অনুভূতি
পর্ব ২৪
মিশু মনি
.
৩৭.
মেঘালয় গুনগুন করে গান গাইছে। ওর কণ্ঠে কিছু একটা মিশে আছে, শুনলেই ভেতরটা কেঁপে যায়। গান শুনে মিশুর আরো কষ্ট হচ্ছে। মিশুকে আনমনা হয়ে ভাবতে দেখে মেঘালয় গান থামিয়ে এসে ওর পাশে বসলো। চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে চোখ ছলছল করছে।
মেঘালয় অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে মিশু?”
মিশু ওর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললো, “কিছু হয়নি তো।”
-“তোমাকে আপসেট দেখাচ্ছে কেন?”
– “আমাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও মেঘ।”
– “কেন? কিছু হয়েছে তোমার?”
– “আমি একা থাকতে চাইছি। যাও এখান থেকে।”
মেঘালয় বেশ অবাক হয়ে গেলো। মিশুকে কখনো এমন দেখায় নি। আর এইরকম কথাও কখনো ও বলেনা। ওর রীতিমত চিন্তা শুরু হয়ে গেলো মিশুর জন্য। খুব খারাপ লাগল তবুও কিছু জিজ্ঞেস করলো না। রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। মিশুর খুব কান্না পাচ্ছে হঠাৎ। কেন এরকম লাগছে ও নিজেও জানেনা। মেঘালয়ের প্রতি কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে ওর। এই সন্দেহ টুকু ও করতে চায়না। ভেতরে কেমন যেন আজেবাজে চিন্তা আসছে, নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। মেঘালয়ের ব্যাপারে এতকিছু জানার পর আগে ওর প্রতি যেমন মনোভাব ছিলো,এখন আর সেরকম নেই। এখন রহস্যজনক লাগছে ছেলেটাকে। এটাই সবচেয়ে বাজে ব্যাপার। একবার মনে সন্দেহ ঢুকে গেলে মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতেই থাকে।
মেঘালয় করিডোরে দাঁড়িয়ে বাইরে চেয়ে আছে। ওর চোখে পানি এসে গেছে। বুকটা চিনচিন করছে। মিশু একটু দূরে সরিয়ে দিলেই ওর খুব কষ্ট হতে থাকে, কেন এমন হয় নিজেও জানেনা। মিশুর সামান্য কষ্টটুকুও ওর উপর বিশাল চিন্তার প্রভাব ফেলে। গতরাতে ওকে থাপ্পড় দেয়ার পর মেঘালয়ের ইচ্ছে করছিলো নিজের হাতটাই কেটে ফেলে, কেন মিশুকে এভাবে আঘাত করে ফেললো সে! এখনো খুব কষ্ট হচ্ছে মিশুর কষ্ট দেখে। মেয়েটা কি এখনও ওকে আপন ভাবতে পারেনি?
মিশুর ভেতর থেকে ঠেলে কান্না আসছে। আর চেপে রাখতে পারছে না। মেঘালয়কে ছাড়া ওর চলবেই না, অযথা ওকে অবিশ্বাস করে নিজেকে পোড়ানোর কোনো মানে হয়? এক ছুটে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো ও। এসে দেখলো মেঘালয় করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে। মিশু ছুটে এসে ওর সামনে দাঁড়ালো। চোখাচোখি হতেই দুজনের গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। কারো আর মুখ ফুটে কিছু বলতে হলোনা। দু ফোটা অশ্রুই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে। মিশু মেঘালয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। মেঘালয় ও ওকে বাহুর বন্ধনে শক্ত করে ধরে রইলো।
মিশু বলল,”তোমার ব্যাপারে এমন কোনো জিনিস যেন না থাকে যেটা আমি জানিনা। আমাকে সবকিছু জানাবা, কিচ্ছু লুকোবে না। নতুন কিছু জানতে পারলে আমার মনে চিন্তা আসে।”
– “আর তুমিও আমার উপর যত রাগই আসুক,কক্ষনো আমাকে এক মুহুর্তের জন্যও দূরে চলে যেতে বলবা না। সবসময় আমি তোমার পাশে থাকতে চাই। তুমি কষ্ট পেলে আমার ও কষ্ট হয় মিশু।”
দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলো। মেঘালয় বেশ বুঝতে পারছে মিশুর প্রতি ওর দূর্বলতা কতখানি বেড়ে গেছে। ছেলেটা খুব শক্ত,কখনো ওর চোখে জল আসেনা। আজ এসে গেলো সামান্য একটু কারণে। কখনো মিশু দূরে ঠেলে দিলে মেঘালয় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলো সবাই মিলে। মেঘালয় মিশুকে রুমে নিয়ে দুজনে খুনসুটি চললো অনেক্ষণ ভর। সন্ধ্যায় ওই কান্নাকাটির পর্বটার পর থেকে দুজনে খুব সহজ হয়ে গেছে। এমন একটা বিশ্বাস জন্মেছে একে অপরের প্রতি যে,কেউ কক্ষনো কাউকে ঠকাবে না। খুবই আপন মনেহচ্ছে দুজনার দুজনাকে।
নতুন কিনে নিয়ে আসা একটা ড্রেস পড়ে সাজুগুজু করে নিলো মিশু। মেঘালয় চেক শার্টের সাথে জিন্স পড়লো। রাত এগারো টার দিকে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ওরা।
গাড়িতে উঠে গান ছেড়ে দিলো। মিশু বসেছে জানালার পাশেই। বেশ প্রশস্ত সিট। মেঘালয় মিশুর পাশেই বসেছে। পুরো সিটটাই ফাঁকা। তবুও ওদের পাশে কেউ বসেনি। আরাফ গাড়ি ড্রাইভ করছে, পূর্ব ও সায়ান ওর পাশেই চাপাচাপি করে বসেছে। মেঘালয় অনেকবার করে বলেছে ওর পাশে বসার জন্য,কিন্তু কিছুতেই ওরা রাজি হয়নি। পিছনের সিট পুরোটাই নবদম্পতিকে ছেড়ে দিয়ে ওরা কষ্ট করেই সামনের আসনে গিয়ে বসেছে। মিশু শুধু মুখ টিপে হাসছে ওদের কার্যকলাপ দেখে।
পূর্ব ও সায়ান খুবই দুষ্টু। নানান রকম ফাজলামি আর দুষ্টুমিতে মেতে থাকে সবসময়। গাড়িতে বসার পর থেকেই ইয়ার্কি করে যাচ্ছে। মেঘালয় ও মাঝেমাঝে ওদের সাথে যোগ দিচ্ছে। আর এদিকে একটু পরপর আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে মিশুর কোমল শরীর টা। মেঘালয়ের উষ্ণ হাতের স্পর্শে বারবার শিহরিত হয়ে উঠছে মিশু। জার্নির সাথে নতুন এক সুখ যুক্ত হয়েছে। গাড়ির ভেতরে এসি আছে তবুও মিশুর জন্য জানালা খোলা রাখতে হলো। ও খোলা জানালায় মাথা রেখে বাইরে চেয়ে থাকে অপলক ভাবে, চুলগুলো এলোমেলো ভাবে উড়তে থাকে। খুবই এনজয় করে ও ব্যাপার টা। আর মেঘালয় ওর মুগ্ধ চোখের দিকে হা করে চেয়ে থাকে।
মিশুর চুল উড়ে এসে মেঘালয়ের মুখে পড়তেই মেঘালয় ওর কোমরে হাত দিয়ে কাছে টেনে নিয়ে বললো, “সারাজীবন যেন তোমার চুলের গন্ধ ঠিক এমন ই থাকে। চুলের গন্ধে ঘুম এসে যায় আমার।”
– “হুম। এবার তো বলো আমার চুলের গল্পটা? সেই কবে থেকে ওয়েট করে আছি। চুলের গল্পটা শুনবো বলে। এখনো কি বলা যাবেনা?”
মেঘালয় মিশুর মাথাটা নিজের কাঁধে নিয়ে বললো, “আমাদের যেদিন প্রথম দেখা হলো, তারপর থেকেই প্রতি রাতে আমি স্বপ্নে দেখতাম একটা মেয়ে এলো চুল ছেড়ে দিয়ে সমুদ্রের তীর ঘেষে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটির মুখ কখনো দেখতে পেতাম না। কিন্তু চুল, হাঁটার স্টাইল সবই কেমন পরিচিত লাগতো। একদম সমুদ্রের কাছ দিয়ে হাঁটতো মেয়েটা। যখন বিশাল ঢেউ এসে মেয়েটির উপর দিয়ে তীরে আছড়ে পড়তো, আমি ভয় পেতাম। এই বুঝি সমুদ্র তার ভেতরে টেনে নিয়েছে মেয়েটিকে। কিন্তু না, ঢেউ নেমে যেতেই দেখতাম মেয়েটি দিব্যি হেঁটে যাচ্ছে। তার কিছুই হয়নি।”
মিশু অবাক হয়ে শুনছিলো। বললো, “তারপর? তারপর কি হলো?”
মেঘালয় বললো, “আমি ঘুমালেই এটা দেখতাম আর অবচেতন মনে সারাক্ষণ এটা ঘুরপাক খেতেই থাকতো। আমার খুব অসহ্য লাগতো। ফ্রেন্ড সার্কেল আর পরিচিত যত মেয়ে আছে, সবার চুল আমি দেখেছি। কারোর ই চুল ওরকম নয়। মিশু সেদিন স্টেশনে যখন তুমি ওভারব্রিজের নিচে বসেছিলে,তখন তোমার মাথায় ওড়না দেয়া ছিলো। কিন্তু তুমি যখন হেঁটে হেঁটে গিয়ে ট্রেনে উঠলে, তখন ওড়না মাথায় ছিলোনা। আমার স্বপ্নের মেয়েটার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছিল তোমার চুল আর হাঁটার ভঙ্গিটা। আমি কেমন যেন ফিল করছিলাম তোমার প্রতি, কিচ্ছু ভাবতে পারিনি। সেজন্যই ছুটে এসে ট্রেনে উঠেছিলাম।”
মিশুর চোখেমুখে মুগ্ধতা আর বিস্ময়! রূপকথার গল্পের মত লাগছে। ও মুচকি হেসে বললো, “আমি এটা নিয়েই চিন্তা করছিলাম। তুমি কেন ওভাবে ট্রেনে গিয়ে উঠলে? আমার এরকম অনেক অভ্যেস আছে। হুটহাট করে এখানে সেখানে চলে যাওয়াটা আমার স্বভাব। কিন্তু তুমি কেন কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ করবা? এসব ভেবে ভেবে মাথা খারাপ করে ফেলেছিলাম।”
মেঘালয় মিশুর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “প্রথম দিন তোমার ভেজা চুল দেখেছিলাম, বৃষ্টিস্নাত চেহারা। আমার মনেহয় বিধাতা উপর থেকেই আমাদের জুটিটা ঠিক করে দিয়েছেন। এজন্যই আমার অবচেতন মন সারাক্ষণ তোমাকে নিয়েই ভাবতো। আর মানুষের অবচেতন মন সারাক্ষণ যা কল্পনা করে, মানুষ সেটাই স্বপ্নে দেখে।”
মিশু অবাক হয়ে বললো, “সত্যি!”
মেঘালয় জবাব দিলো, “হুম। আমি পাগলের মত সবার চুল খুঁজে বেড়িয়েছি যে কার চুলগুলো দেখতে অমন হবে। আমাকে সারাক্ষণ ভাবাতো স্বপ্নটা। আমি সত্যিই ভাবতে পারিনা তুমি কিভাবে হুট করেই আমার জীবনে এসে সবকিছু দখল করে নিলে।”
মিশু মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরে বললো, “এত সুখ কি কপালে সইবে গো আমার?”
পূর্ব উত্তর দিলো, “ভাবি না সইলে আমাদের একটু ভাগ দিয়েন। আমরা সুখ খুঁজে খুঁজে মরি কিন্তু পাইনা।”
ওরা তিনজন হেসে ফেললো। মিশুর লজ্জা লাগলো খুব। ও লজ্জায় মুখ লুকালো মেঘালয়ের বুকে। জোড়ে জোরেই বললো, “আমার সমস্ত টুকু দিয়ে আমি শুধু মেঘালয়কেই সুখী করতে চাই। আমার জীবন চলে যাক।”
সায়ান বললো, “মেঘ ভাগ্য করে বউ পেয়েছিস দোস্ত। ভাবছি আমিও একটা কচি মেয়েকে টুপ করেই বিয়ে করে ফেলবো। কিন্তু ভয় লাগে, এখনকার যা মেয়েরে ভাই। আমাকে ইচ্ছেমত নাচাবে, বাপের দেয়া প্রাণটা অকালেই ঝড়ে যাবে।”
মেঘালয় হেসে বললো, “মনের মত একজন সঙ্গিনী পেলে লাইফটা যে কি পরিমাণ সুখের লাগে দোস্ত! উফফ বোঝাতে পারবো না।”
– “আমরা বুঝতেও চাইনা। এমনিতে তোর প্রেম দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছি। আর কিছু বলিস না ভাই।”
– “আহা শোননা। আজকে তো একসাথে সুইমিংপুলে নেমেছিলাম। মিশুর পা দুটো আমার কাঁধের উপর তুলে নিয়ে…”
সায়ান চেঁচিয়ে উঠলো, “ভাই প্লিজ থাম। আমার দহন বাড়াস না। এসব শুনলে আমার প্রেম প্রেম পায়।”
মেঘালয় ও মিশু হেসে উঠলো। মেঘালয় ওকে জ্বালানোর জন্য বললো, “রাতটা যা ছিলো না দোস্ত, উফফ আমার আফসোস হচ্ছে আগে ক্যান বিয়ে করিনি।”
সায়ান তেলেবেগুনে জ্বলে গেলো। পিছন ফিরে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “ভাবি আছে বলে মুখ খারাপ করতে চাচ্ছিনা। ভদ্র ছেলেটাকে অভদ্র বানাস না বলে দিলাম।”
– “আহা! তুই না রুমে সিসি ক্যামেরা লাগাবি বলছিলি। শোন না।”
সায়ান আরো ক্ষেপে গেলো, “এসব বলবি না। আমার প্রেম প্রেম পায়। শুধু প্রেম প্রেম না, আমার বিয়ে বিয়ে পায়।”
– “হা হা হা, বিয়ে করে ফেল। হুট করে বিয়ে করার মজাই আলাদা।”
– “সবাই তো আর মিশু না যে দুম করেই একটা কাজ করে ফেলবে। আমার গার্ল ফ্রেন্ডকে বললে বলে, “বাপের টাকায় গার্ল ফ্রেন্ড চালাও, সপ্তাহে একদিন শপিং করাই দিতে পারো না। আমার হাত খরচের টাকা বাসা থেকে নিতে হয়, আবার বলে কিনা বিয়া করবো। থাপ্পড় চেনো?”
গাড়ি সুদ্ধ সবাই শব্দ করে হেসে উঠলো। পূর্ব বললো, “তার হাত খরচের টাকা বাসা থেকে নেবে না তো কি তোর কাছ থেকে নেবে? তুই বল, হাত খরচের টাকা দিলে বউকেই দিবো। আগে বিয়ে করো, তারপর দিচ্ছি।”
সায়ান মুখ কাচুমাচু করে বললো, “বলছিলাম রে। আমাকে বলে , তারমানে তুমি আমাকে বিশ্বাস করোনা। তুমি ভেবেছো সবকিছু নিয়ে আমি ভেগে যাবো? সেজন্যই ভয়ে বিয়ে করতে চাও?”
সবাই আবারো হেসে উঠলো। পূর্ব জিজ্ঞেস করলো, “তুই কি বললি?”
– “আমি বলেছিলাম হ্যা এই ভয়টাই পাই। সেজন্যই বিয়ে করবো। তারপর লেগে গেলো তুমুল ঝগড়া। সেই ঝগড়া মেটাতে ওকে একটা শাওমি সেট গিফট করতে হইছে।”
পূর্ব সায়ানের কাঁধের উপর একটা মাইর দিলো। বাকিরা সবাই অট্টহাসি শুরু করে দিলো। আরাফ চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছিলো। ও এবারে মুখ খুললো, “দোস্ত, তোদের রিলেশন মাত্র আড়াই মাসের। এরমধ্যে কি কি দিছিস?”
সায়ান উত্তর দিলো, “আমি ওরে আইফোন দিছি, ওর রাউটার বিল,ওয়াইফাই বিল, মোবাইল রিচার্জ, চারবার শপিং করাই দিছি, দুইটা শাড়ি, বান্ধবীর বিয়ের গিফট, গত সপ্তাহে একটা শাওমি, আমার ক্যামেরাটা নিয়ে সে ট্যুরে গেছিলো এখনো ফেরত দেয় নাই, দিবে কিনা আমি তাও শিওর না। আর ট্যুরে গেছিলো ফ্রেন্ড সার্কেল মিলে, সেই টাকাটাও আমি দিছি। ওরে এতবার বলছি আমার সাথে ট্যুরে যাওয়ার জন্য,সে যাবেনা। নিজের বেলায় ষোলআনা আদায় করে,আর আমার বেলায় দুই আনা। একটা চুমু অব্দি দিতে দেয়না, তিনঘন্টা গাল ফুলিয়ে বসে থাকার পর একটা চুমু নিতে হয়।”
সবাই এত জোরে হেসে উঠলো যে আরাফ গাড়ি চালাতেই পারলো না। ও গাড়িতে ব্রেক কষলো। সায়ানের এই খবর গুলো ওরা জানতো না। ওরা শুধু জানতো সায়ান মেয়েটাকে আইফোন গিফট করেছে। কিন্তু তার এত চাহিদার কথাগুলো ওরা নতুন শুনছে।
ও জিজ্ঞেস করলো, “তোর DSLR ওর কাছে?”
– “হুম। ট্যুরে যাওয়ার সময় নিয়ে গেছিলো।”
– “ওর বাসা কোথায় যেন?”
– “কেন?”
– “গাড়ি ঘুরাচ্ছি, ওর বাসার সামনে ওরে বল ক্যামেরা নিয়ে দাড়াই থাকতে। বলবি সিলেট ট্যুরে যাচ্ছি, ক্যামেরা লাগবে।”
– “আমি পারবো না।”
– “টাকা কি বানের জলে ভেসে আসছে? বাপের কাছে কান্নাকাটি করে ক্যামেরা কিনে নিয়ে গ্রিডি ফার্মারের কাছে ফেলে রাখছে। আমি গাড়ি ঘুরাচ্ছি, এড্রেস বল।”
– “অনেক রাত হইছে, এখন ওরে ডিস্টার্ব করবো না থাক।”
– “তুই যদি ক্যামেরা না নিস, তোরে গাড়ি থেকে লাত্থি দিয়া ফালাই দিবো।”
মিশু মেঘালয়ের কাঁধে হাত রেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো। ওদের বন্ধুদের কাণ্ডকারখানা দেখে মজা লাগছে ওর। আরাফের রাগ দেখে বাধ্য হয়ে সায়ান ওর প্রেমিকার বাসার ঠিকানা বলে দিলো। গাড়ি ঘুরাতে হলোনা। যেই রোড ধরে যাচ্ছে সে রোডের সামনেই ওর বাসা। বন্ধুদের চাপে পড়ে সায়ান মেয়েটাকে কল দিয়ে বাসার সামনে থাকতে বললো। বোধহয় ফোনে অনেক কথা কাটাকাটি ও হলো। সায়ান বলল, ক্যামেরা না নিলে গাড়ি থেকে লাত্থি দিয়ে ফেলে দিবে। সেটা শুনে বোধহয় মেয়েটি ক্ষেপে গেছে। বাসার গেটে এসে দুবার হর্ন দিতেই সে ক্যামেরা হাতে বের হলো।
মেয়েটি ক্ষেপে আছে সায়ানের উপর। গাড়ির জানালা দিয়ে মিশু মাথা বাড়িয়ে হেসে বললো, “আপু আসুন সিলেট যাই।”
মেয়েটি আরো রেগে গেলো। নিশ্চয়ই মনেমনে ভাবছে মেয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? আর রেগে যাচ্ছে। সায়ান ভয়ে ভয়ে বলল, “ওর নাম মিশু, মেঘালয়ের বউ।”
মেয়েটি রাগত অবস্থাতেও হাসার চেষ্টা করলো। আরাফ বললো, “সরি আপু। এত রাতে বাসার নিচে নামানোর জন্য দুঃখিত।”
– “ইটস ওকে, ভেতরে এসে বসুন আপনারা।”
– “থ্যাংকস আপু, আপনি চলুন আমাদের সাথে সিলেট থেকে ঘুরে আসি।”
– “বাসায় ম্যানেজ করতে পারবো না। আপনারা যান।”
বলেই সে ভেতরে চলে গেলো। সায়ানের দিকে একবার তাকালো ও না। আরাফ গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বললো, “ছোটলোকের মত কাজ করলাম তাইনা পূর্ব?”
– “হুম, মাঝেমাঝে ইচ্ছেকৃত ছোটলোকি করতে হয়। এত রাতে ওকে নিচে নামানোর জন্য মেয়েটি বিরক্ত। এটাই ওদের শেষ দেখা আর কালকে নিশ্চিত ব্রেকাপ।”
সায়ান বললো, “এটা কি ঠিক করলি তোরা?”
আরাফ গলা চড়িয়ে বললো, “যার এত চাহিদা মেটানোর পরও সেই মেয়ে বলে বাসা থেকে হাত খরচের টাকা কেন নিতে হয়? আর বিয়ে করতে চাইলে করবে না। বিয়ে করে হাজব্যান্ডের কাছে হাতখরচ নিক তাতে আপত্তি নেই। সে নির্লজ্জের মত বয় ফ্রেন্ডের কাছে টাকা নিবে আবার বিয়ে করতে চাইলে থাপ্পড় লাগাবে সেরকম গার্ল ফ্রেন্ড পোষার কোনো দরকার নাই। প্রেম করবি ভালো কথা, এত চাহিদা কেন?”
– “তুই চাইছিস আমি ওর সাথে ব্রেকাপ করি?”
-“হ্যা। এরপর কি হয় দেখ। আমরা বাপের টাকা চলি ভালো কথা। বাসায় মিথ্যে বলে টাকা নিয়ে তাদের চাহিদা মেটাই আর তারা এভাবে বলবে কোন সাহসে? আমার গালে থাপ্পড় লাগাতে চাইলে উলটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতাম।”
আরাফের রাগ দেখে সায়ান আর কথা বাড়ালো না। আরাফ খুব রাগী। রেগে গেলে চড় থাপ্পড় কিল ঘুষিও বসাতে পারে। তারচেয়ে সে নিশ্চিতে গাড়ি চালাক, সেই ভালো।
মিশু বললো, “সায়ান ভাইয়া, মন খারাপ করবেন না। সবকিছুর একটা সীমা থাকা দরকার, একটা রিলেশনশিপে যাওয়া মানে এই নয় যে সমস্ত কিছু ছেলেকেই বহন করতে হবে। আমি মেঘালয়ের স্ত্রী হওয়ার পরও ওর কাছে আজকে শপিং করিয়ে নিতে আমার খারাপ লাগছে। আমি কোনোকিছুর জন্য কখনো কারো উপর ডিপেন্টেড ছিলাম না। ছোট ছোট গিফট দিলে সম্পর্ক ভালো থাকে, তাই বলে আড়াই মাসে এতকিছু! একটু বেশি হয়ে গেছে।”
মেঘালয় মিশুর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “আমি তো তোমার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছি মিশু। অন্তত আমার কাছে সংকোচ করোনা। আমি তোমার স্বামী।”
– “স্বামী বলেই সমস্ত দায় ভার তোমার? আমি মানতে পারবো না। আমি নিজেও রোজগার করবো যতটুকু পারি। বসে বসে খাওয়া অভ্যেস আমার নেই। যতদিন আমার দেহে কাজ করার সামর্থ্য আছে, আমি করবো। বাঁধা দিতে পারবা না।”
মেঘালয় মিশুর চুলের উপর একটা চুমু দিয়ে বললো, “এজন্যই তোমাকে আমার এত ভালো লাগে। তুমি তথাকথিত মেয়েদের থেকে আলাদা। আমার পাগলী টা।”
মিশু মেঘালয়ের খোঁচা খোঁচা দাড়ির সাথে নিজের গাল ঘষতে লাগলো। ছেলেটাকে ছাড়া কিছুতেই ও বাঁচতে পারবে না। বিধাতা যেন কখনো কোনো অজুহাতে ওদের আলাদা না করেন।
চলবে..
অনুভূতি
পর্ব ২৫
মিশু মনি
.
৩৮.
মেঘালয় মিশুকে সিটে শুইয়ে দিয়ে ওর মাথাটা নিজের কোলের উপর রাখলো। ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, “তুমি ঘুমোও।”
মিশুর মোটেও ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। মেঘালয় জোর করে ওকে ঘুম পাড়াতে চাইছে। বারবার বলছে, “কালকে সারাদিন ঘুরতে হবে। তুমি ঘুমাও সোনামণি।”
বাধ্য হয়েই ও ঘুমানোর ভান করে চোখ বন্ধ করে রইলো। মেঘালয় ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর মেঘালয় ওকে জিজ্ঞেস করলো, “ঘুমাইছো?”
মিশু কোনো সাড়া দিলো না। জেগে আছে বুঝতে পারলে মেঘালয় আবারো জোর করে ঘুম পাড়াতে চাইবে। সেজন্যই ও চুপ করে রইলো।
মেঘালয় যখন বুঝতে পারলো মিশু ঘুমিয়ে গেছে তখন একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে এসি বাড়িয়ে দিলো। ব্যাকসিট থেকে হাত বাড়িয়ে চাদর নিয়ে মিশুর গায়ের উপর দিয়ে দিলো। তারপর আবার ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মিশুর চোখে পানি এসে যাচ্ছে। প্রায় আধ ঘন্টা ধরে ছেলেটা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এভাবে কেয়ার করতে হয় বুঝি? মানুষ নাকি দুই অবস্থায় পড়লে কান্না করে। অধিক সুখে আর অধিক কষ্টে! ইদানীং মিশুর শুধু সুখেই কান্না পায়। এমন করে কেউ কেয়ার করলে সুখী না হয়ে উপায় আছে!
সায়ান জিজ্ঞেস করলো, ” ভাবি ঘুমাইছে?”
মেঘালয় জবাব দিলো, “হুম, বাচ্চাটা ঘুমালো।”
– “হা হা হা, বাচ্চাটা? রাতেও কি বাচ্চাটা বাচ্চাটাই ছিলো?”
– “কথায় বলেনা ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে? বাচ্চা তো সবসময় বাচ্চাই। সে কি বাসর ঘরে হুট করে বড় হয়ে যাবে নাকি?”
পূর্ব বললো, “যাই বল,মিশুর মত আনাড়ি বউ পাওয়াটাও সৌভাগ্য। মেয়েটা কিচ্ছু বুঝেনা। হাতে ধরে সবকিছু শিখিয়ে দিবি,প্রেম শেখাবি, তারপর দেখবি তোর চেয়েও বেশি বেশি করে তোকে ভালোবাসবে।”
মেঘালয় হেসে বললো, “আমার এতেই হবে। সবসময় যে ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসাই লাগবে এমন টা তো নয়। মিশু আজীবন এমন পাগলী আর অবুঝ থাকুক না। আমি একাই না হয় ভালোবাসবো। আমার ভালোবাসা দিয়েই সবটুকু উসুল করে নিবো।”
আরাফ বললো, “সে কি তোকে ভালোবাসে না? লাইফের প্রথম প্রেমে পড়েছে তো, আস্তে আস্তে দেখিস কেমন পাগল হতে শুরু করে।”
মেঘালয় বললো, “আমি চাইনা ও পাগল হোক। ও আমার পাগলী হয়েই থাকুক। তবে ও আমাকে একটু দূরে সরিয়ে দিলেই কেমন যেন আমার মাথা খারাপ হয় যায় রে। আজকে ও আমাকে রেগে বলেছে, আমাকে একা থাকতে দাও কিছুক্ষণ। যাও এখান থেকে। বিশ্বাস কর বাইরে এসে আমি কান্না করে ফেলছি। মেঘালয়ের সমস্ত নিয়ম ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে মেয়েটা। আমি আমার নিয়মের বাইরে গিয়ে যত সব কাণ্ড করে ফেলছি।”
সায়ান বললো, “এরকম ই থাকিস আজীবন। মিশুর জন্য এটা খুব জরুরি। মানুষ বড় হলে নাকি চেঞ্জ হয়ে যায়। তুই আবার ওই নিয়মের মধ্যে ঢুকে যাস না যেন। তাহলে তোকে নিয়ে যত প্রাউড ফিল করি, সব ভেস্তে যাবে আমাদের।”
মিশুর চোখ থেকে পানি পড়ছে। মেঘালয় আর ওর বন্ধু বান্ধবদের কথা শুনে আরো সুখ সুখ অনুভূত হচ্ছে। মেঘালয়ের মত একজনকে পাওয়াটা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। অনেক ভাগ্য করে ওকে পেয়েছে মিশু। এসব ভেবে ভেবে কান্না এসে যাচ্ছে। মেঘালয় ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আরামে চোখ বুজে রইলো ও।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানেনা। ঘুম ভাংলে চোখ কচলে উঠে বসলো। মেঘালয় বললো, “ঘুম হলো মহারাণী’র? আর কিছুক্ষণ ঘুমাতে।”
মিশু মেঘালয়ের গলা জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। ওর বুকে মাথা রেখে শুয়ে বললো, “আর ঘুম আসছে না।”
কথাটা বলা শেষ হতে না হতেই আবারো ঘুমিয়ে গেলো। মেঘালয় হাসলো। পাগলী একটা। এক হাতে ওকে ধরে রইলো মেঘালয়। হাতটা মিশুর কাঁধের উপর দিয়ে নিয়ে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মেঘালয় একটু নড়তেই মিশু রেগে বললো, “এত নড়াচড়া করো কেন?”
মেঘালয় হেসে ফেললো। প্রায় এক ঘন্টা যাবত ওর কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে আর মেঘালয় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সে আবার মেঘালয়কেই ঝাড়ি মারে? হা হা হা।
হাসি চেপে গেলো মেঘালয়। পাগলিটা ঘুমাক আরাম করে। কাঁধটা একটু সোজা করে নিতে পারলে ভালো হতো তবুও আর একবার ও নড়লো না মেঘালয়। গাড়ির গান ও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মিশু ঘুমাচ্ছে বলে সবাই নিরবতা পালন করছে। মেঘালয় সিটে হেলান দিয়ে মিশুকে জাপটে ধরে ঘুমিয়ে গেলো।
গাড়ি ব্রেক কষতেই ঘুম ভাংলো মেঘালয়ের। একটা দোকানের সামনে এসে গাড়ি দাড় করিয়েছে। মেঘালয় কারণ জিজ্ঞেস করতেই সায়ান বললো, “দোস্ত চা খেয়ে আসি। খাবি?”
– “ইচ্ছে তো করছে। মিশু ঘুমাচ্ছে,ওর ঘুম ভাঙাবো না।”
– “আচ্ছা এনে দিচ্ছি।”
ওরা তিনজন গাড়ি থেকে নেমে গেলো। মেঘালয় বসে রইলো মিশুকে ধরে। মিশু একদম ওর বুকে মাথা রেখে গলা ধরে বাচ্চাদের মতন গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। দোকানের বারান্দায় লাইট জ্বলছে, লাইটের আলো এসে পড়েছে মিশুর মুখে। ঘুমন্ত মুখটা দারুণ আদুরে দেখাচ্ছে। কিছু চুল এসে পড়েছে মুখের উপর, আরো বেশি মায়াবতী লাগছে মেয়েটাকে। মেঘালয় অপলক ভাবে চেয়ে রইলো।
মিশু নড়েচড়ে উঠে চোখ মেললো। হাই তুলে বললো কোথায় আমরা?
– “বুঝতে পারছি না। দোকানে তো কোনো সাইনবোর্ড ও নেই। ওরা আসলে জিজ্ঞেস করে নিবো। তবে ঢাকা ছেড়েছি অনেক আগেই ”
– “ওরা কি বিড়ি খেতে গেছে?”
মেঘালয় হেসে বললো, “হুম। একটু আধটু খায় আরকি।”
– “তুমি খাওনা কেন?”
– “আমি আগে মাঝেমাঝে খেতাম। এখন আর ছোঁবো না।”
– “কেন ছোঁবে না?”
– “বারে, নিকোটিন নিলে আয়ু কমে যায়। আমিতো আর তাড়াতাড়ি মরতে চাইনা। আমি মরে গেলে এই পাগলী টাকে ভালোবাসবে কে?”
– “তাহলে আগে খেয়েছো কেন?”
– “আগে কি জানতাম আমার এমন একটা লক্ষী বউ জুটবে? জানলে তো কখনোই খেতাম না।”
– “অনেক আয়ু কমিয়ে ফেলছো। ধরে মাইর দেই?”
– “আচ্ছা দাও।”
– “নাহ, এরকম মিষ্টি ছেলেটাকে মারতে ইচ্ছে হয়?”
বলেই মেঘালয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। মেঘালয় বললো, “আরো একটু ঘুমাও মিশমিশ।”
– “নাহ। এখন ঘুমালে অন্যায় হয়ে যাবে। আমি জার্নিতে কখনোই ঘুমাই না।”
– “সেজন্যই তো সেদিন ট্রেনে আমার বুকের উপর পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিলে।”
মিশু অবাক হয়ে বললো, “সত্যি! ছি আমি কি নির্লজ্জ!”
– “অবশ্য ঘুমিয়েছো বলেই আরো পাগল হয়ে গেছি। তোমার ঘুমন্ত মুখে একটা মায়া আছে।”
পূর্ব এসে গাড়ির পাশে দাঁড়ালো। মেঘালয় জানালা খুলে দিলো। পূর্ব এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বললো, “ভাবির ঘুম ভেঙেছে? ভাবি কি খাবেন আপনি?”
– “চুমু”
কথাটা বলেই জিহ্বায় কামড় দিলো মিশু। ও মোটেও এটা বলতে চায়নি। এমনকি এটা চিন্তাও করেনি। তবুও কেন যে এটাই বেড়িয়ে এলো মুখ দিয়ে! লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। পূর্ব হেসে জানালা থেকে মুখ সরিয়ে নিলো। তারপর দোকানের দিকে চলে গেলো। মেঘালয় মিশুর দিকে তাকিয়ে বললো, “ওর সামনে এটা বলতে হলো?”
মিশু মুখ কাচুমাচু করে বুঝিয়ে বললো। ওর একদম ই অজান্তে মুখ ফস্কে বেড়িয়ে গেছে কথাটা। লজ্জায় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। মেঘালয় হাসছে মুখ টিপে। পাগলি একটা মেয়েকে নিয়ে কি যে করবে!
মিশু বললো, “একটু বাইরে নামতাম।”
– “এখানে নামা যাবেনা।”
– “কেন যাবেনা?”
– “শহরের বাইরে চলে এসেছি, একলা মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেই রিস্কি হয়ে যাবে। তার উপর আমরা চারজন ই ছেলে।”
– “তাহলে তাড়াতাড়ি গাড়ি ছাড়তে বলো।”
মেঘালয় জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে ওদেরকে ডাকলো। সায়ান একটা পলিথিন ব্যাগ ভর্তি খাবার এনে দিলো মেঘালয়ের হাতে। মিশু চেয়ে দেখে সেটার ভেতর দুটো চিপস,কয়েকটা চকোলেট, দই,বিস্কুট, কেক আরো কি কি যেন। ও অবাক হয়ে বললো, “এগুলা কে খাবে?”
সায়ান বললো, “তোমার জন্য।”
– “আমি এত্তগুলা খাবো? আমি কি ছোট মানুষ? এগুলা তো ছোট মানুষ খায়।”
সায়ান হেসে ফেললো। ব্যাগটা দিয়ে গাড়ির ভেতর চেপে বসলো। এবার ও মেঘালয়ের পাশেই বসেছে। পূর্ব ও আরাফ এসে সামনে উঠে পড়লো। এবার গাড়ি ড্রাইফ করে পূর্ব। পাশের সিটে আরাফ বসেছে। মিশু ব্যাগটা নিয়ে ইতিমধ্যে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। ও মেঘালয়কে বললো, “তোমরা সবাই এত্ত ভালো কেন!”
মেঘালয় উত্তরে হাসলো। মিশু একটার পর একটা খেতে শুরু করেছে। মেঘালয় ও চিপস নিচ্ছে একটু পরপর। সায়ান মেঘালয়কে বললো, “দোস্ত গান ধরছিস না কেন?”
মিশুও সাথে যোগ দিয়ে সায়ানকে গান গাইতে বললো। মিশুর কথা শুনে মেঘালয় গান গাইতে আরম্ভ করলো। সাথে ওর বন্ধুরাও যোগ দিলো,
“যার সনে যার ভালোবাসা..
যার সনে যার ভালোবাসা,
তারে ছাড়া প্রাণ বাঁচেনা…
পিরিতি এই জগতে জাতি কূলের ধার ধারেনা… পিরিতি..ই..ই
পিরিতি এই জগতে জাতি কূলের ধার ধারেনা… পিরিতি..ই..ই
এক জাইত্যা লতা আছে বাইতে বাইতে উঠে গাছে,
গাছ মরিলে লতা মরে, তবু লতায় গাছ ছাড়েনা…
পিরিতি এই জগতে জাতি কূলের ধার ধারেনা…”
গান শেষ করতেই মিশু হাত তালি দিয়ে বললো, “খুব সুন্দর করে গেয়েছো।”
মেঘালয় বললো, “তোমার জন্য ছিলো। আমি হচ্ছি সেই লতা,আর তুমি হচ্ছো গাছ। গাছ মরলে লতাও মরবে তবুও লতা গাছ ছাড়বে না।”
মিশু হেসে উঠলো- “গানটা সত্যি সুন্দর ছিলো! আরেকটা গান শুনাবা?
মেঘালয় আবারো গান ধরলো। একটার পর একটা গান চলতেই লাগলো। চারবন্ধু মিলে একসাথে গাইছে। মিশু জানালায় মাথা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে আর গান শুনছে। মেঘালয়ের হাতের মুঠোয় ওর হাত। মিশুর যে কি পরিমাণ আনন্দ হচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করা হয়ত সম্ভব নয়। ও বারবার খুশিতে মেঘালয়কে জাপটে ধরছে। মেঘালয় ওর উচ্ছ্বসিত মুখ দেখে হাসছে।
ভৈরবে এসে গাড়ি থামাল ওরা। রাত আড়াইটা বাজে। রেস্টুরেন্ট এ ফ্রেশ হওয়ার জন্য ঢুকলো। ফ্রেশ হয়ে এসে একটা টেবিলে বসে গেলো নাস্তা করতে। মিশুর একটুও খিদে পায়নি। তবুও মেঘালয় জোর করে খাওয়ালো ওকে। খাওয়া শেষ করে আবারো গাড়ি স্টার্ট দিলো। এবার সায়ান ড্রাইভ করছে। আরাফ মেঘালয়ের পাশে এসে বসে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, পূর্ব সামনের সিটে বসেই ঘুম। সায়ান ড্রাইভ করছে গান ছেড়ে দিয়ে।
মিশু মেঘালয়কে বললো, “আমি একটা কথা বলি তুমি কি রাগ করবা?”
– “না, বলো।”
মিশু বললো, “তুমি এখন একটু ঘুমিয়ে নাও। একটু ঘুম দরকার না বলো? আমি বরং সামনের সিটে গিয়ে সায়ান ভাইয়ার সাথে বসে গল্প করি আর রাস্তা দেখতে দেখতে যাই? আমার বাইরেটা দেখতে খুব ভালো লাগে। এখানে বসে তো ভালোমতো দেখাই যায়না। আর আমি কথা বলতে থাকলে সায়ান ভাইয়ার ও ঘুম আসবে না। সবাই ঘুমাচ্ছো, সে একা একা গাড়ি চালাচ্ছে।”
মেঘালয় বললো, “আচ্ছা ঠিকাছে, সামনে গিয়ে বসো।”
পূর্ব পিছনে এসে মিশুর সিটে বসলো। আর মিশু ড্রাইভারের পাশে অর্থাৎ সায়ানের পাশে বসে ননস্টপ রেডিওর মত কথা বলতে শুরু করলো। মেঘালয় হাসছে ওর কথা শুনে। এভাবে বকবক করলে সায়ানের কান ঝালাপালা হয়ে যাবে। বেচারার ভূলেও ঘুম আসবে না। সায়ান শুধু মাথা ঝাঁকাচ্ছে আর গল্পের সাথে তাল মিলাচ্ছে। মেঘালয় সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। বাকিরা ঘুমিয়ে পড়তেই মিশু সায়ানের সাথে বকবকানি চালিয়ে যেতে লাগলো।
হোটেলে এসে পৌছল সকাল ছয়টার একটু আগেই। মিশু বাইরে নেমে দাঁড়ালো। বাকিদের ঘুম থেকে ডেকে তোলা হলো। মেঘালয় নেমে এসে মিশুকে জিজ্ঞেস করলো, “জার্নি কেমন লাগলো?”
– “খুব ভালো। সামনের সিটে বসতে দারুণ মজা তো। সবকিছু সুন্দর দেখা যায়! আমিতো আর একটুও ঘুমাই নি। তোমার ঘুম হলো?”
মেঘালয় মিশুর কানেকানে বললো, “স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। ‘মিশু রাজ্যের রাজকন্যা’ স্বপ্নে এসে প্রেম বুনছিলো।”
– “ওহ আচ্ছা।”
মিশু মাথা ঝাঁকিয়ে হাসতে লাগলো। ওরা হোটেলের ভেতরে ঢুকে লিফটের কাছে চলে এলো। লিফটে পূর্বরা তিনজন সহ আরো কয়েকজন উঠলো। মেঘালয় মিশুকে নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। পরেরবার মিশুকে নিয়ে লিফটে উঠলো মেঘালয়। এবার শুধু ওরাই দুজন ভেতরে। মেঘালয় একটানে মিশুকে বুকে টেনে নিলো। শক্ত করে এক হাতে ওর মাথাটা চেপে ধরে আলতো করে ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো। মিশুর পেটে হাত রেখে আস্তে আস্তে চাপ দিতে দিতে ওকে উপরে তুলে গভীর আবেশে চুমু খেতে লাগলো।
লিফট থেকে বের হয়ে রিসিপশনিস্টের কাছে এসে মিশু লজ্জায় চোখ মেলতেই পারছিলো না। রুমের চাবি নিয়েই ওরা একসাথে রুমে চলে এলো। দুটো রুম পাশাপাশি। সায়ান, পূর্ব ও আরাফ একরুমে ঢুকে গেলো। মেঘালয় বলে দিলো “আট টায় দরজায় নক করবি।”
রুমে ঢুকে দরজা লক করেই মিশুকে কোলে তুলে এনে বিছানায় ফেলে দিলো মেঘালয়। মিশু লজ্জায় নীল বর্ণ ধারণ করলো। ও দুহাতে মুখ ঢেকে আঙুলের ফাঁক দিয়ে মেঘালয়কে দেখতে লাগলো। মেঘালয় লাগেজ খুলে জামাকাপড় বের করে নিয়ে বললো, “ওঠো, এখন কোনো আদর নয়। গোসল করে রেডি হয়ে নিবে আসো।”
মিশু লজ্জা পেয়ে বিছানা থেকে নামতে গেলো, সেই মুহুর্তে মেঘালয় আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর উপর। একে অপরের মাঝে মিশে যেতে লাগলো। নরম তুলোর বিছানায় তলিয়ে গেলো দুজনে।
চলবে..