অনুভব পর্ব ৮

অনুভব
৮ম পর্ব
মারিয়া আফরিন নুপুর

হঠাৎ অর্ণবকে সামনে দেখেও উনি আশ্চর্য হলেন না কারণ হাসান সাহেব জানতেন এই ছেলেটা আসবেই। সারাজীবন জাহাজে জাহাজে করে ঘুরে বেরিয়েছেন প্রায় পুরো পৃথিবীটাই, তাই শেষ বয়সে এই পোড় খাওয়া নাবিকের ভুল হতে পারে না মানুষ চিনতে। মেয়ে জামাইকে দেখেই এগিয়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরলেন উনি। হাসতে হাসতে বললেন,
___ ” তোমার আর আমার সাথে খুব মিল বুঝেছ জামাই, আমিও তোমার শাশুড়ীকে আনতে তার বাপের বাড়ি যেতাম প্রায় সবসময় সন্ধ্যার দিকে। এই নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যাথা না থাকলেও আমার শশুর মশাইয়ের ঘোর আপত্তি ছিল। ”
অর্ণবের কাছে এবার স্পষ্ট হল মেহুল কার মতন আচরন পেয়েছে। এই ভর সন্ধ্যায় যেখানে মেয়ে জামাই এক মাথা চিন্তা নিয়ে হাজির সেখানে উনি পথের উপর দাঁড়িয়েই বিন্দাস আলাপ জুড়ে দিয়েছেন। হাসান সাহেব তখনও বলেই চলেছেন,
___ ” আসলে জামাই গেলে শাশুড়িদের ভালো মন্দ রান্না করে খাওয়াতে হয়, আর আমি যেতাম কোন খবর দেওয়া ছাড়াই সন্ধ্যার সময়৷ তাই উনাকে আবার যেতে হতো রান্না ঘরে, সে এক যাতা অবস্থা”।
এটুকু বলেই উনি হাহা করে হাসতে লাগলেন। অর্ণবের খুব অসহায় লাগতে লাগল। বাপ মেয়ে দুজনের মানসিক অবস্থা নিয়ে ওর মনে সংশয়ের তৈরী হল। একটু হালকা গলা খাকারি দিতেই হাসান সাহেব হাসি বন্ধ করে ওর দিকে তাকালো,
___ ” বাবা মেহুল কি এসেছে আপনার কাছে?”
___ ” হ্যাঁ এসেছিল দুপুরে, তারপর খেয়ে ব্যাগ গুছিয়ে আবার চলে গেল”।
হাসান সাহেব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বললেন। অর্ণবের মনে যাও একটু আশা ছিল এবার তা যেন নিমিষেই মিলিয়ে গেল। অসহায়ের মতন প্রশ্ন করল ও,
___ ” কোথায় গেছে কিছু বলে গেছে আপনাকে?”
___ ” মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত বাবা, ও আমাদের যে ফ্লাটটা আছে না আজিমপুরে সেখানেই যায়। আর হ্যাঁ তোমাকে যে ওর কথা বললাম সেটা কিন্তু ওকে বলো না।”
অর্ণব অবাক হয়ে গেল, হাসান সাহেব একবারও প্রশ্ন করল না কেন মেহুল চলে এসেছে। এদিকে ও চিন্তায় শেষ মেহুলকে না নিয়ে ফিরলে বাসায় কি হবে তাই ভেবে।
___ ” শোনো জামাই আমরা সবচেয়ে বড় ভুল করি কখন জানো, যখন আমরা কোন ব্যাপার যাচাই না করে সিদ্ধান্ত নেই। আমার মেয়েটা একদম বাচ্চাদের মতন, কোন দিক পাশ নেই। আর হ্যাঁ বাচ্চাদের যেমন আদর করলে সব পিছনের কষ্ট ভুলে যায়। আমার মেয়েটাও সেম। এক নিমেষেই রাগ ভেঙ্গে চুরচুর।”
___ ” আচ্ছা বাবা আমি যাই তাহলে।”
___ ” একদম না রাত হয়ে গেছে অনেক, যেখানে যাবে সকালে যেও এখন না।”
হাসান সাহেবের কথা আর ফেলতে পারল না অর্ণব রয়ে গেল সেই রাতে। একদিনের জার্ণির পরে শরীর খুব ক্লান্ত হলেও কেন জানি না ওর দু চোখের পাতা এক করতে পারল না। বারবার মনে হচ্ছে আচ্ছা মেহুলকে সব বোঝাতে পারবে তো ও।

আরেকজনও বিনিদ্র রাত পার করছে, গাড়ির ঢুলুনীতে চোখ থেকে থেকে লেগে আসলেও কেন জানি মোটেও ঘুম আসছে না মেহুলের। বারবার মনে হচ্ছে অর্ণবের ভালবাসার ডায়রীটায় ওর নাম লেখা নেই, আছে অন্যকারো নাম। কিন্তু কেন, মেহুল তো স্বামী আর ভালবাসার মানুষ হিসেবে অর্ণবকেই ঠায় দিয়েছিল নিজের মনের মনিকোঠায়। ইন্ডিয়ার বর্ডার পার হয়েই সোজা ও চলে গিয়েছি সৈয়দপুর ওখান থেকে প্লেনে করে যশোর তারপর সোজা বাড়িতে বাবার কাছে। হাসান সাহেব একটু অবাক হয়েছিলেন মেয়েকে দেখে কিন্তু সেটা বুঝিতে দেন নি। হেসেই বলেছিলেন,
___ ” কি রে মেহু বাবাকে ছাড়া ইন্ডিয়াতেও ভাল লাগে নি নাকি?”
___ ” বাবা আমি আজিমপুরে কিছুদিন থাকবো, কাউকে বলবে না আমি কোথায় আছি। ”
বাবার প্রশ্নের উওর না দিয়েই বলল মেহুল। হাসান সাহেব মেহুলকে মানুষ করেছেন গতানুগতিক ধারার বাইরে যেয়ে। মেয়েকে সব কিছু করার স্বাধীনতা দিয়েছেন কোন কৈফিয়ত দারি ছাড়াই। মেয়েও হতাশ করেন নি তাকে প্রতিটা ক্ষেত্রে তার মেয়ে আজ সফল।
___ ” মেহু তুই যা করবি সেটা বুঝে শুনেই করবি এটা আমি জানি। কিন্তু দেখিস সব সময় বিবেক দিয়ে না কিছু সময় আবেগ দিয়েও চলতে হয় মা।”
___ ” বাবা মানুষের লাইফে এমন কিছু মোড় আসে যেখানে আবেগ বিবেক সব শূন্য হয়ে যায়। আমারও তাই হয়েছে৷ তাই বিবেকের সাথে আবেগ মিশিয়ে ভাবার জন্য আমার কিছুদিন নিজেকে দেওয়ার মতন সময় চাই। ”
মেহুল আরো কিছু কাপড় ওর কাবার্ড থেকে নামাতে নামাতে উত্তর দিল। হাসান সাহেব আর কিছু না বলেই চুপ করে রইলেন, মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুর পাক খাচ্ছে কিন্তু উওরদাত্রী যেন আর মৌনতায় ডুবেছে। টানা দেড় দিনের যাত্রা শেষে মেহুল যখন ওদের ফ্লাটে পৌছাল তখন বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। বাসার যিনি কেয়ারটেকার আছেন সে বেশ বয়স্ক লোক নাম জব্বার। মেহুল কাকা বলেই ডাকে, ওকে এত সকালে এভাবে দেখে বেশ অবাকই হল জব্বার।
____ ” খালাম্মা আমনে এতো বেয়াইন্না বেলা, সব কুশল আছেনি তো?”
___ ” হ্যাঁ কাকা সব ঠিক আছে, আমার জন্য কড়া লিকার দিয়ে চা বানান। আর যদি কেউ আসে আমার খোঁজে সোজা বলে দেবেন যে আমি বাসায় নেই।”
এটুকু বলেই মেহুল চলল রুমের দিকে। জব্বার চুপ করে রইল, মালিকের মেয়েটাকে খুব ভালোবাসে ও কিন্তু এই ব্যাপারটা যেন কিছুতেই বুঝতে পারতেছে না যে বিয়ের দুই দিন পরেই এখানে কি জন্য এলো, আর একাই বা কেন এলো।

মেহুল ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল জব্বার চা রেখে গিয়েছে। চা শেষ করে নিজেকে খুব ফ্রেশ লাগল ওর কাছে। ফোন বের করল হাসান সাহেবকে কল দেওয়ার জন্য,
___ ” হ্যালো বাবা”
___ ” মেহুল তুমি কোথায়?”
ওপাশ থেকে শোনা গেল অর্ণবের ধরা গলা। ঠোঁটের এক প্রান্ত কামড়ে ধরে গলার কাছে মুচড়ে আসা কান্নাটা আটকালো মেহুল। খুব কষ্টে কান্না আটকে বলল,
___ ” কি অবস্থা কেমন আছেন আপনি। সরি না বলে চলে এসেছিলাম। আসলে ভালো লাগছিল না। বাবাকে বলবেন আমি ভাল আছি। আপনিও ভাল থাকবেন। খোদা হাফেজ।”
অনেকটা মেশিনের মতন গড়গড় করে কথা গুলো বলে ফোন কেটে সুইচ অফ করে রেখে দিল মেহুল। বালিশের সাথে মুখটা শক্ত করে চেপে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে চলল ও।

ফোন কেটে যেতেই আবারও কল ব্যাক করলো অর্ণব কিন্তু ফোন নট রিচেবেল। হাসান সাহেব বেশ হালকা কণ্ঠে বললেন,
___ ” বাবা ও ধরবে না ফোন। কিছুদিন যেতে দেও সব ঠিক হয়ে যাবে।”
___ ” বাবা আমি মেহুলকে ভালবেসে ফেলেছি, খুব করে ভালোবেসেছি। আপনার মেয়েকে ছাড়া চলবে না।”
অর্ণবের অশ্রুসিক্ত কণ্ঠ শুনে হাসান সাহেব এবার বেশ বিপদেই পড়লেন। খুব জানতে ইচ্ছে করতে লাগল তার যে এত ভালবাসে তার মেয়েকে, কিন্তু কি এমন হয়েছিল যে তার মেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। হাসান সাহেবের সব কিছু কেমন জানি গুলিয়ে যেতে লাগল। অর্ণব এবার হাঁটু গেড়ে বসল হাসান সাহেবের সামনে, উনার হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল,
___ ” বাবা আমি কিছু কথা বলতে চাই শুনবেন প্লীজ।”
হাসান সাহেব মাথা ঝুলিয়ে সায় দিলেন। অর্ণব শুরু করল বলা, ঝিলমিলের সাথে পরিচয় থেকে শুরু করে গ্যাংটকে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা। হাসান সাহেব খুব মনযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন। অর্ণব বলা শেষ করে তাকালো হাসান সাহেবের দিকে। মাথা নাড়াতে নাড়াতে হাসান সাহেব বললেন,
___ ” না বাপু আমি ভেবেছিলাম আমার মেয়ে আমার মতন হয়েছে, কিন্তু কিসের কি আমার মেয়ে আমার আশায় ঢাললো পানি। মায়ের মতন বলদমান হয়েছে আর কি।”
অর্ণব কথার আগা গোড়া বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকালো শশুরের দিকে।
___ ” তোমার কবরস্থ শাশুড়ি মাদারকে ভুলক্রমে এক বার বলছিলাম আমার প্রথম ক্রাশ আমার স্কুলের ম্যাডাম ছিল। তার পর সে দীর্ঘ ছয়মাস তার বাপের বাড়ি ছিল, লও ঠ্যালা।”
অর্ণব এবার হাসবে না কাঁদবে সেটাই বুঝতে পারল না। মেয়ে তো মেয়েই মাশাল্লাহ তার বাপ আরো এক কাঠি বাড়া সুবহানল্লাহ। হাসান সাহেব দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন,
___ ” কি না কি হয়েছে সোজা ইন্ডিয়া থেকে দেশে এসে হাজির৷ একদম মায়ের মতন হয়েছে আর কি। ”
___ ” জি বাবা।”
অর্ণব কিছু না বুঝেই সায় দিল। হাসান সাহেব অনেকটা ষড়যন্ত্র করার মতন ফিসফিসিয়ে বললেন,
___ ” একটা বুদ্ধি আছে এতে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙ্গবে না। মানে মেহুর রাগও কমে যাবে আবার তোমার আর আমারে বকবেও না।”
হাসান সাহেবের বুদ্ধিটা খুব ভালো লাগল অর্ণবে শুধু এখন সব কিছু গুছিয়ে নিতে পারলে কালকে সকালের অপেক্ষা…..

চলবে
মারিয়া আফরিন নুপুর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here