অদ্ভুত মুগ্ধতা-২ প্রথম পর্ব

অদ্ভুত মুগ্ধতা-২
প্রথম পর্ব
লিখা: মিশু মনি
.
আকাশ টা ভীষণ মেঘ করে এসেছে।এখুনি বোধহয় বৃষ্টি নামবে।

আনন্দে নেচে উঠলো মিশুর মনটা।এই সময়ে বৃষ্টিটাকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।হুমায়ূন আহমেদের বৃষ্টিবিলাসে বেড়াতে এসেছে ও।একদিকে বৃষ্টিবিলাস,একদিকে দিঘী লীলাবতী।সন্ধ্যে হয়ে এসেছে প্রায়।এমন মুহুর্তে বৃষ্টি না এলে কি মানায়? বৃষ্টি না দেখেই এখান থেকে চলে গেলে বৃষ্টিবিলাসী আর হওয়া হলো কোথায়? বৃষ্টি এলে যদি আর না থামে,সেই অজুহাতে একটা রাত নুহাশে কাটিয়ে যেতে পারলে বেশ হতো।রাত্রিবেলা দিঘী লীলাবতী’র ঘাটে নেচে নেচে ভিজতে পারার একটা সৌভাগ্য হতো।এতক্ষণ মনেমনে বৃষ্টিকেই আহবান করছিলো মিশু।অবশেষে সেই প্রতীক্ষিত রিমঝিম সাড়া দিয়েছে!

মৈত্রী মিশুকে খুঁজতে খুঁজতে এসে দেখলো ও হুমায়ূন আহমেদ স্যারের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপ হয়ে।খুব মনোযোগ দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।এক রাশ ঘন কালো মেঘের উড়ে যাওয়া আর মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে ভেসে ওঠা বিজলীর খেলা দেখছে বোধহয়।মৈত্রী এগিয়ে এসে বললো,”কিগো এখানে দাঁড়িয়ে আছো যে? কত জায়গায় তোমাকে খুঁজলাম আর তুমি এখানে?”

মিশু একবার মৈত্রীর দিকে তাকালো কিন্তু কোনো উত্তর দিলোনা।ওকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছে।এত আনন্দিত হওয়ার মত কি ঘটেছে? নাকি বৃষ্টির জন্যই ওর চোখে মুখে এত আনন্দ!

মৈত্রী একবার কবরের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে বললো,”নয়ন তোমারে পায়না দেখিতে, রয়েছো নয়নে নয়নে।বাহ! এজন্যই আমি তোমাকে এতক্ষণ দেখতে পাইনি।”
মিশু হেসে বললো,হয়ত বা।এখন কি নয়নে নেই?
– উহু,এখন মণিতে।আচ্ছা,সেই আসার পর থেকেই তুমি এই জায়গাটাতেই বারবার এসে দাড়াচ্ছো।কেন বলোতো?
মিশু মৈত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,আমি মরে গেলে আমার কবরের পাশে এসে দাঁড়াবে না কখনো?

মৈত্রী একটু চমকে উঠে বললো,আমি সারাক্ষণ তোমার কবরে পড়ে থাকবো।

মিশু মৃদু হেসে বললো,তাহলে? আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ স্যার।উনি বেঁচে থাকলে আমি অবশ্যই ওনার সাথে একবার হলেও দেখা করতাম।সেই আশা তো পূর্ণ হয়নি,তাই ওনার কবরের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকি।খুব প্রশান্তি আসে হৃদয়ে।
মৈত্রী মুগ্ধ হয়ে বলল,হুমায়ূন আহমেদের লেখা তোমার এত পছন্দ? কখনো তো বলোনি!

এমন সময়ে ফোটায় ফোটায় বৃষ্টি পড়তে লাগলো।মৈত্রী দৌড়াতে শুরু করে মিশুকেও দৌড় দিতে বললো।ওরা এক ছুটে বৃষ্টিবিলাসের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।মৈত্রী মাথায় হাত দিয়ে নিজের চুল গুলো ঝেড়ে বলল,জোরে বৃষ্টি নামছে।আর সন্ধ্যাও হয়ে এসেছে প্রায়।চলো এক্ষুনি বেড়িয়ে পড়ি মিশু।

মিশু বেশ জোর গলায় বলল,না।আমি আজ এখানেই থাকবো।
– কি পাগলামি কথাবার্তা বলো! এখানে থাকার নিয়ম নেই সম্ভবত।আর তুমি থাকতে চাইলেই বা কে থাকতে দিবে বলো?
মিশু বাচ্চাদের মত জেদ করে বলল,আমি জানিনা,আমি বুঝিনা আর কিছু বুঝতেও চাইনা।ওই বুড়ো দাদুটা তো তোমার পরিচিত।তুমি ওনাকে বুঝিয়ে বলো গিয়ে।আমি এখানে আজকের রাতটা থাকবো।থাকবো থাকবো থাকবো।থাকা গেলেও থাকবো, না থাকা গেলেও থাকবো।
মৈত্রী চিন্তিত মুখে বললো,আব্বু আমাদের সন্ধ্যার আগেই যেতে বলেছিলো।তাছাড়া আমরা এখানে কোথায় থাকবো?
– গেটে বিশাল একটা বাড়ি দেখলাম যে? ওটা মনেহয় গেস্ট হাউজ।তুমি একবার দাদুকে বলেই দেখোনা।প্লিজ প্লিজ প্লিজ।

মৈত্রী একটু কঠিন গলায় বলল,সব কিছু নিয়ে জেদ করা ভালো নয় মিশু।এত জেদি স্বভাব কেন? আর আমাদের এখনো বিয়েই হয়নি।আমি কিভাবে ওনাকে বলবো আজকের রাতটা এখানে থাকবো? সব মানুষ তো সাফায়েত উল্লাহ সাহেব নন।উনি কি ভাব্বেন আমাদের?

মিশুর মনটা মুহুর্তেই খারাপ হয়ে গেলো।এভাবে না বকলেও পারতো মৈত্রী।এত সুন্দর আর প্রিয় একটা জায়গায় এসে থেকে যাওয়ার ইচ্ছা হওয়াটাই স্বাভাবিক।তাই বলে বকা দিতে হবে? এখানে থাকার নিয়ম আছে কিনা,লোকটা কিছু ভাব্বে কিনা মিশু তো এসব নিয়ে ভাবেনি।ওর ইচ্ছে হচ্ছিলো বৃষ্টিতে ভিজবে,দিঘীর পাড়ে বসে থাকবে,রাত্রিবেলা সবকিছু কেমন রহস্যময় সুন্দর লাগে সেটা উপভোগ করবে।কিন্তু মৈত্রী তো ওর মত করে ভাবছে না।একটা বার দাদুর সাথে কথা বললে কি এমন ক্ষতি হয়? উনি তো থাকার ব্যবস্থা করেও দিতে পারেন!

মিশু মুখ কালো করে এসব ভাবছিলো।মৈত্রী ওর দিকে না তাকিয়েই বলল,চলো বেড়িয়ে পড়বো।এমন বৃষ্টি না এলে দাদু আমাদের খুঁজতে বের হতো বুঝলে? সন্ধ্যা নেমে গেছে।
মিশু কিছু না বলেই একটা দৌড় শুরু করলো।সোজা ছুটতে লাগলো।মৈত্রী হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে।মিশু ছুটতে ছুটতে আড়ালে মিলিয়ে গেলো।কই যে গেলো মেয়েটা! যদি আর ওকে খুঁজে পাওয়া না যায়? কিরকম বিশ্রী ব্যাপার হবে।আর এখানকার কর্মচারীরাই বা কি মনে করবে? এমনিতেই রাত নেমে এসেছে,এখনো বেরোনো হলোনা।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন



মিশু ছুটে এসে একটা মাটির ঘরের সামনে থামলো।হুমায়ূন আহমেদ শখ করে মাটির ঘরও তৈরী করেছিলেন! কি অদ্ভুত! এখানে যত জঙ্গল হয়ে আছে,সাপ খোপ থাকতে পারে।তাই সেদিকে গেলো না।সামনের রাস্তা ধরে হাটতে লাগলো।জোরে বৃষ্টি নেমেছে।বৃষ্টির ফোটা গায়ে পড়ামাত্রই ঠাণ্ডা অনুভূত হচ্ছে।মিশু একটু এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো একবার।সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারময় পরিবেশ আর বৃষ্টির সৌন্দর্যের সাথে মিশে গিয়ে নুহাশ পল্লীর সৌন্দর্য অনেক বেড়ে গেছে! অদ্ভুত মুগ্ধতায় ছেয়ে যাচ্ছে মনটা! কি মন মাতানো সৌন্দর্য! হাজারো গাছ আর লতাপাতায় ঘেরা,কি অপরূপ সুন্দর ই না লাগছে! হুমায়ূন স্যার নাকি এক হাজার প্রজাতির গাছ লাগিয়েছেন এখানে! কতটা বৃক্ষপ্রেমী হলে এটা করা যায়? এরিয়া টা অনেক ছোট,কিন্তু অনেক অচেনা অচেনা গাছ রয়েছে।সে জন্যই ভালো লাগে বেশি!

মিশু হাটতে হাটতে দিঘী লীলাবতী’র কাছে এসে দাঁড়ালো।পুকুরে বড় বড় বৃষ্টির ফোটা পড়ছে।ভূতবিলাসের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবারো দিঘী’র কাছে এসে দাঁড়াল ও।ঘাটে দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগলো বৃষ্টিতে।চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ করে দুহাত দুদিকে মেলে দাঁড়িয়ে রইলো।এমন সময় মৈত্রী ছুটতে ছুটতে এসে হাজির।ওর গায়ে রেইনকোট।গাড়িতে সবসময় রেইনকোট রাখে ও।সেটা পড়ে চলে এসেছে মিশুকে খুঁজতে।মিশুর পিছনে দাঁড়িয়ে ওর বৃষ্টিতে ভেজার দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলো।ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে।অন্ধকারে ওকে আরো বেশি মায়াবী লাগছে।এ জন্যই গল্প,উপন্যাস আর সিনেমা গুলোতে বৃষ্টিভেজার দৃশ্য উঠে আসে!

মিশু যতক্ষণ চোখ বুজে রইলো মৈত্রী কোনো কথা বললো না।মিশু চোখ মেলে ওকে দেখতে পেয়ে বলল,তুমি!
মৈত্রী কিছু জবাব দেয়ার আগেই মিশু বললো,চলো ফেরা যাক।এরচেয়ে বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবেনা।সুন্দর জিনিস অল্প সময়ের জন্য উপভোগ করতে হয়।
তারপর মৈত্রীর হাত ধরে বাধাই করা রাস্তাটা ধরে এগোতে লাগলো।সোজা এসে গাড়িতে উঠে পড়লো।মৈত্রীর পরিচিত দুজন লোক এখানে দেখাশোনা করে।ওরা বৃষ্টি থামার পরে যেতে বলল ওদেরকে।কিন্তু মিশু আর এক মুহুর্তও থাকতে রাজি নয়।ও একরকম জোর করেই মৈত্রীকে নিয়ে গাড়িতে উঠল।
.
মৈত্রী খুব ধীরেধীরে গাড়ি চালাচ্ছে।মিশু ভেজা অবস্থাতেই গাড়িতে বসে আছে।মৈত্রী একবার মিশুকে বলল,আমার শার্ট প্যান্ট খুলে দেই পড়বে?
মিশু মুখ টিপে হেসে বললো,না।তুমি কি পড়ে থাকবে তাহলে?
– আমার তো গায়ে রেইনকোট আছে।আর তুমি একদম ভিজে গেছো।এই অবস্থায় মোহাম্মদপুর অব্দি গেলে কঠিন অসুখ করবে।
মিশু অভিমানের সুরে বলল,করুক।তাতে তোমার কি?
– রাগ করে আছো? সরি মিশু।আমার তখন ওভাবে রিয়েক্ট করা উচিত হয়নি।
মিশু কোনো জবাব দিলোনা।মৈত্রী সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছে।খুব জোরে বৃষ্টি হচ্ছে।রাত নেমেছে অনেক আগেই।এত রাতে এই ঝড় বৃষ্টিতে গাড়ি চালিয়ে বাসায় যেতেই তো মিশুর ঠাণ্ডা বসে যাবে একেবারে।তাছাড়া এরকম আবহাওয়ায় গাড়ি চালাতেও ইচ্ছে করেনা।একটু ভেবে বলল,মিশু একটা কাজ করা যায়না?
– কি কাজ?
মৈত্রী বললো,কাছেই একটা পরিচিত খামারবাড়ি আছে।আমরা বরং সেখানে যাই? ভালো গেস্ট হাউজ আছে,রাত্রে থাকতে অসুবিধা হবেনা।এত ঝড়ের রাতে বাসায় ফেরার চেয়ে ওখানে গিয়ে থাকলে ভালো হবে।কাল দিনের বেলা জায়গাটা ঘোরাঘুরি করে দেখা হয়ে গেলে বাসায় ফিরবো।
মিশু একটু রাগত কিন্তু ঠাণ্ডা স্বরে বলল,তোমার আব্বু কিছু বলবে না? ওখানকার লোকেরা কি ভাব্বে? আমাদের এখনো বিয়ে হয়নি।
মৈত্রী হেসে বললো,বাব্বাহ এত্ত অভিমান! তোমার জন্যই তো বলছি ওখানে যেতে। ভেজা কাপড়ে আর কতক্ষণ ই বা থাকবে।তাছাড়া বৃষ্টি বেড়ে যাচ্ছে,এত রাতে এই ঝড়ে কিভাবে যাবো বলো?

মিশু কিছু না বলে চুপ করে রইলো।ওর এখন চুপচাপ বৃষ্টি দেখতেই ভালো লাগছে।কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না।ওকে চুপ থাকতে দেখে মৈত্রী বলল,আহা! এভাবে রেগে থেকো না প্লিজ।সরি বললাম তো।এখন বলো এখানকার খামারবাড়ি তে যাবা? নাকি রাজেন্দ্রপুরে একটা রিলেটিভ আছে সেখানে যাবা?

– খামারবাড়িতেই চলুন।কারো বাসায় যাবো না এখন।

বৃষ্টির তোড় বেড়েই চলেছে।মৈত্রী দ্রুত গাড়ি চালিয়ে খামারবাড়িতে নিয়ে আসলো।ম্যানেজার সাহেবকে ফোন দিয়ে কথা বলে তাড়াতাড়ি বাংলোয় আসতে বললো।
ম্যানেজার আসার পর মৈত্রী সব খুলে বললো।তারপর জিজ্ঞেস করলো, এখানে কাছেই কোনো মার্কেট আছে কিনা? মিশুর জন্য জামা কিনতে হবে।

ম্যানেজার চাচা জানালেন উনি ব্যবস্থা করে দিবেন এখনি।তারপর রুমের দরজা খুলে দিয়ে চলে গেলেন।কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই ফিরে আসলেন একটা শাড়ি,ব্লাউজ আর তোয়ালে নিয়ে।আকাশী রঙের শাড়ি দেখে মিশু বেশ খুশিই হলো।পাশের রুমে গিয়ে শাড়ি বদলে আসলো।

এসে দেখলো খাবারের ব্যবস্থাও হয়ে গেছে; ডিমের ওমলেট আর পরোটা।আপাতত এটাই খেয়ে থাকতে হবে,দেরীতে ভাত নিয়ে আসা হবে।বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে।এর মধ্যে এটাই যথেষ্ট খাবার।মিশু মৈত্রীর সামনেই বসে পড়লো খাওয়ার জন্য।মৈত্রী খেয়াল করে দেখলো ভেজা চুল মিশুর মুখের উপর এসে পড়েছে।বেশ সুন্দর আর মায়াবী লাগছে ওকে! আর শাড়িতে ওকে এতটা মিষ্টি লাগে,মনটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়! মৈত্রী মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো!

চলবে.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here