অনুভূতির অন্বেষণ পর্ব -১২

#অনুভূতির_অন্বেষণ
#চন্দ্রিকা_চক্রবর্তী
#পর্বঃ১২

(৩৩)

সাদমানের একেবারে পায়ের কাছে এসেছে গাড়িটা থেমেছে। যেরকম গতি সঞ্চার করা ছিলো গাড়িতে, তাতে সাদমানের মনে হয়েছিলো হয়তো গাড়িতে বসা লোকটি তাকে মারার উদ্দেশ্যে আসছে। বেশ বিচলিত হয়ে গিয়েছিলো সে যখন গাড়িটা তার থেকে কিছুটা দূরে ছিলো। ভাবছিলো নিজের গাড়িতে আবার উঠে বসবে কীনা। তবে সেসব ভাবতে ভাবতে গাড়ি নিজে থেকেই থামিয়ে দিয়েছে লোকটি।

চোখে চশমা পরে থাকায় বৃষ্টির পানিতে সবকিছু ঘোলাটে দেখছে সাদমান। তাই নিজের চশমা খুলে ফেললো সে। তবে চশমা খুলে তাকাতে না তাকাতেই দেখলো তার সামনে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এসে আরিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ এই একটা পরিবেশে আরিয়ানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেশ অবাকই হলো সাদমান। কথপোকথন শুরু করার উদ্যোগ আরিয়ানই গ্রহণ করলো।

—-মিশুর জীবন থেকে সরে যাও।

ফোঁস করে একটা শ্বাস ছাড়লো সাদমান। এই ছেলে তাহলে এসব বলতে এসেছে? আজকে এই আবহাওয়াতেই বলতে হতো এসব? যত্তসব উটকো ঝামেলা!

—-শুনতে পেরেছো আমার কথা? মিশুকে ছেড়ে দাও। তার থেকে দূরে থাকো।

—-ও ভাই! আপনার কী আসলেই মাথায় সমস্যা হ্যাঁ? মানে পাগল নাকী আপনি? আমার মা ওইদিকে আমার জন্য চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে, আমি আছি বাসায় ফেরার তাগিদে, আর আপনি মাঝরাস্তায় গাড়ি আটকিয়ে এসব ফালতু কথা বলতে আসছেন?

—-তোমার জন্য ফালতু হতে পারে। কিন্তু আমার জন্য আমার জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলোর মধ্যে এটি একটি।

—-আপনি এতোটা নির্লজ্জ কেন? সেদিন রাস্তায় সবার সামনে অপমানিত হয়ে, মিশরাতের হাতে জনসম্মুখে থাপ্পড় খেয়ে, আন্টি পা ঝাড়া দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেওয়ার পরেও আবার এই মুখ নিয়ে আমার কাছে আসছেন ওই একই মানুষের বিষয়ে কথা বলতে?

—-আমি কী সেটা তোমাকে বলার প্রয়োজন মনে করছি না। যা বলেছি, তাই করো।

—-আদেশ দিচ্ছেন মনে হচ্ছে?

—-যা ভাবো তাই।

—-সাদমান হাসান যার তার অনুরোধ ও রাখে না। আদেশ তো কোন ছাড়! যেভাবে এসেছেন, সেভাবে কেটে পড়ুন।

—-আমি কিন্তু ফাজলামো করছি না!

—-আলবাত আপনি ফাজলামো করছেন! আপনার মতো বেকার মানুষরা এরকমই করতে পারে। কাজকর্ম আপনার হয়তো নেই, আমার আছে। বাপের ব্যবসায় আপনা-আপনি কাজ জুটে গেছে। তবে এতো ভালো কপাল আমার না। সারাদিন যথেষ্ট খাটাখাটুনি গিয়েছে। এখন বাড়ি ফিরতে হবে। আপনার মতো কাজকর্ম ফেলে কারোর পিছুপিছু ঘোরার সময় আমার নেই।

—-শেষ বারের মতো বলছি। মিশরাতের থেকে দূরত্ব বজায় রাখো।

আরিয়ানের একই কথা বারেবারে শুনতে শুনতে এবার সত্যিই মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে সাদমানের। দু-তিন কদম এগিয়ে আরিয়ানের বরাবর গিয়ে দাঁড়ালো সাদমান। কাকতালীয়ভাবে দু’জন সম উচ্চতা সম্পন্ন। তাই মুখোমুখি দাঁড়ানোর ফলে একজনের মুখ একেবারে আরেকজন মুখ বরাবর। আরিয়ানের চোখে চোখ রেখে সাদমান বললো

—-মিশরাতের থেকে দূরত্ব যদি বজায় রাখতে হয়, সেটা আপনি রাখবেন। আমি না। কারণ বিগত পাঁচ বছর যাবত তাকে আগলে রাখার দায়িত্ব আমি পালন করছি। সেই পাঁচ বছর যা তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় এই পর্যন্ত। সেই সময় আপনি তার পাশে থাকা তো দূর, নিজেই তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। যখন সে খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলো, তখন আপনাকে পায়নি। তখন এই আমি ছিলাম তার সাথে। তখন থেকে এখন অবধি সেই আমিই আছি। মিশরাত আপনাকে ভুলে একটা স্বাভাবিক জীবনে আস্তে আস্তে ফিরতে চাইছে, এটা বুঝি সহ্য হচ্ছে না আপনার? তাই আবার চলে এসেছেন তার জীবনে গন্ডগোল বাঁধাতে?

—-আমি কোনো গন্ডগোল বাঁধাতে আসিনি। নিজের করা ভুলগুলো শুধরে নিয়ে মিশুকে নিজের জীবনে আবার ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।

—-আপনি কতোটুকু ভুল শুধরেছেন, সেটা মিশরাত আমাদের সবাইকে বলেছে সেদিন রেস্টুরেন্টে আপনার সাথে দেখা করতে যাওয়ার পরে। পুরাতন প্রেমিকার সাথে বদ্ধ ওয়াশরুমে দাঁড়িয়ে ফষ্টিনষ্টি করছিলেন। এরপরও আপনি বলছেন নিজের ভুল শুধরাতে এসেছেন? কোন সাহসে মিশরাতকে নিজের জীবনে আবার চাইছেন আপনি? আপনার সেই যোগ্যতা আছে? টাকা পয়সা বা সামাজিক প্রতিপত্তির ভিত্তিতে হয়তো যথেষ্ট আছে। কিন্তু সবথেকে বড় যোগ্যতাই আপনার নেই। চারিত্রিক যোগ্যতা।

—-মুখ সামলে! আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার স্পর্ধা দেখাতে যেও না। ফল ভালো হবে না!

—-কী ফল খারাপ হবে শুনি? সত্যি শুনতে তেঁতো সবারই লাগে।

—-কীসের সত্যি হ্যাঁ? আরে মোনা কে আমি সেদিন ডাকিনি৷ সে জোর করে….

এতটুকু বলে থেমে গেল আরিয়ান। এরপর হুট করে বললো

—-অদ্ভুত! আমি তোমাকে জবাবদিহিতা কেন করতে যাচ্ছি? ইউ আর নোবডি!

—-হাসালেন! আমাকে বললেন আমি কেউ-ই না। আবার আমার কাছেই মিশরাতের ব্যাপারে কথা বলতে আসলেন! যাই হোক, আপনার কথা বলা শেষ? যদি এখনো কিছু বাকি থাকে তো একা বকবক করুন। এমনিতেও আমি আপনার কথাগুলো কানে নিচ্ছি না। পাগলের প্রলাপ ভেবেই উড়িয়ে দিচ্ছি। আর রাত দশটার দিকে বৃষ্টিতে ভিজে আমি কোনো পাগলের প্রলাপ শুনতেও চাই না।

সাদমান ফিরে যেতে নিলেই তার শার্টের কলার ধরে ঘুরিয়ে নিজের গাড়ির সাথে চেপে ধরলো আরিয়ান। রক্তগরম চোখে তাকিয়ে আছে সাদমানের দিকে। চিৎকার করে বলে উঠলো

—-আমি মশকরা করছি না! মিশু থেকে দূরে থাক! ঠান্ডা মাথায় বোঝাতে এসেছি। সহজ কথা সহজভাবে না বুঝলে কিন্তু আরও অনেক উপায় আমি জানি। আমি কিন্তু জানে মেরে ফেলবো তোকে বললাম!

কয়েক মুহুর্ত আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো সাদমান। সেই হাসির শব্দ প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। আরিয়ান চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে সাদমানের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ হেসে নিজের হাসি থামালো সাদমান। বাম ভ্রূ উঁচু করে চোখ বাঁকিয়ে নিজের শার্টের কলারের দিকে তাকালো যেখানে আরিয়ান দু’হাতে চেপে শক্ত করে ধরে আছে। নিজের দু’হাত দিয়ে ঝাড়া দিয়ে আরিয়ানের দু’হাত কলার থেকে ছাড়িয়ে নিলো সাদমান।

—-আমাকে কী দেখে স্কুল কলেজে পড়ুয়া নিব্বা মনে হয়? আমাকে হুমকি দিতে আসিস? আব্বে ওই! এতোক্ষণ যাবত ভদ্রভাবে আপনি করে সম্বোধন করে কথা বললাম সেটা ভালো লাগেনি বুঝি? এতো ভদ্রতা তাহলে আর বজায় রেখে লাভ কী! কুকুরের পেটে যেমন ঘি হজম হয় না, তোর ও ঠিক তেমনিভাবে ভালো ব্যবহার হজম হচ্ছে না। শোন, তোর এই রাগ নিজের পকেটে পুরে রাখ। যাদের সাথে রাগ দেখানোর হ্যাডম থাকে, তাদের সাথে দেখাবি। যার-তার সাথে রাগ দেখাতে আসলে উল্টো ক্যালানিও খেতে হতে পারে।

—-আমার রাগের কিছুই দেখিসনি এখনো৷ দেখতেও যাস না। চন্ডালের রাগের থেকেও অধিক!

সাদমান কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফোন বেজে উঠলো তার। পকেট থেকে ফোন বের করে বাম হাত দিয়ে ফোন ঢেকে নাম্বারটা একবার দেখে নিলো সাদমান। ভেবেছিলো তার আম্মু ফোন করেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আম্মু নয়, বরং মিশরাত ফোন করেছে। এই ব্যাপারটা আরিয়ানও খেয়াল করলো। খেয়াল হতেই দপ করে যেন রাগটা মাথায় জ্বলে উঠলো আবার। মিশরাত বারেবারে এই ছেলেকেই কেন এতো গুরুত্ব দেয়? তাকে ফোন দেয়া তো দূর, সে ফোন দিলেও সেটা কেটে দেয়।

বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে কথা বলা সম্ভব নয় বলে রাস্তার ডান পাশে থাকা একটা টিনের ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ালো সাদমান। আরিয়ান তার পিছুপিছু গেল সেখানে যেটা হয়তো সাদমান লক্ষ্য করেনি। বৃষ্টির শব্দ অনেক বেশি বিধায় সাদমান ফোন রিসিভ করে ফোনের স্পীকার অন করলো। সে কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই শুনতে পেল মিশরাতের ক্রন্দনরত কন্ঠ।

—-সাদমান, অনেক বড় বিপদে পড়েছি সাদমান। আমি জানি তুমি হয়তো ব্যস্ত। কিন্তু প্লিজ বস কে কিছু একটা বলে দ্রুত বাসায় আসো। আমি খুব অসহায় বোধ করছি সাদমান। এতোটা অসহায় কখনো নিজেকে মনে হয়নি এই জীবনে।

—-মিশরাত, শান্ত হও! প্লিজ কান্না থামাও। আমাকে ধীরেসুস্থে বলো কী হয়েছে? আমি অফিস থেকে বের হয়ে গিয়েছি অনেক আগেই। তুমি শুধু আমাকে সমস্যা টা বলো?

—-আম্মুকে নিয়ে আমি বের হয়েছিলাম সাদমান। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারিনি। কোনো গাড়ি পাচ্ছি না। তাই হেঁটে যাচ্ছিলাম। পুরো রাস্তা অন্ধকার। পাড়ায় ইলেক্ট্রিসিটি নেই। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে সামনে আগাচ্ছিলাম আমি আর আম্মু। কিন্তু আম্মু সামলাতে পারেনি নিজেকে। কিছুদূর গিয়েই ইট বা পাথর কিছু একটার সাথে পায়ে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েছে রাস্তায়। হাতের চামড়া উঠে গিয়েছে অনেকটুকু। মাথার বাম পাশে কেটে গিয়েছে। মাঝরাস্তা থেকে আম্মুকে নিয়ে ফিরে এসেছি। এখন কোনোমতে ড্রেসিং করিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আম্মু অসুস্থ হয়ে পড়ছে চিন্তায় চিন্তায়। আমি নিজেকে এতোক্ষণ যাবত শক্ত রাখলেও এখন আর পারছি না সাদমান।

—-মিশরাত কী হয়েছে সেটা বলবে তো? এতো রাতে তোমাদের বাইরে বের হওয়ার কী প্রয়োজন পড়লো? কিছু লাগলে আমি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারতে। আমি নিয়ে আসতাম।

—-কোনো জিনিস লাগবে না সাদমান। মানুষ লাগবে। ইশুকে লাগবে সাদমান।

থমকে গেল সাদমান। পরবর্তীতে ঠিক কী বলা উচিত সে বুঝতে পারছে না।

—-হ্যালো সাদমান, শুনেছো আমার কথা?

—-কীহ্! মিশরাত, আমি বোধহয় বৃষ্টির কারণে ঠিকমতো কথাটা বুঝতে পারিনি। কী লাগবে?

—-আমার বোন কে লাগবে সাদমান। ইশু সেই বিকেলে তার বান্ধবীর বাসায় গিয়েছে। এখনো ফেরার নাম নেই। আ…আমার বোনটার সাথে উল্টোপাল্টা কিছু হয়নি তো সাদমান?

ফোন হাতে রেখেই অবিশ্বাস্য চোখে দু’কদম পিছিয়ে গেল সাদমান। অপর প্রান্ত থেকে মিশরাত বারেবারে তাকে ডেকে চলেছে।

—-সাদমান, হ্যালো? শুনতে পাচ্ছো আমার কথা? কিছু বলছো না কেন? হ্যালো সাদমান?

এতোক্ষণ যাবত কী কী কথা হয়েছে, তা সবটুকু শুনেছে আরিয়ান। সাদমানের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সে। যে ছেলেটা এতোক্ষণ তার সাথে এভাবে কথার পিঠে কথা বলে যাচ্ছিলো, এখন তার হাত কাঁপছে! সাদমানের কাঁপা হাত থেকে দ্রুত ফোন নিয়ে নিজের কানে লাগালো আরিয়ান।

—-হ্যালো মিশু?

—-কে!

—-মিশু, আমি আরিয়ান।

—-আপনি? আপনি সাদমানের সাথে কী করছেন? তার ফোন আপনার কাছে কেন যাবে?

—-মিশু, এখন এসব বলার সময় না। বিপদের সময় পুরাতন কথা ঘাটতে নেই। আমাকে একটু বলো যে ইশরাত কোথায় গিয়েছিলো। কোন বান্ধবীর বাসা? বাসা কোথায় বা বাসায় যাওয়ার রাস্তাই বা কোনটা?

—-আপনার কিচ্ছু জানতে হবে না। শুনেছেন আপনি? আপনার সাহায্যের কোনো দরকার নেই আমাদের। দয়া করে আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাতে আসবেন না।

—-আমার কথা আমাকেই ফেরত দিচ্ছো। সমস্যা নেই। যা ইচ্ছে বোলো। তবে এখন বোকা রাগ দেখিও না মিশু। এখন ইশরাতকে খোঁজা প্রয়োজন। আবেগী না হয়ে বাস্তবটা চিন্তা করো। নিজের বোনের জন্য হলেও?

—-

—-মিশু, প্লিজ চুপ থেকো না। বলো আমাকে?

(৩৫)

প্রায় পঁচিশ মিনিট যাবত কামরুলের উপর প্রহার চলছে। তাকে এলোপাতাড়ি মারছে সাদমান।

খানিকটা সময় আগের কথা। দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে কামরুলের বাবা দরজা খুলে দেন। কে এসেছে সেটা দেখার আগেই উনাকে পাশ কাটিয়ে মানুষটা ভেতরে চলে যায়। এরপরই নিজের ছেলের গলার আওয়াজ শুনতে পান তিনি। মূলত ছেলের চিৎকারের আওয়াজ। দৌড়ে গিয়ে সেখানে তিনি দেখেন উনার ছেলেকে এইমাত্র বাসায় আসা ছেলেটা বেদম প্রহার করছে। তার সাথে সাথে একটা কথাই শুধু মুখ দিয়ে বের হচ্ছে

—-ইশরাত কোথায়? ইশরাতকে কোথায় আঁটকে রেখেছিস? বল?

বেচারা কামরুলের অবস্থা খুব খারাপ। যতোই আকুতি মিনতি করছে ছেড়ে দেওয়ার ততোই যেন সাদমানের প্রহার করার মাত্রা বেড়ে চলেছে।

—-একী! কে তুমি হ্যাঁ? আমার ছেলেকে মারছো কেন?

—-আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করুন ইশরাত কোথায়। চুপচাপ সব সত্যি স্বীকার করতে বলুন। নয়তো কিছুক্ষণ পর ছেলের জানাজা পড়া লাগবে!

কামরুলের আব্বুর সাদমানের কথা শুনে যেন এখনই জান বেরিয়ে যায় অবস্থা।

—-ই…ইশরাত কে? আমার ছেলের সাথে তার কী সম্পর্ক বাবা? আমি তো কিছু জানি না।

—-এখন আপনাকে বলার সময়টুকুও আমার নেই। নিজের ছেলের জীবনের মায়া যদি থাকে, তাহলে আমাকে সত্যি টা বলতে বলুন তাকে।

—-ভাই, আমারে আর মাইরেন না ভাই। সত্যি বলছি, আমি ইশরাতের কোনো খবর জানি না। আমি তো তার সাথে কয়েকদিন ধরে কথাবার্তাই বলি না এখন। ট্যুরে যাওয়ার কয়েকদিন আগে শুরু করেছিলাম একটু সাহস করে কথা বলা।

কথা শেষ করতে না করতেই কামরুলের পিঠে আরেকটা লাথি দিলো সাদমান।

—- ও মা! ভাই মাইরেন না! আমার কথাটা শোনেন? আমি তার সাথে যোগাযোগ করা আবার বন্ধ করে দিয়েছি। আপনার হুমকি পাওয়ার পরে আর তার সাথে কথা বলার সাহস আমার হয় নাই। আর তাকে কিডন্যাপ করার মতো দুঃসাহস দেখাবো? এতো বড় কলিজা আমার হয় নাই এখনো ভাই। কসম ভাই, আমি জানি না সে কোথায়।

সাদমান পুনরায় কামরুলকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগে তার ফোন বেজে উঠলো। মিশরাত ফোন দিয়েছে

—-হ্যালো মিশরাত, তুমি চিন্তা করো না। আমি যেভাবে হোক, যেখান থেকে হোক, ইশরাতকে নিয়ে আসবোই। তাকে ছাড়া বাসায় ফিরছি না আমি। তুমি প্লিজ চিন্তা করো না, আন্টিকে একটু শান্ত হয়ে থাকতে বলো।

—-সাদমান, আমার কথাটা তো শুনবে একবার? ইশুকে পাওয়া গিয়েছে সাদমান।

—-হ্যাঁ? সত্যি বলছো? কোথায় ছিলো সে? কেমন আছে এখন? কোনো সমস্যা হয়নি তো?

—-সে শারীরিকভাবে অক্ষত এবং নিরাপদ আছে। তবে আজকে যেই কান্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছে, শুধু একবার আসুক বাসায়। আজকে তার একদিন তো আমার যতোদিন লাগে! আম্মুও রীতিমতো লাঠিপেটা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

—-মানে? কোথায় সে এখন?

—-তার বান্ধবীর বাসায়। আরিয়ান হক সেখানে গিয়েছে। ইশু সেখানেই আছে। আমাকে ফোন দিয়েছে আরিয়ান। বললো ইশু নাকী তার সাথে আসতে রাজি হচ্ছে না। তাই তোমাকে ফোন দিলাম। তুমি এখন কোথায়?

কামরুলের দিকে নিচে তাকিয়ে দেখলো সাদমান। বেচারা এখনো সাদমানের পায়ের নিয়ে। তার বুকের উপর পা দিয়ে এখনো চেপে ধরে রেখেছে সাদমান। কাতর চোখে সাদমানের দিকে তাকিয়ে আছে একটু ছাড়া পাওয়ার আশায়। পা সরিয়ে নিলো সাদমান। ধুর! এতোক্ষণ যাবত শুধুশুধু একটা নিরপরাধ ছেলেকে কী মারা টাই না মারলো সে!

কামরুলের বাবার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো সে। একটু আগে এই মানুষটা কেই বলছিলো নিজের ছেলের জানাজা পড়তে হতে পারে! ধুর! এভাবে বলা ঠিক হয়নি। এতোটা উত্তেজিত হওয়া ঠিক হয়নি। কিন্তু সে করবেই বা কী! শত হলেও ব্যাপারটা ইশরাতকে নিয়ে ছিলো!

—-ক্ষমা করবেন আংকেল। ভুল হয়ে গিয়েছে।

কামরুলকে নিচে থেকে তুলে বিছানায় বসিয়ে আবারও গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল সাদমান। মিশরাত ফোনে মেসেজ করে দিয়েছে ইশরাতের বান্ধবীর বাসার ঠিকানা।

(৩৬)

—-ইশরাত, আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবো নিরাপদে। তোমার আম্মু আর আপু খুবই উতলা হয়ে আছে তোমাকে দেখার জন্য।

—-আপনাকে কী বলেছি তা শুনতে পান না? আমি যাবো না আপনার সাথে কোথাও। আপনার সাহায্য নেওয়া থেকে সারা রাত আমার বান্ধবীর বাসায় থেকে যাওয়াটা হাজার গুণে ভালো। এখানে আমি নিরাপদে থাকবো অন্তত।

—-আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি চাই না ইশরাত। নিরাপত্তার কথা কেন তুলছো?

—-যার কারণে আমার বোন কষ্ট পায়, তার থেকে বড় দুশমন আমার জীবনে দু’টো নেই। আপনাকে আমি দু’চোখে দেখতে পারি না জানেন আপনি? বেরিয়ে যান এখান থেকে।

ইশরাতের বান্ধবী সমেত তার বাসার লোকজনের সামনে ইশরাতের কাছ থেকে অপমানিত হচ্ছে আরিয়ান। কষ্ট পেলেও এই অপমান সহ্য করা ছাড়া আর কিছু করার নেই আরিয়ানের। মিশরাতকে পাওয়ার জন্য তার যতো অপমান সহ্য করতে হোক না কেন, সে করবে। একটু আগে যখন ইশরাতের খবরটা মিশরাতকে সে ফোনে জানিয়ে ছিলো, তখন মিশরাতের কন্ঠে খুশির কম্পন সে শুনেছে। এই ছোট্ট ব্যাপারটা তার জীবনে এখন অনেক বড় কিছু। মিশরাতের মুখে এতোটুকু হাসির বিনিময়ে সে তার জীবন দিয়ে দিতেও প্রস্তুত!

শোনা গেল গাড়ির আওয়াজ। চোখে পড়লো সাদমানের গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমেই এক দৌড়ে ইশরাতের বান্ধবীর বাসায় চলে আসলো সাদমান। ইশরাত লক্ষ্য করে দেখলো, সাদমানের এখন বেহাল দশা! বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছে। পুরো শরীর বেয়ে পানির ফোঁটা পড়ছে মেঝেতে। শার্টের টাই আলগা করা, কলার এলোমেলো। চুলগুলো সামনে এসে পড়ে আছে। পুরো চেহারায় ভীতির ভাব স্পষ্ট। ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে ইশরাতের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সাদমান। কাঁপা কাঁপা হাত দুটো দিয়ে ইশরাতের মুখমন্ডল স্পর্শ করলো। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলো। ইশরাতের সাদমানের দিকে তাকিয়ে এখন একটা বিষয়ে বেশ খটকা লাগছে। তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে মনে হচ্ছে? এটা কী বৃষ্টির পানি? নাকী…

ইশরাত আর কিছু ভাববার অবকাশ পেল না। রুমে উপস্থিত সবার দিকে একবার তাকিয়ে ইশরাতের হাত ধরে হাঁটা দিলো সাদমান। সোজা গিয়ে গাড়িতে নিয়ে বসালো ইশরাতকে। নিজেও বসলো। ইশরাত চলে যাওয়ায় আরিয়ানও নিজের গাড়িতে উঠে চলে গেল। এতোক্ষণ শুধু ইশরাতের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলো।

গাড়িতে উঠে বসার পরপর তার কয়েকটা দৃশ্য বারবার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। ইশরাতের খবর শুনে সাদমানের এরকম অদ্ভুত ব্যবহার করছিলো কেন? তার হাত কাঁপছিলো কেন? এখনও বা এখানে এসে ইশরাতকে এভাবে স্পর্শ করছিলো কেন? মিশরাতের সাথে যদি সাদমানের সম্পর্ক থাকে, তাহলে ইশরাতের প্রতি তার এতোটা কেয়ার কেন? তবে কী কোথাও একটা ভুল হচ্ছে? ফোন বেজে উঠলো আরিয়ানের।

—-আরাভ, আমি খুব কনফিউশনে পড়ে যাচ্ছি রে। মিশরাতের সাথে যদি সাদমানের…

—-মিশরাত, মিশরাত, মিশরাত। আর কতো আরিয়ান? আর কতো? মিশরাত ছাড়া আর কারোর অস্তিত্ব তোর জীবনে নেই? নিজের পরিবার বলতে, মা-বাবা বলতে কেউ নেই? জানিস না আন্টি অসুস্থ?

—-আম্মু! আম্মুর কী হয়েছে?

—-জেনে কী করবি? তুই শুধু মিশরাতের পেছনেই ঘুরতে থাক। আর তো তোর কোনো কাজ নেই জীবনে, তাই না?

—-এভাবে বলিস না আরাভ প্লিজ। আম্মুর কী হয়েছে? শরীর খারাপ করেছে আবার? নুজহাত তো এখন সেখানেই আছে। আমি তো তাকে আম্মুর দায়িত্ব দিয়ে এসেছিলাম।

—-নুজহাতের দেখাশোনা কী তোর জন্য আন্টির চিন্তাকে কমিয়ে দিতে পারবে? কখন থেকে তোকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি আমি আর তোর ফোন ধরার নামই নেই! আন্টি বারেবারে আমাকে ফোন করছে। কান্না করছে মানুষটা, তার ছেলেটা কোথায়, কী অবস্থায় আছে তা জানার জন্য। এই বজ্রপাতে কতো মানুষ মরে জানিস? আর তুই আছিস এই অবস্থায় গাড়ি নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেরিয়ে মিশরাত মিশরাত নাম জপা নিয়ে ব্যস্ত? পাগলামিরও একটা লিমিট থাকা উচিত আরিয়ান। কোন আরিয়ানকে আমি দেখছি এটা হ্যাঁ? যার কোনো সেল্ফ রেসপেক্ট নেই? এই আরিয়ান কতো শত ছেলেদের একটা সময় আইডল ছিলো! আর আজকে তার এমন বেহাল দশা? জায়গায় জায়গায় অপমানিত হয়ে আসিস? লজ্জা লাগে না তোর?

—-মিশুকে একটাবার আমার জীবনে ফিরিয়ে এনে দে! বিশ্বাস কর, একেবারে আগের মতো হয়ে যাবো। প্রমিস!

রাগে ফোন কেটে দিলো আরাভ। খুব তাড়াতাড়ি তার কিছু একটা করা প্রয়োজন। মিশরাতের সাথে প্রয়োজন হলে নিজের কথা বলতে হবে। আরিয়ানকে নিয়ে এখন চিন্তার মাত্রা বেড়েই চলেছে তার মনে৷ এভাবে পাগলামো করতে থাকে, ছেলেটা একসময় না একসময় কী ভুলভাল করে বসবে কে জানে!

এমনিতেই সাদমানের ব্যাপারটা খুব কষ্টে তাকে বুঝিয়েছে। নয়তো সাদমানের সাথেও হয়তো উল্টোপাল্টা কিছু করে বসতো।

(৩৭)

একটু পরপর সাদমানের দিকে তাকাচ্ছে ইশরাত। ছেলেটা একটা কথাও বলছে না। আজকে বাসায় গেলে তার কপালে যে শনি আছে, এটা সে নিজেও বুঝতে পারছে। ফোনে চার্জ ছিলো না তার। ফোন গিয়েছিলো বন্ধ হয়ে। ইলেক্ট্রিসিটি না থাকার দরুন চার্জে আর বসাতে পারেনি। তবুও কারোর ফোন থেকে কল অবশ্যই করতো। কিন্তু এই মিলি টা হলো সব সর্বনাশের মূল। আজকে তার ছোট ভাইয়ের জন্মদিন এটা কে জানতো! এখানে আসার পর থেকেই ইশরাত দেখেছিলো সবাই হাসিখুশিতে মত্ত। তাকেও সামিল করালো অনুষ্ঠানে। এই অনুষ্ঠানের পাল্লায় পড়েই তো কপাল পুড়লো। সময় কোনদিক দিয়ে বয়ে গেল সে নিজেও বলতে পারবে না। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর খাওয়া দাওয়া সেরে তার মনে পড়লো যে ফোন করে কিছু জানানো হয়নি তার আম্মু বা আপুকে। কেবল মিলির আব্বুকে মিশরাতের ফোন নাম্বার বলছিলো কথা বলার জন্য, তখনই আরিয়ান এসে হাজির।

বাসায় গিয়ে কী হবে সেটা পরের টা পরে দেখা যাবে না হয়। কিন্তু ইশরাত ভাবছে এখনকার কথা। ছোটখাটো বিষয়ে যেই ছেলেটা তার উপর এতো রাগ দেখায়, সে ছেলেটা আজ চুপচাপ কেন?

—-আপনি তো পুরোপুরি ভিজে আছেন। বাসায় গিয়ে গরম পানি দিয়ে গোসল সেরে নেবেন। এমনিতেই ভেজা শরীর, ভেজা চুলে এতোক্ষণ যাবত বসে আছেন, জ্বর না আসলেই চলে।

সাদমান এখনো চুপ

—-আপনার শরীর খারাপ লাগছে? কথা বলছেন না কেন আমার সাথে?

—-

—-শুনছেন? আপনি কিছু বল…

ইশরাত কথা শেষ করার আগেই গাড়ি থামিয়ে দিলো সাদমান। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে জড়িয়ে ধরলো ইশরাতকে। ইশরাতের মুখভঙ্গি এখন দেখার মতো! চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে তার। এতো বড় হা করে আছে যে মশা মাছি যা আছে সব দলবেঁধে তার মুখে অনায়াসে ঢুকে যেতে পারবে। সাদমান তো এটা? মা গো! রাত-বিরেতে সাদমানের ভূতের সাথে বাড়ি ফিরছে না তো আবার! ভেবেই শরীর কেঁপে উঠল ইশরাতের। তবে তার সেই কাঁপুনি সেকেন্ডের মধ্যে থেমে গেল ঠিক তখন, যখন বুঝতে পারলো তার কাঁধে তরল কিছু বেয়ে বেয়ে পড়ছে। সাদমান কী তবে কাঁদছে!

চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসী ছাড়া দয়া করে কেউ কপি করবেন না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here