অদ্ভুত মুগ্ধতা -২
পর্ব ৮
মিশু মনি
.
মিশু ঘাস ও লতাপাতা দিয়ে জংলী সেজেছে। যাকে বলে একদম পিওর জংলী।
মাথায় পাতার টায়রা,কোমরে পাতার বিছা,হাতে পাতার ব্রেসলেট, পায়ে পাতার নূপুর আর পুরো গায়েই পাতা দিয়ে আস্তরণ বানিয়ে একেবারে একাকার অবস্থা!
মিশুকে দেখেই মৈত্রী হো হো করে হেসে উঠলো। পাগল হয়ে গেলো নাকি মেয়েটা! এভাবে জংলী সেজেছে, দেখলেই যে কেউ জংলী ভেবে ভূল করবে। সবুজের ভিতরে মানিয়েছেও দারুণ! গায়ের রঙের সাথে সবুজের মিল আছে অনেক।
মিশু এগিয়ে এসে বললো, ইন্তানু জকোতোনুবাকাদুনা?
মৈত্রী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, বুঝি নাই। বাংলায় বলো।
– ইন্তানু জকিয়ান্তানামা জুনুবালানা?
– ধুর মেয়ে, এইসব কি বলো?
– লীলাবালিকা মেইনু ইন্তানুজুকুমিনা?
মৈত্রী হেসে বলল, মিশু রিয়েলি তুমি একটা….
– কি? আমি একটা?
– জংলী ভাষা ছাড়লা কেন? বলো বলো, বেশ মজা লাগছিলো তো।
– ইন্তাজানুবানা জুকিমান্তানানুবানা।
– হা হা হা,তুমি এই সাজেই থাকো। এভাবেই তোমাকে নিয়ে ঢাকায় যাবো। তুমি গাড়ি থেকে নেমে এভাবে আজগুবি ভাষায় কথা বলবা।পারবা না?
মিশু লাফিয়ে উঠে বলল, দারুণ মজা হবে। চলো না তাড়াতাড়ি চলো। আমি একটু লিজেন্ড হতে চাই।
– লিজেন্ড হতে চাও?
– হ্যা চাই। লি লি লিজেন্ড হতে চাই, ওয় ডিংকাচিকা ডিংকাচিকা।
মিশুর নাচ দেখে মৈত্রী হেসে উঠলো। নাচের ধরণ দেখলেও যেকেউ জংলী ভেবে ভূল করবে। মেয়েটা সত্যিই পারেও বটে!
মৈত্রী বলল, এসব পাতা পেলে কোথায়?
– পাশেই একটা জংগল আছে। আসো দেখাচ্ছি।
মিশু মৈত্রীকে নিয়ে একটু দূরে পাশের একটা জংগলে চলে গেলো। গাজীপুরে সত্যিই অনেক জংগল! নুহাশ পল্লীতে যেতেও জংগলের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। এখানকার জংগল টার অবস্থা আরো ঘন। চারিদিকে শুধু বিভিন্ন প্রজাতির গাছ আর গাছ! সবুজের শ্যামলিমায় ঢাকা। দেখলেই মনে একটা পবিত্রতার ছাপ চলে আসে। বাংলোর এত কাছেই এমন একটা জংগল পাওয়া যাবে, মৈত্রী ভাবতেও পারেনি। এর আগেও একবার এসেছিলো এখানে কিন্তু এই জংগলের এই দিকটা দেখা হয়নি।
মিশু ওকে নিয়ে অনেক ভিতরে চলে গেলো। চারিদিক ঘুরে ঘুরে দেখালো। নানান অদ্ভুত অদ্ভুত গাছ দেখে মৈত্রী অবাক চোখে চেয়ে রইলো।
মিশু বললো, এই গভীর জংগলে আপনাকে বাঁচাতে কেউ আসবে না।
– মানে! আমাকে মারতে কে আসবে?
– আমিই মারবো।
– সত্যি! আমাকে মেরে লাভ কি?
– এই মেরে ফেলা আর সেই মেরে ফেলা এক নয়।
– তাহলে?
মিশু একটু এগিয়ে এসে বললো, তোমার লজ্জাহরণ করবো।
মৈত্রী এক পলক তাকালো মিশুর দিকে। তারপর হো হো করে হেসে উঠলো। এমন জোরে আর অদ্ভুত ভাবে যে মনেহচ্ছে পুরো জংগল কাঁপিয়ে হাসছে। মিশু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো।
মৈত্রী বললো, অনেক বেলা হয়েছে। এবার চলো তো।
– বারে, লজ্জাহরণ করবো না?
– বিয়ের রাতে করিও এখন চলো পাগলী মেয়ে।
মৈত্রী মিশুর দিকে তাকিয়ে দেখলো বেচারি লজ্জায় ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে। ও অবাক হয়ে বলল, মিশু কি হলো তোমার?
– কথা বলবেন না তো।
– কেন?
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
– দেখছেন না আমি লজ্জায় নীল হয়ে যাচ্ছি!
– হা হা, লজ্জায় তো মানুষ লাল হয়, কেউ আবার নীলও হয় নাকি?
– হ্যা হয়,এটা আমার স্টাইল।
মৈত্রী কিছু না বলে হাঁটা শুরু করেছে। মিশুর সাথে বেশিক্ষণ থাকাটা সুবিধার না। মেয়েটা ইদানীং বড্ড ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। কখন কি করে বসে ঠিক নেই। পাগলী একটা!
মিশু মুখটা মিটমিট করতে করতে মৈত্রীর পিছুপিছু যাচ্ছে। ছেলেটা এত ভদ্র কেন? মাঝেমাঝে একটু অভদ্র হলে কি এমন ক্ষতি হয়? বউয়ের সাথে সামান্য একটু অভদ্রতাও যে ভদ্রতার মধ্যেই পড়ে সেটাও কি বুঝেনা? নাকি এখনো মিশুকে বউ বউ লাগেনা? বুঝেছি, এবারে বউ হতে উঠতে হবে।
মিশু এসব ভাবতে ভাবতে হাঁটছে।মৈত্রী বারবার পিছনে ফিরে তাকাচ্ছে আর হাসছে। এভাবে হেঁটেই ওরা বাংলোয় ফিরে আসলো।মিশু বাংলোর সামনে থেকে কিছু ফুল তুলে নিয়ে খোপায় গুঁজে দিলো। তারপর আরো একটা লতার মালা বানিয়ে গলায় পড়লো। পুরো শরীর টা এখন লতাপাতায় ঢাকা। শাড়ির রংটাও কচি কলাপাতা রঙের হওয়ায় আরো ফুটে উঠেছে। বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে!
মিশু তাড়াতাড়ি চারিদিক টা ঘুরে এসে মৈত্রিকে বলল,আমি রেডি।এবারে চলো।
মৈত্রী বেড়িয়ে পড়লো মিশুকে নিয়ে।
★
মুগ্ধতা মর্ম’র আশেপাশেই ঘুরঘুর করছে। মর্ম বিভিন্ন ক্যামেরা নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে, লোকেশন দেখছে, আরো টুকটাক অনেক কাজ করছে। মুগ্ধতা ওকে সহযোগিতা করেছে। এসিস্ট্যান্ট এর চাকরী টা পেয়ে গেছে তো। এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। মর্ম একবার ও মুগ্ধতা’র দিকে তাকাচ্ছে না। তাকালেই বুঝতে পারতো মেয়েটা কিভাবে হা করে চেয়ে থাকে ওর দিকে।
এভাবে সারাক্ষণ মর্ম’র পাশে থেকে কাজ করতে লাগলো মুগ্ধতা। মর্মকে সত্যিই ভীষণ ভালো লেগে গেছে ওর। হঠাৎ ই কাউকে কেন যে ভালো লাগে, বুঝতে পারেনা ও। ভালো লাগাটা হঠাৎ এসে হঠাৎ ই হারিয়ে যায়! কিছু কিছু ভালো লাগা ভালোবাসায় রূপ নিয়ে চিরস্থায়ী হয়ে থেকে যায় হৃদয়ে।
সব কাজ শেষ করে মর্ম বলল, চলুন মনিহারে সিনেমা দেখতে যাবো।
মুগ্ধতা চমকে উঠে বলল, আমাকে বলছেন?
– তো? আশেপাশে কেউ থাকলে তাকে বলছি।
– কিন্তু মনিহার তো সেই স্টেশনে। এখান থেকে অনেক দূর।
– তাতে কি? আজ আর কোনো কাজ নেই। কাল থেকে আবারো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বো। সময়ই পাবো না। তাই আজকেই ঘুরে আসিনি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে বিখ্যাত সিনেমায় মুভি না দেখলে কি হয়?
মুগ্ধতা বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠে বলল, আমিও কখনো ভিতরে ঢুকিনি। শুনেছি উপরতলাতেও গাড়ি নিয়ে ওঠা যায়। বাইরে থেকেই দেখেছি কিন্তু কখনো মুভি দেখা হয়নি সিনেমা হলে।
– তাহলে দ্রুত রেডি হয়ে নিন। বিকেল থেকে সন্ধ্যার শো দেখে রাতেই ফিরবো। আমার বোনও চলে আসবে, ওদেরকে রিসিভ করে নিয়ে আসবো।
মুগ্ধতা এক পলক চেয়ে থেকে রুমে চলে গেলো। এতবড় একজন ডিরেক্টরের সাথে সিনেমা দেখতে যাওয়ার ব্যাপার টা বিস্ময়কর লাগছে। বেশ উত্তেজনাপূর্ণ ব্যাপার ই বটে!
মৈত্রী গাড়ি নিয়ে এসে পলওয়েল কারনেশন শপিং কমপ্লেক্সের সামনে দাড় করালো।
মিশু বলল, এখানে কি করবো?
– কেনাকাটা করবা। নামো,
– এখানে? এই অবস্থায়?
– এখানে নামলেই লিজেন্ড হতে পারবা। নেমে পড়ো।
মিশু গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়ালো। মৈত্রী গাড়ি পার্কিং করতে নিয়ে গেলো। মিশু খেয়াল করলো আশেপাশের লোকজন ওর দিকে হা করে চেয়ে আছে। এটাই স্বাভাবিক। যেরকম জংলী সাজে এসেছে, তাতে সবার আরো অবাক হয়ে যাওয়ার কথা। যেকারো মনে হবে মেয়েটা জংগল থেকে ভূল করে শহরে চলে এসেছে।
মৈত্রী গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করতেই দেখলো মিশুর ফোন বেজে চলেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে কল করেছে Khuzinta vabi. মৈত্রী রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে খুজিন্তার গলা ভেসে আসলো- কিরে মিশু, রোমাঞ্চ হলো?
মৈত্রী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। তারমানে খুজিন্তাই মিশুর কানে এসব ঢোকাচ্ছিলো! আজব!
খুজিন্তা বলল, যেভাবে বলেছিলাম সেভাবে করেছিস তো? দ্যাখ মৈত্রী ভাইয়া কিন্তু একদম বোরিং একটা মানুষ। যদিও লোকটা ভালো কিন্তু মেয়েরা যে সবসময় দুষ্টু দুষ্টু ছেলেদের পছন্দ করে সেটা ওনাকে বুঝতে হবে তো। এই বয়সে আমরা একটু দুষ্টুমি ই তো চাই। সেটা না পেলে কি ভালো লাগে?
মৈত্রী বেশ কড়া গলায় বলল, মিশু ফোন রিসিভ করেনি।
খুজিন্তার ভয়েসটা যেন একটু কেঁপে উঠলো। ভাসুরের সম্পর্কে এসব বললে ভাসুর যদি নিজ কানে শুনে ফেলে, কিরকম লজ্জার হয় ব্যাপারটা! এটা বোধহয় শুধুমাত্র একটা মেয়েই বুঝতে পারবে। খুজিন্তা জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল, সরি ভাইয়া।
বলেই টুক করে ফোন কেটে দিলো। কিন্তু মৈত্রীর মুখের ধরণ টা হলো একদম দেখার মত। এসব কি বললো খুজিন্তা? অবশ্য ঠিকই বলেছে। কিন্তু মিশুকে বিন্দুমাত্র আঘাত করতে চায়না বলেই ও এখন অব্দি মিশুর সাথে কখনো অভদ্র আচরণ করেনি। কিন্তু এ তো দেখছি একেবারে উলটো ব্যাপার!
মৈত্রী কৌতুহল বশত মেসেজ অপশনে ঢুকে মিশু ও খুজিন্তার এসএমএস গুলো দেখতে লাগলো। দেখতে দেখতে একেবারে লজ্জায় মৈত্রীর ফর্সা মুখ লাল টুকটুকে হয়ে গেলো! রাতে মৈত্রীর সাথে ঘুমানোর আইডিয়া টাও খুজিন্তাই দিয়েছে। আরো কত রকম দুষ্টু বুদ্ধি! মেয়েরা যে এসব ব্যাপার এভাবে শেয়ার করতে পারে সেটা দেখেই মৈত্রীর বেশ লজ্জা লজ্জা লাগছিলো। অবশ্য এতে মিশুর কোনো দোষ নেই। খুজিন্তার প্রতি প্রথমে রাগ হলেও পরে আর রাগ করতে পারলো না।কারণ একটা মেসেজ দেখেই মৈত্রীর মনে হলো, এটা অন্যায় কিছুই হয়নি।
খুজিন্তা লিখেছিল,মিশু তুই বড় হয়েছিস। দুদিন বাদে তোর বিয়ে। তুই যেরকম কচি খুকি,তাতে তোর কপালে দুঃখ আছে বুঝলি? এসব ব্যাপার তোর জানা দরকার।
মেসেজ টা দেখে মৈত্রী হাসলো। আর একটুও রাগ করার ইচ্ছে নেই।
ও গাড়ি থেকে নেমে মিশুর কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। কিন্তু একটু এগিয়ে এসেই দেখলো, একগাদা ছেলেপেলে আর লোকজন মিশুকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আর অনেকেই ওর পাশে সেলফি তুলছে। কেউবা ক্যামেরায় বিভিন্ন এংগেলে ছবি উঠাচ্ছে, আর মিশু বিভিন্ন পোজ দিয়ে তাদের সাহায্য ও করছে। পাগলী মেয়েটা!
একটু এগিয়ে আসতেই মৈত্রী দেখতে পেলো, মিশু একজন পুলিশের সাথে কথা বলছে।
মিশু বলছে, ইন্তা আন্না কুতিবো হেতি নিবা নানুমাকানি আজাই উরবো নিকুলা ইন্তাগো।
পুলিশ লোকটা হা করে শুনছে ওর কথা। যদিও এই ভাষার বোধগম্য ব্যক্তি এই শহরে নেই, কারণ ভাষাটা মিশুরই আবিষ্কার। তবুও পুলিশটা এমন ভাব ধরছে যেন সে সবই বুঝতে পারছে। মৈত্রী কাছে না এসেই দূরে দাঁড়িয়ে কাহিনী টা উপভোগ করতে লাগলো। ওর ও বেশ মজা লাগছে।
পুলিশ জিজ্ঞেস করলো, আপনি বাংলা ভাষা বোঝেন?
– ইনুনিকা আলালাই উড়ুক্কু বিনাবাই নেভিয়ান্তা নু।
পুলিশ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ওহ আচ্ছা। ইংরেজি বুঝেন?
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, সামথিং সামথিং। নট এ মাচ।
– ওহ আচ্ছা আচ্ছা। আপনার ইংরেজি উচ্চারণ বেশ চমৎকার দেখছি।
– আই লার্ন্ট ইংলিশ ফর্ম এ জেন্টেলম্যান।
– তাই? কে সে?
মিশু আশেপাশে তাকিয়ে মৈত্রীকে দেখতে পেয়ে একবার চোখ মারলো। তারপর মৈত্রীকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়ে বলল, হি ইজ হি।
এবারে সবার দৃষ্টি চলে গেলো মৈত্রীর দিকে। এই তামিলভাষী জংলী মেয়েকে সে কোথ থেকে উদ্ধার করে আনলো সেটাই জানার কৌতুহল সবার চোখে! মৈত্রী মুখ টিপে হাসলো।
চলবে..