“অদ্ভুত মুগ্ধতা ”
পর্ব ১৫
মিশু মনি
.
বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে মিশু।কিছুতেই ঘুম আসছে না।অনেক রাত হয়ে গেছে।ঘুমানো টা খুবই দরকার কিন্তু ঘুমকে তো জোর করে ডেকে আনা যায়না।শুয়ে থাকতে থাকতে উঠে পড়লো মিশু।মর্ম নয়ত মৈত্রী যেকোনো একজনের সাথে গিয়ে একটু গল্প করতে হবে।কিন্তু এত রাতে কাকে ডাকলে সে বিরক্ত হবেনা? ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে বেড়িয়ে আসলো ও।
মর্ম’র ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে তাকিয়ে দেখলো বিছানায় কেউ নেই।তারমানে মর্ম এখনো বাসায় ফেরেনি! গত দুইদিনে মর্ম’র সাথে মিশুর দেখাই হয়নি একদম।ও খুব সকালে উঠে বাইরে বেড়িয়ে যায় আবার ফেরে অনেক রাত করে।এত কিসের ব্যস্ততা বুঝতে পারেনা মিশু।দুদিন আগেও মিশুকে নিয়ে ক্যাফেতে গিয়েছিল,ফেরার পথে একটা ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ গল্পও করেছে।কিন্তু গত দুদিন ধরে কোনোভাবে কথা তো দূরে থাক,দেখাই হয়নি! একই বাসায় পাশাপাশি রুমে থেকেও দেখা না হওয়ার বিষয় টা খুবই আশ্চর্যের! হতে পারে মর্ম কোনো কাজে বাইরে গেছে।দুদিন ধরে বাইরেই আছে হয়ত।কিন্তু মিশুকে একবার ফোন দিয়ে জানালেই পারতো।মিশু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত সাড়ে ১২ টা বাজে।মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো ওর।
ক্রমশই মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।ঘুমও আসছে না।এখন মৈত্রীর ঘরে গিয়ে ওর সাথে গল্প করতে হবে।মিশু মৈত্রীর দরজায় এসে দুবার ডাকতেই মৈত্রী এসে দরজা খুলে দিলো।ঘুম ঘুম চোখে চেয়ে হাই তুলে বললো,মিশু! এত রাতে!
– আমি আপনার সাথে ঘুমাবো।
কথাটা শুনে একদম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো মৈত্রী।দুজন যুবক যুবতী যে একসাথে ঘুমানো যায়না সেই জ্ঞানটাও কি ওর হয়নি! নাকি ও কিছু না ভেবেই বলে দিলো কথাটা? মৈত্রী হেসে বললো,হঠাৎ এই ইচ্ছে?
– আমার খুব মন খারাপ লাগছে।একদম খুবই খারাপ।ঘুম আসছে না।আমার মনে হয় আপনি ঘুম পাড়িয়ে দিলে ঘুম আসবে।
– হুম বুঝলাম। আসো ভিতরে,গল্প করি।
– আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?
– একটু ঘুম এসে গিয়েছিলো।বসো তুমি।
মৈত্রী টেবিলে রাখা ফ্লাক্স থেকে এক কাপ চা ঢেলে মিশুকে দিল।তারপর নিজে এক কাপ নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল,শরীর কেমন এখন?
মিশুকে আরো বিষন্ন দেখাচ্ছে।ও যে ভালো নেই,সেটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।মৈত্রী মিশুর একটু কাছে এগিয়ে এসে বললো,কিছু নিয়ে তুমি আপসেট?
– আমার অসুখ টাই তো আপসেট হয়ে থাকা।
মৈত্রী হাসার চেষ্টা করে বললো,হুম।জটিল অসুখ বাধিয়ে ফেলেছো।এখন তো দেখি ইনসোমনিয়ার লক্ষণ ও প্রকাশ পাচ্ছে।রাত্রে ঘুম আসেনা কেন?
মিশু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।মৈত্রী খেয়াল করে দেখলো ওর চোখ ছলছল করছে।যেন এক্ষুনি টপ করে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়বে।তারমানে মিশুর শরীর টা আবারো খারাপ করেছে! মৈত্রী অপলক ভাবে চেয়ে রইলো ওর দিকে।যদিও যথাসাধ্য চেষ্টা করছে মিশুর থেকে দূরে থাকার।কিন্তু মনকে কিছুতেই দূরে সরিয়ে রাখা যায়না!
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
মিশু বললো,আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই।
– বলো,কি কথা?
– আমার তের বছর বয়সে অসুস্থ হওয়ার কারণ টা বলতে চাই।
মৈত্রী খানিক টা অবাক হলো।মিশুর আরো কাছাকাছি বসে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,বলো।এতে করে তোমার ই ভালো হবে।
মিশু চায়ের কাপ টা নামিয়ে রাখলো পাশের টেবিলের উপর।তারপর মৈত্রীর মুখোমুখি বসে বলতে আরম্ভ করলো,আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি।খুবই দুষ্টু আর মিশুক টাইপের ছিলাম।অনেক বান্ধবী ছিলো আমার।একদিন এক বান্ধবী’র বাসায় গিয়েছিলাম ওকে ডাকতে।একসাথে স্কুল যাবো বলে।গিয়ে দেখি ওর চাচা বসে টিভি দেখছে।আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল,কেমন আছো মিশু? আমিও হেসে হেসে ওনার সাথে কথা বললাম।আমাকে বলল,তিথি একটু ওর মায়ের সাথে পাশের বাড়িতে গেছে।স্কুলের সময় হয়েছে যখন, এক্ষুনি ফিরে আসবে,তুমি বসো।আমি ওনার পাশেই সোফায় বসে টিভি দেখতে লাগলাম।আর অপেক্ষা করছিলাম তিথির জন্য।তারপর হঠাৎ..
এ পর্যন্ত বলে মিশু হাফাতে লাগলো।মৈত্রী খেয়াল করে দেখলো ও খুব ঘামছে।চোখ দুটো বড় বড় করে চেয়ে আছে দেয়ালের দিকে।খুব ভয়ংকর দেখাচ্ছে মিশুকে।মৈত্রী একটু ও ভয় না পেয়ে বলল,তারপর হঠাৎ কি হলো?
মিশু একটা অস্ফুট শব্দ করলো।মুহুর্তেই চেহারাটা কেমন বদলে গেলো ওর।হাফাতে হাফাতে বললো,তারপর চাচা দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।আমি খুব ভয় পেয়ে যাই।উনি আমার মুখ চেপে ধরে..
বলতে বলতে মিশু মৈত্রীর বুকে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠল।কাঁদতে কাঁদতে বলল,আমি তখন খুবই ছোট আর ওনার মেয়ের মত।ওনার নিজের ও একটা ছোট্ট মেয়ে ছিল।একজন বাবার কখনোই এটা করার কথা না।সেদিন বাসায় কেউই ছিলোনা।আমার উপর খুবই অমানুষিক নির্যাতন করেছিলো ওই লোকটা।
মৈত্রী একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে।চোখের পলক ও পড়ছে না ওর।মিশু কেঁদে ওর বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে।মিশুকে সান্ত্বনা দেয়ার শক্তিটাও হারিয়ে ফেলেছে ও।ওরকম একটা নির্যাতন ওইটুকু বয়সে যেকোনো মেয়ের পক্ষেই সহ্য করা কষ্টের।মিশু শব্দ করে কাঁদছে, মৈত্রীর নিজের চোখেও পানি এসে গেছে।ও নিরবে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
মিশু বললো,সেদিন আমি ওখানেই অজ্ঞান হয়ে যাই।তারপর আমাকে কিভাবে কে বাসায় রেখে গেছে আমি জানিনা।জ্ঞান ফিরলে কথাটা আম্মুকে বলার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু বলতে পারিনি।জানিনা কেন বলতে পারিনি।ধীরেধীরে কেমন যেন হয়ে গেলাম আমি।কয়েক মাস মানসিক ভাবে অসুস্থ ছিলাম।সুস্থ হওয়ার পরও নিজেকে অন্যগ্রহের প্রাণী মনে হয়েছিলো।আমি অনেকবার বলার চেষ্টা করেও কাউকে বলতে পারিনি কথাটা।আজ প্রথম আপনাকে বললাম।
মৈত্রী কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না।বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে ওর।গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছেনা।মিশুকে স্পর্শ করার শক্তিটাও বোধহয় নেই।মিশু নিজেই ওর বুকে মাথা রেখে কাঁদছে।
একটু থেমে মিশু আবারো বললো,আমার মাঝেমাঝে খুবই ভয় করে।হঠাৎ করেই মনে হয় কেউ বুঝি আমার উপর আক্রমণ করতে আসছে।রাতে ঘুমালেও মাঝেমাঝে ঘুম ভেঙে যায়।মনে হয় কেউ আমার মুখ চেপে ধরে আমাকে মেরে ফেলবে।খুব কষ্ট হয় আমার।এই বুঝি আমার গলা চেপে ধরে কেউ আমাকে খুন করে ফেলবে।মনে হয় অন্ধকার রুমে কেউ বিশ্রীভাবে পোশাক খোলার চেষ্টা করছে,বিদঘুটে তার হাসি।কিন্তু জানিনা কেন কথাটা কাউকে বলতে পারিনা।মাঝেমাঝে হঠাৎ ই খুব আপসেট হয়ে পড়ি।আর যখন নিউজে দেখি ছোট ছোট মেয়েরা ধর্ষণ হয়েছে,আমি মেনে নিতে পারিনা।আমার পৃথিবীটা ছোট হয়ে আসে।আপনি ই বলুন,একটা পূর্ণবয়স্ক মেয়ে ধর্ষিতা হলে নাহয় অনেক কারন দেখানো যায়।মেয়েটা বেহায়া,বাজে,বেপর্দা,অশালীন, খারাপ চরিত্রের আরো অনেক কথা অনেকে বলতে পারবে।কিন্তু একটা ছোট্ট নয় বছরের বাচ্চা ধর্ষিতা হলে কোন কারণ টা দেখাবেন আপনি? বাচ্চাটার এখনো বয়ঃসন্ধি ই শুরু হয়নি।সে কি অপরাধ করেছিলো? আমিতো বাচ্চা একটা মেয়ে ছিলাম।আমার কি অপরাধ ছিলো? মেয়ে হয়ে জন্মানো টাই আমার অপরাধ? নাকি বাবার বয়সী একজন চাচাকে বিশ্বাস করে তার পাশে বসাটা অপরাধ? আমি তো ছোট মানুষ ছিলাম,আমি কি বুঝতাম ওসব যে ওই লোকটা এসব করতে পারে?
মিশু আবারো চিৎকার করে কেঁদে উঠল।মৈত্রীকে শক্ত করে ধরে জোরে জোরে কাঁদছে ও।মৈত্রী নিজেকে সামলাতে পারলো না।ওর ও মিশুর মত চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।মৈত্রীর বুক ফেটে কান্না আসতে লাগলো। ওর প্রিয় মানুষ টার এত কষ্ট দেখে সহ্য করতে পারছে না ও।মিশুর শরীর কাঁপছে, ঘেমে গিয়েছে।কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে ওর।দম বন্ধ হয়ে আসবে মনে হচ্ছে।
মিশু বললো,সবাই কেন আপনার মত হয়না? এ বাড়িতে আমি আটদিন ধরে আছি।প্রায় প্রত্যেক টা দিনই আপনার সাথে বসে গল্প করেছি।একই গাড়িতে পাশাপাশি কতবার বাইরে গিয়েছি।একই রুমে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে কাটিয়ে দিয়েছি।দুদিন রাতে আপনি আমায় ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন।কোনোদিনো আপনার চোখে খারাপ উদ্দেশ্য আমি দেখিনি।সবাই কেন আপনার মত হয়না?
মৈত্রী নিজেও কাঁদছে।কিছু বলার ভাষা নেই ওর।মিশুর কান্নার শব্দ রাতের স্তব্ধতা ভেঙে দিয়েছে।মৈত্রীর নিজেকেও অপরাধী মনে হচ্ছে।চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসছে।এই হাহাকার কেউ বুঝবে না।এমন সময় সাফায়েত উল্লাহ সাহেব এসে দরজায় দাঁড়ালেন।বাবার দিকে তাকিয়েও মৈত্রী মিশুকে উঠতে বললো না।মিশু অনবরত কেঁদেই চলেছে।সাফায়েত উল্লাহ সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন।এই চঞ্চল হাসিখুশি মেয়েটার এত কিসের কষ্ট! ও এভাবে কাঁদছে কেন? মৈত্রীর মত শক্ত ছেলেটার চোখেও পানি!
উনি নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন।ভিতরে এসে ডাকলেন, মিশু।
ওনার ডাক শুনে মিশু মৈত্রিকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসলো।তারপর চোখ মুছতে মুছতে বলল,সরি আংকেল।
– কি হয়েছে মা তোর? এভাবে কাঁদছিস কেন? তোর কান্না দেখে আমার ও কান্না পাচ্ছে।তুই জানিস না আমি তোকে কত ভালোবাসি?
মিশু উঠে এসে সাফায়েত উল্লাহ সাহেবকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো।বলল,আপনি একজন সত্যিকার বাবা।আপনার মত সব বাবা হলে কোনো মেয়ের কষ্ট থাকতো না।
– কি হয়েছে বলবি না?
– কিছু না।
– তাহলে কাঁদছিস কেন পাগলী?
– আমি আপনাদের ছেড়ে কোথাও যাবো না।আমার ভয় করে খুব।এই যন্ত্রণা আমাকে বাচতে দেবেনা।
– কে বলছে তোকে যেতে? তুই আমার মেয়ে না?
মিশু উঠে দাড়াতেই সাফায়েত উল্লাহ সাহেব ওর চোখের পানি মুছে দিলেন।এতক্ষণে তানিন এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে।ঘটনার কিছুই ও বুঝতে পারলো না।কিন্তু মিশুকে এ অবস্থায় দেখে ভীষণ খারাপ লাগলো।সাফায়েত উল্লাহ সাহেব বললেন,তানিন মিশুকে ঘুম পাড়িয়ে দে তো মা।
তানিন এসে মিশুকে ধরে বলল,কি হয়েছে তোমার?
মিশু কিছু না বলে চোখ মুছলো।তারপর সাফায়েত উল্লাহ সাহেব জোর করে মিশুকে মৈত্রীর বিছানায় শুইয়ে দিলেন।তানিন পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।জ্বর এসেছে মেয়েটার! একথা শুনে মৈত্রী দ্রুত জ্বরটা মেপে দেখলো তারপর ওষুধ বের করে খাইয়ে দিলো।একটা ঘুমের ওষুধ ও খাইয়ে দিয়েছে ওকে।এই মুহুর্তে ঘুমটা বিশেষ দরকার।তানিন কিছুক্ষণ মিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই মিশু ঘুমিয়ে পড়লো।
তানিন ওর মাথায় জলপটি দিয়ে দিচ্ছে।মৈত্রী ও সাফায়েত উল্লাহ সাহেব পাশে চেয়ারে বসে আছেন।সাফায়েত উল্লাহ সাহেব চিন্তা করছেন ব্যাপার টা নিয়ে।যতটুকু কথা তিনি শুনতে পেরেছেন,তাতে বিষয় টা আন্দাজ করতে ওনার সময় লাগলো না।বললেন, মৈত্রী একটা কথা বলবো?
– হ্যা আব্বু।
উনি বললেন, মিশুর সবকথা আমি শুনিনি।শুধু শেষটুকু শুনেছি।তাতে বুঝলাম,ওর পৃথিবীতে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মানুষ টা হচ্ছিস তুই।আমাদের পরিবার টাকে মেয়েটা খুবই বিশ্বাস করে।রাত্রিবেলা মর্ম’র সাথে বেড়াতে যায় এই বিশ্বাসের জোরেই।আমাদের বাসায় এতদিন ধরে থাকার সাহস পেয়েছে তোর কারণেই।ও একটা মানুষ কেই সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে সেটা তুই।বুঝেছিস তো?
মৈত্রী বাবার দিকে তাকালো।ওর চোখ লাল হয়ে আছে।একটু কাঁদলেই মৈত্রীর চোখ লাল হয়ে যায় সেটা জানেন উনি।বললেন,ও নিজেও আমাদের বাসায় থেকে যেতে চায়।তাই আমি চাই একটা বন্ধন তৈরী করতে।
– কি রকম আব্বু?
– তুই ওকে বিয়ে করবি?
প্রশ্নটা আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত মনে হলো মৈত্রীর।এত কষ্টের পর মেয়েটাকে একটু সুখের পরশ যদি দিতে পারতো নিজেকে ধন্য মনে করতো ও।সাফায়েত উল্লাহ সাহেব বললেন,ও অনেক দিন যাবত ফোভিয়ায় ভুগছে।এই মুহুর্তে ওকে হাসিখুশি রাখাটা খুবই দরকার।সেটা ও এ বাড়িতে থাকলে পাবে।তাছাড়া মিশু নিজেই এ বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইছে না।আমি মনে করি,এটাই সব থেকে ভালো সিদ্ধান্ত।
মৈত্রী একবার মিশুর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকালো।খুবই পবিত্র আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছে মুখটা।এই মেয়েটা একা একা বাসায় থাকলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে।মৈত্রীর নিজের ও ইচ্ছে করছে সারাজীবন মিশুকে আগলে রাখতে। ও একটু ভেবে বলল,সিদ্ধান্ত টা ভালো।কিন্তু মিশু কি এটাই চায়?
– সেটা আমাদের চেয়ে তোর ভালো বোঝার কথা।শুনলাম ও নাকি তোর উপর রাগ ঝাড়তেই এই কাজটা করেছে?
সাফায়েত উল্লাহ সাহেব আঙুল দিয়ে আয়নার দিকে দেখিয়ে দিলেন।ড্রেসিংটে
বিলের আয়নার মাঝখানটা ভেঙে আছে।ও সেদিকে তাকিয়ে আবারো বাবার দিকে তাকালো।
বাবা বললেন,মিশু তোর ভরসাতেই এ বাড়িতে আছে।আর বেশিরভাগ সময় তোর সাথেই কাটিয়েছে।তুই নিজেই একজন মনের ডাক্তার।ব্যাপার টা তোর আগে বোঝা উচিৎ।ভেবে চিনতে সিদ্ধান্ত নে।তোর ইচ্ছা না থাকলে মর্ম’র সাথে ওর বিয়ে দিয়ে ওকে এখানে রেখে দিবো।
মৈত্রী চমকে উঠল এ কথায়।মিশুকে পাওয়ার সুযোগ টা কিছুতেই ছাড়তে চাইবে না ও।বাবার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না।
সাফায়েত উল্লাহ সাহেব বললেন, আমি ভেবেছি ওকে আমার মেয়ে করে নিজের কাছে রাখবো।মেয়েটাকে খুবই আপন মনে হয়।আমার একটা ছেলের সাথে ওর বিয়ে দিয়ে আমার বিজনেসের সবকিছু ওকে বুঝিয়ে দিবো।তারপর দু বাপ মেয়ে মিলে বিজনেস দেখাশোনা করবো।মেয়েটাকে সবসময় ব্যস্ত রাখা দরকার।আর তোরা ক্যারিয়ারের পিছনে ছুটবি নাকি হিমালয় জয় করতে ছুটবি সেটা তোদের ব্যাপার।
মৈত্রী বলল,কিন্তু আব্বু মিশুকে এত তাড়াতাড়ি সংসারে জড়িয়ে ফেলাটা কি ঠিক হবে? ওর পড়াশোনা আছে,ক্যারিয়ার আছে।
সাফায়েত উল্লাহ সাহেব বললেন, হ্যা।সেজন্যই তো ওকে নিজের কাছে রাখতে চাইছি।ওকে সংসারের কোনো দায়িত্ব দেয়া হবেনা।ও শুধু খাবে,পড়াশোনা করবে,আর পুরো বাড়ি নেচেনেচে বেড়াবে।আমার সাথে অফিসেও যাবে।খুজিন্তাকে যেমন নিজের মেয়ে করে নিয়েছি,ওকে ও নিয়েছি।তানিনের মতই ওরা এ বাড়িতে থাকবে।যা মন চাইবে,তাই করবে।
মৈত্রী খুশি হয়ে বলল,থ্যাংকস আব্বু।এতে করে ওর জীবন থেকে বিষণ্ণতা নামক অভিশাপ টা দূর হয়ে যাবে।
– প্রথম দিন ও যখন এসেই তোর মাকে জড়িয়ে ধরেছিল,চোখের পানি মুছে দিয়েছে, তখন ই আমি ভেবেছি তোর সাথে ওর বিয়ে দিবো।যাই হোক,কাল সকালেই তুই,আমি আর তিন্নি মিশুদের বাসায় যাবো।সরাসরি ওদের বাসার সবার সাথে কথা বলে একটা সিদ্ধান্তে আসবো।
তানিন এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে শুনছিলো সবকিছু।ওর খুবই আনন্দ হচ্ছে।মিশুর কষ্ট দেখে বুক ফেটে কান্না আসতে চাইছিলো।ওই মেয়েটাকে সব সময়ের জন্য এ বাড়িতে রেখে দিলে খুবই ভালো হয়! সবসময় ওকে সাথে নিয়ে গল্প হাসিতে ব্যস্ত রাখলে ও দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে।
সাফায়েত উল্লাহ সাহেব ও মৈত্রী বেড়িয়ে আসলো ঘর থেকে।মৈত্রী তানিনের রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো। আর তানিন অনেক্ষণ মিশুর মাথায় জলপটি দিয়ে দেয়ার পর ঘুমিয়ে পড়লো।কিন্তু কিছুতেই মৈত্রীর চোখে ঘুম নেই।নিজের অজান্তেই কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজিয়ে ফেললো ও।বড় হওয়ার পর কখনো ও এভাবে কাঁদেনি।আজ মিশুর কষ্ট দেখে ভিতর থেকে কান্না চলে এসেছে।পৃথিবীতে মানসিক যন্ত্রণার চেয়ে কঠিন কোনো অসুখ বোধহয় নেই।শারীরিক অসুস্থতা হঠাৎ হয়ে ভালো ও হতে পারে।কিন্তু মানুষের মস্তিষ্ক এমন ই একটা সিপিইউ, যা থেকে ভালো খারাপ কোনো স্মৃতি ই কখনো মুছে যায়না।হয়ত চাপা পড়ে থাকে।কিন্তু প্রতিমুহুর্তে তা ধীরেধীরে দহন করে শেষ করে দেয় মানুষকে।এর চেয়ে যন্ত্রণা আর হয়না!
চলবে..