#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৫১
.
.
শেষ লাইনটি পড়েই তিহানের বুক ধক করে উঠল। এ কী পড়েছে সে! আদৌ কী এ লিখার সত্যতা আছে! আর যদি সত্যি হয়ও এই অবস্থায় নিদ্রা একা একা কী করছে? কীভাবে সামলাচ্ছে নিজেকে? বয়সও তো অল্প। ধ্যাৎ! কেন এই ডায়েরিটা আগে তার চোখে পড়েনি? আর কেনই বা সে বাড়ি থেকে আনা বইগুলো হাতিয়ে দেখেনি।
ভেবেই মাথা ঘুরাচ্ছে তিহানের। সেই সাথে প্রচুর পরিমানে রাগও হচ্ছে। তার ভেতরে যে এক ভয়ংকর অপরাধবোধের অনুশোচনা কাজ করছে।
বিছানায় বসে কপালে হাত দিয়ে নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছে তিহান। যে মেয়ে তার জন্য এতো পাগল, সেই মেয়েকে সে কী করে এতগুলো দিন কষ্ট দিতে পারলো! তাও আবার নিজের ব্যাক্তিগত সমস্যার জন্য। তার জীবনের সমস্যা দেখার বা ভোগ করার দায়ভার তো নিদ্রার না। তাহলে কেন সে এভাবে কষ্ট পাবে! ডায়েরির প্রতিটি পাতায় যেন ছিল তিহানের প্রতি নিদ্রার অপরিমাপ যোগ্য ভালোবাসার টান। যেটা কিনা এতগুলো দিনের জমানো তিহানের সংশয়গুলোকে ভেঙে চূড়মার করে, নতুন করে ভাবনার চালিকাশক্তি দিচ্ছে। নিদ্রার জন্য তিহানের মনে এতদিন চারভাগের একভাগ জায়গা থাকলেও সেই একভাগ যেন পৌছে গিয়েছে চারভাগেরও উপরে। তার সন্তান যে নিদ্রার গর্ভে!
ভেবেই বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল তিহান৷ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দেখে চারিপাশ যেন নীরবতার চাদরে ঢেকে আছে। শুধু মাঝে মাঝে দূর থেকে নাইট গার্ডের বাঁশির আওয়াজ আর কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ শোনা যাচ্ছে। বাহির থেকে চোখ ফিরিয়ে দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত ২:৪৩ মিনিট। এ সময় যে বাড়ির সামনে থেকে কোনো রিকশা পাওয়া যাবে না মেইন রোডে যাওয়ার জন্য। মেইন রোডে গেলে একটা না একটি গাড়ি পাওয়া যাবেই। তবে এই রাস্তাটাই তো সমস্যা। রিকশা করে গেলেই মিনিট বিশেক লেগে যায়। আর হেঁটে গেল কম করে হলেও ত্রিশ মিনিট লাগবে। কিন্তু এ কথা ভেবে যে তার বসে থাকা সম্ভব না, আর না ভোরের আলো ফোঁটা অবধি অপেক্ষা করা সম্ভব। তিহান এক মিনিটও দেরি না করে দ্রুত কাপড় চেঞ্জ করে মোবাইল, মানিব্যাগ আর নিদ্রার ডায়েরিটি একটি শপিং ব্যাগে নিয়ে ঘর তালা মেরে বেড়িয়ে গেল।
.
ভোরের আলো ফুটছে। চারিদিক সোনালী রোদের আলোয় ঝলমল ঝলমল করছে। সেই সোনালী রোদের মিষ্টি তাপ হসপিটালের জানালার গ্লাস ভেদ করে নিদ্রার চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় তার। ক্লান্ত মুখ নিয়ে টিপটিপ করে চোখ মেলতেই পাশে দেখতে পায় তার মা আইরিন বেগম আর তানহাকে। আর তাদের সামনেই ছোট্ট খাটে ঘুমিয়ে আছে তার নারী ছেড়া ধন। তিহানের চিহ্ন।
নিদ্রা খুব করে চাইছে উঠে বসে তার ছেলেকে কোলে নিতে। কিন্তু পারছে না, কাঁচা সেলাই যে ছিঁড়ে যাবে। তাই বেডে শুয়েই মৃদু গলায় বলল,
” আপু! আপু! ”
ঘুমের মাঝে নিদ্রার গলা শুনে ধরফরিয়ে উঠল তানহা। বলল,
” কিরে কষ্ট হচ্ছে? ব্যাথা করছে সেলাই? ”
” না আপু, আমি একদম ঠিক আছি। ”
” তাহলে এতো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়লি যে? শরীরটাতো তোর ক্লান্ত। এই সময় বেশি করে ঘুমনো প্রয়োজন। ”
” ঘুম ভেঙে গেলে কি জোর করে ঘুমানো যায় বলো। ”
” হুম, তাও ঠিক। ”
” আপু, একটু কষ্ট করে বাবুকে আমার বুকের উপর দিবে? আসলে এখন পর্যন্ত তো ওকে ছুঁয়ে দেখিনি তাই আর কি! ”
” তোর বাচ্চাকে তুই বুকে নিবে এতে আবার আসলে টাসলে কি? দ্বারা আমি এখনি তোর কোলে শুয়ে দিচ্ছি বাবুকে। ”
বলেই তানহা খুব যত্নসহকারে বাবুকে কোলে নিয়ে নিদ্রার বুকে শুয়ে দিল। বলল,
” তুই থাক আমি একটু বাহির থেকে আসছি। ”
” কোথায় যাবে আপু? ”
” এইতো এইখানেই বেশি দূরে না। ”
” আচ্ছা আপু। ”
” হুম, আর শোন তোর মাথার কাছে তোর মোবাইল রাখা আছে। কোনোকিছুর প্রয়োজন হলে কিংবা কোনো সমস্যা হলে আমায় কল করিস। ”
” তুমি চিন্তা করো না আপু। কোনো সমস্যা হলে আমি তোমায় জানাবো। ”
মুচকি হেসে তানহা বেড়িয়ে গেল কেবিন থেকে। এদিকে তানহা যেতেই নিদ্রা তার ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলো। এতদিন গর্ভে রাখার পর কোলে নেয়ার আনন্দই যেন অন্যরকম। যে আনন্দের সাথে পৃথিবীর অন্যকোনো আনন্দের তুলনা হয়না। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে চোখের জল ফেলে নিদ্রা মনে মনে বলল,
” নাই-বা আপনাকে নিজের করে পেলাম, আর নাই-বা আপনার ভালোবাসা পেলাম। তবে আপনার দেয়া যেই চিহ্নটি পেয়েছি এতেই আমি খুশি। অন্তত তার মুখ দেখে, তাকে বুকে জড়িয়ে বাকী জীবনটা তো পার করে যেতে পারব এই অনেক। ”
কথাগুলো মনে আওরাতেই চোখের জল ছেড়ে দিল নিদ্রা। এমনসময় তানহা কেবিনে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
” নিদ্রা…..নিদ্রা..! ”
তানহাকে এরকম হাঁপাতে দেখে নিদ্রা বলল,
” কি হয়েছে আপু? তুমি এভাবে হাঁপাচ্ছো কেন? ”
তানহা কিছু বলতে নেবে তার আগেই অতল ও তিহান একপ্রকার দৌড়ে কেবিনে ঢুকলো। আর তাদের পেছন পেছন আসছে অতলের বাবা-মা। এতদিন পর ছোট ছেলের হদিস পেয়েছে যে, এখন কি আর ঘরে মন টিকবে! তাইতো বড় ছেলে অতলের পিছু পিছু তারাও ছুটেছে।
তিহান কেবিনে পা রাখতেই চোখ দুটো যেন থমকে যায়। এ যে এক মনোমুগ্ধকর অপরূপ দৃশ্য। এ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে যে যুগের পর যুগ পার করে দিতে পারবে তিহান। ছোট্ট নিদ্রার কোলে যে আরেক ছোট্ট তিহান প্রশান্তির ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তিহান মুচকি হেসে মনে মনে বলল,
” নিদ্রা বাচ্চা বয়সের হলেও মায়ের মমতা, অনুভূতিগুলো যেন পূর্ণ বয়স্ক মায়ের মতোই প্রকাশ করছে। ”
নিদ্রা হা হয়ে তাকিয়ে আছে তিহানের দিকে। সে কী আদৌ সত্যি দেখছে না-কি চোখের ভুল বুঝতে পারছে না। যার ফলে তার চোখেমুখে নেই কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। না আছে মুখে হাসি, না আছে চোখে জল। টোটালি যেন একটা রোবট শুয়ে আছে বিছানা জুড়ে।
তিহান আগ পিছ না ভেবে এগুলো নিদ্রার দিকে। আস্তে করে ছেলেকে নিদ্রার বুক থেকে নিয়ে নিজের বুকে মিশিয়ে ধরল।
এদিকে একচুল পরিমাণ তিহানের হাতের ছোঁয়া নিদ্রার হাতে পড়তেই সারা শরীর কেঁপে ওঠে নিদ্রার। চোখের কোণ বেয়ে জল বেড়িয়ে আসতে চাইলেও নিদ্রা নিজেকে সামাল দিয়ে মনে মনে বলল,
” ফিরে এসেছে। হ্যাঁ, সে ফিরেছে তবে আমার জন্য নয়, ফিরেছে সে তার সন্তানের জন্য। তার রক্তের জন্য, তার ভবিষ্যতের জন্য। ”
ভেবেই মুখ ঘুরিয়ে নিল নিদ্রা তিহানের দিক থেকে। যেটা কি-না খুব সহজেই তিহান বুঝতে পারল। যার ফলে তিহান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার ঘুমন্ত নিষ্পাপ রাজপুত্রের মুখখানির দিকে।
.
আটদিনের ছেলে নিহানকে বুকে জড়িয়ে তিহান বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটছে আর তার অনুপস্থিতিতে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা অতলের মুখ থেকে শুনে চোখের জল ফেলছে। অতলের কথা শেষ হতে অতল চোখের জল মুছতে লাগল। তিহান বলল,
” কেঁদো না ভাইয়া। কাঁদলেতো আর আমাদের ফাতেমা ফিরে আসবে না।উল্টো তোমরা দুজন কষ্ট পাবে। জানো ভাইয়া, কিছু কিছু ঘটনা আকস্মিকভাবে ঘটে থাকে। যার পেছনে কারো কোনো হাত থাকে না কেবল আল্লাহ পাক ছাড়া। আজ যদি ভাবীর দশমাস হতো তারপর এই ঘটনাটি ঘটতো তোমরা নিজেদের সারাজীবনেও ক্ষমা করতে পারতে না। যে কেন দশমাস হতেই হসপিটালে নিয়ে ভাবীকে মুক্ত করলে না? এখন কিন্তু সেই দোষারোপ নিজেদের করতে পারবে না তোমরা। কারণ ভাবীর তো ডেলিভারীর ডেট-ই আসেনি, তাহলে মুক্ত করবে কীভাবে? তাহলে তুমি নিজেই ভেবে দেখো এখানে কি তোমাদের বিন্দুমাত্র দোষ আছে? ”
অতল নাক টেনে বলল,
” কিছুকিছু ক্ষেত্রে যে দোষ গুনের উপর নির্ভর করা যায় না তিহান। তুই জানিস মাঝরাতে যখন তানহার চুপিচুপি কান্নার আওয়াজ পাই আমার বুকের ভেতর কেমন করে? ”
তিহান কিছু বলতে নেবে ঠিক সেসময় তানহা এসে বলল,
” তোমাদের দু’ভাইয়ের কী মাথা ঠিক আছে নাকি পুরাই গিয়েছে? আশেপাশে তাকিয়ে দেখোতো বেলা কত গড়িয়েছে। মিনিট দশেক পরেই মাগরিবের আযান দিবে। এই ভর সন্ধ্যে বেলা তোমরা নিহানকে নিয়ে বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটছ কাজটা কেমন হচ্ছে? আর নিহানের তো ১ মাসও পেরোয়নি এখনো। যদি কোনো খারাপ বাতাস লেগে যায়! ”
” আরে কিচ্ছু হবে না, তুমি ওসব নিয়ে ভেবো না। আর নিহান তো একা নয়, আমরা তো আছি। ”
” একা থাকার বয়সও কিন্তু এখনো নিহানের হয়নি। ”
” ও সরি। ”
” সে যাই হোক, তিহান ভাইয়া আপনি নিহানকে নিয়ে ভেতরে যান। নিদ্রা অপেক্ষা করছে নিহানকে খাওয়ানোর জন্য। ”
তিহান মুচকি হাসি দিয়ে চলে যেতে নিলেও আবার পিছু ফিরে তাকিয়ে বলল,
” ভাবী, আপনি আমায় ছোট ভাই হিসেবে শুধু নাম ধরে ডাকতে পারেন। আর আমায় আপনি আজ্ঞা করবেন না, তুমি করেই বলবেন। ”
বলেই তিহান চলে গেল বাড়ির ভেতরের দিকে।
এদিকে তিহানের এই একটি কথা শুনে তানহা ও অতলের মন জুড়ে বয়ে গেল এক প্রশান্তিময় হাওয়া। তবে কেউ সেই প্রশান্তিময় হাওয়াকে মেলে ধরল না একে অপরের সামনে। দুজন দুজনের মুখের দিক তাকিয়ে প্রাপ্তিময় হাসি দিয়ে রইলো কিছুটা সময়। তারপর অতল বলল,
” সবার এতো খেয়াল যে রাখো, নিজের খেয়ালটা কবে রাখতে শিখবে শুনি? ”
” আমার খেয়াল রাখার জন্য তো তুমিই আছো। আমি খেয়াল রেখে কী করব বলতো। যার কাছে তোমার মতো বর রয়েছে তার বুঝি নিজের খেয়াল রাখার প্রয়োজন আছে! উহু…কোনো প্রয়োজন নেই।”
” দূর থেকে খুব তো মায়া ধরানো কথা বলতে জানো। কাছে এলেই চুপসে যাও কেন, এভাবে মায়া মায়া কথা বলতে পারো না? ”
” বদ্ধ ঘরে তোমার চোখে চোখ রাখতেই না, আমি সবকিছু ভুলে যাই। মায়া ধরানো কথা তো দূরে থাক স্বাভাবিক কথাই মুখ দিয়ে বের হতে চায় না।”
” বউটা আমায় এতো ভালোবাসে? ”
” কেন, জানো না বুঝি! ”
” জানি… তারপরও বললাম আর কি…”
” ঢং… সবকিছুতে ঢং। ”
“বউয়ের সাথে ঢং করব না তো পাশের বাড়ির মেয়ের সাথে ঢং করব না-কি! দুনিয়ার যত ঢং রঙ তো বউয়ের সাথেই করতে হয়।হা… হা… ”
” আর দাঁত কেলাতে হবে না। চারিদিকে আযান পড়ছে ঘরে চলো, নামায পড়তে হবে।”
“না, আমি ঘরে যাবো না। তুমি ঘরের কাজ শেষ হলে নামাযে গিয়ে দাঁড়াও। আমি মসজিদে গেলাম জামাত শুরু হয়ে যাবে। ”
” ও আচ্ছা যাও কিন্তু…”
” কিন্তু কি? ”
” না থাক কিছু না, তুমি নামাযে যাও আমি ঘরে চললাম। ”
” আগে বলো কী বলতে চেয়েছিলে! ”
তানহা গলা খাকড়িয়ে বলল,
” নামায পড়ে আসার সময় একটি প্রেগন্যান্সির কিট নিয়ে এসো। ”
বলেই তানহা দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল।
.
নিহানকে ঘুম পারিয়ে নিহানের পাশেই শুয়ে আছে নিদ্রা। চোখটা প্রায় লেগে এসেছিল তার। এমন সময় তিহান এসে বলল,
” নিদ্রা, একটু বেলকনিতে আসবে? ”
নিদ্রা মুখে কিছু না বলে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল বেলকনির দিকে।
তিহান বলল,
.
.
চলবে…