#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_১৬
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
থমথমে পরিবেশ। গুমোট, নিস্তব্ধতা ভেতরের অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলছে। আয়েশা সুলতানা উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছেন। দরজার মোটা পর্দার আড়ালে এক-জোড়া পা দেখা যাচ্ছে। ভেতর ঘরে তুমুল অস্থিরতা। টানটান উত্তেজনা কাজ করছে। বাবার একটা হ্যাঁ, না তে তার জীবনের অনেক কিছু পাল্টে যাবে। হয়তো সুন্দর গোছানো একটি জীবনে পদার্পণ করবে নয়তো সবটা ওলটপালট হয়ে যাবে। তরী মনে মনে শতবার বিধ্বস্ত হলো। খুব করে চাইলো তার জীবনের জোড়াটা শক্তভাবে লেগে থাকুক মাহমুদের সাথে।
নিস্তব্ধতার বুক ছিঁড়ে রুক্ষ স্বর শোনা গেল। মরুভূমির মতো খা খা করে উঠলো অন্তঃকরণ।
বাবা গম্ভীর স্বরে আয়েশা সুলতানার উদ্দেশ্যে বললেন,
-“দুঃখিত! আপনাকে খুশি করতে পারছিনা। আমি আপাতত মেয়ের বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবছিনা।”
আয়েশা সুলতানা খানিকটা চুপ রইলেন। নিরব হয়ে ধাতস্থ করলেন নিজেকে। শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিলেন। বললেন,
-“এখন বিয়ে দিতে না চাইলে না দেবেন। এতে আমাদেরও খুব একটা আপত্তি নেই। আপনারা রাজি থাকলে আপাতত আংটি পরিয়ে রাখা যায়।”
তরীর মা সরাসরি কিছু বলছেন না। তবে চোখের দৃষ্টি বলে দিচ্ছে ‘তরীর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, সেটা আপনি জেনেও কীভাবে প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন?’
যদিও তরীর মা মুখ ফোটে কিছুই বললেন না, তবুও আয়েশা সুলতানার অস্বস্তি বাড়লো। লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজে পেলেন না।
তরীর বাবাকে ক্রমশ গম্ভীর দেখালো। কাঠখোট্টা স্বভাবের মানুষটি নিজের গাম্ভীর্যতা বজায় রেখেই বললেন,
-“আমি আমার বড়ো ভাইকে কথা দিয়ে রেখেছি। কথা বরখেলাপ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার ভাতিজা দেশে ফিরলেই বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে যাবে।”
আয়েশা সুলতানা আর কথা খুঁজে পেলেন না। এই মুহূর্তে কথা বলা মানে নিজের অসম্মান ডেকে আনা। উঠে পড়লেন তিনি। রামির মুখ ফ্যাকশে দেখালো। তরী আপুকে তার ভীষণ পছন্দ। অন্য কোথাও বিয়ে হবে শুনেই কেমন বুক জ্বালা করছে।
পর্দার আড়ালের পা জোড়া থেমে গেল। তর্জন-গর্জন করে বর্জ্রপাত হলো। বিদ্যুৎ চমকানোর মতো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো তরীর। তার বিয়ে ঠিক, অথচ সে অবগত নয়। তাও আবার যাকে সারাজীবন বড়োভাই মেনে এসেছে, তাকে কিভাবে স্বামীর আসনে বসাবে? আকাশ-পাতাল এক হয়ে গেল যেন। বিষন্নতার ভীড় ঠে*লে বাড়লো রাগের মাত্রা। টানা চোখ দুটো কানায় কানায় জলে ভর্তি। টুপটাপ বৃষ্টি ফোঁটার মতো ঝরে গেল সমস্ত আশা, আকাঙ্ক্ষা। মাথার ভেতর একদলা ভোতা অনুভূতির সঞ্চার হলো। প্রচন্ড রাগে চিড়বিড়িয়ে উঠলো মন। বাধ্য সন্তানের ট্যাগ লাগানো তরী পারলোনা বাবা-মায়ের মুখের উপর চিৎকার, চেঁচামেচি করতে। কেবল টুপ করে ভোরের ফুলের মতো ঝরে গিয়ে মিইয়ে গেল। তার জীবনের রঙিন অধ্যায় হারিয়ে সাদা-কালো অধ্যায় পাতা খুলে বসলো। ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে খিল পড়লো ভেতর থেকে। আঁটকে রাখা জলকণার ভারিবর্ষণ হলো।
তরী কাঁদছে। শব্দহীন নিরব কান্না। টকটকে লাল চোখ দুটো তার অপ্রকাশিত ভালোবাসার সাক্ষী। সে তো জীবনে প্রেম চায়নি। আর না মাহমুদকে প্রথম দেখায় মুগ্ধ হয়েছে। তার প্রেমে কোন নিমন্ত্রণ ছিলোনা। একেবারে উড়ে এসে জুড়ে বসা প্রেম। তবুও এত গভীরতা, মায়া, কেন? এই কেন এর উত্তর তরী খুঁজে পেলোনা। শুধু বুঝতে পারলো এই প্রেম তার জীবন-মরণের প্রেম। পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া প্রেম। তার কষ্ট বুঝি কেউ উপলব্ধি করতে পারবেনা! বাবা-মাকে ও ছাড়তে পারবেনা আর না তাকে বশীকরণ করা ওই মানবকে। কেন এলো তার জীবনে? তাকে এভাবে দগ্ধ করা খুব কি প্রয়োজন ছিল? ফোন বেজে চলেছে তুমুল শব্দে। তরী ধরলোনা। অবহেলায় পড়ে থাকা মুঠোফোন বারবার শব্দ করে অতিষ্ঠ করে তুলছে তাকে। তরী এখন ফোন রিসিভ করলেই কিছু একটা অঘটন ঘটে যাবে। হাউমাউ করে কেঁদে ফেলবে। এতটাও ছোট হতে চায়না সে।
★★★
মায়ের কাছে রিফিউজ হওয়ার কথা শোনার পর থেকেই প্রচন্ড মেজাজ খা*রা*প হয়ে আছে মাহমুদের। এই মুহূর্তে তরীকে খুব প্রয়োজন। মাহমুদ জানে তাকে কাছে পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবুও ফোনে একটুখানি প্রশান্তি খুঁজলো। অথচ মেয়েটা লাপাত্তা। তাকে ভয়*ঙ্কর যন্ত্রণায় ফেলে নিশ্চিন্তে পড়ে আছে। মাহমুদ আবারও কল দিলো। বরাবরের মতো এবারও সাড়া নেই। মাথা ধরেছে ভীষণ। মা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি আর দ্বিতীয়বার তরীদের বাসায় সমন্ধ নিয়ে যেতে পারবেন না। টিশার্ট ছাড়িয়ে ফ্যানের নিচে বসে রইলো মাহমুদ। মাথার ভেতর এখনো ধপধপ করে উঠছে।
রাতে এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটলো। লজ্জাবতী তরীর নম্বর থেকে কল এলো। মাহমুদ পলকহীন কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো ফোনের স্ক্রিনে। ভীষণ চেনা এই নম্বর তাকে খানিক স্তব্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। মাহমুদ ধীরে সুস্থে ফোন রিসিভ করলো। কানের পাশে শক্ত করে ধরলো মুঠোফোন। ওপাশ থেকেও নিরবতা। মাহমুদ স্তব্ধতাকে বিদায় জানিয়ে শব্দ তুললো,
-“তরী!”
ওপাশ থেকে ফুঁপিয়ে ওঠার শব্দ শোনা গেল। তরী কাঁদছে। বিচলিত হলো মাহমুদ। কন্ঠে উৎকন্ঠা ঝরে পড়লো,
-“কাঁদছেন কেন, তরী? সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আছো তো!”
তরী ফুঁপিয়ে উঠে চাপা গলায় বলল,
-“কিচ্ছু ঠিক হবে না। বাবা মানবে না।”
-“আমি কি আপনাকে এমনি এমনি বোকা বলি, তরী? আপনি সত্যিই বোকা। অল্পতে ভেঙে পড়লে চলবে? আমরা মানাবো আপনার বাবাকে। কোন না কোন পথ নিশ্চয়ই আছে। আপনি একদমই কাঁদবেন না।”
-“আপনি বাবাকে জানেন না। বাবা একরোখা। নিজের সিদ্ধান্তের উপর কারো মতামত টুকুও পছন্দ নয় উনার।”
-“চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?”
অতঃপর স্বর কোমল হয়ে এলো মাহমুদের। কঠিন আবেগ নিয়ে শুধালো,
-“তরী, আপনাকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। ভিডিওতে আসবেন?”
তরী এমনিতেও ভিডিও কলে ভীষণ লজ্জা পায়। তার ওপর আয়নায় তাকিয়ে দেখলো নিজের এলোমেলো অবস্থা। চোখমুখ ফুলে বি*শ্রী অবস্থা। জবাব না পেয়ে মাহমুদ আবারও বলল,
-“কী এত ভাবছেন, তরী? আপনাকে সবরকম ভাবেই আমার চোখে স্নিগ্ধ লাগে। প্লিজ আসুন না, তরী!”
তরী দ্বিধা ভরা গলায় জবাব দিলো,
-“আচ্ছা।”
মাহমুদ খট করেই লাইন কে*টে দিলো। তরী এক ছুটে ওয়াশরুম থেকে চোখেমুখে পানি দিয়ে এলো। মাহমুদ ভিডিও কল দিয়ে বসেছে। হাজারো অস্বস্তি নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে রিসিভ করে ফোন সামনে ধরলো তরী। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলে উসকোখুসকো, মলিন চেহারা। তবে ঠোঁটের কোনে ঠাঁই পেলো নিটোল হাসি। মুহুর্তের জন্য তরীর সংকোচ দূর হয়ে গেল। ফোলা ফোলা চোখজোড়া ফোনের স্ক্রিনে নিবদ্ধ। ঘোর লাগলো তরীর। এত সুন্দর মানুষ হয়? তরীর চোখ বলছে তার দেখা সেরা রূপবান এই লোক। অনিমিখ তাকিয়ে রইলো ক্লান্তিমাখা চেহারায়। মাহমুদ চুপটি করে তাকিয়ে দেখলো তার তরীর চোখের মুগ্ধতা, ভাসা ভাসা চোখজোড়া। চমৎকার হেসে উঠলো সে। রগঢ় করে শুধালো,
-“এমনভাবে কী দেখছেন, তরী?”
তরী ভড়কালো। লজ্জায় জবুথবু হয়ে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল,
-“কিছু না।”
মাহমুদের অনুরাগী স্বর,
-“আমি অনেককিছু দেখছি, তরী। এক টুকরো স্নিগ্ধ ভোর, বিলের জলে ফোটে ওঠা রঙিন পদ্ম।
আপনার দু-অক্ষরের ছোট্ট নামটি আমার পাশে চাই তরী। আপনি কেবল আমার তরী হবেন। আপনার হাতটি ধরার সুযোগ দেবেন আমায়?”
তরী কথা খুঁজে পেলোনা। সুখ সুখ যন্ত্রণায় বুকটা ধক করে উঠলো। একটু আগের বিরহ যেন তাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল বহুদূর। সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ভুলে বসলো এক মুহুর্তের জন্য। তরী আবেগে ভেসে উঠলো,
-“আমি শুধু আপনার হতে চাই। আপনি ছাড়া আর কারো নয়।”
মাহমুদের চোখ ঝলমল করে উঠলো। প্রশান্তিতে ভরে উঠলো মন। প্রফুল্লচিত্তে হেসে উঠলো। ফিসফিস ধ্বনিতে আওড়ালো,
-“আপনি শুধু আমার, তরী।”
টুপ করেই কল কে*টে গেল। দ্বিতীয়বার কল ব্যাক করার পরও ধরলোনা তরী। মাহমুদ ধরে নিলো হয়তো লজ্জা পেয়েছে নয়তো ঘরে কেউ এসেছে।
তরী ঠিক থাকলে সে সবরকম যুদ্ধে নামতে রাজি।
আজ একবার ভাইয়ার নম্বরে ডায়াল করলো।
-“কিরে কেমন আছিস?”
মাহমুদ শান্ত স্বরে জবাব দিলো,
-“হুম ভালো। তোমরা দুজন কেমন আছো?”
-“আলহামদুলিল্লাহ তোর ভাবি, আমি ভালোই আছি।”
মাহমুদ ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো। সময় নিয়ে নিচু স্বরে শুধালো,
-“কাল একবার তোমরা দুজন আসতে পারবে?”
-“কেন? জরুরি কিছু?”
-“হ্যাঁ, তোমাদের প্রয়োজন।”
-“অফিসের পর আসলে চলবে?”
-“এসো সময় করে।”
-“ঠিক আছে।”
ভাইয়ার সাথে কথা শেষ করে রামির ঘরে একবার উঁকি দিলো মাহমুদ। ছেলেটা পড়তে চায়না মোটেই। এখনো পড়ার টেবিলে উদাস হয়ে বসে আছে। কী যেন ভেবে চলেছে! মাহমুদ নিঃশব্দে পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাথায় দু’আঙ্গুলে টোকা দিয়ে বলল,
-“পড়া বাদ দিয়ে কী এত ভাবছিস?”
রামির কপালে চিকন দু-একটা ভাঁজ পড়লো। চিন্তিত স্বরে বলল,
-“আচ্ছা ভাইয়া, তরী আপুকে কিডন্যাপ করলে কেমন হয়? তখন দেখা যাবে আঙ্কেল মেয়ে হারানোর শো*কে রাজি হয়ে যেতে পারে।”
মাহমুদ বলল,
-“ পড়া বাদ দিয়ে এসব ভাবছিস? তোর দুষ্টু বুদ্ধি নিজের মাথায় রাখ। খবরদার আমাদের উপর এপ্লাই করতে আসবিনা। কিডন্যাপ করলে দেখা যাবে তরীর বাবা আমাদের দিয়ে জে*লে*র ঘানি টা*না*চ্ছে*ন!”
রামি ভাবুক হয়ে বলল,
-“তাহলে কী করা যায়?
আমি তরী আপুকে চাই মানে চাই। দরকার পড়লে তাদের দরজায় গিয়ে অনশন ধর্মঘট ঘোষণা করবো।”
বিরক্ত হয়ে তাকালো মাহমুদ।
-“অনশনে তুই ম*র*বি। তাতে তরীর বাবার কী?
তারচেয়ে বরং মন দিয়ে পড়াশোনা কর। এটা কাজে দেবে।”
রামি চোখমুখ কুঁচকে বলল,
-“পড়াশোনা আমার মোটেই ভালোলাগে না। কোন বাসায় কাজের লোক হিসেবে আমাকে রাখবে কি-না খোঁজ নিয়ে দেখো।”
মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কথা বাড়াতে চাইলোনা। এক্ষুণি এখান থেকে যাওয়া উচিত। নয়তো কথা বলেই ছেলেটা সারারাত পার করে দেবে। লম্বা কদমে রামির ঘর ছাড়লো মাহমুদ।
★★★
সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই সময়। বড়োভাই আর ভাবি এসে উপস্থিত। সন্ধ্যার চায়ের আড্ডা বসলো মাহমুদের ঘরে। মা ছাড়া তারা বাকি চারজন উপস্থিত। মাহমুদ তরীর ব্যাপারে কথা তুললো। তাদের সম্পর্কের কথা গোপন রেখে জানালো সে তরীকে পছন্দ করে। এতে তরীর উপর চা*প কম আসবে। মা যেতে চাচ্ছেন না। মাহমুদ চায় এবার সরাসরি সে যাবে, সাথে ভাই-ভাবি। একটা হেস্তনেস্ত সিদ্ধান্ত হবে। তরীকে যে তার বড্ড প্রয়োজন।
#চলবে……..#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_১৭
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
মাহমুদের একরোখা মনোভাবে বাঁধা সৃষ্টি করলো ভাইয়া। বিচক্ষণ মানুষ গম্ভীর স্বরে বললেন,
-“এখনই আমাদের যাওয়া ঠিক হবেনা। গতকাল মা যেহেতু গিয়েছেন, আমাদের একটু সময় নেওয়া উচিত। এখন গেলে তরীর বাবা উত্তেজিত হয়ে যেতে পারেন।”
মাহমুদের চোখেমুখে দুশ্চিন্তা। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে শুধালো,
-“তাহলে করণীয় কী?”
ইরা বলল,
-“এখনই যেহেতু তরীকে তার পরিবার বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে না। আমার মনে হয় এখন চুপ থাকা উচিত। কিছুদিন পর নাহয় ঠান্ডামাথায় আরেকবার প্রস্তাব রাখা যাবে।”
মাহমুদ স্বস্তি পেলো না। ভাই-ভাবির কথাও ভেবে দেখলো। এখন যাওয়াটা উচিত হবেনা।
এখন আর চাইলেও তরীকে সামনে পাওয়া যাবেনা। ওর বাবা-মা নিশ্চয়ই এখন আর তাদের বাসায় আসতে দেবেনা। কপাল চেপে ধরলো দু-হাতে। ঝিমঝিম করে উঠলো মাথা।
সকালে ভাইয়ার অফিস থাকায় দ্রুত রাতের খাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়লো তারা।
★★★
শান্ত, স্নিগ্ধতার প্রতীক হয়ে আসে শরৎ। যৌবনে হেসেখেলে আবেদনময়ী করে তোলে নিজেকে। সদ্য প্রেমে পড়া প্রেমিকের মতো মুগ্ধ হয় মানুষ। শিশিরভেজা শিউলি লুটিয়ে পড়ে দূর্বাঘাসের বুকে। ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে শরৎ এর এই অনুপম সৌন্দর্যে বিভোর মাহমুদ তরীকে তুলনা করলো শিশিরভেজা শিউলির সাথে। সে দূর্বাঘাস। তার সৌভাগ্য বলে কোমল সুগন্ধি ফুল তার বুকে লুটিয়ে পড়বে কোন একসময়। মেয়েটা তখন কতখানি লজ্জা পাবে ভেবেই হাসলো মাহমুদ। ভাবতে ভাবতেই হাতের কফি ঠান্ডা হয়ে এলো। ঘরে ফিরে ঠান্ডা কফি রেখে দিল। কলেজের জন্য বের হতেই সিঁড়িতে চোখাচোখি হয়ে গেল তরীর বাবার সাথে। মাহমুদ সচারাচর দেখা হলেই সালাম দেয়। আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা। তরীর বাবা সালামের জবাব দিয়ে পাশ কাটিয়ে উপরে উঠে গেলেন। ভালো-মন্দ কিছু বললেন না। মাহমুদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নেমে পড়লো। আজকাল একা একাই কলেজ যেতে হয়। তরীর দেখা পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছে। তার দেখা পাওয়া মানে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া।
ক্লাস শেষ দিয়ে ক্লান্ত মাহমুদ ঘন্টার পথ পাড়ি দিলো। বাস জার্নি করে দাঁড়ালো তরীর ক্যাম্পাসের সামনে। রোদের তেজ ম্লান হয়ে এলেও গরম পড়ছে খুব। শার্টের টপ বোতাম দুটো খোলা। ক্লান্তি এসে ভর করেছে চোখ দুটোতে। পুরো ক্যাম্পাস ফাঁকা হয়ে গেল। তরীর দেখা পাওয়া গেল না। মাহমুদের শিথিল কপালে ঢেউ বয়ে গেল। পকেট হাতড়ে মুঠোফোন বের করে চাপলো তরীর নম্বরে। রিং হতে হতে শেষ মুহূর্তে ফোন ওঠালো তরী। নিস্তেজ কন্ঠে বলল,
-“হ্যালো।”
মাহমুদের সমস্ত গ্লানি নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। শীতল বাতাস শরীর ছুঁয়ে দিলো যেন। থেমে থেমে মোলায়েম কন্ঠে শুধালো,
-“কোথায় আপনি, তরী?”
তরী চুপ করে রইলো খানিকক্ষণ। শোনা গেল শ্বাস-প্রশ্বাসের নমনীয় শব্দ। সাড়া না পেয়ে মাহমুদ ফের বলল,
-“ক্যাম্পাসে দেখছি না কেন আপনাকে?”
এতক্ষণে তরীর মৃদু স্বর ভেসে এলো,
-“আজ ক্লাস এটেন্ড করিনি।”
-“আমি ক্যাম্পাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
তরীর উৎকণ্ঠা টের পেলো মাহমুদ।
-“আপনি আমাকে না জানিয়ে কষ্ট করে কেন গেলেন?”
মাহমুদ তরীর অস্থিরতায় হাসলো।
কাতর গলায় শুধালো,
-“আমি ভীষণ ক্লান্ত, তরী। একটু দেখা দেবেন?”
তরী কিছু বললনা। খট করেই লাইন কে*টে দিল। মাহমুদ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ। ফোন পকেটে ঢুকানোর কোন তাড়া নেই। কিছু একটার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে চেয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরই তরীর নম্বর স্ক্রিনে ভেসে উঠলো। ঠোঁটের কোন চওড়া হলো মাহমুদের। যেন সে জানতো তরী দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে ঠিকই তাকে কল দেবে। এক ঝলক দেখা দিয়ে তৃষ্ণা মেটাবে। রিসিভ করতেই তরীর শুভ্র মুখশ্রী ভেসে উঠলো। গভীর চোখজোড়া তাকেই দেখছে। খানিকটা দ্বিধা, খানিকটা লজ্জার মিশেলে মোহনীয় রূপ সৃষ্টি হলো। মাহমুদ বিভোর নয়নে চাইলো। তরীর চিকন ঠোঁট জোড়া নড়েচড়ে উঠলো,
-“ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে। দুপুরে খেয়েছেন?”
তরীর এই যত্ন টুকু ভীষণ আদুরে আদুরে ঠেকলো মাহমুদের কাছে। সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে একটুখানি সতেজ বাতাস ছুঁয়ে দিলো শরীরের প্রতিটি লোমকূপ। নিজেকে কেমন সুখী সুখী মনে হলো। ছোটো স্বরে জবাব দিলো,
-“নাহ্, কলেজ থেকে আপনার ক্যাম্পাসে চলে এসেছি।”
তরীর ভীষণ দুঃখ দুঃখ লাগলো। কাতর চোখজোড়া টলমল করে উঠলো। মাহমুদ হাসলো। নিস্তেজ গলায় বলল,
-“এতটা মায়া দেখাবেন না, তরী। আমি যে আর দূরে থাকতে পারবোনা।”
তরীর এলোমেলো চোখজোড়া কিছু বলতে চাইছে। সময় নিয়ে অধিকার খাটিয়ে বলল,
-“তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরুন। এভাবে না খেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন।”
মাহমুদ বাধ্য ছেলের মতো মাথা ঝাঁকাল। প্রফুল্লচিত্তে লাইন ডিসকানেক্ট করে পকেটে ঢুকালো। বাস ধরলো। বাস কন্ট্রাক্টরের হাঁকডাঁকের বিরক্তিও আজ তাকে ছুঁতে পারলোনা। জানালায় উঁকি দিয়ে আকাশে তাকালো। রাশি রাশি শুভ্র মেঘ পেঁজা তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। মাহমুদ বাসের সিটে হেলান দিয়ে চোখের পাতা এক করে নিলো। চোখজুড়ে তরী, শুধুই তরী।
★★★
ছোট্ট অরু ড্যাবড্যাব করে তরীকে দেখছে। তরীর নজরে পড়লো অনেকক্ষণ ধরেই অরু তাকে দেখছে। সে ভুরু উঁচিয়ে শুধালো,
-“কী?”
অরু ভাবুক হয়ে বলল,
-“তোমার কি বিয়ে হয়ে যাবে?”
-“কে বলল তোকে?”
-“আমি জানি। তোমার বিয়েতে আমি কিন্তু নাচবো। অনেক আনন্দ করবো।”
তরী বলল,
-“বিয়ে হলে তো আমি শশুর বাড়ি চলে যাবো। তখন কী করবি?”
অরু কোমরে একহাত রেখে হাত নাড়িয়ে বলল,
-“ওমা তুমি তো আবার আসবেই!”
ছোট্ট তরী বুঝলোনা বিয়ে মানে কী। শুধু বুঝলো আপুর বিয়ে হলে সে খুব আনন্দ করতে পারবে।
তরী বলল,
-“এখন চল ঘুম পাড়িয়ে দিই।”
অরু বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। তরী হাত বুলিয়ে দিলো তার মাথায়। বেশিক্ষণ লাগলোনা, অরু ঘুমিয়ে পড়লো।
তরীর চোখে ঘুম নেই। ফোন হাতে বসে রইলো। মুঠোফোনে তীব্র শব্দ হতেই ভাবলো মাহমুদ বুঝি তাকে স্মরণ করেছে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই হাসি হাসি মুখটি ম্লান হয়ে গেল।
“তিয়াস ভাইয়া” নামটা জ্বলজ্বল করে উঠতেই তরী চমকে উঠলো। বুকের ভেতর বিষাক্ত এক যন্ত্রণা হলো। রিসিভ করার ইচ্ছে হলোনা তার। প্রথমবারেই কল কে*টে গেল। দ্বিতীয়বার কল বাজার পর তরীর মনে হলো একবার কথা বলা উচিত। তিয়াস ভাইয়াকে সে বিয়ে করতে পারবেনা ব্যাপারটা খুলে বলতে পারলে হয়তো তিনি বুঝবেন। লম্বা শ্বাস নিলো তরী। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে কল রিসিভ করলো।
ভেসে এলো পুরুষালি স্বর। কোমল হয়ে শুধালো,
-“ কেমন আছো তরী?”
তরী ওই কোমল স্বরে কোন অনুভূতি খুঁজে পেল না। তার সমস্ত আবেগ, প্রেম ওই একজনের জন্যই। তরী স্বাভাবিক গলায় জবাব দিলো,
-“ভালো।”
-“আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবে না?”
তরী তিয়াসের প্রশ্নের জবাব দিলোনা। মেজাজ খা*রা*প হলো তার। কন্ঠের ভিত মজবুত রেখে প্রশ্ন ছুঁড়লো।
-“তুমি আমায় তুমি করে কেন ডাকছো, ভাইয়া?”
তিয়াস বোধহয় একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেল। নিজেকে সামলাতে তার খনািক সময় লাগলো। বলল,
-“এখন কি আর তুমি ছোটো আছো? বড়ো হয়েছো না?”
তরীর রাগ ধীরে ধীরে বাড়লো। চোখমুখ শক্ত করে বলল,
-“বড়ো হই আর ছোটো। তুমি আমায় তুই করেই ডাকতে। ছোটোবেলায় বোনের মতো কোলেপিঠে চড়িয়েছো। নিশি আপু তো আমার বড়ো, তাহলে তাকে কেন তুমি ডাকছো না?”
-“নিশি আর তুমি কি এক হলে?”
-“কেন নয়?”
-“তুমি কি বুঝতে পারছোনা, তরী?”
তরী কন্ঠস্বর উঁচু করলো,
-“কী বুঝবো আমি? আমি জানি তুমি আমার বড়োভাই। ব্যস, এই সুন্দর সম্পর্কে কেন অন্য সম্পর্ক টা*ন*ছো? তোমায় নিয়ে অন্যকিছু ভাবতে আমার লজ্জা হয় বিশ্বাস করো।”
-“সময়ের ব্যাপার তরী। সবটা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।”
তিয়াস হয়তো ভাবছে তরী লজ্জা পাচ্ছে। অথচ এটা বুঝলোনা তরীর মন তাকে ঠাঁই দিতে নারাজ।
খট করে লাইন কে*টে ফোন সুইচ অফ করে রাখলো তরী। ঝিম মে*রে শুয়ে রইলো। পাগল হয়ে যাচ্ছে সে।
মাহমুদ ফোনে ট্রাই করলো তরীকে। ফোন সুইচ অফ বলছে। চিন্তা হলো তার। একবার ছাদে গিয়ে দাঁড়ালো। খোলা হাওয়ায় গা ভাসিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তরীকে আবারও ট্রাই করলো। বারবার সুইচ অফ দেখাচ্ছে। মাহমুদের মন উতলা হয়ে উঠলো। তরী যদি তার হয়ে যেতো, তবে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখতো তাকে। চাইলেই যে সবটা সম্ভব হয়না।
কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে নেমে পড়লো সে।
★★★
দ্বাদশ শ্রেণির ইংরেজির ক্লাস নিয়ে বের হলো মাহমুদ। ফোনের স্ক্রিনে তরীর বার্তা। চোখ রাখলো মাহমুদ। বৃদ্ধাঙ্গুলি ছুঁয়ে দিতেই বার্তাটি স্পষ্ট হয়ে ধরা দিলো।
❝আমার ভার্সিটির পাশের কফিশপে আসতে পারবেন? আমি ক্লাস শেষে অপেক্ষা করবো।❞
তরী তাকে ডেকেছে! দিন দিন তরীর এই পরিবর্তন মাহমুদকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। বুঁদ হয়ে থাকতে চায় তার ডিঙি নৌকার মাঝে। মাহমুদ তরীর স্বাভাবিক কথাতেও কেমন ভালোবাসা খুঁজে পায়। সে হাসে, কারণে-অকারণে।
#চলবে…….
(