অনুভূতির অন্বেষণ পর্ব -১১

#অনুভূতির_অন্বেষণ
#চন্দ্রিকা_চক্রবর্তী
#পর্বঃ১১

(২৭)

ইশরাতের তুলতুলে গাল দু’টো এখন রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। কারণ ডান হাত দিয়ে তার দু’গাল চেপে ধরে রেখেছে সাদমান। অগ্নিসম রাগ চোখে।

—-ছেলের নাম কী? কোন ছেলে?

—-উমমম…

—-কথা বলতে বলছি না? বল? কে সেই ছেলে?

ইশরাত হাত দিয়ে ইশারা করলো তার মুখের দিকে। মূলত সাদমান তার গাল চেপে ধরে রেখেছে সেদিকে। কিছু একটা বুঝে সাদমান তাকে ছেড়ে দিয়ে একটু সরে দাঁড়ালো। তবে পুরোপুরি দূরে গেল না।

—-সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আমি কিন্তু আঙুল বাঁকাতে জানি! এখন আমি গাল ছেড়ে দিয়েছি। এখন কথা বের হচ্ছে না কেন মুখ দিয়ে?

ইশরাতের মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে সাদমান। মুখে গাম্ভীর্য বজায় রেখেছে। তবে সে যে কিছুক্ষণের মধ্যেই হতবুদ্ধি হয়ে যাবে সেটা বুঝতে পারেনি। তার কারণ?

ইশরাত এখন ভ্যা ভ্যা করে কান্না শুরু করেছে। কিছুক্ষণ বোকার মতো সেদিকে তাকিয়ে থেকে তাড়াতাড়ি আবার তার মুখ চেপে ধরলো সাদমান। রান্নাঘরে থাকার কারণে বোধহয় এখনো পারভীন সুলতানার কানে ইশরাতের কন্ঠ পৌঁছায়নি। এদিকে সাদমানের ভাগ্য ভালো। ইশরাতের মুখ ধরে চেপে রাখা অবস্থায় চাপা কন্ঠে বললো

—-এই চুপ! কাঁদছো কেন?

মুখ চেপে রাখার দরুন কান্নার শব্দ শোনা না গেলেও ইশরাতের ফোঁপানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে।

—-কান্না বন্ধ করো! সেদিন রাস্তায় বলেছিলাম না একদম কান্না না করতে? মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিচ্ছি। সাবধান যাতে কান্নার শব্দ বের না হয়!

সাদমান হাত সরিয়ে ফেলায় এবার আর জোরে শব্দ করে কাঁদেনি ইশরাত। তবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে এখনো কাঁদছে।

—-বলছি না কান্না বন্ধ করতে? তোমার কান্না আমার সহ্য হয় না বোঝো না তুমি?

—-একদম দরদী কথা বলতে আসবেন না। সবসময় আমার কান্নার কারণ যে আপনিই হোন, সেটা জানেন আপনি? হয়তো জানেন। জেনেও আমাকে কষ্ট দেন।

—-কী কষ্ট দিয়েছি এখন তোমাকে? একটা প্রশ্ন কখন থেকে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছি, এটাকে কষ্ট দেওয়া বলে?

—-আপনি কতো জোরে আমাকে বকা দিয়েছেন। জানেন এভাবে আমার আব্বু আম্মুও কখনো বকে না আমাকে। আপু তো দূরে থাক। আপনি কেন আমাকে শুধুশুধু কষ্ট দেন?

—-আমি প্রথমে তো শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করছিলাম। তখন জবাব দিলেই তো হতো।

—-কেন? আপনি জবাব চেয়ে কী করবেন? আপনার পেছনে এতোদিন ধরে ঘুরঘুর করলাম। আপনি আমার দিকে ফিরে পর্যন্ত তাকাননি। তাহলে এখন আমি কোথায় যাবো, কার সাথে যাবো, কারোর সাথে সম্পর্কে জড়াবো কীনা সেটা আপনাকে কেন বলতে যাবো?

এখন রাগ দেখাতে যাবেন না দয়া করে। একটু যুক্তিসঙ্গত উত্তর দিন? আপনার কী সমস্যা যদি আমি কারোর সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ হই-ও?

ইশরাতের সামনে থেকে সরে গিয়ে আবারও সোফায় বসে পড়লো সাদমান। মাথা নিচু করে নিজের চুল নিজেই শক্ত করে ধরে রেখেছে। প্রায় মিনিট তিনেকের মতো নীরবতা পালন করলো। এরপর আকস্মিক বলে উঠলো

—-এতো কম বয়সে পেকে যাওয়ার কী খুব প্রয়োজন ছিলো? আর কয়েকটা দিন সবুর করতে পারতে না?

—-মানে?

—-এতো ছোট কেন তুমি ইশরাত? আর একটু বড়ো হলে কী হতো? আমি পারছি না এভাবে দূরে থাকতে। অথচ কাছে যাওয়ার সময়ও আসেনি।

—-আপনার কথার মাথামুণ্ডু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

—-আমি না করেছিলাম বলে এখন ঢ্যাং ঢ্যাং করে আরেকটা ছেলের কাছে যেতে হবে? কেন? বয়স কতো তোমার? বিয়ের সময় চলে যাচ্ছে? প্রেম করার সময় চলে যাচ্ছে?

—-এগুলো আমার কথায় উত্তর? সেই তো আপনি ঘুরেফিরে আগের জায়গাতেই চলে আসলেন। আমার জীবন এটা। আমি কখন প্রেম করবো, কখন বিয়ে করবো, কাকে বিয়ে করবো সেটা আমি বুঝে নিবো। আপনাকে বলার প্রয়োজন মনে করছি না। আর আপনিও অনধিকার চর্চা করতে একদম আসবেন না! নওশাদের সাথেই আমি প্রেম করবো। দেখি আপনি কী করতে পারেন!

সোফা থেকে এক লাফে উঠে ইশরাতের দুই বাহু চেপে ধরলো সাদমান। প্রচন্ড শক্ত করে।

—-খুন করে ফেলবো একদম বলে দিলাম!

ইশরাতের বাহু ছেড়ে উল্টো হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো সাদমান।

—-নওশাদ না কে, আমি তাকে চিনিও না, জানিও না। তবে তোকে চিনি আর জানি। কখনো যদি স্বেচ্ছায় কোনো ছেলের আশেপাশে দেখেছি, তখনই বুঝে নিতে পারবো ছেলে টা কে। এরপর থেকে তোর বাইরে বের হওয়া বন্ধ। ট্যুরের আশা ছেড়ে দে। আমি রাজি হচ্ছি না। আর আমি রাজি না মানে আন্টিকে রাজি করাতে পারবি না। না মিশরাত রাজি হবে। আর বাকি রইলো আংকেল? চেষ্টা করে দেখতে পারিস।

প্রেম করার অনেক শখ তোর তাই না? করাচ্ছি প্রেম। শুধু কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর। বুঝে যাবি সবকিছু।

(২৮)

—-ইশু, কী হয়েছে রে? এতো দেরী হলো যে তোর আসতে? আর সাদমানের বাসা থেকে আসার পর এভাবে এক জায়গায় স্ট্যাচুর মতো বসে আছিস কেন?

—-আপু, সত্যি করে বল তো? তোরা কী আমার থেকে কিছু লুকোচ্ছিস?

—-মানে! কী লুকোবো?

—-সাদমানকে নিয়ে কিছু? মানে আমি বুঝে উঠতে পারছি না, সাদমান যদি কিছু বলে আমার ব্যাপারে, তার মানে সেটাই আব্বু আম্মু আর তোর কাছে শিরোধার্য। আমার জীবন নিয়ে সাদমানকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তোরা কীসের পরিপ্রেক্ষিতে দিস একটু বলবি?

—-কী সব যা-তা কথা বলছিস? সাদমানকে আমি কোথায় তোর জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দিলাম? আমি তো শুধু ট্যুর এর কথাটা বলেছি। কারণ সেখানে কামরুল নামের ছেলেটা থাকবে তাই। নয়তো তা-ও বলতাম না। আম্মু সাদমানকে আমাদের জন্য শুভাকাঙ্ক্ষী মনে করে। এটা কিন্তু আসলেও ভুল না। সাদমান আব্বুর অবর্তমানে এখন কতো দায়িত্ব পালন করছে সেটা তুইও জানিস। অথচ সে কিন্তু আমাদের না কোনো আত্মীয় হয়, আর না রক্তের সম্পর্কের কেউ। আজকাল এরকম ছেলে দেখিস?

আমি যখন পাঁচ বছর আগে পুরোপুরি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম, তখন সাদমান শক্ত হাতে আমাকে আগলে রেখেছিলো। যার কারণে আমার পরিবারের পরেই তার স্থান আমার জীবনে সবচেয়ে বিশেষ। সাদমান কিন্তু শুরুতেই আমাদের পরিচিত ছিলো না। কিন্তু একটা অপরিচিত ছেলে হয়েও সে আমাদের পরিবারকে নিজের পরিবারের মতো সামলাচ্ছে। বর্তমান জামানায় তো বাইরের কোনো ছেলেকে হুটহাট বিশ্বাস করা যায় না। মেয়েদের ব্যক্তিগত ব্যাপারের কথা বললাম আর কী। কিন্তু বুকে হাত রেখে বল তো? সাদমানকে কখনো তুই সেইদিক থেকে অবিশ্বাস করেছিস? করিসনি। আমিও করিনি। কারণ সে কখনো বাজে নজরে আমাদের দিকে তাকায়নি। আমাকে সে নিজের পরম বন্ধু ভাবে। আমিও তাকে। আমরা একজন একে অপরকে নিয়ে কী ভাবি সেটা শুধু আমরাই জানি।

এবার তুই একটু বল তো? আব্বুর পরে আর এমন কোনো পুরুষ আছে যাকে তুই ভরসা করতে পারিস?

মাথা নিচু করে ফেললো ইশরাত।

—-আমি জানি আছে এবং একজনই আছে। সাদমান। আম্মুও ঠিক সেই ভরসা করেই সাদমানের কথায় গুরুত্ব দেয়। আব্বুও হয়তো তা-ই!

হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, ইদানীং সে কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করছে তোর সাথে। তার মনোভাব পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে তোর প্রতি। এটার কারণ আমারও অজানা। কিন্তু উত্তর আমি নিয়েই নিবো তার থেকে। তবে দেখ, কামরুল কে সেটা সাদমান না বললে আমরা কেউ জানতে পারতাম না। আমার থেকে বেশি আমার বোনের নিরাপত্তার দিকে যেই ছেলেটা নজর রাখে, তাকে আমি কী করে সন্দেহ করবো?

চুপ করে রইলো ইশরাত।

—-ইশু?

—-হুম?

—-সাদমানের সাথে আজ পর্যন্ত তোর ঠিক কী কী কথা হয়েছে সেগুলো সব আমাকে বলতে পারবি? কামরুলের ব্যাপারটাও খোলাসা কর। একেবারে প্রথম থেকে।

(২৯)

গাড়িতে বসে আছে মিশরাত আর সাদমান। গন্তব্য হলো তাদের কর্মক্ষেত্র। সাদমান অনেকটা চুপচাপ আছে আজকে। মিশরাতের নজরে এড়ায়নি সেই ব্যাপারটা।

—-কিছু ভাবছো মনে হচ্ছে?

—-না, তেমন কিছু না।

—-ইশরাতকে তুমি পছন্দ করো সেটা বলতে কী সমস্যা?

হুট করেই গাড়িতে ব্রেক কষলো সাদমান। চোখ দু’টো ছোট করে ফিরে তাকালো মিশরাতের দিকে।

—-মানে!

—-আমাদের দু’বোনের নিরাপত্তার কথা তুমি ভাবো, সেটা বুঝলাম। তার জন্য তুমি ইশুর দিকে নজর রাখছো, সেটাও বুঝলাম। তুমি তার নিরাপত্তার জন্য তার সাথে ট্যুরে যেতে চাইছিলে, সেটাও বুঝলাম। অনেক কিছু বুঝলাম আবার কিছুই বুঝলাম না।

গাড়িতে উঠার পর মিরর গ্লাসে আমার বোনের দিকেই কেন তোমার নজর যায়? সে ঘনঘন ফোন হাতে নেয় বলে আম্মুকে বললে তার উপর নজর রাখার জন্য। রাস্তায় সে শাড়ি পরে সেজেগুজে বের হলে তোমার রাগ হয়। কোনো ছেলের সাথে কথা বললে তুমি সহ্য করতে পারো না। ইশু ছোট, এখনো অনেক কিছু বোঝে না। তবে আমি কিছুটা হলেও বুঝি।

কামরুল নামের ছেলেটা তার পেছনে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে লেগে ছিলো। এরপর একদিন কলেজ থেকে হুট করে গায়েব। ফিরলো প্রায় মাস খানেক পর। সেটাও হসপিটাল থেকে। শারীরিকভাবে সে আহত ছিলো। এক মাস পর যখন কলেজে এসেছিলো তখনও ঠিকঠাক ভাবে হাঁটতে পারতো না। এরপর থেকে ইশুর সাথে আর কথাই বলতো না। কেন? হুট করে এসব কী করে হলো? কামরুলকে তো আমরা কেউ চিনতাম না। তাই আমাদের কারোর তাকে নিয়ে কিছু করার বা বলার প্রশ্নই আসে না। চিনতে শুধু তুমি।

শুনলাম নওশাদ নামের কোন ছেলের কথা ইশু তোমাকে বলেছিলো। সে এটা নিতান্তই তোমাকে মজার ছলে বলেছিলো।

হ্যাঁ, সব কথা সে আমাকে বলেছে এবং কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে সেটা স্বীকারও করেছে গতকাল রাতে। তো সে যখন বলেছিলো নওশাদের সাথে প্রেম করবে, তখন নাকী তুমি বলেছিলে তাকে খুন করে ফেলবে?

আমি জানি এটা রাগের বশবর্তী হয়ে বলেছো। কিন্তু কেন তুমি এমনটা বলবে? ইশুর নিরাপত্তার দিকে নজর রাখা এক জিনিস আর তার উপর অধিকার খাটানো আরেক জিনিস। তোমার এসব ছোটখাটো কর্মকাণ্ড বলে দেয় যে তুমি তাকে নিয়ে কতোটা পজেসিভ। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা নয়? আমার বোন যখন তাহলে তোমাকে নিজের মনের কথা বলার জন্য উতলা ছিলো, তখন তুমি তাকে ফিরিয়ে দিলে কেন?

—-আমি এখন তোমাকে কিছুই বলতে পারছি না মিশরাত। বলতে পারো আমি কিছু বলতে চাইছি না। কিন্তু খুব শীঘ্রই সবকিছু জানতে পারবে৷

—-তুমি কিন্তু একটা রহস্যের জ্বাল বুনছো সাদমান!

—-হয়তো। কিন্তু রহস্যভেদ ও কয়েকদিনের মধ্যেই ঘটবে।

—-আমি তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড সাদমান। তুমি আমার থেকেও কথা লুকোচ্ছো এখন?

—-আমি সেটা করেছি তাতে কিছু কারণ ছিলো। তোমাদের কাছে কতোটুকু গ্রহণযোগ্যতা পাবে সেই কারণ আমি জানি না। তবে আমার যা ঠিক মনে হয়েছে, তাই করেছি।

শুনলাম আংকেল নাকী সামনের সপ্তাহে আসছেন? আন্টি বললো।

—-হ্যাঁ, কেন?

—-কিছুই যখন বলা হয়নি এই ব্যাপারে, তাহলে বাকিটাও পরেই না হয় জানবে।

গাড়ি স্টার্ট দিলো সাদমান।

—-পরিবেশটা খুব থমথমে হয়ে গেল। এখন একটা মজার কথা বলি শোনো। একটু স্বাভাবিক করি পরিবেশটাকে। আজকে গাড়িতে উঠার আগে লুৎফা আন্টি আমার কাছে এসেছিলো৷ এসে কী বলেছে জানো?

—-কী?

—-সাদমান, তুমি আর মিশরাত বিয়ে করবে কবে?

—-কীহ্! উনি কী পাগল?

—-হা হা! আমারও ঠিক একই কথা মাথায় এসেছিলো উনার প্রশ্নটা শুনে। তবে এরকম দৃশ্য খুবই কমন আমাদের সমাজে। তুমি আর আমি দু’জনে প্রাপ্তবয়স্ক। সবসময় একসাথে থাকি, চলি। কাজে যাই একসাথে, ফিরিও একসাথে। আবার তোমার পরিবারের সাথে আমার এবং আমার পরিবারের সম্পর্ক কতোটা ভালো, তা এই বিল্ডিংয়ের সবাই জানে। তাই হয়তো উনার মনে এরকম প্রশ্ন উদয় হয়েছে।

মিশরাত স্মিত হেসে বললো

—-তো তুমি বিয়ে করো না কেন?

—-এতো তাড়াতাড়ি করার ইচ্ছে ছিলো না। তবে এখন মনে হচ্ছে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হতে পারে।

—-মানে?

—-মানে পরে বুঝবে। আমার একটা কথা মনে পড়েছে হুট করে। হুমায়ুন আহমেদ বলেছিলেন,

“ছেলে মেয়ে বন্ধু হতে পারে। কিন্তু তারা অবশ্যই একে অপরের প্রেমে পড়বে। হয়তো খুবই অল্প সময়ের জন্য, অথবা ভুল সময়ে, কিংবা দেরীতে, আর না হয় সবসময়ের জন্য। তবে তারা প্রেমে পড়বেই।”

ঠিক বুঝলাম না ব্যাপারটা। তাহলে আমাদের ক্ষেত্রে এমন হলো না কেন? তুমি মেয়ে তো? নাকি আমি ছেলে না?

অট্টহাসি দিয়ে উঠলো মিশরাত।

—-এসবই তোমার মাথায় আসে তাই না?

—-যাক, এতোক্ষণ যাবত বজায় থাকা গুরুগম্ভীর ভাব টা এখন কিছুটা হলেও মুখ থেকে মুছেছে।

গাড়িতে দু’জনই কথা বলতে, হাসিঠাট্টা করতে ব্যস্ত। কিন্তু তাদের দু’জনের কেউ দেখতে পেল না, তাদের গাড়ির পেছনে কেউ একজন গাড়ি নিয়ে তাদের উপর নজর রাখছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।

হঠাৎ করেই ফোন বেজে উঠলো সেই মানুষটির।

—-হ্যাঁ আরাভ, বল।

—-কোথায় তুই? সকাল সকাল কই চলে গেলি? নাস্তা করেছিস কিছু? আমি তো ঘুম থেকে উঠে তোকে দেখতে পেলাম না আর।

—-মিশু আবারও সেই ছেলেটার সাথে আরাভ। সারাক্ষণ ওই ছেলেটার সাথেই থাকে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি যে আমাকে সে গ্রহণ করছে না তার আরেকটা কারণ হলো সাদমান নামের এই ছেলেটি।

—-সাদমানের উপর নজর না রেখে কী করে মিশরাতের সাথে কথা বলার সুযোগ তৈরি করতে পারবি সেটা আগে ভাব।

—-লাভ নেই। আগে এই ছেলের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর মিশরাতের সাথে বোঝাপড়া হবে।

—-কী ব্যবস্থা করবি?

—-পথের কাঁটা উপড়ে ফেলতে হয় আরাভ। গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। সেসব রেখে দিলে সামনে আগানো যাবে না।

—-তুই বলতে কী চাইছিস বল তো?

—-আমার মিশুকে চাই আরাভ। এবার তার জন্য যা কিছু করতে হোক না কেন, আমি করবো। সে আমার মানে আমার।

—-তুই কী কোনোভাবে সাদমানের কোনো ক্ষতি…

ফোন কেটে দিলো আরিয়ান। আরাভ হতবিহ্বল হয়ে ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। ছেলেটাকে আটকানো দরকার। এসব কী উন্মাদের মতো ব্যবহার শুরু করেছে! সেদিন এমনিতেই মোনা কে জানে মেরে ফেলতে নিয়েছিলো কারণ সে আবারও মিশরাত আর আরিয়ানের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি করতে এসেছিলো। এখন কী তাহলে সাদমানকে ও মেরে ফেলার কথা ভাবছে নাকী আবার! না, না। মিশরাত মিশরাত করতে করতে ছেলেটা হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ছে। তাকে আটকানো প্রয়োজন। খুব করে প্রয়োজন।

(৩০)

দিন পাঁচেক পরের কথা। সাদমান আর মিশরাত এখনো অফিসে। হুট করে সাদমান বললো

—-মিশরাত, আজকে বোধহয় আমি তোমার সাথে বাসায় ফিরতে পারবো না।

বিকেলের দিকে হাতের কাজ শেষ করে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিবে মিশরাত, তখনই সাদমান এই কথা বললো।

—-কেন?

—-বস বললো নেক্সট প্রজেক্টে নাকী কাজের চাপ বেশি পড়বে। তাই দেরীতে ফিরতে হবে বাসায়। যারা যারা আমরা এই প্রজেক্টে আছি, তাদের সকলের জন্যই এক নিয়ম। তুমি থাকলে তোমার জন্যও থাকতো।

—-তাহলে ফিরবে কখন?

—-এইতো, কাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বা তার থেকে একটু কম বাজবে। নয়টার উপর তো হবেই।

—-ঠিক আছে, কী আর করার! আমি রিকশা করে চলে যাবো।

—-একা যেও না মিশরাত। তোমার জন্য বড্ড চিন্তা হয়।

—-আমি ছোট্ট বাচ্চা না তো সাদমান! অতিরিক্ত চিন্তা করো তুমি।

—-এতোদিন করতাম না। কিন্তু ভুলে যেও না আরিয়ান হক এখনো তোমার পিছু ছাড়েনি। সে তোমাকে এর আগেও জোর করে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে গিয়েছিলো যেদিন আমাদের পার্কে ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিলো সেদিন। তখন তো দিনের বেলা ছিলো। তবুও সে দুঃসাহস দেখিয়েছে। আর যখন তুমি বাসায় ফিরবে তখন তো সন্ধ্যা।

—-আচ্ছা, আমি না হয় শেফালীকে সাথে করে নিয়ে যাবো। তার বাসা তো আমার বাসায় যাওয়ার রাস্তাতেই পড়ে। তাকে একসাথে যাওয়ার অফার দিলে আশা করি রাজি হবে।

—-আচ্ছা, পৌঁছে ফোন দিও।

(৩১)

রাত এখন প্রায় সাড়ে আটটা। ইশরাত বিকেলের দিকে তার এক বান্ধবীর বাসায় গিয়েছে। বলেছিলো সন্ধ্যা সাতটা কী সাড়ে সাতটার মধ্যে ফিরে আসবে। তবে এখনো তার আসার নাম নেই। তার উপর সবথেকে চিন্তার বিষয় হলো তার ফোন বন্ধ। এদিকে কিছুক্ষণ আগে থেকেই শুরু হয়েছে প্রবল ঝড়বৃষ্টি। মিশরাতের বাসায় ইলেক্ট্রিসিটিও চলে গিয়েছে। এই পাড়ায় বেশিরভাগ বাসাবাড়িতে এখন ইলেক্ট্রিসিটি নেই। পরিবেশ অনেকটাই থমথমে, নীরব এবং অন্ধকার।

রেণু আক্তার কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন রীতিমতো। বারেবারে আল্লাহর নাম স্মরণ করছেন। মিশরাতের মনেও অশান্তি শুরু হয়েছে। নিজের বোকামির উপর নিজের রাগ হচ্ছে এখন তার। ইশরাত যেই বান্ধবীর বাসায় গিয়েছে, তার ফোন নাম্বারও রাখা হয়নি। নয়তো সেখানে ফোন করা যেতো। এখন তো কোনো উপায় দেখতে পারছে না।

—-ও মিশু, মেয়েটার কী হলো হ্যাঁ? এই অন্ধকার বৃষ্টি বাদলের রাতে কোনো বিপদে পড়লো না তো?

—-আম্মু, প্লিজ কেঁদো না। আল্লাহ ভরসা। কিছু হবে না আমাদের ইশুর। আমি না হয় বের হয়ে দেখছি।

—-তুই কী বের হবি? যেই অবস্থা শুরু হয়েছে বাইরে, সামনে আগানোর কোনো অবস্থা আছে নাকী? ইশুকে এমনিতেই পাচ্ছি না। এরপর যদি তোকেও না পাই? তুই থাক বরং, আমি বের হচ্ছি।

—-আম্মু, তুমি তো আরও পারবে না। আর তোমাকে আমি একা বের হতে দিয়ে নিজে বাসায় বসে থাকবো?

—-চল তাহলে দু’জনে বের হই?

—-বের তো হতেই হবে৷ কিন্তু রাস্তায় তো কোনো যানবাহন চোখে পড়ছে না। এতো জোরে জোরে বজ্রপাতের শব্দ আসছে! এই বজ্রপাতের ভয়েই হয়তো বা রিকশা বা অটো নিয়ে কেউ বের হওয়ার সাহস পাচ্ছে না।

—-সাদমান ছাড়া আর কোনো উপায় নেই রে!

—-কিন্তু সাদমান তো এখন কাজে আছে আম্মু। এই প্রজেক্টে যারা আছে, তাদের সাথে বসের পার্সোনাল মিটিং ও আছে। সে তো মনে হয় না এসময় ফোন ধরবে।

(৩২)

যদিও পারভীন সুলতানাকে সাদমান বলে দিয়েছে আজকে আসতে দেরী হবে, তবুও উনার ফোন দেওয়া থেমে নেই। মায়ের মন বলে কথা! না জানি এই ঝড়বৃষ্টিতে কী অবস্থায় আছে!

আসলেই অবস্থা খুব বেশি একটা সুবিধার না। সাদমান অফিস থেকে বের হয়ে গাড়িতে তো উঠেছে, কিন্তু এই অবস্থায় গাড়ি চালাতে ব্যাপক বেগ পেতে হচ্ছে। শার্ট হালকা ভিজে গিয়েছে। হাতে পানি লেগে আছে। তার সাথে সাথে পারভীন সুলতানার ক্রমাগত ফোন। সাদমান আশ্বস্ত করলেও যেন চিন্তা থামছে না উনার। হুট করেই সাদমানের গাড়িতে ব্রেক কষতে হলো। কারণ তার সামনে একটি কালো রঙের গাড়ি এসে থেমে আছে। তার কাছাকাছি গাড়িটা অবস্থান করছে না। বেশ খানিকটা দূরেই আছে। নিরবিচ্ছিন্ন বৃষ্টির দরুন সেই গাড়িতে বসে থাকা মানুষটার চেহারা দেখতে পাচ্ছে না সাদমান। গাড়ির হর্ণ বাজিয়ে চলেছে সে ক্রমাগত। কিন্তু যখন গাড়িটার কোনো নড়নচড়ন দেখলো না, তখনই বুঝতে পারলো ইচ্ছে করেই এমনটা করছে গাড়িতে বসে থাকা মানুষটি। মেজাজ ক্রমশ খারাপ হচ্ছে সাদমানের। এই অবস্থায় কোথায় তার বাড়ি ফেরার তাগদা, আর এই মানুষটা তাকে খামোখা আঁটকে রেখেছে।

গাড়ি থেকে নেমে গেল সাদমান। উদ্দেশ্য হলো সেই গাড়িটার সামনে যাওয়া। তবে সে তার গাড়ি থেকে নেমে মাঝরাস্তায় দাঁড়ানোর পরপরই দেখলো ওই গাড়িতে বসে থাকা মানুষটি গাড়িটাতে বিপজ্জনক গতি সঞ্চার করে তার দিকে ক্রমশ ছুটে আসছে।

চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসী ছাড়া দয়া করে কেউ কপি করবেন না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here