অন্তঃকরণে তোরই পদচারণ পর্ব -০৭+৮

#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-৭
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★বড্ড প্রফুল্ল মনে ঠোঁটে হাসির রেখা ঝুলিয়ে বাসার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো খুশি। তবে সামনে দুকদম বাড়াতেই তার হাসি মুখটা হাওয়া বের হওয়া বেলুনের মতো চুপসে গেল। কারণ তার সামনেই তার মা জননী অগ্নিমূর্তি রুপ ধারণ করে আছে। তা দেখেই খুশির অন্তরের পানি শুঁকিয়ে এলো। আজ যে ওর কপালে মঙ্গল বাদে আর সবদিনই আছে তা ভালোই বুঝতে পারছে ও। খুশি নিজের সাহায্য স্বরূপ ভাই আর বাবার দিকে তাকালো। কিন্তু তাদের করুন চেহারা দেখে মনে হচ্ছে না তাদের কাছ থেকে কোন সাহায্যের আশা করা যায়। খুশি বেটা, আব তো তু গায়া কামছে।

সাহেলা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো।
–আসেন আসেন মহারাণী। আপনার আসার সময় হয়ে গেছে? এতো জলদি কেন আসলেন? রাত ১২ টার নাহয় আসতেন।

খুশি একটু জোরপূর্বক হেসে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো।
–কি বলো মা? আমি এতো দেরি করে কি করে আসতে পার?।তুমিই তো তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলেছ তাইনা?আর তুমি তো জানোই আমি তোমার কতটা অনুগত সন্তান। তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই আমার একমাত্র কাজ।পৃথিবী উল্টে গেলেও তোমার কথার অমান্য হবে না। আমার মতো বাধ্য, সুশৃঙ্খল, ভদ্র,অনুগত,সহজ, সরল মেয়ে তুমি গুগলে সার্চ দিয়েও পাবে না। আরে আমার তো ফেবারিট গানও মাকে নিয়ে।
♬ আম্মাজান আম্মাজান চোখের মনি আম্মাজান
♬ জন্ম দিছেন আমায় আপনার দুগ্ধ করছি পান
♬ আম্মাজান আম্মাজান আম্মাজান আম্মাজান

–চুপ। একদম চুপ। ইয়ার্কি হচ্ছে আমাার সাথে? এটা তোর বাড়ি ফেরার সময় হলো? কলেজ তো সেই কোন বেলায় শেষ হয়ে গেছে। তাহলে তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি হ্যাঁ? সত্যি করে বল কোথায় গিয়েছিলি তুই হ্যাঁ?

রাকিব হাসান একটু সাহস যুগিয়ে বলে উঠলেন।
–আরে মেয়েটা মাত্রই আসলো। ওকে একটু সময় তো দাও। আসতেই সওয়াল-জবাব শুরু করে দিয়েছ।

নিভানও বোনের সাপোর্টে বলে উঠলো।
–হ্যাঁ আম্মু দেখনা আপুর মুখটা কেমন শুঁকিয়ে গেছে। আগে একটু খেতে দাও আপুকে।

সাহেলা বেগম ধমকের সুরে বললেন।
–চুপ কর তোরা। তোদের আস্কারা পেয়েই আজ ও এমন উড়নচণ্ডী হয়ে গেছে। সবসময় শুধু ওর ওকালতি করার জন্য এগিয়ে আসিস। আজকে কেউ কথা বলবিনা। নাহলে সব কয়টাকেই আজ চরম শিক্ষা দিয়ে দিবো।

সাহেলা বেগমের রাম ধমকে ওরা দুজন দমে গেল। খুশি বুঝতে পারলো এভাবে কাজ হবে না। তাই ওর সো কল্ড মেলোড্রামা শুরু করে দিলো। নেকি সুরে দুখিয়ারী ভাব ধরে বলে উঠলো।
–থাক তোরা কিছু বলিস না। এটাই আমার পাওনা। আম্মু তুমি কি একবারের জন্যও জানতে চেয়েছ আমার দেরি হলো কেন? তা কেন জানতে চাইবে? তোমার তো আমার ওপর কোন ভরসাই নেই। আরে আমি কি ইচ্ছে করে লেট করেছি নাকি? জানো আমিতো কলেজ ছুটে হতেই সোজা বাসায়ই আসছিলাম। কিন্তু হঠাৎ দেখি একটা বাচ্চা রাস্তার ভেতর কাঁদছে। তাই আমি ওর কাছে গিয়ে জানতে পারলাম বাচ্চাটা নাকি ওর মায়ের কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছে। তোমরা তো জানোই আমি কতো সেনসেটিভ। কারোর কষ্ট আমার সহ্য হয়না। তাই আমি ওই বাচ্চাটার মাকে খুজতে লাগলাম। অনেক খোঁজার পর অবশেষে তাকে পেয়ে তার কাছে বাচ্চাটাকে হস্তান্তর করে তারপরে না আসলাম। তারপর হলো আরেক ঝামেলা। রাস্তায় গাড়ি পেলাম না একটাও। পুরো রাস্তা হেঁটে হেঁটে এসেছি জানো? আমার পা দুটো তো ব্যাধায় টনটন করছে। কিন্তু তোমাদের সেদিকে খেয়ালই নেই। আসতেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলে। ভালো মানুষের দামই নেই এই যুগে।

কথাগুলো বলে খুশি নেকি কান্না করতে লাগলো। খুশির মেলোড্রামায় নিভান আর রাকিব হাসান যেন কেঁদে দেওয়ার উপক্রম। তারা তড়িঘড়ি করে খুশির কাছে এলো। খুশিকে ধরে সোফায় বসিয়ে বললো।
–আহারে আমার মামুনি টা কত কষ্ট পেয়েছে। আর তুমি কিনা ওকে আরও কথা শুনিয়ে যাচ্ছো? তুমি এতো কঠোর কিভাবে হতে পারো?

নিভানও করুন সুরে বললো।
–আপুর তোমার পায়ে অনেক ব্যাথা হচ্ছে বুঝি? দাঁড়াও আমি এক্ষুনি পেইন কিলার অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিচ্ছি।

সাহেলা বেগমেরও এবার একটু অপরাধ বোধ হচ্ছে। মেয়েটা যে তার জনদরদী সেটা সে ভালো করেই জানে। তাই ওর মিথ্যে কাহিনিকে অবিশ্বাস করতে পারলোনা। সে দ্রুত কিচেনে গিয়ে মেয়ের জন্য খাবার গরম করতে লাগলো। যাই বলুক মেয়েকে তো সেও কম ভালোবাসে না। তার প্রথম সন্তান খুশি। মা হওয়ার সৌভাগ্য সে খুশিকে দিয়েই পেয়েছিল। বিয়ের পর অনেক দিন বাচ্চা হচ্ছিল না তার। অনেক চিকিৎসার পর খুশি তার গর্ভে এসেছিল। খুশির যেদিন জন্ম হয় সেদিন ছিল সাহেলা বেগমের সবচেয়ে খুশির দিন। তাইতো মেয়ের নামও সে খুশি রেখে দিয়েছিল। তবে মেয়েটার জন্য একটু চিন্তা হয়।খুশির মাত্রাতিরিক্ত চঞ্চলতা সাহেলা বেগমের চিন্তার কারণ। তাইতো সে একটু কড়া হয়ে যায় মাঝে মধ্যে। ওর ভবিষ্যতের চিন্তা হয় সাহেলা বেগমের। নাজানি এই মেয়ে অন্যের ঘরে গিয়ে কিভাবে সংসার করবে? তারা কি ওকে এভাবে মেনে নিতে পারবে?
___

রাত আটটার দিকে বাসায় ফিরলো প্রহর। জিদান তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
–কিরে গাড়ির টায়ার পানচার হয়ে গিয়েছিল নাকি? আজ হঠাৎ একটু লেট করে ফিরলি মনে হয়। না মানে তুই তো আবার বাচ্চাদের মতো সন্ধ্যার আযানের সাথেই দৌড়ে বাড়ি ফিরে আসিছ। তা রাতের অন্ধকারে ভয় পেলি নাতো?

প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–বাবা তোমার মনে হয় না, তোমার একটু বেটার জোক্স ট্রাই করা উচিত? আই মিন বয়সের সাথে তোমার জোক্স গুলোরও ডেট এক্সপায়ার হয়ে যাচ্ছে। আই থিংক তোমার একটু চর্চা করা উচিত।

–হাহ্ যার ছেলের জওয়ানি এক্সপায়ার হয়ে যাচ্ছে। তার জন্য জোক্স এক্সপায়ার হওয়াটা খুব একটা বড়ো ব্যাপার না। কদিন পর তুই নিজেই মানবজাতির জন্য পারমানেন্ট জোক্স হয়ে যাবি। তা ছিলি কোথায় শুনি?

–ফার্মহাউস গিয়েছিলাম। তাই দেরি হয়েছে।

–তুই আবার ওই বোরিং জায়গা টায় গিয়েছিলি? ওই ফার্মহাউস টা তোকে শেষ করে দিলো। কি আছে শুনি ওখানে? তাও যদি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য যেতি তবুও একটা কথা ছিল। তুই কি করিস? ওইসব পশুপাখির ন্যানি হয়ে যাস। আরে ভাই ওতো সুন্দর একটা ফার্মহাউস টাকে তুই চিড়িয়াখানা বানিয়ে দিয়েছিস। কোথায় গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ওখানে ডেট করতে যাবি। তানা পশুপাখির পটি পরিস্কার করিস। ডিসকাস্টিং।

ডেট করার কথা শুনে প্রহরের হঠাৎ খুশির কথা মনে পড়ে গেল। তখন খুশিও এমনই বলেছিল।এখন ওর বাবাকে কি করে বলবে যে সে সত্যিই আজ ওখানে কোন মেয়েকেই নিয়ে গিয়েছিল। বাবা শুনলে নির্ঘাত এটা নিয়ে নতুন কাহিনি শুরু করে দিবে। একেতো নাচুনি বুড়ী, তারওপর ঢোলের বাড়ি হয়ে যাবে।না না বাবাকে খুশির কথা মোটেও বলা যাবে না। প্রহরের ভাবনার মাঝেই ওর বাবা আবার বলে উঠলো।
–বায়দা ওয়ে ফার্মহাউসে তো তুই ছুটির দিনে যাস। তো আজ হঠাৎ কি মনে করে? নাকি তোর ছাগল গরু বাচ্চা দিয়েছে। আর তুই দায়মা হওয়ার দায়িত্ব পালন করতে গিয়েছিলি?

প্রহর একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–ওই এমনি আরকি। একটু যেতে ইচ্ছে করছিল তাই। তুমি এসব ছাড়না। অনেক ক্ষিদে লেগেছে। চলো ডিনার করে নেই।

প্রহর প্রসঙ্গ পাল্টে দ্রুত ফ্রেশ হতে চলে গেল। ব্যাপার টা কেমন সন্দেহজনক মনে হলো জিদান সাহেবের কাছে। আজকে প্রহরের গতিবিধি কিছুটা অন্যরকম মনে হচ্ছে। আর তার সন্দেহর মাত্রা আরও বেড়ে গেল ডাইনিং টেবিলে বসে। আজ প্রহর বিনা কোন বাক্য ব্যায় করে চুপচাপ ঢেঁড়স খাচ্ছে। আর ওকে দেখে মনে হচ্ছে খাবারে ধ্যান নেই ওর। মন অন্য খেয়ালে ডুবে আছে। জিদান সাহেব গভীর সন্দেহের দৃষ্টিতে প্রহরকে পর্যবেক্ষণ করছে।

প্রহরের মন সত্যিই এখন খাবার টেবিলে নেই। না চাইতেও বারবার খুশির কথা মনে পড়ছে। খুশির ওই কথাগুলো গভীর ভাবে ভাবাচ্ছে ওকে। ফাহিম কি ঠিকই বলে? মেয়েটা কি সত্যিই অন্যরকম? ও কি সত্যিই ভালোবাসে আমাকে? প্রহরের হঠাৎ খুশির সেই ছাগলছানার সাথে বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল। আর মনে পড়তেই ঠোঁটের কোনে আবারও হাসির রেখা ফুটে উঠলো।

ব্যাস এবার তো জিদান সাহেবে চোখ চড়কগাছ হয়ে গেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না তার। এটা কি সত্যিসত্যিই তার ছেলে? নাকি তার ছেলের মাঝে কোন ভূত প্রেত ঢুকে গেছে? নাহ আর বসে থাকা যায় না। জিদান সাহেব ফোন বের করে দ্রুত ফাহিমের নাম্বারে ফোন দিয়ে বললো।
–এই ফাহিম বাবা জলদি ডাক্তার, ওঝা,কবিরাজ সব নিয়ে আসো। তোমার বন্ধুর কিছু হয়ে গেছে।

জিদান সাহেবের কথায় হকচকিয়ে উঠলো প্রহর। ভ্রু কুঁচকে বললো।
–কি বলছ বাবা? আমার আবার কি হবে?

–কি হবে মানে? আরে তুই হাসছিস। তাও আবার আপন মনে। এটা কি তোর কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আরে যে তুই কাপিল শার্মা শো,আর টক শো এর মাঝে পার্থক্য খুজে পাস না।সেই তুই আজ হাসছিস এটা কোন নরমাল ব্যাপার না। নিশ্চয় তোর মাঝে প্রেতাত্মা ঢুকে গেছে।

প্রহর একটু থতমত খেয়ে বললো।
–তুমিও না বাবা তিল কে তাল বানিয়ে ফেলো। এমন কিছুই না আমি একদম ঠিক আছি।

–মোটেও না। তোর শিরায় শিরায় পরিচিত আমি। সত্যি করে বল ঘটনা কি?

–ঘটনা হলো তোমার মাথা গেছে। ইউ নিড ডক্টর।
কথাটা বলেই প্রহর ওর বাবার হাত থেকে বাঁচার জন্য তড়িঘড়ি করে ওখান থেকে কেটে পড়লো। ওর বাবার তীক্ষ্ণ নজর। তার কাছ থেকে সহজে কোন কিছু লুকানো যায় না। তাই এখান থেকে চলে যাওয়ায় শ্রেয় মনে করলো সে। যেতে যেতে ফাহিমকে ফোন করে আসতে মানা করে দিলো। ওটা আবার আরেকজন। দেখা যাবে সত্যি সত্যিই চলে আসবে।
___

পরেরদিন যথা সময়ে খুশি হেলেদুলে যাচ্ছে প্রহরের কাছে। তখনই মেয়েলি কন্ঠে কেউ ওকে ডাক দিল। খুশি পাশে তাকিয়ে দেখলো, দুহাত দূরে ক্যাফেটেরিয়ায় একটা মেয়ে বসে আছে। মেয়েটা হাতের ইশারায় ওকে ডাকছে। খুশি একটু অবাক হলো। কারণ সে মেয়েটাকে চিনে না। অপরিচিত মেয়েটা ওকে কেন ডাকছে? তারওপর মেয়েটা মাত্রাতিরিক্ত সুন্দর। এতো সুন্দর মেয়ে হয়তো এর আগে দেখেনি ও। একেবারে ফেইরি প্রিন্সেসের মতো দেখতে।মেয়েটার ডাকে খুশি সেদিকে এগিয়ে গেল। মেয়েটার সামনে গিয়ে বললো।
–জ্বি আপু কিছু বলবেন?

মেয়েটা নরম সুরে বললো।
–হ্যাঁ কিছু বলতাম। আগে বসনা প্লিজ?

খুশি সামনের চেয়ার টেনে বসলো। তারপর মুচকি হেসে বললো।
–আপু একটা কথা বলবো? আপনি কিন্তু অসম্ভব সুন্দর। ফিল্মের হিরোইন দের থেকেও বেশি সুন্দর। সত্যিই বলছি।

নিজের প্রশংসা শুনে খুশি হওয়ার কথা হলেও, মেয়েটির চেহারায় তার ফলশ্রুতি তেমন দেখা গেল না। মেয়েটি মলিন হেঁসে বললো।
–কি লাভ হলো এতো সুন্দর হয়ে? সেইতো অবহেলিত হতেই হলো।

–মানে?

–হায়, আমি রুশা।দেখ তোমাকে কিছু বলতে চাই। তুমি যে কিছুদিন যাবৎ প্রহরের পিছনে ছুটছ সেটা আমি দেখেছি। তো আমি বলবো তুমি এসব ছেড়ে দাও। কারণ তুমি কখনোই সফলতা পাবে না। যার দরুন তোমার কোমল মনটা একসময় ভেঙে যাবে। তাই তোমার ভালোর জন্যই বলছি। নিজের আত্মসম্মান ত্যাগ করে ওর পিছে পিছে ঘুরোনা। প্রহর একটা পাথর। ওর মাঝে কোন অনুভূতি নেই। ও কখনোই তোমাকে ভালোবাসতে পারবে না। ভেবনা এসব আমি বানিয়ে বলছি। আমি এসব নিজের অবিজ্ঞতা থেকে বলছি। এইযে তুমি বললে আমি কতো সুন্দর। কিন্তু জানো এই আমিও ওর কাছে অবহেলিত হয়েছি। আমিও একসময় তোমার মতো পাগল হয়ে পড়ে থাকতাম ওর পেছনে। কিন্তু ওর মন গলাতে সক্ষম হইনি। বরং সে আমাকে উল্টো অপমানিত করে ফিরিয়ে দিয়েছে। আর আমিও আর সাহস পাইনি। কারণ নিজের সেল্ফরেসপেক্ট কে আর ছোট করতে পারছিলাম না। তাই তোমাকেও বলবো নিজেকে কষ্ট দিতে না চাইলে ওই পথ থেকে ফিরে আসে। ঐ পথের কোন মঞ্জিল নেই। ওর কাছে শুধু অবহেলা ছাড়া আর কিছুই পাবে না।

খুশি স্মিথ হেঁসে বললো।
–আমার জন্য এতটা ভাবলেন তার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। এখন আমি আপনাকে কিছু কথা বলি। প্রথমত আমাকে যতোটা অবুঝ ভাবছেন আমি ততটাও কিন্তু না। মানুষকে পরখ করার যথাযথ বুদ্ধিমত্তা আমার আছে। আর একটা কথা কি জানেন সত্যিকারের ভালোবাসায় অপেক্ষা,অবহেলা দুটোই হয়তো আছে। তবে ব্যার্থতা নেই।আমি জানি না আপনার ভালোবাসা কতটা গভীর ছিল। আপনার ভালোবাসা যদি সত্যিই এতটা গভীর হতো তাহলে আপনি সফলতা অবশ্যই পেতেন। এতো সহজে হার মেনে নিতেন না। আর হ্যাঁ সেল্ফরেসপেক্ট আর অবহেলার কথা বলছিলেন না আপনি? আমার মতে আত্মসম্মান ক্ষয় বা অবহেলিত তখনই হয়, যখন কেউ আপনাকে আশা দিয়ে আবার দূরে ঠেলে দেয়। কিন্তু এখানে প্রহর কখনো এমন কোন আশাই দেয়নি।সেতো আমাকে এসে বলেনি যে, এসো আমাকে ভালোবাসো। আর আমিও তাকে জিজ্ঞেস করে ভালোবাসিনি। আমি যেমন আমার ইচ্ছেই ভালোবাসেছি।সেও তেমন তার ইচ্ছে অনুযায়ী আমাকে মানা করতেই পারে। তাহলে আত্মসম্মান ক্ষয় যাওয়ার প্রশ্ন আসছে কোথাথেকে? তবে হ্যাঁ তার না কে হ্যাঁ তে পরিবর্তন করার যথার্থ চেষ্টা করতে আমি পিছু হটবো না। এতে আমার যতো এফার্ট করতে হয় করবো।সহজলভ্য কোন জিনিসের দাম থাকে না। সেখানে এটাতো ভালোবাসা। এতো সহজে পেয়ে গেলে কি আর তার মূল্য থাকবে? আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। তারপরও যদি অপারগ হই। তাহলে ভাববো আমার ভালোবাসাতেই কোন কমতি ছিল। আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন। এখন আমি আসি ভালো থাকবেন।

কথাটা বলে খুশি উঠে চলে গেল। আর রুশা খুশির যাওয়ার পানে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা যেন আজ ওকে ভালোবাসার নতুন সঙ্গা বুঝিয়ে গেল।
___

–এই এই আসছে আসছে তাড়াতাড়ি এক্টিং শুরু করে দে। ভালো করে করবি কিন্তু। ধরা পড়লে খবর আছে কিন্তু তোর।

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে খুশি ওর ক্লাসের বন্ধু শাহিন কে এসব কথা বলছে। ওরা আজ প্রহরের সামনে একটু এক্টিং করতে চায়। যেখানে সে প্রহরকে বুঝাতে চাইছে যে,কেউ তাকে হ্যারেস করছে। আর সেটারই প্রাকটিস করছে তারা। শাহিনের কাপড়চোপড় আর লুক সেভাবেই রাস্তার বখাটে ছেলেদের মতো করে দিয়েছে। তবে শাহিন বেচারা একটু ভীতু স্বরে বললো।
–আরে দোস্ত আমার না ভয় লাগছে। না মানে জিজু যদি সব বুঝে যায় তাহলে কিন্তু আমাকে ওয়ান পিচে বাসায় ফিরতে হবে না। জিজুর যে বডি। একখান পাঞ্চ পরলেই আমার কাম তামাম। বলছি কি আইডিয়া টা ড্রপ করলে চলে না?

খুশি দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–ওই শাহিন্যা মাঝপথে এসে ব্যাক আউট করলে কিন্তু তোর খবর আছে। আর দিয়ার লাইগ্যা যে পরাণ ডা উথালপাতাল করে। ওইডা কিন্তু ঠুস করে ফাটাই দিমু আমি। মনে রাখিস আমারে ছাড়া কিন্তু তোর পিরিতের রেলগাড়ী চালু হইবো না।

শাহিন অসহায় কন্ঠে বললো।
–দোস্ত তুই এতো ডমিনিটিং ক্যারে? কথায় কথায় এতো হুমকি দেস ক্যা? আমিতো চেষ্টা করছি।

প্রহরকে ভার্সিটির বাইরে আসতে দেখে খুশি তড়িঘড়ি করে বললো।
–ওই দেক আসছে। নে তাড়াতাড়ি শুরু কর।

খুশি নিজের হাত শাহিনের হাতের ভেতর দিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে প্রহরকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলো।
–নেহিইই, ছেড়ে দে সয়তান। আমাকে ছেড়ে দে। বাঁচাও আমাকে কেউ বাঁচাও দয়া করে।

শাহিনও খুশির হাত ধরে ভিলেনি হাসি দিয়ে ওকে টিস করার এক্টিং করছে। প্রহররা দূর থেকে এসব দেখতে পেল। প্রহর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ওদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলো। তারপর ধীরে ধীরে ওদের দিকে এগিয়ে গেল। খুশি সেটা দেখে মনে মনে আনন্দে লাফাচ্ছে। ওর প্ল্যান কাজ করছে। প্রহর নিশ্চয় আমাকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যেই আসছে ইয়েএএএ। প্রহর ওদের কাছে এসে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। খুশি ওকে দেখে বলতে লাগলো।
–প্রহর দেখোনা এই গুন্ডা টা আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। প্লিজ বাঁচাও আমাকে।

প্রহর এক ভ্রু উঁচিয়ে ছেলেটাকে দুই আঙ্গুলের ইশারায় কাছে ডাকলো। বেচারা শাহিনের তো ভয়ে কলিজা শুঁকিয়ে যাচ্ছে। তবুও ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেল প্রহরের কাছে। প্রহর এক হাত উঠিয়ে শাহিনের কাঁধে রাখলো। শাহিনের ভয়ে ঘাম ছুটে যাচ্ছে। প্রহর চোখের সানগ্লাস টা খুলে ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠলো।
–আচ্ছা তোমার মাথায় কি উপর ওয়ালা কিছু দেয়নি? মানে তোমার কি নিজস্ব কোন বুদ্ধিমত্তা নেই?

শাহিন ভয়ে ভয়ে ঘাড় কাত করে বললো।
–জ্বি জ্বি আছে তো।

–তাহলে তুমি এই পাগল মেয়েটার সাথে কি করছ?

প্রহরের কথায় খুশি চোখ বড়বড় করে তাকালো। প্রহর আরও বললো।
–শোন তোমাকে একটা ভালো বুদ্ধি দেই। কান খুলে শুনে রাখো। যদি নিজের জীবনের ফালুদা করতে না চাও তাহলে এই পাগল মেয়েটার থেকে দূরে থাকো। আর হ্যাঁ এরপর যদি আবারও এসব নওটাঙ্কি করতে দেখেছি। তাহলে সত্যি সত্যিই দুজনকেই পাগলা গারদ পাঠিয়ে দিবো বুঝেছ?

শাহিন ভীতু স্বরে বললো।
–জ্বি জ্বি জিজ,,আই মিন ভাই বুঝতে পারছি। আর এমন ভুল হবে না।

–ওকে যাও এখন।
কথাটা বলে প্রহর আবারও ঘুরে দাঁড়িয়ে উল্টো পথে হাঁটা ধরলো।উল্টো ঘুরে সানগ্লাস পড়তে পড়তে তার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠলো আবারও হাসির রেখা। খুশির বোকার মতো কাজকর্ম দেখে তার ভীষণ হাসি পাচ্ছে।

কিন্তু খুশি দমে যাওয়ার পাত্রী না। সে দ্রুত পায়ে প্রহরের সামনে এসে তেজী কন্ঠে বললো।
–এই এই এক মিনিট, তুমি আমাকে পাগল বললে কেন? আমাকে কোনদিক দিয়ে তোমার পাগল মনে হয়? হ্যাঁ আমি তোমার প্রেমে পাগল দিওয়ানি হতে পারি। তাই বলে আমার রুফ টপ একেবারে ফিট আছে বুঝেছ। তাই আমাকে পাগল বলার শাস্তি পেতে হবে তোমাকে।

প্রহর ভ্রু কুঁচকে বললো।
–হোয়াট রাবিশ? কিসের শাস্তি?

–হ্যাঁ শাস্তি। আর শাস্তি হলো এখন আপনি আমাকে ফুচকা খাওয়াবেন। তারপর আমাকে বাসায় ড্রপ করে দিবেন।

প্রহর দায় শাঁড়া ভাবে বললো।
–ইন ইউর ড্রিমস। আই উইল নেভার ডু দ্যাট।

–করবে নাতো?

–নেভার

প্রহর সোজা ওর গাড়ির দিকে যেতে লাগলো। দ্যা গ্রেট খুশি তার ওভারঅল মেলোড্রামা শুরু করে দিলো। রাস্তার মাঝে ঠাস করে বসে পড়ে মরা কান্না শুরু করে দিলো। তারপর আহাজারি করতে করতে বললো।
–হায় আমার কি হবে এখন? আমার জামাই আমারে ছাইড়া চইলা যাইতাছে গো? কেউ কিছু করো। কেউ আমার বিচার করো।

খুশির আচমকা এ্যাকশনে তব্দা খেয়ে গেল প্রহর। আশেপাশের সব লোকজনও তাকিয়ে রইলো। প্রহর খুশির সামনে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–হোয়াট দ্যা হেল? হোয়াট ইজ দিস ননসেন্স? স্টপ দিস রাইট নাও। গেট আপ খুশি। গেট আপ রাইট নাও।

খুশি তার ভলিউম আরও বাড়িয়ে দিলো। আশেপাশের লোকজন এসে বলতে লাগলো।
–কি হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন?

খুশি দুখিয়ারি কন্ঠে বলে উঠলো।
–কি কমু দুঃখের কথা খালা। আমার জামাই আমারে রাস্তার মধ্যে ফালাইয়া চইল্যা যাইতাছে। আমি অহন কি করুম? আপনেরা একটু এই অবলার বিচার করেন। তারে একটু কন আমারে যেন এমনে ফালাইয়া না যায়।

একজন মহিলা প্রহরের সামনে এসে বললো।
–এইযে বাবা তুমি তোমার বউয়ের সাথে এমন করতাছ কেন? দেখছ কতো কানতাছে মাইয়াডা? তোমার কি মায়াদয়া নাই?

প্রহর দাঁত কিড়মিড় করে বললো।
–হোয়াট রাবিশ। কার বউ?কিসের বউ? সি ইজ নট মাই ওয়াইফ।

খুশি আরও জোরে জোরে আহাজারি করে বললো।
–হায় হায় দেখছেন আপনেরা? অহন আমারে সে বউ বইলাও স্বীকার করবার চায়না। অহন মোর কি হইবে? আমার মরে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

এবার আশেপাশের লোকজন প্রহর কে বলতে লাগলো।
–আরে ভাই এমন করছেন কেন? নিজেদের মধ্যে যা হয়েছে সেটা বাসায় গিয়ে সলভ করুন। এভাবে রাস্তার ভেতর তামাশা করাটা কেমন দেখায়? প্লিজ ভাই আপনার বউকে সাথে করে নিয়ে যান।

প্রহর পড়ে গেল মহা বিড়ম্বনায়। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে ওর। মেয়েটা কি নাটক শুরু করে দিয়েছে। এখন এই লোকজনকে কিভাবে বুঝাবে? শেষমেশ আর উপায় না পেয়ে খুশির দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–চলো,,

ব্যাস খুশির সব কান্না শেষ। ফট করে উঠে দাঁড়িয়ে বললো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ চলো সোয়ামালাই।

খুশি যেতে যেতে সবাইকে ধন্যবাদ জ্ঞ্যাপন করে গেল।
__

খুশি ওর কথা অনুযায়ী প্রহরকে নিয়ে ফুচকার দোকানে এলো। রাস্তার পাশে এভাবে খোলা দোকানে এই প্রথম প্রহর আসলো। অস্বস্তিতে শরীর ছেয়ে যাচ্ছে ওর। এখানকার আনহায়জেনিক খাবার দেখে নাক কুঁচকে আসছে ওর। প্রহর খুশির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো। –তুমি এখানকার এই আনহায়জেনিক খাবার খাবে? জানো এসব খাবারে কতে ব্যাকটেরিয়া আছে? ফুচকা খেতেই হয় কোন ভালো রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাও।

–আরে কি বলছো তুমি? ফুচকার আসল মজা তো এসব রাস্তার স্টল গুলাতেই। আর এই মামার ফুচকা সবচেয়ে বেস্ট। একবার খেয়ে দেখ সারাজীবন মুখে লেগে থাকবে।

–ওহ প্লিজ। আমি আর এইসব স্ট্রিট ফুড? ডোন্ট ইভেন থিংক। তোমার খাওয়া লাগে তাড়াতাড়ি করে খাও আর আমাকে ছাড়।

–কিহ? তারমানে তুমি কখনো ফুচকা খাওনি? তুমি তো জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাওয়া মিস করেছ বস। আরে ফুচকা শুধু ফুচকা না। এটা হলো অমৃত। যা খেলে জীবন ধন্য হয়ে যায়। আরে জীবনে একবার ফুচকার স্বাদ না নিলে, তুমি মরে গেলেও মুক্তি পাবে না। তোমার অতৃপ্ত আত্মা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াবে। বুঝতে পেরেছ?

–দরকার নেই আমার ধন্য হওয়ার। তুমি খেলে খাও। নাহলে আমি চলে গেলাম।

খুশি বাঁকা হেসে মনে মনে বললো, আজ তো তোমাকে অমৃতর স্বাদ গ্রহণ করিয়েই ছাড়বো। খুশি ফুচকার অর্ডার দিলে ফুচকা ওয়ালা মামা ওকে এক প্লেট ফুচকা দিল। খুশি দু তিনটে খাওয়ার পর হঠাৎ প্রহরের হাতে জোরে একটা চিমটি কেটে দিল। প্রহর ব্যাথার বহিঃপ্রকাশ করার জন্য মুখ খুলতেই খুশি ফট করে একটা ফুচকা প্রহরের মুখের ভেতর পুরে দিলো। মুখে পুরে দিয়েই মুখের ওপর হাত চেপে ধরে বললো। –দেখ ফেলে দিবে না কিন্তু। নাহলে কিন্তু আমি আবারও এখানে কান্নাকাটি শুরু করে দিবো। প্লিজ খাওনা শুধু একটা। আমার জন্য প্লিজ….

শেষের কথাটা অনেক টা অনুনয়ের সুরে বললো খুশি। প্রহরের হঠাৎ কি যেন হয়ে গেল। সে কেন যেন খুশির কথা ফেলতে পারলোনা। তাই অগত্যা ফুচকা টা কোনরকমে গিলে নিলো সে। প্রহরের ফুচকা খাওয়া দেখে খুশি অসামান্য কোন কিছু পাওয়ার মতো অমায়িক এক হাসি হাসলো। সে হাসিটায় যেন অন্যরকম এক মোহনীয়তা ছিল। একদম নিস্পাপ সেই হাসি। আমাকে ফুচকা খাইয়ে কি এমন খুশি পেল এই মেয়েটা? যার প্রতিফলন স্বরূপ সে এমন করে হাসছে। যে হাসিটা প্রহরের গড়ে তোলা শক্ত দেয়ালে সজোরে আঘাত হানছে। তবে কি এই খুশি নামের বুলডোজার টা সত্যিই ওর দেয়াল ভেঙে গুড়িয়ে দিবে?
#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-৮
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★সময়ের পালাক্রমে অতিবাহিত দিনের সাথে যোগ হয়েছে আরও একটি সপ্তাহ। খুশির প্রয়াস এখনো জারি আছে। সে যথাযথ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে প্রহরের মন জয় করার। যদিও প্রহরের ওপর তার প্রচেষ্টার কোন প্রভাব পড়ছে কিনা সেটার তেমন কোন আভাস দৃশ্যমান হয়নি।

তবে প্রহরের দিক থেকে কিছু না বদলেও আবার যেন কিছুটা বদলেছে। আজকাল কেমন যেন খুশির উপস্থিতি ওকে বিরক্ত করে না। বরং ওর পাগলামি গুলোয় মাঝে মধ্যে অনেক হাসি পায় ওর। যদিও তার সেই মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ না করার যথাযথ চেষ্টা করে সে। উপরে উপরে খুশির ওপর রাগও দেখায় প্রহর। যদিও সে জানে না তাতে কতটা সফল হয়। কারণ না খুশি ওর রাগে ভয় পেয়ে দমে যায়। আর না প্রহর খুশির আবহমণ্ডল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হচ্ছে। খুশির চঞ্চলতা আর উদ্দীপনার ঘূর্ণি ঝড়ে প্রহরের শক্ত দেয়ালটা নড়ে উঠছে। মনে হচ্ছে হয়তো যেকোনো সময় সেটা ভেঙে পড়তে পারে।তবে প্রহর সেটা ঠিক রাখার যথাযথ চেষ্টা করছে। সে চায়না তার দেয়াল কেউ ভাঙ্গুক। ওর মন পর্যন্ত কাউকে পৌঁছাতে দিতে চায়না । এসব মোহমায়ার মিথ্যে জালে নিজেকে ফাঁসাতে চায়না সে। এসব যে শুধুই ছলচাতুরী আর ধূর্ততা।

খুশি আপনমনে হাটতে হাঁটতে দিয়াকে খুঁজছে। কলেজে আসার পর থেকে এখনো দেখতে পায়নি ওকে। আরও কিছুটা হাঁটার পর বটগাছ তলায় বসে থাকতে দেখলো দিয়াকে। খুশিকে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে দিয়ার পাশে বসে হালকা রাগী কন্ঠে বললো।
–কিরে আবুইল্যার মা, কই হারায় গেছিলি? আবুইল্যার বাপেরে পাইয়া গেছস নি?

দিয়া কিছুটা বিরক্তির সুরে বলে উঠলো।
–ইয়ার মজা করিস নাতো। এমনই মেজাজ হাই হয়ে আছে।

–ওমা কেডা আবার তোর মেজাজের তন্দুরি চিকেন বানায় দিলো। তুই খালি একবার ক আমারে। অহনি তারে ধর তক্তা মার পেরেক কইরা দিমু।

দিয়া ওর হাতে থাকা একটা লেটার খুশির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো।
–নিজেই দেখে নে।

খুশি ভ্রু কুঁচকে লেটার টা হাতে নিয়ে খুলে পড়তে লাগলো।
“প্রিয় দিয়া,
তোয়ার লাই আর ফড়াণ ডা বাকুম বাকুম হরে। আই উঠতে,বইতে,খাইতে,হুইতে, নাইতে, যাইতে,হাগতে,মুততে ব্যাগ্গিন সময়ে তোয়ার কথাই মনে ফরে। এহন তো খোয়াবেও তোয়ারেই দেহি। তোয়ার চান্দের লাহান মুখটা দেখবার লাই আই হারাদিন বইয়া থাহি। হাগা আইলেও আটকাইয়া বইয়া থাহি। তোয়ার সুরত খানা দেইখা গাইবার মন চায়,
♬ হরেনা চোখের হলক (পরেনা চোখের পলক)
♬কি তোঁয়ার রূপের ঝলক (কি তোমার রুপের ঝলক)
♬দোয়ায় লাগে মুখডা তোঁয়ার (দোহায় লাগে মুখটি তোমার)
♬এক্কান্না আচলে ডাহ (একটু আঁচলে ঢাকো)
♬আঁই হুশ আজামু, মরি যামু(আমি জ্ঞান হারাবো,মরে যাবো)
♬ বাচাইতে হাইত্তো নো কেউ (বাঁচাতে পারবেনা কেউ)
তোঁয়ারে আই মেলাআআআ হেরেম(প্রেম) হরি। আঁই তোঁয়ারে ছাড়া বাচুম নো। দিয়া, তুমি আঁর দিয়া। আঁই তোঁয়ার বাত্তি। জলদি হইয়া যাও আঁর জীবন সাথী।
♬ ও দিয়া……….আ( ও প্রিয়া……আ)
♬ ওওও দিয়া……
♬ নিহাস আঁর তুমি জানে হগ্গুল দুনিয়া
(নিঃশ্বাস আমার তুমি জানে এই দুনিয়া)
♬ দিয়া আঁর দিয়া

বুইজ্জো নি কতা? তয় বুজবার হারলে আঁর হেরেম ডা মাইন্না লও। আর আঁরে ধন্য হরো। তোঁয়ার আঞ্চলিক ভাষা ফছন্দ দেইখ্যা আঁর নোয়াখাইল্যা বন্ধুরে দিয়া এই চিডি লেহাইলাম। আশা হরি তুমি খুশি হইবা।

ইতি তোঁয়ার দিওয়ানা,মাস্তানা
শাহিন্যা, থুক্কু শাহিন।

চিঠি শেষ হওয়ার আগেই এদিকে খুশি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বেচারি এমন খাতারনাক লাভ লেটার হজম করতে পারছে না। দিয়া রাগ দেখিয়ে বললো।
–তুই হাসছিস? আর আমার এদিকে শরীর জ্বলে যাচ্ছে রাগে। ওর শাহিন্যার সাহস কি করে হলো আমাকে লাভ লেটার দেওয়ার? ওরে তো আমি নর্দমার পানিতে ডোবাবো।

খুশি কোনরকমে হাসির ফোয়ারা থামিয়ে বলে উঠলো।
–আরে রাগছিস কেন? বেচারা কত্তো ভালোবাসে তোরে। একটু ওর প্রতি নজর দিলেই তো পারিস।

–তুইও ওর সাপোর্ট করছিস? তুই আমার বান্ধবী না দুশমন?

–তোর বান্ধবী দেখেই তোকে বলছি। বেচারা সত্যিই তোকে ভালোবাসে। একটা চাঞ্চ তো দিয়ে দেখতেই পারিস। তোর ওইসব ক্রাশ ফ্রাশের পেছনে পাগল না হয়ে ওর দিকেও তো একটু নজর দিতে পারিস। ছেলেটা কিন্তু সরল মনের। এমন ছেলে পাওয়া কিন্তু টাফ বুঝেছিস?

–তোর সত্যিই এমন মনে হয়? হুমম ঠিক আছে। একটু বাজিয়ে তো দেখায় যায় কি বলিস?

–ইয়া বেবি। এই না হলে আমার বুদ্ধিমান বান্ধবী।
__

নিভান অনেকক্ষণ হলো বসে আছে স্পৃহার অপেক্ষায়। কিন্তু মেয়েটির কোন খবরই নেই। একটু পরে স্পৃহা দৌড়াতে দৌড়াতে ওখানে এলো। নিভানের সামনে এসে হাঁটুতে ভড় দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো।
–অ্যাম সরি। আমি অনেক লেট করে ফেলেছি তাইনা? আসলে আমি না রিহার্সেল করছিলাম। তাই লেট হয়ে গেছে।

নিভান ভ্রু কুঁচকে বললো।
–রিহার্সেল? কিসের রিহার্সেল?

–আরে তুমি জানো না। কয়দিন পরই তো আমাদের বার্ষিক ক্রিড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। সাথে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হবে। আর আমি নৃত্য প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছি।

–তুমি নাচও জানো বুঝি।

স্পৃহা বসতে বসতে বললো।
–তেমন জানি না। তবে শেখার অনেক শখ। নাচতে অনেক ভালো লাগে আমার।

–ওওও

–তা তুমি কোন কিছুতে নাম দাওনি?

–না আমার এসব এক্সট্রা কারুকলামে খুব একটা ইন্টারেস্ট নেই।

–আরে কি বলছ? তুমি তো এতো সুন্দর আর্ট করতে পারো। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলে তো তুমিই ফাস্ট হবে অ্যাম শিওর।

–আর্ট করি আমি আমার নিজের জন্য। কারণ এটাতে আমার মনের আলাদা এক প্রশান্তি পাই।তবে এটা নিয়ে কোন কম্পিটিশন করতে আমার ভালো লাগে না।

–আচ্ছা, তুমি যেটা ভালো মনে করো।

–আচ্ছা তাহলে আজকে আর আর্ট ক্লাসের দরকার নেই। তুমি বরং ভালো করে প্রাকটিস করো কেমন।

স্পৃহা মুখ লটকিয়ে বললো।
–আরে কি প্রাকটিস করবো? আমি তো ভালো করে পারছিই না। কেউ তেমন শেখানোর মতোও নেই। আমি বোধহয় এবারও পারবোনা।

নিভান কিছু একটা ভেবে বললো।
–আচ্ছা তুমি চাইলে আমার বাসায় এসে আপুর কাছ থেকে শিখতে পারো। আমার আপু অনেক ভালো নাচ জানে। স্কুলে সে নাচের জন্য অনেক প্রাইজ জিতেছে। আপু তোমাকে ভালো করে শিখিয়ে দিবে।

–ওয়াও সত্যিই? তাহলে তো অনেক ভালো হবে। আসলে তোমার কাছ থেকে এতো শুনে শুনে এখন আমারও আপুকে অনেক দেখার ইচ্ছে হয়। আর এই সুযোগে দেখাও হয়ে যাবে। আর নাচ শেখাও। সাথে তোমার বাগানটাও দেখতে পাবো। তাহলে আমি আজকে বাসায় বলে রাখি। তারপর কাল থেকে তোমার সাথে যাবো কেমন?

–আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে এখন আমি যাই ওকে।

–ওকে বাই।
___

আজ শুক্রবার। প্রহরের সাপ্তাহিক রুটিন অনুযায়ী সে আজ সে ফার্মহাউসে এসেছে। ছুটির দিন টা সে এখানেই কাটায়। যানবাহন আর কোলাহল মুক্ত এই মনোরম পরিবেশটা তার ভালো লাগে। আর সেই সাথে ওর পালিত পশুপাখি গুলোর সাথেও সময় কাটাতে পারে। এদের সময় কাটাতেও অনেক ভালো লাগে প্রহরের। মানব জাতির মতো মুখোশ ধারি না এরা। এদের মাঝে নেই কোন কৃত্রিমতা। নেই ধূর্ততা বা স্বার্থপরতা। এরা ভালোবাসার বদলে শুধু ভালোবাসায় দিতে যানে। তাইতো এদেরকেই সবচেয়ে আপন মনে হয় প্রহরের।

প্রহর ছুটির সারাটাদিন এদের সাথেই কাটায়। নিজের হাতে এদের সব কাজ করে। আজও তাই করছে। প্রহর এসেই কাপড় চেঞ্জ করে একটা টিশার্ট আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে বাইরে এলো পশুপাখি গুলোর কাছে। প্রহরের সাথে আজ ফাহিমও এসেছে। ফাহিমও প্রায়ই আসে এখানে। প্রহরের মতো ওরও এখানে সময় কাটাতে ভালোই লাগে।

প্রহর ফার্মের দিকে এগিয়ে যেতেই ওর পোষা কুকুর দুটো দৌড়ে এলো প্রহরের কাছে। প্রহর নিচে এক হাঁটু গেড়ে বসে কুকুর দুটোকে আদর করতে করতে বললো।
–কি ব্যাপার জনি এন্ড স্যামি। কেমন আছিস তোরা? আজতো আমি আসার আগেই এতো চকচক করছিস? ব্যাপার কি বলতো? এতো পরিস্কার হলি কিভাবে?

কুকুর দুটো তখন ঘেউ ঘেউ করে সামনের দিকে কিছু ইশারা করে দেখাচ্ছে। প্রহর ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকাতেই, আচমকা খুশি সামনে এসে প্রকট হলো। দুই হাত ছড়িয়ে সারপ্রাইজ দেওয়ার মতো করে বলে উঠলো।
–টাডা……

হঠাৎ খুশিকে এখানে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেল প্রহর। আর খুশির পোশাক আশাক দেখে আরও ভ্রু কুঁচকে এলো ওর। খুশি শার্ট আর জিন্স প্যান্ট পড়েছে। শার্টের সামনে দুই মাথা গিট্টু দেওয়া আর পায়ের কাছে প্যান্ট গোড়ালির অনেক টা ওপর পর্যন্ত গুটিয়ে রেখেছে। মাথায় একটা স্কার্ফ বাঁধা। আর দুই হাতে দুটো ক্লিনিক ব্রাস ধরে আছে। খুশির এই আবতার দেখে প্রহর ভ্রু কুঁচকে ভাবছে, খুশি? এই মেয়ে আবার এখানে কখন এলো? আর কিভাবে এলো? আমি যে এখানে আসবো তা ও জানলো কি করে? প্রহর এবার তীক্ষ্ণ সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো ফাহিমের দিকে। এই কাজ এই ফাহিমের তা ভালোই বুঝতে পারছে ও। প্রহরের তাকানো দেখে ফাহিম জোরপূর্বক হেসে বললো।
–এ এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? আমি মোটেও নিয়ে আসিনি ভাবিজীকে।

প্রহর দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
–আচ্ছা তো সে নিজে নিজেই সব জেনে গেল তাইনা? বোকা পেয়েছিস আমাকে? তোকে তো আমি পরে দেখছি।
প্রহর এবার খুশির দিকে তাকিয়ে বললো।
–তুমি এখানে কি করছ হ্যাঁ?

খুশি তার বৈশিষ্টতা অনুযায়ী নিজের মতো করে বলে উঠলো।
–ওমা কি করছি মানে? এটা আবার কোন প্রশ্ন হলো? আরে আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি। আমার হবু বরের সবকিছু দেখাশোনা করার দায়িত্ব তো আমার তাই না? আপনার মতো এই পশুপাখি গুলো এখন থেকে আমারও বাচ্চার মতো। তাই আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে সকাল সকাল চলে এলাম। আর এসেই আমি আমার কাজে লেগে পড়েছি দেখেন।
খুশি ওখানকার কর্মরত মহিলা রোজিনা বেগম কে ডাক দিয়ে বললো।
–এই রোজিনা সুন্দরী তুমি বলোনা।

রোজিনা বেগমকে এমন নামে ডাকতে দেখে ফাহিম মুখ টিপে হাসছে। খুশির কথামতো রোজিনা বেগম প্রহরের সামনে এসে বললো।
–জে বাবা, মাইয়াডা সকাল সকাল আইয়াই কামে লাইগ্যা পড়ছে। আমি কতো মানা করলাম, কিন্তু হেই হুনলোই না। এই জনি আর স্যামিরেও হেয়ই গোসল করাই দিছে। এক্কেরে শ্যাম্পু দিয়া ঘইষা মাইজা চকচকা কইরা দিছে।

প্রহর এবার সামান্য বিস্ময় নিয়ে তাকালো খুশির দিকে। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–দেখ তোমার এসব করার কোন দরকার নেই। তুমি যাও এখান থেকে।

খুশি জেদ ধরে বললো।
–মোটেও না। আমি এখানেই থাকবো। দেখ আমার এই পশুপাখি গুলোর ওপর অনেক মায়া বসে গেছে। তাই ওদের সাথে একটু সময় কাটাতে চাই। দেখ আমি তোমাকে প্রমিজ করছি আজকে আমি তোমাকে একটুও জ্বালাবো না। তোমার কাছেও যাবোনা। শুধু ওদের সাথে একটু থাকতে দাও। প্লিজ প্লিজ প্লিজ….

খুশির এমন অনুনয় দেখে প্রহর কেমন যেন আর মানা করতে পারলোনা। ফাহিমও পাশ থেকে বলে উঠলো।
–থাকতে দেনা ওকে। বেচারি শুধু একটু পশুপাখি গুলোর সাথে সময়ই তো কাটাতে চাচ্ছে।

প্রহরও তাই মাথা ঝাকিয়ে বললো।
–ঠিক আছে। তবে বেশিক্ষণ না। কিছুক্ষণ থেকে চলে যাবে।

খুশি আনন্দিত হয়ে বললো।
–ওকে ওকে।

খুশি আবারও ধেইধেই করতে করতে গিয়ে নিজের কাজে লেগে পড়লো। মনের আনন্দে এদিক ওদিক লাফাতে লাগলো। কখনো মুরগির পেছনে দৌড়াচ্ছে, তো কখনো ছাগল ছানা কোলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার নিজের মতো তাদের সাথে কথাও বলছে। যেন ঈদের আনন্দ লেগেছে ওর মাঝে। প্রহর কিছুক্ষণ সেটা দেখে আবার নিজের কাজে অগ্রসর হলো সে। প্রহর পাইপ লাগিয়ে ঘোড়া গুলোকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে।যদিও এসব কাজের জন্য অনেক লোক রাখা আছে। তবুও প্রহরের নিজের হাতে সব করতে ভালো লাগে। এক হাতে পাইপ ধরে আরেক হাতে ঘোড়ার গায়ে ব্রাস দিয়ে ঘষে দিচ্ছে। পাইপের পানি ছিটে প্রহরের শরীর ভিজে যাচ্ছে। টিশার্ট গায়ে লেপ্টে গিয়ে প্রহরের সুঠাম বডি দৃশ্যমান হয়ে যাচ্ছে। চুল ভিজে কপালে পড়ায় প্রহর সেগুলো হাত দিয়ে ব্রাস করে পেছনে ঢেলে দিচ্ছে।

এদিকে প্রহরের এই এট্রাক্ট্রিভ প্রদর্শন দেখে আরেকজনের মনে হাই হুতাশ উঠে গেছে। প্রহরের থেকে কিছুটা দূরে ছাগল ছানাকে কোলে নিয়ে, ছানাকে আদরের ছলে শুধু প্রহরকেই অবলোকন করে যাচ্ছে খুশি। চোরা চোখে লোলুভ দৃষ্টিতে প্রহরকে দেখতে দেখতে, ছাগল ছানার উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করে বললো।
–হায়,, কেউ তো একটু ঠেকাও তাকে। এতোটা হটনেস যে, স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর সেটা কি সে জানে না? সেতো পানিতেও আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে।মাই হটি কাউ বয়। দেখেছিস ক্যাটরিনা, আমার বয়ফ্রেন্ড কি হটি? না না তুই দেখিস না। তোর দুলাভাই হয়। দুলাভাইয়ের দিকে এভাবে তাকাতে নেই। পাপ হয় বুঝেছিস। তুই বরং তোর হবু বর সালমান ভাইকে দেখ। এই দেখ আমি তার নতুন ছবি নিয়ে এসেছি।

খুশি ওর ফোন বের করে সালমান খানের একটা ছবি বের করে দেখালো। ছানাটা হঠাৎ খুশির কোল থেকে লাফ দিয়ে নেমে ছুটে গেল। খুশি দুষ্টু হেসে বললো।
–হায় বেচারি হবু বরকে দেখে লজ্জা পেয়ে গেছে। এই এই শোন না?
খুশিও ছানার পেছন পেছন ছুটতে লাগলো।

কাজের ফাঁকে না চাইতেও অবাধ্য চোখ শুধু খুশির দিকেই যাচ্ছে প্রহরের। মেয়েটার এই প্রাণবন্ত, হাস্যোজ্জ্বল মুখ খানাই যেন প্রহরের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। খুশির থেকে আসা তপ্ত আবহে প্রহরের মাঝে কিছু যেন গলতে শুরু করেছে। কোন এক অদৃশ্য মধ্যাকর্ষন শক্তি ওকে চুম্বকের মতো খুশির পানে টানছে। প্রহর নিজের সর্বশক্তি নিজেকে ফিরিয়ে আনার যথাযথ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে বারবারই ব্যাহত হচ্ছে সে। মনে হচ্ছে যেন ওর মন মস্তিষ্ক ওর সাথেই বেইমানি করছে। সব হয়তো এই মেয়েটারই ষড়যন্ত্র। এর জন্যই আমার নিজের সবকিছু আমার সাথেই বিদ্রোহ করছে। প্রহর কোনরকমে মাথা ঝাকিয়ে নিজের কাজে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করলো।

রোজিনা বেগম বসে বসে ঘোরার জন্য ঘাস কাটছে। পাশেই খুশি বসে একটা খরগোশ ছানাকে নিয়ে আদর করছে।সে তার ওয়াদা অনুযায়ী আজ আর প্রহরের কাছে গিয়ে ওকে জ্বালাবে না। তাই খুশি শুধু পশুপাখি গুলোর সাথে আর এখানকার কর্মচারীদের সাথেই সময় কাটাচ্ছে। সে খরগোশ ছানাকে আদর করতে করতে রোজিনা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
–আচ্ছা রোজিনা সুন্দরী তুমি এখানে কতদিন ধরে আছ?

রোজিনা বেগম ঘাস কাটতে কাটতে বললো।
–সেতো মেলা বছরই হইলো। পিরাই দশ বছর তো হইলোই। এইহানে প্রথমে আমরা শুধু কেয়ার টেকারের কাজ করতাম। তবে প্রহর বাবা এইসব জীব জনার আনার পর থাইকা এইগুলার দেহাশোনা করি।

–তোমরা মানে? আর কে কে আছে?

–মানে আমি আর আমার হেই। আরও অনেক লোকজন আছে।

খুশি দুষ্টু হেসে বললো।
–আরেব্বাহ,, রোজিনার তো দেখছি আলমগীরও আছে। তাইলে তোমারই মজা রোজিনা সুন্দরী। এই খোলা ফার্মহাউসে রোজিনা আলমগীর খালি রোমাঞ্চ করে বেড়াও তাইনা?

রোজিনা বেগম লাজুক হেসে বললো।
–কি যে কন্না আফনে। আমগো কি হেই বয়স আছে নি?

খুশি বিজ্ঞ জ্ঞানীদের মতো বললো।
–আরে এজ ইস জাস্ট নাম্বার রোজিনা সুন্দরী। মন জওয়ান থাকলেই হলো।

খুশির কথায় রোজিনা সুন্দরী লজ্জায় লাল,নীল হয়ে গেল।

প্রহর বসে কবুতর গুলোকে দানা খাওয়াচ্ছে। ফাহিমও ওর সাথেই আছে। দুজনেই কবুতর গুলোকে দানা ছিটিয়ে দিচ্ছে। সব কবুতরগুলো ওদের সামনে জড়ো হয়ে দানা খাচ্ছে। তবে প্রহরের বেইমান চোখ দুটো আবারও ওর সাথে বিরোধীতা করতে লাগলো। নজরের তীর ঘুরেফিরে শুধু খুশিতেই বিঁধে যাচ্ছে। খুশি প্রাণবন্ত ভাবে নিজের কাজে মত্ত। সে মিউজিক সিস্টেমে #আয়ই রে খুশি গানটা ছেড়ে দিয়ে ছাগল আর কুকুর গুলোর সাথে নাচছে।মাঝে মধ্যে রোজিনা আর বাকি কর্মচারীদেরও টেনে নিয়ে নিজের নাচের সঙ্গী বানাচ্ছে।তারাও কোনরকমে হাত পা নাড়ছে।কখনো ফোন বের করে সবার সাথে সেলফি নিচ্ছে। এমনকি বেচারা পশুপাখি গুলোও বাদ যাচ্ছে না। খুশি ছাগল ছানার সাথে গাল ঠেকিয়ে ঠোঁট চোখা করে পাউট করে সেলফি নিচ্ছে। সাথে ছানাটার মুখটাও চোখা করে পাউটের মতো করে দিচ্ছে। কখনো আবার মাঠে যে পানি জমে ছিল সেগুলোর মাঝে লাফিয়ে লাফিয়ে আনন্দে কাঁদা ছিটাচ্ছে। লাফাতে লাফাতে আবার পিছলে কাঁদায় ঠাস করে পড়েও যাচ্ছে। নিজে পড়ে গিয়ে নিজেই আবার হাসছে।

খুশির এই মহান কৃতকার্য দেখে প্রহরের ঠোঁটে চলে এলো হাসির রেখা। ফাহিম সেটা দেখে স্মিথ হেঁসে বললো।
–দেখেছিস আমি বলেছিলাম না মেয়েটা ইউনিক? সি ইস স্পেশাল। দেখ সে আজ অসম্ভব সাধন করে দিলো।তোর মতো রোবটের মুখে হাসি ফুটিয়ে দিল।ভাবতে পারছিস এটা কতো বড়ো ব্যাপার?

আজ আর ফাহিমের কথায় রাগ হলোনা প্রহর। বরং খুশিকে পর্যবেক্ষণ করায় মনোনিবেশ করলো সে। আজ প্রথম প্রহর খুশিকে ভালো করে দেখছে। মেয়েটার উচ্চতা স্বাভাবিকই হবে। খুব লম্বাও না আবার খাটোও না। গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা না,উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। কিছুটা স্বর্ণের রঙ। চেহারায় নিস্পাপ পরিস্ফুটিতা ভাসমান। কেমন যেন অদ্ভুত এক মায়া আছে ওই মুখমণ্ডল জুড়ে। আর সবচেয়ে বেশি মায়ার সমুদ্র বইছে ওই ডাগর ডাগর আঁখি যুগলে। ওই চোখে বেশিক্ষণ তাকালে মনে হয় ওই মহাসমুদ্রে ডুবে যাবে সে। আজ না চাইতেও ফাহিমের কথাটা মানতে হচ্ছে প্রহরের। মেয়েটা সত্যিই ইউনিক। যেখানে আজকাল কার মেয়েরা এসব পশুপাখির ফার্মে আসলে নাক সিটকে কপালে তুলে নেয়। ফাহিম কয়েকবার ওর বন্ধুদের নিয়ে এসেছিল। তাদের মাঝে মেয়ে বন্ধুও ছিলো। তারা এসব পশুপাখির ধারে কাছেও যায়নি। দূর থেকেই নাক সিটকে চলে গেছে। সেখানে এই মেয়েটা ওদের সাথে এমন ভাবে মিশছে যেন,নিজের ভাই বোন। মেয়েটা সত্যিই যেন কোন প্রকৃতির রুপ। ওর মাঝে কোন কৃত্রিমতা নেই। প্রহর মেয়েটাকে কখনো অন্য সব মেয়েদের মতো আটা ময়দা মেখে সাজুগুজু করতে দেখেনি। সবসময় সিম্পল ভাবেই থাকে।

সব পর্যালোচনা শেষে প্রহরের মন মস্তিষ্ক এই রায় দিল যে,মেয়েটা সুন্দর। শুধু সুন্দর না।অসম্ভব সুন্দর আর মায়াবী। ফাহিম পাশ থেকে দুষ্টু হেসে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলো।
–এমন একটা মেয়ে আমাকে এভাবে এপ্রোচ করলে আমি কবেই হ্যাঁ বলে দিতাম। নিজেকে পরম সৌভাগ্য মনে করতাম।

ফাহিমের কথায় প্রহরের ঘোর কাটলো।মজা করে বললেও ফাহিমের কথাটা কেন যেন প্রহরের পছন্দ হলো না। কোথায় কিছু একটা বিঁধল ওর। প্রহর কিছু না বলে গলা খাঁকারি দিয়ে ওখান থেকে উঠে গেল। ওর মাঝে কেমন সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে ওর ঘোছাতে হবে। এভাবে ছন্নছাড়া হয়ে গেলে চলবে না।

প্রহরের যাওয়া দেখে ফাহিম হালকা হাসলো। বন্ধুর মনোভাব বুঝতে পারছে সে। দুষ্টু হেসে গেয়ে উঠলো।
♬ না না কারতে পেয়ার হায় তু কারগায়া কারগায়া
♬ ইউ আর ইন লাভ, ইউ আর ইন লাভ

চলবে…..

/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here