধার রুমে থাকতে পারেনা সে।মায়ের সাথে মধুর স্মৃতির আলোড়নে মেয়েটা ঘুমানোর চেষ্টায়। কাল আবারও এক ব্যস্ত সকাল অপেক্ষা করছে।
.
নাস্তার টেবিলে ভাইয়ের গোমড়া মুখশ্রী দৃষ্টির অন্তরালে এলো তৃপ্তির।দুইজনেই ইগোর কারণে চুপ।তৃপ্তি ভাইকে পরে অনুষ্ঠানে গিয়ে মানিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করলেও ভাইয়ের এমন করুণ চেহারায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো,
–“বুঝলে লাভি,আজকাল ছেলেরাও মেয়েদের মতো গাল ফুলিয়ে রাগ করে থাকে।দেখতে কেমন আলু আলু লাগে।”
–“ভাইয়া,আপু তোমাকে আলু বলেছে।”
প্রিয় হাসলো শব্দ করে।
রূপমের রাগের মাত্রা বাড়লো এতেই,
–“ঠাস করে দিবো প্রিয়।কোনো এক রাক্ষসীর কথায় আমাকে পঁচানোর চেষ্টা করবি না।”
–“পঁচা জিনিসকে কি আবার পঁচানো যায়?”
তৃপ্তি এক চোখ বুঁজে ভাইকে আরো ক্ষেপালো।
–“তৃপ্তি উ’ষ্ঠা দিবো,বে’য়াদপ।”
–“টাইম নেই ভাই।”
তৃপ্তি চুলে হাত বুলিয়ে ঢং করলো কেবল।

হেসে উঠলো সকলে। রূপম নিজেও খানিকটা দমলো।তার এই বোনের সাথে যতোই লড়াই করুক না কেনো,দিনশেষে এই মেয়েগুলোই তো তার পরিবার। রূপম কথা বাড়ায় না আর। নীরবে খাওয়াতে মনোনিবেশ করলো।

ডাইনিং এর দুয়ারে ছেলে মেয়ের খুনসুটি দেখে আঁখি ভারী হয় অরিত্রনের।এমন কলরব এক সময় তার ঘরে থাকতো।এক ঝড়ে সব শেষ হলো কেবল।

–“বাবা?”
প্রিয় দৌড়িয়ে আলিঙ্গন করলো বাবাকে।তৃপ্তি বাবার উপস্থিতি বুঝে উঠে পড়লো হুট করে।আজকাল বাবার দিকেও তাকাতে তার অন্তর কাঁপে।বয়সের ছাপ বাবার শরীরে স্পষ্ট।মনটা ফেটে যায় মেয়েটার।না পারে অতীত ভুলতে,না পারে বাবাকে মেনে নিতে।বাবার এমন জিদে মেয়েটাও কেমন পাষাণ হলো।রুম হতে ব্যাগ নিয়ে ডাইনিং রুম পার করতে নিলে বাবা ডেকে উঠে তাকে,
–“খাবার শেষ না করে কই যাস?”
–“তোমাকে দেখে খিদে মিটেছে।”
তৃপ্তি দ্রুত পায়ে সম্মুখে এগোয়।বাবার সাথে কড়া ভাষায় কথা বলাটা তার মনে লাগে।প্রচুর লাগে।তবে,সে উপায়হীন।বাবা হতে সবটা জানতে আরো কঠোর হবে তৃপ্তি।
লিফট বন্ধ।হয়তো কোনো সমস্যা! সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সিদ্ধান্ত নিলো।4-B ফ্ল্যাট ক্রস করতে গেলেই তার বাবার বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ হয় তৃপ্তির।লোকটা তৃপ্তির তাড়াহুড়ো দেখে হাঁক ছাড়লো,
–“বাবা থেকে পালাচ্ছো?তোমার বাবার লজ্জা নেই,এতো কান্ড করে আবার তোমাদের সাথে সম্পর্ক রাখে।”
কিছু বন্ধু কেবল বন্ধু নয়,তারা হয় নীরব শত্রু। এই লোককেও এমনটা ভাবে তৃপ্তি।তার থমকে যাওয়া পা বাঁক ফেরালো লোকটার পানে,
–“বাবার সাথে মধুর কথা বলে এখন আমাকে কথা শোনাচ্ছেন বাবার নামে? তা আমার বাবা আমার পরিবারের সাথে যায় করুক আপনার কি তাতে?বাবা আমাদের না দেখলে আপনি আমাদের খরচ চালাবেন?যদি তাই করেন,তাহলে আজ এই মুহূর্তে আমার বাবাকে বলবো আমাদের সাথে সকল সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে।”
তৃপ্তির মুখে শক্ত হাসি।আঁখিতে আগ্নেয়গিরি।এই মেয়েটা যখন এক ভ্রু উঁচু করে তাচ্ছিল্যের সহিত বাক্য ছুঁড়ে,তবে সম্মুখের মানুষ ব্যাপক হচকায়।
–“বেয়াদপ হয়েছে মেয়েটা।”
–“সেটা পুরনো কথা।নতুন কিছু বলার হলে থামাবেন আমায় পরেরবার।”
তৃপ্তি নিচে নামে।লোকটাকে উচিত জবাব দিতে পেরে সে সন্তুষ্ট।মানুষের সামনে কঠোর হওয়াটাই শ্রেয়।যতো দূর্বলতা জানবে মানুষ,ততই ঘাড়ে চেপে বসে।তৃপ্তি এইসবের ধার ধারে না,না নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে।

তৃপ্তি প্রথমে আলেয়ার বাড়ি যায়।তার বিজনেসের সকল জিনিসপত্র সেথায় থাকে।সবকিছু দুই বান্ধুবি প্যাকিং করে ডেলিভারির জন্যে পাঠিয়ে দেয়।পরপর রিক্সা ডেকে দুইজনই উঠলো ভার্সিটি যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

(৯)
ঢাকা শহরের জ্যাম মানে সময় খোয়ানো।গাড়িতে অবস্থানরত আদ্রিন বিরক্ত। কারের সাইডে লম্বা ট্র্যাফিক। অপর পাশের জ্যাম ছুটেছে।তবে তাদের দিকটায় গাড়ি অনড়।খানিকবাদে, অপর পাশেও দেখা মিললো লম্বা লাইন।তন্ময়ের সমেত কথা বলার সময় বাইরে দৃষ্টি দিলো আদ্রিন।দৃষ্টি থমকে যায় রিক্সায় হাস্যোজ্বল রমণীর পানে চেয়ে।হাসির মাঝে মেয়েটা আঁখিতে আঙ্গুল ছুঁয়ে দিচ্ছে সযত্নে।কাজল নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি!আদ্রিনের শান্ত হৃদয় মুহূর্তেই অশান্ত রূপ ধারণ করে।ঠান্ডা পরিবেশে উষ্ণতা ঘিরে ধরে হঠাৎই।
রিক্সায় তৃপ্তি বসে।তার হলদে-শুভ্র মুখশ্রী রোদের কারণে,না হাসির দরুণ এমন লালচে আভায় মত্ত হয়েছে জানা নেই আদ্রিনের।তবে তার ভালো লাগছে।মেয়েটার হাসিতে বিদ্যমান প্রশান্তিটা অনুভব করছে ঠিক হৃদমাঝারে।তন্ময় সামনের সিট হতে পেছনে বসা আদ্রিনকে ইশারায় বললো,
–“স্যার,তৃপ্তি ম্যাডাম।”
–“নজর ঘোরাও,তন্ময়।”
শান্ত জবাবের মাঝে তীব্র হুশিয়ারি আদ্রিনের।
তন্ময় কথা বাড়ালো না।বসের বাধ্য কর্মচারীর মতো সামনে থাকা টয়োটা গাড়ির পানে দৃষ্টি আবদ্ধ করলো।

সবুজ রঙের কামিজের উপর কালো ডেনিম জ্যাকেট সাথে শালীনতার সমেত গায়ে ওড়না টানা তৃপ্তির।তার এহেন রূপে,মোটেও তাকে কিশোরী উপাধি দেওয়া যায় না।আদ্রিনের খুব করে ইচ্ছে করলো, সেদিনের তাকে দেওয়া কিশোরী উপাধিটা ছিনিয়ে নিতে। ঐ পাশে জ্যাম ছুটেছে।রিক্সা এগিয়ে যাচ্ছে ধীর গতিতে।তৃপ্তিও আদ্রিনের নজর হতে হাওয়া হচ্ছে ক্রমশ।
আদ্রিন নিজের হৃদয়ের অস্থিরতার শব্দ শুনতে পাচ্ছে স্পষ্ট।মোবাইল বের করলো সে।তৃপ্তিকে পাঠানো ক্যাফের ঠিকানা এখন অব্দি মেয়েটা চেক করলো না।আদ্রিন ভেবেছে মেয়েটা ঘুমে।উঠলে ঠিকই জবাব দিবে।কিন্তু, তৃপ্তির এহেন কাজে আদ্রিনের ব্যাপক রাগ হয়।তৃপ্তি তার উত্তর না দিলেও, আদ্রিন ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়।সকল কাজ শেষে দুইটার আগেই মেয়েটার ভার্সিটির সামনে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো আদ্রিন।যেভাবে হোক,নিজের জীবনে তৃপ্তির আগমন সে করেই ছাড়বে।স্রষ্টা নিজ হতেই যে তাদের দেখা করিয়েছে সরাসরি!

গাড়িতে বসে সকল মিটিংয়ের সিডিউল পরিবর্তন করলো।তৃপ্তি মেয়েটা হুট করে তার জীবনে এসে তার মন,হৃদয়,সময় সবটাই উলোট পালট করেছে।তন্ময় অবাক হয়ে স্যারের পরিবর্তন দেখে।যেই মানুষ সময়ে সামান্য উনিশ-বিশ হলেই বিপরীত পক্ষের সকলকে মিটিংয়ে চওড়া ভোগান্তির শিকার করাতো,সেই মানুষ আজ কি কারণে মিটিংয়ের সময়ের এমন নকশা বদলাচ্ছে তা নিয়ে ব্যাপক চিন্তা তন্ময়ের।স্যারকে এইসব ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেও নিজের সম্মান খোয়াতে চায় না ছেলেটা।স্যারের দেওয়া নির্দেশনা সে পালন করছে কেবল।তবে মনে প্রশ্নের কমতি নেই।

মিটিংয়ের ফাঁকে, ডিল ফাইনালের মাঝে তৃপ্তিকে দেওয়া মেসেজে বারংবার উঁকি দিচ্ছে আদ্রিন।মনমতো ফলাফল এখনো পায়নি সে।

কুয়াশাচ্ছন্ন শহরে সূর্যের রশ্মির আলোড়ন।এই যেনো শীতের হিমের হিং’স্রতার মাঝে এক স্বস্থি।শেষ মিটিংয়ের ইতি ঘটিয়ে আদ্রিন একাই বেরিয়ে পড়লো অফিস হতে।ড্রাইভার হতে চাবি সংগ্রহ করে গাড়িতে বসলো আদ্রিন।কালো রঙের কোট খুলে পাশের সিটে রাখলো আলগোছে।তিমির রঙের শার্টের হাতা টেনে স্টিয়ারিংয়ে দক্ষ হাতের স্পর্শে গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো মেহেবুবার সমেত দেখা হওয়ার আশায়। লুকিং গ্লাসে নজর দিয়ে জেলের আস্তরণ মাখা চুল আরেকবার পরখ করলো।প্রিয়তমার সামনে উপস্থিত হওয়ার পূর্বে তার যেনো সবদিকেই কানায় কানায় পরিপূর্ণ হওয়া চাই!

(১০)
ট্রাফিকের কারণে ভার্সিটি পৌঁছাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো তৃপ্তির।উল্টো পাঁচ মিনিট দেরী হলো তার ক্লাসে।পরপর তিনটা ক্লাস শেষ করে মোবাইল হাতে নেওয়ার সময় হলো তার কেবল।সম্পূর্ণ ক্লাসে তার মন মোবাইলের নিকট ছিলো।উদ্দেশ্য আদ্রিন।লোকটা গতরাতে তার মেসেজের উত্তর কি দিয়েছে এটা নিয়ে তার যতো চিন্তাভাবনা।বিজনেসের জিনিসপত্র কালেক্ট করতে পূর্বেই গোডাউনে ছুটে আলেয়া।বর্তমানে সময় নিয়ে ভার্সিটির ক্যান্টিনে নিজের স্থান পাতলো তৃপ্তি।আদ্রিনের মেসেজ ঢু মারতেই তার দৃষ্টিতে এলো আদ্রিনের মেসেজ।লোকটা তার ভার্সিটির নিকটে বিখ্যাত ক্যাফের নাম পাঠিয়েছে।তৃপ্তি সামান্য নিরাশ।তার পক্ষে এই মুহূর্তে এমন দামী ক্যাফেতে ট্রিট দেওয়া খানিক অসম্ভব।পরক্ষণে বিকাশে টাকা আছে অল্প,সেই ভেবেই মেয়েটা হাঁফ ছাড়ে।এলোমেলো পায়ে বেরুনোর পাশাপাশি কাঁধের মাঝ বরাবর চুলে বেণী পাকালো সে।ছোট অবাধ্য কেশের কয়েক গোছা কপালে এবং মুখের উপরে বিচরণ করছে।
আদ্রিন ভার্সিটির সামনের দিকে গাড়ি পার্ক করে দাঁড়িয়ে ছিলো মেহেবুবার আশায়।মিনিট বিশেক পর দেখা মিলল তার কাঙ্খিত মনের মানুষটার।মেয়েটা কানে ফোন লাগিয়ে ব্যস্ত।উল্টো পথে হেঁটে যাচ্ছে।আদ্রিন পিছু নিলো তার।বেণী পাকানো রমণীটা তাকে নিজের জালে জব্দ করেছে।
ইতিমধ্যে আদ্রিন বেশ কাছাকাছি পৌঁছেছে তৃপ্তির।হঠাৎই,পেছনে বাঁক ফিরতেই আদ্রিনের সমেত ধাক্কার সম্মুখীন হওয়ার উপদ্রব হলে আদ্রিন এক পাশ সরে সামলিয়ে নেয় তৃপ্তির বাহুকে জব্দ করে,
–“রিল্যাক্স!”
–“আরে আপনি?”
তৃপ্তি বেশ অবাক।
–“এতো দ্রুত হেঁটে কই যাচ্ছিলে?”
আদ্রিন প্রশ্ন করলো তৃপ্তিকে।
–“আপনাকে ফোন করেই আমি ক্লান্ত।ফোন তুলছিলেন না কেনো?”
–“আমাকে?”
আদ্রিন পকেট হতে নিজের মোবাইল বের করলো।
“মেহেবুবা” নামের পাঁচটা মিসড কল।অথচ তার ফোন সাইলেন্ট।আলতো হাসলো আদ্রিন,
–“মিটিংয়ে সাইলেন্ট করার পর আর জেনারেল করা হয়নি।”
তৃপ্তির ভেতরটা উত্তাল।আদ্রিনের সেই তির্যক হাসিটা মন উত্তালের কারণ।তার উপর ক্যাজুয়াল কালো শার্টে তার সুঠাম তনুর তামাটে রঙের মোহে নজর ফেরানো দায়।মনটা কেমন অবাধ্য হয়ে চায় যেনো!তবে,থামে তৃপ্তি। বেসামাল মনকে সামলিয়ে নেওয়ার বৃথা চেষ্টায় সে বলে,
–“সমস্যা নেই।একটু অপেক্ষা করুন।আমি আসছি।”
–“কই যাও?”
–“বিকাশের দোকানে।”
–“এনি প্রব্লেম?”
আদ্রিন চিন্তিত।
–“আরে না।ভুলে ক্যাশ আনা হয়নি।তাই বিকাশ শেষ ভরসা।”
–“আচ্ছা,পরে যেও। আমার সাথে আসো।”
–“টাকাটা…”
বলতে দিলো না আদ্রিন।ফোড়ন কেটে সেই শুধালো,
–“মিটিংয়ের সিডিউল উল্টো পাল্টা করে এইখানে আসা।সময় খুব কম।”
আদ্রিন নিজেই হাঁটা শুরু করলো তৃপ্তিকে টপকিয়ে।অসহায় তৃপ্তি উপায়ন্তর না দেখে তারই পিছে ছুটলো।কেনো যেনো আদ্রিনের সমেত তার তর্ক করার ইচ্ছে পোষণ হলো না।আদ্রিনের স্থলে অন্য কেউ হলে তৃপ্তি নিশ্চয় দমে যেতো না,বরং জিদ দেখাতো।আদ্রিনের লম্বা অবয়ব কথায় ব্যস্ত ফোনে।নিশ্চয় লোকটার বেশ কাজ।তার ঘাড়ের উপরিভাগে বিদ্যমান চুল একেবারে মিহি,তবে তালুর উপরে চুলের গোছা বেশ ঘন।তৃপ্তির অবাধ্য নজর হৃদয়ের গহীনের সাড়ায় নিভৃতে পর্যবেক্ষণ করছে সেই সুঠামদেহী মানবকে।
তবে,তৃপ্তি এক দ্বিধায় ভুগছে বিল নিয়ে।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো আদ্রিন একাই খাবে,আর তারই বিল দিবে তৃপ্তি।

উন্নত মানের ক্যাফে।স্টাফ এবং ম্যানেজারের সাথে আদ্রিনের দক্ষতা দেখে সে বুঝলো আদ্রিন এইখানে সবার পরিচিত।শান্তপূর্ণ স্থানে জায়গার ব্যবস্থা হলো আঁখির পলকে।
আদ্রিনের সমেত এইভাবে রেস্টুরেন্টে আসায় তৃপ্তির মন অশান্ত।কেমন অনুভূতি হচ্ছে তার।ব্যাপক অন্যরকম।লাজুকতা ভর করছে বিনা দ্বিধায়।
আদ্রিন মেন্যু ঠেলে দিলে তার নিকট তৃপ্তি মিছা হেসে বললো,
–“আমি খাবো না।আপনি অর্ডার করুন।”
–“তবে আমার পছন্দের খাবার খাও আজ।”
আদ্রিন বিনা সংকোচে অর্ডার দিলো খাবারের।তৃপ্তি নীরব। কিই বা করার আছে তার?
মেহেবুবার অস্বস্তি বুঝতে পেরে আদ্রিন আওড়ালো,
–“বি ইজি।আমি থাকতে কোনো দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই,তৃপ্তি।”
–“আমি ঠিক আছি।”
মিথ্যে হাসলো সে।
–“মন থেকে আসা হাসি আর মিথ্যের হাসির মাঝে ব্যাপক ডিফারেন্স।”
এইবার মেয়েটার মন হালকা হলো।প্রশান্তির হাসি দেখা মিললো মেয়েটার অধরে,
–“সত্যি ঠিক আছি।”
–“শান্তি আমি।”
অস্ফুট কন্ঠে আওড়ালো আদ্রিন।না বুঝে তৃপ্তি ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো,
–“কি?”
–“কিছুই না তো।”
আদ্রিন আঁখি বুঁজে অধর প্রশস্ত করলো।

–“আপনার বাসার সবাই রাজ’নীতি করে।আপনি কি যুক্ত তাতে?নাকি কেবল বিজনেসম্যান?”
খাবারের মাঝে ডুবে প্রশ্ন করলো তৃপ্তি।
–“ওনলি বিজনেসম্যান। ঐসব রাজ’নীতি আমার দ্বারা হবে না।তোমার বাসায় সবাই ভালো?”
পাল্টা প্রশ্ন করলো আদ্রিন।
–“হ্যাঁ ভালো।আপনার ভাইবোন নেই?”
–“আছে।একজন বোন।বিবাহিত।একটা ছোটো রাজকন্যা আছে আমার।সাফা ওর নাম।”
আদ্রিন কথার ইতিহাস লম্বা করছে অতীব চালাকির সহিত।
–“আমার একজন স্টুডেন্ট আছে,নাম সাফা।সে নিজেও অনেক কিউট।”
তৃপ্তি এক মুহূর্তের জন্যে তার কষ্ট,জীবনের রহস্য সবটা যেনো ভুলেছে।মেয়েটাকে প্রাণৌজ্জ্বল লাগছে বেশ।
–“আমার বোনের বাড়ি তোমার এলাকায়।বাই এনি চান্স,আমার সাফা তোমার স্টুডেন্ট না তো?ওয়েট দেখায়।”
আদ্রিন গ্যালারি হতে বের করলো তার এবং সাফার ছবি।
তৃপ্তির অবাক চরমপর্যায়ে।সুইমিং পুলের নীল পানিতে ভাসমান আদ্রিন,তার কাঁধে বসা সাফা।দুইজনের মুখেই বিশ্বজয়ের হাসি।
–“হ্যাঁ,এটাই তো আমার সাফা।কি কাকতালীয় ব্যাপার!”
তৃপ্তির চমকিত মুখশ্রীর স্ফীত অধরের জোয়ারে
আদ্রিনের জ্ব’লন্ত হৃদয় ভেসে হারিয়ে গেলো অতলে।
–“বাহ।মনে হচ্ছে আমাদের পরিচয়টা আরো গাঢ় হতে চললো।”
আদ্রিন বেশ নাটকীয় সুরে বলে।
–“হয়তো।”
আদ্রিন অদৃশ্য নজরে তৃপ্তির পানে চেয়ে।
আজ তৃপ্তির মাঝে সে দুই ধরনের পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছে।এক,তৃপ্তি আদ্রিনের সহিত বেশ প্রাণৌচ্ছ্বল।আর দুই,তৃপ্তি আদ্রিনের সমেত একটুও অস্বস্তিবোধ করছে না। এতে আদ্রিনের মনোবল বাড়লো সহস্র গুণ।

ক্যাফে হতে বেরুলো দু’জন।আদ্রিনকে বিল দিতে দেখেনি তৃপ্তি।সে নিজে এই ব্যাপারটা উঠাতে চাইলে আদ্রিন এড়িয়ে চললো।বারংবার ফোন আসাতে বিরক্ত সে।বিদায়বেলায় তৃপ্তি হাত নাড়িয়ে আদ্রিনের উদ্দেশ্যে বললো,
–“আপনি ব্যস্ত মহাশয়।আমি বরং যায়।তবে হ্যাঁ,এরপরের ট্রিট কিন্তু আমার পক্ষ থেকে।আপনি কোনো চালাকি করতে পারবেন না।”
আদ্রিন খেয়াল করলো না।সে মোবাইলের মাঝেই অন্যজনকে শাসন করছে।
তৃপ্তিও আর বিরক্ত করলো না তাকে।চুপটি করে তার পাশে দাঁড়িয়ে।
মোবাইল রেখে আদ্রিন অনুনয়ের সুরে বলে,
–“কিছু বলছিলে?”
–“হুহ,আসি আমি।”
তৃপ্তি রিক্সা নিতে এগিয়ে গেলে আদ্রিন থামায় তাকে,
–“ওয়েট।”
অতঃপর আদ্রিন নিজেই রিক্সা ঠিক করে ভাড়াটা মিটিয়ে দিলো।তৃপ্তির এতো মানা শুনলো না তৃপ্তির অবাধ্য অদৃশ্য প্রেমিক।
–“সরি,তোমাকে নামিয়ে দিতে পারলাম না।অফিসে ফিরতে হবে এখনই।”
–“আরে,আপনি কেনো ভাড়া দিলেন।শুনুন,পরের বার কিন্তু আমি সবকিছুর হিসাব মিটিয়ে দিবো।আপনি কোনো চালাকি করবেন না।আমি তো আপনার কাছে ঋণী হয়ে গেলাম।”
তৃপ্তির কথায় অধিকারবোধ।
–“তোমাকে ঋণী করে যদি বারবার তোমার দেখা পাওয়া যায়,তবে আমি তোমাকে আরো ঋণী করতে চাই। এতো ভেবোনা।সাবধানে যাও।পৌঁছে মেসেজ দিয়ে জানিও।”
আদ্রিন চলে যাচ্ছে বক্তব্যে শেষে।তার বলা প্রত্যেকটা কথা ঠিক কতটা দাগ কে’টেছে তৃপ্তির মনে তা যদি ছেলেটা জানতো!বিস্ফোরিত নজরে তৃপ্তি এখনো আড়ালে মাথা বাঁকিয়ে পুরুষটির পানে চেয়ে।ছেলেটা যাওয়ার পথেও রিক্সার পানে তাকাচ্ছে বারংবার।তৃপ্তির ব্যাকুল মনটা কি অবাধ্য কিছুর আবদার করার অপেক্ষায়?

চলবে…..
কপি করা বারণ।কেমন হয়েছে গল্প অবশ্যই জানাবেন।গল্পটা পুরোই আমার মনের কল্পনার সংমিশ্রনে লিখা। কারো ধর্ম,জাতিকে কষ্ট দেওয়ার কথা আমি দুঃস্বপ্নেও ভাবিনা।গল্পকে কেবল গল্প হিসেবে নিবেন,অন্য কিছুর সাথে মেলাবেন না।
সকল ধর্মের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা রয়েছে।
ছবি কালেকশন: Ankitaaww (ইনস্টাগ্রাম)।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here