#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-৯
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★অনেক ছোটাছুটি করে এখন একটু শান্ত হয়ে বসে সামনে ছাগল ছানার দূরন্তপনা দেখছে খুশি। তখনই পাশে এসে বসলো ফাহিম। মুচকি হেসে বললো।
–তো ভাবিজী, কি করছেন?
খুশিও মুচকি হেসে বললো।
–এইতো ক্যাটরিনার কাজকর্ম দেখছি।
ফাহিম ভ্রু কুঁচকে বললো।
–ক্যাটরিনা? কোথায়?
–আরে ওইযে, ওই ছানাটার নাম দিয়েছি ক্যাটরিনা। ভালো নাম না?
ফাহিম হেঁসে উঠে বললো।
–ভালো মানে, মারাত্মক ভালো হয়েছে। সত্যিই ভাবিজী ইউ আর গ্রেট। আচ্ছা আপনি কি ওদের সাথে কথাও বলেন?
–হ্যাঁ বলিতো। কখনো কখনো ওদের কথা ডাবিংও করে দেই।
–ও তাই। তাহলে বলুন তো এখন ওরা কি বলছে?
–বলতে পারি। তবে আপনাকেও আমার সাথে যোগ দিতে হবে। আমি ক্যাটরিনার ডাবিং করবো আর আপনি ক্যাটরিনার সামনের পশুটার ডাবিং করবেন ঠিক আছে?
–ওকে ভাবিজী। লেটস হ্যাভ সাম ফান।
ক্যাটরিনা নামের ছাগল ছানাটার সামনে কুকুর স্যামি এসে দাঁড়িয়েছে। ফাহিম স্যামির পক্ষ থেকে ডাবিং করে বললো।
♬ এহ,, কেয়া বলতি তু?
খুশি ক্যাটরিনার ডাবিং করে বললো।
♬ এহ,,কেয়া মে বলু?
♬ সুন (ফাহিম)
♬ সুনা (খুশি)
♬ আতি কেয়া খান্ডালা? (ফাহিম)
♬ কেয়া কারু আকে মে খান্ডালা? (খুশি)
♬ আরে ঘুমেঙ্গে,ফিরেঙ্গে,নাচেঙ্গে,গায়েঙ্গে
♬ এ্যাশ কারেঙ্গে অর কেয়া?
খুশি ক্যাটরিনার ডাবিং করে এটিটিউট নিয়ে বললো।
–এই স্যামি আমার সাথে একদম ফ্লার্ট করার চেষ্টা করবে না।আমাকে এসব আমির গান শুনিয়ে পটাতে পারবিনা। আমি আগে থেকেই অন্য এক খানের বাগদত্তা।
ফাহিম এবার স্যামির ডাবিং করে বললো।
–খান? কোন খান?
–সাবকি আন, সাবকি শান দ্যা ওয়ান ওনলি সালমান খান। আমি সালমান খানের বাগদত্তা বুজেছ?
–তো হাম ভি কিসি সালমান সে কাম হে কে? আরে কি আছে ওই সাল্লুর মাঝে?
–দেখ আমার উনাকে সম্মান দিয়ে কথা বলবে ঠিক আছে। আরে কোথায় সে আর কোথায় তুমি। উনার বডি দেখেছ? কি ফিট বডি উনার। এখন তো আমিও উনার মতো ফিট হওয়ার জন্য ডাইটিং করছি। আমি এখন শুধু দুই বেলা ঘাস খাই। আর ভাত ভুসি তো খাইই না।
–আরে কি সাল্লু সাল্লু লাগিয়ে রেখেছ?আমার মতো হ্যান্ডসাম, নওজোয়ান পাত্র রেখে তুমি ওই বুইড়ারে পছন্দ করলা? আরে বুইড়া হওয়ারও এক্সপায়ারি ডেট চলে গেছে ওর। আর তাছাড়া ওর ম্যানুফ্যাক্সারিং ইফেক্ট আছে।
–কি বলো সত্যিই?
–আবার জিগায়। আরে সেই জন্যই তো সে এখনো বিয়ে করে না। দেখ আমি আবার জনদরদী টাইপস। কাওকে সমস্যায় পড়া দেখলে তার হেল্প করি। আমার কাজ ছিলো তোমাকে সাবধান করা। এখন বাকিটা তুমি দেখ।পরে যেন আবার আপসোস করে চোখের জলে সমুদ্র বানিওনা।
–ধন্যবাদ স্যামি। তুমি সত্যিই আমার কতবড় উপকার করলে। আমিতো না জেনেশুনে অনেক বড় ভুল করতে যাচ্ছিলাম। থ্যাংক ইউ হ্যাঁ?
–আরে মেনশন নট। এটাতো আমার কর্তব্য। বাইদা মেঠোপথ ওসব বাইরের মাল ছাড়োনা। আমার মতো দেশি মালে নজর দাও। আমার মতো স্থায়ি টেকসই মাল হারিকেন লাগিয়ে খুঁজলেও পানে না।
–যাহ কিযে বলোনা।
–আঃ আঃ হাসিতো ফাঁসি। তাহলে এখন বলো,
♬ মুজসে শাদি কারোগি
♬ হো মুজসে শাদি কারোগি
♬ তুজসে শাদি কারুঙ্গি
♬ হা তুজসে শাদি কারুঙ্গি
ফাহিম হাসতে হাসতে খুশির হাতের সাথে হাইফাই দিয়ে বললো।
–ওয়াও ভাবিজী তুসি তো গ্রেট হো।সুপার সে উপার হো। আই মিন লাইক ছাগলেরও লাভ স্টোরিও সেট করে দিলে। সত্যিই ইউ আর জিনিয়াস।
খুশি গর্বে গদগদ হয়ে বললো।
–বাচ,কখনো অহংকার করিনি।
–তো মহান মানবী জী এই অধমের ওপরও একটু আপনার কৃপাদৃষ্টি করুন। এই প্রহরের সাথে থেকে থেকে আমি নিজেও সিঙ্গেল থেকে গেলাম। এখন আপনিই কোন চমৎকার করেন। সিঙ্গেল মরতে চাইনা ভাবিজী।
খুশি এক হাত উঠিয়ে ঋষি মুনিদের মতে করে বললো।
–চিন্তা করোনা বৎস। এই মহান দয়াময় মাতা খুশি সবার কল্যাণে নিয়জিত। তোমারও একটা গতি করে দেবে সে। সো জাস্ট চিল বৎস।
খুশির কথা বলার ভঙ্গি দেখে ফাহিম হেঁসে দিল। খুশিও খিলখিল করে হাসতে শুরু করলো।
প্রহর কফি হাতে বাইরে এসে দেখলো খুশি আর ফাহিম আড্ডা জমিয়ে বসে আছে। দুজনে হাসির ঝর্ণা বইয়ে দিচ্ছে। প্রহরের ভ্রু কুঁচকে এলো। ব্যাপার টা ওর কেমন যেন লাগছে। এ্যাক্সুয়ালি কেমন লাগছে সেটা ওর নিজেরও বোধগম্য হচ্ছে না। প্রহর গলা খাঁকারি দিয়ে ফাহিমকে ডাক দিয়ে বললো।
–ফাহিম তোর জন্য কফি এনেছি।
ফাহিম বলে উঠলো।
–আমি এখন কফি খাবোনা। তুই খা।
কথাটা বলে ফাহিম আবারও খুশির সাথে আড্ডা দিতে লাগলো। ওদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে। প্রহর যেন এখানে আনওয়ান্টেড পারসন হিসেবে চলে এসেছে। ব্যাপার টা কেন যেন গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না প্রহরের কাছে।
প্রহর ওদের থেকে কিছুটা দূরে পেছনে পুল সাইডে রাখা একটা গোল টেবিলের চেয়ারে বসলো। কফি খেতে খেতে আরচোখে ওদের দেখছে। দুজন কথার ফুলঝুরি জ্বালিয়ে নিয়েছে।হাসিতো যেন থামছেই না। আবার হাসতে হাসতে দুজন হাত মিলিয়ে হাই ফাই দিচ্ছে। কি এতো কথা বলছে শুনি? রোজ তো আমার পেছনে ঘুরঘুর করে। আর আজ যেন আমাকে চোখেই পড়ছে না তার। যেন আমি এখানে ইনভিজিবাল। ফাহিমের সাথে খুব ভাব জমেছে তার। প্রহরের হাত পায়ের ভেতর কেমন শিনশিন করছে। কেমন একটা অধীরতা কাজ করছে। তখনকার ফাহিমের বলা কথাটা মনে পড়ছে ওর। কোথাও যেন জ্বলন অনুভব করছে ও। দ্রুত ক্রমে পা উপর নিচে নাচাচ্ছে শুধু। হঠাৎ করেই কেন যেন রাগ লাগতে শুরু হলো ওর। স্বাদহীন ব্লাক কফিটা আজ যেন আরও বেশি তিক্ত লাগছে। কি হচ্ছে এসব আমার সাথে? ওই মেয়ে যা খুশি তাই করুক তাতে আমার কি? ওই মেয়ে আমার থেকে যত দূরে থাকে ততই তো ভালো। তাহলে আমার এমন লাগছে কেন? এমন ইরিটেশন হচ্ছে কেন? বাই এনি চান্স আমি কি জেলাস হচ্ছি? লাইক রিয়েলি? আমি আর জেলাস? তাও আবার আমারই বন্ধুর ওপর? প্রহর তোর মাথাটা সত্যিই গেছে। এই মেয়েটা সত্যিই তোর মাথা নষ্ট করে দিয়েছে। ইউ হ্যাভ টু রিফ্রেশ ইউরসেল্ফ। ওই পুঁচকে মেয়েটার কাছে আমি হেরে যেতে পারি না। নো চান্স।
প্রহর নিজের ওপরই বিরক্ত হয়ে ওখান থেকে উঠে গেল।
ফার্মের সব কাজ শেষে প্রহর বাসার ভেতর এসেছে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। উপরে এসে নিজের রুমের দরজা খুলে সামনে তাকাতেই থমকে গেল প্রহর। রুমের ভেতর খুশি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে তার ভেজা চুল ঝাড়ছে।তার পড়নে প্রহরের একটা সাদা শার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। যা খুশির জন্য ফুল প্যান্ট বলা যায়। খুশির শরীরে নিজের জামাকাপড় দেখে রাগ হওয়ার কথা হলেও কেন যেন রাগ হচ্ছে না। বরং উল্টো খুশিকে এইভাবে দেখে কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছে ওর।আশেপাশের সবকিছুর থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে ওর। সদ্য শাওয়ার নেওয়া খুশির স্নিগ্ধতা যেন প্রহরকে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় মোহিত করে দিচ্ছে। বুকের বাম পাশে জঙধরা কোন কিছু যেন জেগে উঠে নতুন উদ্যমে চলা শুরু করছে।
আয়নায় প্রহরকে দেখে পেছনে ফিরে তাকালো খুশি। প্রহরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–আরে তুমি, ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? চুপিচুপি চেক আউট হচ্ছিল বুঝি হ্যাঁ? আমাকে অনেক হট লাগছে বুঝি? আরে দেখতে চাইলে সরাসরি দেখনা। আমি তো তোমারই।
কথাটা বলেই খুশি দুষ্টু হেসে চোখ মেরে দিল।
প্রহর অপ্রস্তুত হয়ে বললো।
–শ শাট আপ ইডিয়ট। তুমি আমার রুমে কি করছ? আর আমার জামাকাপড় পড়েছ কেন?
–আরে এখানে আমার তোমার আবার কি? সবইতো আমাদেরই তাইনা? আসলে আমার জামাকাপড় সব কাঁদা ময়লা লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই গোসল করে সেগুলো পরিস্কার করে ড্রাই মেশিনে শুকাতে দিয়েছি। আর আমার পড়ার কিছু ছিলনা তাই তোমার জামাকাপড় পড়ে নিয়েছি। আমার জামাকাপড় শুঁকিয়ে গেলে চেঞ্জ করে নিবো।
প্রহরের কেমন গলা শুঁকিয়ে আসছে। আর বেশিক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ওর সর্বনাশ অবধারিত। তাই সে ওখান থেকে চলে যেতে উদ্যোত হলো। উল্টো ঘুরে এক কদম বাড়াতেই হঠাৎ কিছু একটা ভেবে প্রহর আবারও খুশির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
–শোন, যতক্ষণ তোমার কাপড়চোপড় না শুকায়। ততক্ষণ নিচে যাওয়ার দরকার নেই। এখানেই থাক। চেঞ্জ করে তারপরেই বের হবে বুজেছ?
খুশি মাথা ঝাকালো। মানে সে বুঝেছে। প্রহর আর এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে চলে এলো ওখান থেকে। ওর সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। যেন ধীরে ধীরে সব ওর আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। খুশির মায়াজাল ওকে গ্রাস করার চেষ্টা করছে। প্রহর নিচে এসে সুইমিং পুলে ঝাপ দিল। পানিতে ডুবে নিজের অবাধ্য অনিয়ন্ত্রিত মন মস্তিষ্ককে শান্ত করার চেষ্টা করছে। যদিও তা কতটা কার্যকরী হচ্ছে তা জানা নেই প্রহরের।
ত্রিশ মিনিট পর খুশি চেঞ্জ করে নিচে নেমে এলো। প্রহর আর ফাহিম সুইমিং পুলের পাশেই বসেছিল। খুশি ওদের কাছে এসে বললো।
–এখন যেতে হবে আমার। নাহলে বাসায় যেতে দেরি হয়ে যাবে। বাই।
কথাটা বলে খুশি যেতে নিলে প্রহর বললো।
–তুমি একাই যাবে?
–হ্যাঁ, তো দোকা কই পাবো? আসার সময় তো একাই এসেছি।
ফাহিম বলে উঠলো।
–আরে ভাবিজী আপনার দেবর থাকতে আপনি একা কেন যাবেন? চলুন আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসছি।
–আরে না না আমি একাই যেতে পারবো। আপনার কষ্ট করতে হবে না।
প্রহর দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–বেশি স্মার্টনেস দেখাতে হবে না তোমাকে। একা যাওয়ার কোন দরকার নেই। পরে কিছু হয়ে গেলে সেই দ্বায়ভার আমাকেই নিতে হবে।
প্রহর এবার ফাহিমের দিকে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–তোর এসব ঝামেলা নেওয়ার দরকার নেই। আমিই ওকে নামিয়ে দিয়ে আসছি।
ফাহিম বাঁকা হেসে বললো।
–ইয়েস বস। যাহা আপনি বলিবেন।
অতঃপর প্রহর খুশিকে নিয়ে গাড়িতে রওয়ানা হলো। খুশি গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে জানালার ওপর হাত রেখে, তাতে থুতনি ঠেকিয়ে বাইরের হাওয়া খাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে মুচকি হেসে মুহূর্ত টা উপভোগ করছে। বাতাসে চুলগুলো উড়ছে তার। গাড়ি চালানোর মাঝেই প্রহর আরচোখে তাকাচ্ছে খুশির দিকে। খুশির নিস্পাপ মায়াবী মুখের মায়া যেন ধীরে ধীরে প্রহরের সর্বত্র জুড়ে ছেয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন কালাযাদু করে বস করছে ওকে। এই প্রথম কারোর কাছে হেরে যাওয়ার ভয় হচ্ছে। এই নতুন আবহে ভেসে যাওয়ার ভয় তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তবে কি খুশি ওর এতবছরের গড়ে তোলা দেয়াল টা ভেঙে দিল? এখন কি করবে ও? কি করে এই অধই সমুদ্রে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচাবে নিজেকে?
প্রহরের ভাবনার মাঝেই ওরা খুশির বাসার সামনে চলে এলো। আজ কেন যেন প্রহরের মনে হচ্ছে রাস্তাটা অনেক তাড়াতাড়িই শেষ হয়ে গেল। খুশি নামার আগে সেদিনের মতো আবারও বলে উঠলো।
–প্রহর ওই দেখ ওটা কি?
প্রহর ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠলো।
–তোমার কি আমাকে এতটাই বোকা মনে হয়? একই ট্রিকস কতবার এপ্লাই করতে চাও?
খুশি ইনোসেন্ট ভাব ধরে বললো।
–আমি আর ট্রিকস? হায় এতবড় মিথ্যে অপবাদ জাতি সইবে না। আমার মতো মাছুম, ইনোসেন্ট, কুচ্চু, পুচ্চু, বাচ্চার নামে এমন অপবাদ শোনার আগে আমি কানে হেডফোন কেন লাগিয়ে নিলাম না? কেহ দো কি ইয়ে ঝুট হে।
–হয়েছে তোমার ড্রামা? ইউ ক্যান গো নাউ।
খুশি একটা ভেংচি কেটে গাড়ির দরজা খুলে এক পা বেড় করলো। প্রহর সামনে তাকাতেই খুশি ফট করে ঘুরে এসে চুমু দিয়ে দিল। কার্য সিদ্ধি করে বেড়িয়ে যেতে যেতে বললো।
–“জো মে বলতাহু, ও মে কারতাহু। জো মে নেহি বোলতা ও তো মে ডেফিনেটলি কারতাহু।”
তারপর হাসতে হাসতে দৌড়ে চলে গেল।
প্রহর কিছুক্ষণ মূর্তির মতো তাকিয়ে রইলো। তারপর সিটের সাথে মাথা এলিয়ে হঠাৎই নিচের ঠোঁট কামড়ে হেঁসে উঠলো। বুকের যন্ত্র টার গতি অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেল। প্রহর বুকের বাম পাশে হাত রেখে বিড়বিড় করে বললো।
–শান্ত হ ভাই। এখন কি লাফিয়ে বাইরে চলে আসবি নাকি?
নিজেকে একটু সামলে নিয়ে প্রহর আবারও ব্যাক করলো। সে আবার ফার্মহাউসেই ফিরে এলো। ফিরে আসার কিছু সময় পর ফাহিমও চলে গেল। প্রহর পুল সাইডে বসে শূন্য চোখে পুলের পানির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের সামনে ভাসছে শুধুই খুশির সেই প্রাণবন্ত মুখখানা। আর মাথায় চলছে আকাশ পাতাল ভাবনার বেড়াজাল। ভাবনায় ছেদ পড়লো রোজিনা বেগমের আগমনে। রোজিনা বেগম প্রহরের জন্য কফ নিয়ে এসেছে। গরম কফির মগটা প্রহরের দিকে এগিয়ে দিলো। প্রহর কফির মগটা হাতে নিল। তখনই ওর নজর পড়লো রোজিনা বেগমের হাতের দিকে। রোজিনার বেগমের হাতে একটা ব্রেসলেট দেখতে পেল প্রহর। যেটা সে বোধহয় খুশির হাতে দেখেছিল। প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–চাচী কিছু মনে করবেন না কিন্তু এটাতো বোধহয় খুশির তাইনা?
রোজিনা বেগম হাসিমুখে বললো।
–যে প্রহর বাবা, এইডা খুশি ম্যাডামের। আমারে দিয়া দিছে। মাইয়াডা খুবই ভালো। আমি খালি কইছিলাম আপনের হাতের এইডা মেলা সুন্দর। আমার মাইয়ারেও একটা কিনা দিমু। কত দাম এইডার? হেই কথা হুইনা সে সাথে সাথে আমারে এইডা খুইলা দিয়া দিলো। কইলো তোমার মেয়েরে দিয়ে দিও। এটা আমার পক্ষ থেকে গিফট। আমি কতো মানা করলাম হুনলোই না। হাচা কইতাছি এমন সাফ মনের মাইয়া পাওন যায়না। আজকাল কার জামানায় যেইহানে ধনী লোকেরা গরীব গো ঘেন্নার চোখে দেখে। সেইহানে এই মাইয়াডা কি সুন্দর একদিনেই এক্কেরে আপন কইরা লইছে আমগো।সারাদিন আমগো লগে কত্তো মিইল্যা মিশা কাটাইলো। যেন আমরা হের আপন লোক। মাইয়াডার সাথে সময় কাটাইয়া আমগোও অনেক ভালো লাগছে। আপনে কিছু মনে না করলে একখান কথা কইতাম।
–বলুন না চাচী। জিজ্ঞেস করার কি আছে?
–প্রহর বাবা, মাইয়াডা হাচাই আপনেরে অনেক ভালোবাসে। আমি মাইয়াডার চোখে সেইডা দেখছি। আপনে ভাইবা দেখেন একটু। ছোট মুখে একখান কথা কই আপনেরে। মাইনষের জীবনে সত্য ভালোবাসা পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। তয় সবচেয়ে দূর্ভাগা ওই মানুষ, যে সেটা সময় থাকতে চিনবার পারেনা। মেলা কথা কইলাম ভুল হইলে মাফ করবেন।
কথাগুলো বলে রোজিনা বেগম চলে গেল।
আর পেছনে প্রহরের ভাবনা যেন আরও পাহাড় সমান রুপ ধারণ করলো। এলোমেলো সবকিছু যেন আরও ছন্নছাড়া হয়ে গেল।খুশি যে একটা সরল মনের মেয়ে এই ব্যাপার টা ও নিজেও বুঝতে পারছে। এই প্রথম কারোর ওপর বিশ্বাস করতে মন চাচ্ছে ওর। তবে খুশি কি পারবে ওর বিশ্বাসের মান রাখতে?
__
খুশি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন ঘাঁটছে। তখনই দরজায় টোকা পড়লো। খুশি সেদিকে তাকিয়ে দেখলো ওর ফুপি বেলি এসেছে। খুশি আনন্দচিত্তে উঠে দাঁড়িয়ে বললো।
–ফুপি……
দৌড়ে গিয়ে বেলিকে জড়িয়ে ধরে বললো।
–ওয়াও ফুপি তুমি এসেছ। জানো কতো মিস করেছি তোমাকে? মিস করতে করতে আমি নিজেই মিসিং জাচ্ছিলাম।
বেলি ভেতরে এসে বেডের ওপর বসে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ কতো মিস করেছিস তা জানা আছে। এইজন্যই তো একটা ফোনও করিসনি। এখন নওটাঙ্কি করে লাভ নেই। চকলেট একটাও পাবি না। যা সর।
খুশি তার ওভার অল মেলোড্রামা চালু করে দিলো। কপালে হাত ঠেকিয়ে দুখিয়ারি ভাব ধরে বললো।
–নেহি নেহি,, এই অবলা নারীর সাথে এতো অবিচার কইরেন না। ♬ কইরেন না কইরেন না ফুপিজান গো, ও ফুপিজান কইরেন না এমন গোওওও… আমার ফুপিইই.. ফুপিজান গোওওও…
বেলি হেঁসে দিয়ে বললো।
–হইছে হইছে আর ড্রামা করতে হবে না। তুই পারিসও বটে।
খুশিও হেঁসে দিয়ে বেলির কাঁধ জড়িয়ে ধরে দুষ্টুমি করে বললো।
–তো টুরে কেমন মজা করলে? ওখানে কোন ফুপার টুপার সন্ধান পেলে নাকি?
বেলি খুশির মাথায় আলতো করে চাপড় মেরে বললো।
–বদমাশ মেয়ে। মুখে কিছুই আটকায় না তাইনা? আমি একজন টিচার।আমি ওখানে স্কুলের স্টুডেন্ট দের নিয়ে টুরে গিয়েছিলাম। তোর ফুপা খুঁজতে নয়।
–হ্যাঁ তো কি হয়েছে? টিচার হয়ে কি প্রেম করা যায় না নাকি? কিন্তু তুমি তা করবে কেন? তুমি তো তোমার না হওয়া বয়ফ্রেন্ডের শোকে সারাজীবন কাটিয়ে দিবে। ফুপি এতো বছর হয়ে গেছে তবুও তুমি তোমার অতীত ভুলতে পারলে না? যে ব্যাক্তি তোমাকে হয়তো মনেও রাখেনি তার জন্য তুমি তোমার জীবন কেন নষ্ট করছো?
বেলি শান্ত সুরে বললো।
–এতে তার কি দোষ আছে? সেতো আর জানতো না আমি তাকে ভালোবাসি। সেতো শুধু আমাকে তার বন্ধু ভাবতো। দোষ তো আমারই। আমিই বলতে দেরি করে ফেলেছি। ততদিনে সে অন্য কাওকে মন দিয়ে দিয়েছে। আর দুটো ভালোবাসার মানুষের মাঝে আসার আমি কে?
খুশি ক্ষোভ নিয়ে বললো।
–কে মানে? অ্যাম শিওর ওই লোকটাকে তোমার চেয়ে বেশি ভালো আর কেউই বাসতে পারবেনা। আরে তুমি এতো সহজে কেন হার মেনে নিলে? একবার বলেতো দেখতে? আমি হলে কখনোই এতো সহজে হার মানতাম না। অন্তত মনের কথা টা তো বলতাম। তারপর সে ডিসাইড করতো সে কাকে চায়।
–এতো সহজ না। ভালোবাসার মানুষকে পাওয়াটা বড় কথা না। তার খুশিটাই বড়। সে যাতে খুশি থাকে সেটাই মেনে নেওয়া ভালো।
–বুঝলাম। কিন্তু তুমি তো তাকে ভুলে জীবনে সামনে এগুতে পারছোনা। তাকে ভুলে গিয়ে অন্য কাওকে বিয়ে কেন করে নিচ্ছো না? ভুলে যাও ওই স্বার্থপর লোককে।
–এটা যে সম্ভব নারে। তাকে পাই বা না পাই। কিন্তু মনটা তো তার নামেই লেখা।এখন অন্য কাওকে যে আর ভালোবাসতে পারবোনা। এমনিতেও বুড়িই হয়ে গেছি। বাকি জীবনও তার স্মৃতি আকড়ে ধরে খুশি খুশি কাটিয়ে দিবো। এটাতেও এক অন্য রকম আনন্দ আছে। তুই এখন এসব বুঝবি না। যখন কাওকে মনে প্রাণে ভালোবাসবি তখন বুঝবি।
বেলির কথায় খুশির বুকের ভেতর ধুক করে উঠলো। সেও যে এখন কাওকে ভালোবাসে। মনে প্রাণে ভালোবাসে। ওর ভালোবাসার পরিণতিও যদি ফুপির মতো হয় তাহলে কি করবে ও? প্রহর যদি কখনো ওকে ভালো না বাসে তাহলে? ও কি পারবে প্রহরকে ছাড়া বাঁচতে? ফুপির মতো ওযে এতো শক্ত না। ও হয়তো মরেই যাবে। প্রহর বিনা এই জীবনের কল্পনা করাও যেন ওর জন্য অসম্ভব। কি হবে ওর ভালোবাসার পরিণতি?
#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-১০
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
★অতিবাহিত দিনের সাথে যোগ হয়েছে আরও একটি সপ্তাহ। ফাল্গুন মাস পেরিয়ে চৈত্রতে পদার্পণ করেছে। শীতের আবহাওয়া অনেক টা কমতে শুরু করেছে। বাতাসের আনাগোনায় হালকা গরমের আভাস বিদ্যমান। কখনো প্রখর রোদের তপ্ততা, তো কখনো আবার শীতল বাতাসের আচ্ছন্নতা।
সময় যেমনই হোক, প্রহরের জীবনে যেন আষাঢ়ের ঘনঘটা বইছে। নব ভাবপ্রবনের ঝুম বর্ষার আর্দ্রতা ভাসাচ্ছে তাকে। শত প্রচেষ্টা করেও নিজেকে এই বর্ষনে ভেজা থেকে আটকাতে পারেনি। সব সংকল্পই ওর ব্যার্থ হয়েছে। বারবারই চরম ভাবে পরাজিত হতে হয়েছে ওকে। তবুও জীবনের এই নির্মম পরাজয়ে কেন যেন কোন খেদ নেই। নেই কোন গ্লানি। বরং এই পরাজয়েই মাঝেই যেন অসীম এক জয় লুকিয়ে আছে। এই পরাজয়েই আছে অপরিসীম সুখআনন্দের পূর্বাভাস। তাইতো নিজেকে আর আটকাতে চায় না সে। ভাসাতে চায় এই নব আবেগের জোয়ারে। এই প্রথম আর ভয় হচ্ছে না ওর।
খুশি নামের বর্ষা ওকে ভিজিয়ে দিয়েছে। সে চেয়েও পারেনি নিজেকে বাঁচাতে। এই কয়দিনে খুশি ওর চারপাশের দেয়াল ভেঙে ওর মন পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়ে গেছে।খুশি জিতে গেছে তার চ্যালেঞ্জ। সে যে এখন শরীর ভেদ করে হৃদপিণ্ডে হামলা করেছে।ধীরে ধীরে হৃদপিণ্ডের জমিন দখল করে নিয়েছে। মন মস্তিষ্কেও তার বিচরণ চলছে। সে যেন আমার মাঝে আমিটাকেই সরিয়ে দিয়ে সর্বত্র নিজের রাজত্ব বিরাজ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তার এই ষড়যন্ত্র যে সফল হওয়ার পথে, সেটারও আভাস পাচ্ছে প্রহর। জানা নেই শেষ পর্যন্ত ওর মাঝে ওর নিজের বলতে কিছু থাকবে কিনা। মেয়েটা যে ওকে নিঃস্ব করার ধান্দায় আছে।
ভার্সিটিতে নবীন বরণ উৎসব আজ। ভার্সিটি, কলেজের সব স্টুডেন্ট একসাথেই অংশগ্রহণ করছে। সেই উপলক্ষে জমজমাট আয়োজন করা হয়েছে। পুরো ক্যাম্পাস নতুন বধুর সাজে সজ্জিত করা হয়েছে। রঙ বেরঙের কাপড়চোপড় আর সাজসজ্জায় আবৃত স্টুডেন্ট দের পদচারণায় মুখরিত পরিবেশ। ক্যাম্পাসের মাঠে বড়ো করে স্টেজ করা হয়েছে। সেখানে স্টুডেন্ট রা নিজেদের ইচ্ছেমতো নানান রকমের পারফরম্যান্স দিচ্ছে। নাচ গান সহ আরও অনেক রকম প্রতিভা প্রদর্শন করছে।
তবে সেসবে প্রহরের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। প্রহর একপাশে একটা চেয়ারে বসে আছে। পাশেই ফাহিম বসে আছে। ফাহিমের জোরাজুরিতে পার্পল কালারের একটা পাঞ্জাবি পড়েছে সে। তবে পাঞ্জাবি পরে খুবই আনকম্ফোর্টেবল লাগছে ওর। এসব ওর একদমই ভালো লাগে না। ওতো আজ আসতোও না। তবে আজ খুশি নাকি স্টেজে পারফরম্যান্স দিবে। কদিন ধরে সেটা বলে বলে ওর কান ঝালাপালা করে দিয়ে দিয়েছে। যদিও উপরে না দেখালেও মনে মনে প্রহর নিজেও আগ্রহী খুশির পারফরম্যান্স দেখার জন্য। শুধুমাত্র সেই জন্যই তো ওর আসা। নাহলে এসব ফাংশনে ও কখনোই আসে না। ফাহিমও প্রথম প্রথম খুব অবাক হয়েছিল প্রহরকে এখানে দেখে। তবে পরে সে বুঝতে পেরেছে আসল কারণ টা। প্রহর না বললেও ওর মনোভাব ঠিকই বুঝতে পারছে ফাহিম। প্রহরের জীবনের এই পরিবর্তন দেখে সে সত্যিই খুব খুশি। বন্ধু টার জীবন এবার বুঝি একটু লাইনে আসবে।
প্রহরের নজর শুধু খুশিকেই খুঁজছে। আসার পর একবারও দেখেনি। আজকাল ওর নজর শুধু খুশির খোজেই থাকে। মেয়েটা যে ওর অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। যে আগে ওর কাছে মহা বিরক্তির কারণ ছিল। সেই এখন যেন ওর দৃষ্টি সীমানার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাইতো নজর শুধু তাকেই খোঁজে। প্রহরের এই অধীরতা দেখে ফাহিম দুষ্টু হেসে বললো।
–সবুর কর ভাই। সবুরের ফল মিঠা হয়। ভাবিজী অবশ্যই আইবো।
প্রহর অপ্রস্তুত হয়ে বললো।
–হোয়াট রাবিশ। এমন কিছুই না। আমি কেন ওকে খুঁজতে যাবো?
–এখন এক্সাক্টলি কি কারণে খুজতাছস। হেইডা তো তুইই ভালো জানোস। আমি অবলা প্রাণী কিভাবে বলবো? তয় শুনছি ভাবিজী নাকি পারফরম্যান্স এর জন্য রেডি হইতাছে।
ওদের কথার মাঝেই প্রহরের নজর গেল স্টেজের পাশে। খুশি এইমাত্র এসে দাঁড়িয়েছে ওখানে। প্রহরের নজর খুশিতে আবদ্ধ হতেই আশেপাশের সবকিছু অদৃশ্য হয়ে গেল। ফাহিমের বকবকও ওর কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে খুশির পানে।খুশি ওর পারফরম্যান্স এর জন্য লাল পাড়ের সাদা জর্জেট জরির কাজ করা শাড়ি পড়েছে। সাথে হরেক রকম ভারি অর্নামেন্ট আর অপরুপ সাজে সজ্জিত।যেন পুরোনো দিনের কোন রাজকুমারীর মতো লাগছে। এই প্রথম খুশির এমন রুপ দেখছে প্রহর। প্রহরের হৃদপিণ্ডে যেন ঝংকার দিয়ে উঠছে। চোখের নজর স্থির হয়ে গেছে।
খুশি প্রহরদের দেখতে পেয়ে হাত নাড়িয়ে ওদেরকে ইশারা করলো। প্রহরের ঘোর কাটলো।মাথা ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে নিজেকে একটু সামলে নিল সে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে খুশির দিকে এগিয়ে গেল ওরা। খুশির কাছে এসে ফাহিম বলে উঠলো।
–ওয়াও ভাবিজী কি লাগছো। একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছ। আজতো কারোর নজর সরবেই না তোমার থেকে।
খুশিও গদগদ হয়ে বললো।
–শুকরিয়া শুকরিয়া দেবরজী। আসলে আজকে আমার পারফরম্যান্সে আমি একটা রাজকুমারীর রোল প্লে করছি। তাই ওরা আমাকে এতো সাজিয়ে একেবারে শোপিস করে দিয়েছে।
–ওকে ওকে অল দ্যা বেস্ট ভাবিজী।
ফাহিমের একটা ফোন আসায় ও ওখান থেকে একটু দূরে চলে গেল। খুশি এবার প্রহরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–কি ব্যাপার কিছু বললে না? আমাকে কেমন লাগছে? আমার জন্য নাহয় একটু মিথ্যে প্রসংশাই করে দাও।
প্রহর কি বলবে? খুশিতো আর জানে না যে, সে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। কোন ভাষায় কি বললে খুশির সৌন্দর্য জাস্টিফাই হবে তা আপাতত জানা নেই প্রহরের। তবুও খুশির মন রক্ষার্থে সে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–ঠিকই লাগছো।
খুশি মুখ কুঁচকে বললো।
–ঠিকই লাগছে! এটা আবার কেমন প্রসংশা? মনে হচ্ছে তোমার বাথরুম চেপেছে। আর সেটা অনেক কষ্টে চেপে ধরে কথা বলছ। তুমি এতো কিপটুস কেন? প্রসংশা করতেও কিপ্টামি করো। যেন প্রসংশার ওপর কোটি টাকার ট্যাক্স লেগেছে। কিপ্টার দাদা চিপ্টা হুহ্। আরে প্রসংশা করতে হলে আমার মতো মন খুলে করো। এইযে যেমন তোমাকে আজ এই পাঞ্জাবি টাতে চরম,মারাত্মক,ভয়ংকর লেভেলের হ্যান্ডসাম লাগছে। মন চাচ্ছে এখুনি একটা জোরদার পাপ্পি দিয়ে দেই।
খুশির কথায় প্রহরের বিষম উঠে গেল। মেয়েটা সত্যিই পাগলী। মুখে যা আসে তাই বলে দেয়। মেয়েটা একদিন ওর হার্ট অ্যাটাক করিয়েই ছাড়বে।
খুশি কিছুটা দূরে দিয়াকে দেখতে পেয়ে, ওর দিকে হাত উঁচু করে নাড়াতে লাগলো। তখনই হঠাৎ প্রহরের চোখ পড়লো খুশির কোমড়ের দিকে। খুশির কোমড়ের কাছে শাড়ি একটু সরে গিয়ে কোমড় দেখা যাচ্ছে। প্রহর আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখলো অনেক ছেলেরাই খুশির দিকে তাকিয়ে আছে। চট করেই যেন প্রহরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। প্রহর ঝট করে খুশি হাত ধরে নিচে নামিয়ে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো। –স্টপ ইট ইডিয়ট। কি করছ এসব?
খুশি ভ্রু কুঁচকে বললো।
–আমি আবার কি করলাম? আমিতো দিয়াকে ডাকছিলাম।
–দিয়াকে পড়ে ডাকবে। আগে গিয়ে নিজেকে ঠিক করো?
–নিজেকে ঠিক করবো মানে? কি ঠিক করবো?
প্রহর অন্য দিকে তাকিয়ে ইতস্তত ভাবে বললো।
–তোমার কাপড় ঠিক করো।
খুশি নিজের দিকে চোখ বুলিয়ে বললো।
–কই? সবতো ঠিকই আছে।
প্রহর দাঁত চিবিয়ে চোখের কোনা দিয়ে ইশারায় দেখিয়ে বললো।
–তোমার কোমড়,,
খুশি দুষ্টু হেসে বললো।
–ওও এই কথা? চুপিচুপি আামকে চেকিং করা হচ্ছে বুঝি? তা কেমন দেখলে? সুন্দর না আমার কোমড়? একেবারে হট কোমড়।
প্রহরের এবার রাগী কন্ঠে বললো।
–জাস্ট শাট আপ ইডিয়ট। তোমার কোমড় থেকে শাড়ী সরে গেছে। ঠিক করে এসো ওটা।
খুশি কোমড়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো সত্যিই কাপড় সরে গেছে। তবুও খুশি ওর দুষ্টুমি বজায় রেখে বললো।
–ও এটা? শাড়িতো বড়ো আপুরা পড়িয়ে দিয়েছে। আমি এসব পারি না। তবে তুমি চাইলে এটা ঠিক করে দিতে পারো। দাওনা ঠিক করে।
–হোয়াট? হ্যাভ ইউ গন ম্যাড? আমি কেন করবো?
খুশি ভাবলেশহীন ভাবে বললো উঠলো।
–ঠিক আছে না করলে। আমি এভাবেই থাকবো। আমার কোন সমস্যা নেই।এতো সুন্দর কোমড় যখন আছে, তখন প্রদর্শন করাতো দরকার তাইনা? মানুষও তো একটু দেখুক আমার হট কোমড়।
কথাটা বলে খুশি নির্বিঘ্নে সামনের দিকে পা বাড়ালো। তবে এগুতে পারলো না। পেছন থেকে সজোরে টান পড়লো প্রহরের হাতের। খুশি বাঁকা হাসি দিল। প্রহর খুশির হাত শক্ত করে ধরে সামনের একটা ক্লাসরুমের দিকে টেনে নিয়ে গেল। পেছন থেকে খুচি মুচকি হাসছে। সে জানতো প্রহর ওকে কখনো ওভাবে যেতে দিবেনা। এতদিনে একটু হলেও যে সে প্রহরের মনে জায়গা করতে পেরেছে এতটুকু ভরসা পাচ্ছে ও।
প্রহর খুশিকে টেনে ক্লাসরুমে নিয়ে এস সামনে দাঁড় করালো। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললো।
–শাড়ী যখন সামলাতে পারোনা তাহলে এসব পড়ার কি দরকার? ইডিয়ট একটা। এখন চুপচাপ এখানে দাঁড়িয়ে থাকো।
কথাটা বলে প্রহর খুশির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে ওর শাড়ি ঠিক করে দিতে লাগলো। খুলে যাওয়া সেপ্টিপিন টা আবার ঠিক করে শাড়ির সাথে লাগিয়ে দিচ্ছে। তখনই মহান খুশি দেবি বিশেষ টিপ্পনী কেটে বললো।
–বায়দা মহাসড়ক, এখানে কেউ নেই।তুমি চাইলে এডভান্টেজ নিতে পারো। আই ওন্ট মাইন্ড।
যথাযথ ভাবেই প্রহর একটা রাম ধমক দিয়ে বললো।
–শাট আপ ইডিয়ট। কথা বলার আগে একটু ভেবে চিন্তে বললে কি খুব একটা ক্ষতি হয় তোমার? যখনি মুখ খোল শুধু ফালতু কথাই বলা লাগবে?
খুশি ভেংচি কেটে বিড়বিড় করে বললো।
–হুহ্ কথায় কথায় খালি শাট আপ। সারাজীবনে মনে হয় এই দুইটা ইংরেজি শব্দই শিখেছে। এতো পড়াশোনা করে তাহলে কি লাভ হলো? এরচেয়ে তো আমিই ভালো। টেনেটুনে পাশ করে তাও তো তার চেয়ে ভালো জানি। আর কথা বলার আগে আবার ভাবনা চিন্তার কি আছে? কথা বলা কি কোন ওপেন হার্ট সার্জারী নাকি যে, বোর্ড মিটিং ডেকে কথা বলতে হবে?
বিড়বিড় করে বললেও প্রহরের কান পর্যন্ত ঠিকই পৌঁছালো খুশির কথা। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে হাসলো সে। এই মেয়ের কোন গতি নেই। পাগলের পাগলই থেকে যাবে। সাথে বাকিদেরও পাগল করে দিবে।
___
খুশির পারফরম্যান্স এর সময় হয়েছে। প্রহর আর ফাহিম সামনের দর্শক সারিতে বসে আছে।কিছুক্ষণ পরেই পারফরম্যান্স শুরু হয়ে গেল। স্টেজে রাজা মহারাজার দরবারের মতো কিছু লোক সৈন্য সেজে দাঁড়িয়ে আছে। আর দুজন রাজা রানী সেজে বসে আছে। একজন সৈন্য সামনে এসে হাঁক ছেড়ে বললো।
–সাবধান,হুশিয়ার, কটনবার, ম্যাঙ্গোবার,চকোবার, শনি থেকে শুক্রবার। তো যেমনটা আমরা সবাই জানি। আজকে আমাদের রাজকুমারী পরীজানের স্বয়ম্বর হবে।আজ রাজকুমারী সব রাজকুমারদের মাঝ থেকে তার হবু বরকে খুঁজে নিবে। দেখা যাক কে হয় সেই ভাগ্যবান রাজকুমার। তো সবার প্রথমে আমাদের রাজকুমারীকে ডেকে নেই। রাজকুমারী পরিজান হাজির হোওওওওও….
একটু পরে খুশি মাথার ঘোমটা ধরে ধীরে ধীরে স্টেজে এলো। স্টেজের মাঝ বরাবর এসে সুন্দর করে বসলো। প্রহরের নজর আর হৃদপিণ্ড দুটোই খুশিতে আটকে আছে। ব্যাকরাউন্ডে মিউজিক বেজে উঠলো।
♬ নাজার জো তেরি লাগি
♬ মে দিওয়ানি হো গায়ি
♬ দিওয়ানি হো দিওয়ানি, দিওয়ানি হো গায়ি
♬ মাশহুর মেরে ইস্ক কি কাহানি হো গায়ি
♬ কেহ তে হে এ দিওয়ানি মাস্তানী হো গায়ি
♬ দিওয়ানি হো দিওয়ানি, দিওয়ানি হো গায়ি
গানের তালে নাচছে খুশি।আজ যেন খুশির অন্যই এক রুপ দেখতে পাচ্ছে প্রহর। এক মোহয়সী নারীর রুপ দেখতে পাচ্ছে ও। যে চাইলে তার মোহনীয়তার তীরে যে কাওকে সহসাই ঘায়েল করতে পারে। যেমন টা এইমুহূর্তে প্রহরকে ঘায়েল করছে। খুশির তীক্ষ্ণ তীর প্রহরের হৃদয়ের আরপার করে দিচ্ছে।
খুশির নাচ শেষে সে তার আসনে গিয়ে বসলো। সেই সৈন্য টা আবারও হাঁক ছেড়ে বললো।
–তো স্বয়ম্বর আরম্ভ করা হোক। আমাদের রাজকুমারী পরিজানের জন্য শুধু সাধারণ রাজকুমার না।বরং বড়ো বড়ো সেলিব্রিটি এমনকি বড়ো বড়ো সুপার হিরোরাও এসেছে। তো সবার প্রথমে আসছে মাকড়সা মানব।আই মিন স্পাইডার ম্যান। স্পাইডার ম্যান হাজির হোওওও…
সবাই স্টেজের এনট্রির দিকে তাকিয়ে আছে। তবে স্পাইডার ম্যান এলো উপর থেকে। এদিক ওদিক জালি ছড়িয়ে, জালি ধরে ঝুলে ঝুলে এলো। খুশির সামনে এসে বসে বললো।
–রাজকুমারী পরিজান আমাকে আপনার বর হিসেবে গ্রহণ করুন। আমার মতো জীবনসঙ্গী আর একটাও পাবেন না। আরে আমার সাথে থাকলে আপনার জীবনে কখনো গাড়ী ভাড়া লাগবে না। কখনো জ্যামে আটকে থাকার প্রয়োজন হবে না। কাপড় শুঁকানোর জন্য কখনো দড়ির দরকার হবে না। ভেবে দেখুন আমার মতো কাজের লোক আর একটাও পাবেন না।
খুশি বলে উঠলো।
–হ, আর সারাজীবন বসে বসে খালি মাকড়সার জালি পরিস্কার করবো তাইনা? না বাবা না মাফ করুন।
সৈন্য টা এবার নেক্সট ক্যান্ডিডেট বাহুবলীর নাম ধরে ডাক দিল। একটু পরে কাঁধে বিশাল ভারী একটা শস্ত্র নিয়ে ধুপধাপ করে হেঁটে এলো বাহুবালী। খুশির সামনে এসে বললো।
–রাজকুমারী পরিজান আপনি আমাকে আপনার জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করুন। আমার কোয়ালিটি প্রো ম্যাক্স। মানুষ গরুর থেকে দুধ বের করে। আর আমি সোজা চিজ বের করে আনি। মুরগির থেকে ডিমের বদলে অমলেট বের করে আনি। ফল খেতে চাইলে ফলের গাছ শুদ্ধ উপড়ে নিয়ে আসি। কোথাও বেড়াতে গেলে লাগেজ নিতে হবে না। কারণ আমি পুরো বাসাই হাতে করে নিয়ে যাই। আমার মতো ট্যালেন্টেড ব্যাক্তি আর কেউ নেই।
খুশি বলে উঠলো।
–উহুম আপনাকে বিয়ে করা যাবে না। আপনার মাঝে ম্যানুফ্যাক্সারিং ডিফেক্ট আছে।
–কি ডিফেক্ট?
–আমি শুনেছি আপনার নেচার ঠিক নেই। আপনার কাটাপ্পার সাথে গে ওয়ালা সম্পর্ক আছে। তাই আপনি ক্যান্সেল।
এরপর আসে আয়রন ম্যান। সে খুশির সামনে এসে বললো।
–রাজকুমারী আমাকে বিয়ে করুন। আমাকে বিয়ে করলে আপনার শরীরে কখনো আয়রনের ঘাটতি থাকবে না।
এরপর আসে ক্রিশ। সেও এসে নিজের প্রতিভার গুনগান গায়। এভাবে একে একে সব সুপার হিরো আর রাজকুমার রা এসে তাদের প্রদর্শনী করে। সব ক্যান্ডিডেট দের কথা শোনা শেষে সৈন্য বললো।
–এখন সব ক্যান্ডিডেট গুলো লাইন হয়ে দাঁড়িয়ে যাও। রাজকুমারী সবাইকে দেখবে। তারপর তার যাকে পছন্দ হবে তার গলায় মালা পড়াবে।
অতঃপর খুশি ফুলের মালা হাতে দাঁড়িয়ে সবার সামনে গিয়ে ঘুরে ঘুরে সবাইকে দেখতে লাগলো। সব ক্যান্ডিডেট গুলো নিজের গলায় মালা নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে লাগলো। একপর্যায়ে সবাই ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিলো। এদের ধাক্কাধাক্কিতে খুশির গায়েও ধাক্কা লেগে খুশি ব্যালেন্স হারিয়ে স্টেজ থেকে নিচে পড়ে যেতে লাগলো। প্রহর সামনের সারিতেই বসে ছিল। খুশিকে পড়ে যেতে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে সেদিকে দৌড়ে গেল প্রহর।খুশি পড়ে যেতে লাগলে প্রহর দৌড়ে গিয়ে নিচ থেকে খুশিকে ধরে ফেললো। খুশি পড়ার সময় ওর হাতে থাকা মালাটা সোজা প্রহরের গলায় গিয়ে পড়লো। খুশি নিজেকে প্রহরের কোলে দেখে দুষ্টু হেসে বললো।
–বাহ্, দেখেছ আমার মতো আমার মালাটাও ঠিকই তার আসল ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে।
প্রহর একবার নিজের গলার দিকে তাকালো। তারপর কিছু না বলে খুশিকে কোলে রেখে ওভাবেই হাঁটা ধরলো। খুশিও মুচকি হেসে দুই হাতে প্রহরের গলা জড়িয়ে ধরে প্রহরের দিকেই তাকিয়ে রইলো।
চলবে……
1953/