#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৮
.
.
অতল আর কোনো কথা বলল না। হয়তো তার বাবার পাহাড় সমান কষ্টের পরিমাপ করার চেষ্টা করছে কিংবা তার বলা কথাগুলোর উত্তর খুঁজে বেরাচ্ছে।
ভাবনা চিন্তার মাঝেই বেশখানিকটা সময় পাড় হয়ে গেল কিন্তু এখনো তিহানের কোনো খবর জানতে পারেনি তারা। চতুর্দিকের ঝামেলা মিলিয়ে এক অসহ্য যন্ত্রণা বুকের মাঝে বয়ে বেড়াচ্ছে অতল। একদিকে নিজের ছোট ভাইয়ের জীবন-মরণ লড়াই। অন্যদিকে বাবার আর্তনাদ, মায়ের অসুস্থতা আর..তানহার ব্যবহার। সবমিলিয়ে যেন পাগল পাগল লাগছে অতলের। কেন এতো দায়িত্ব তার? কী এমন দায় পড়েছে সবাইকে সান্ত্বনা দেয়ার, ভালো রাখার। সে ঘরের বড় ছেলে বলেই কি তার এতো দায়? কিন্তু সেও যে মানুষ তারও যে কষ্ট হয় কারো থেকে সান্ত্বনার পাবার প্রয়োজন হয় সেটা কেউ কেন বুঝে না? তিহান…সে-তো হসপিটালের বেডে শুয়ে জীবন যুদ্ধে লড়াইয়ে কাতরাচ্ছে। আর অতল সে হসপিটালের বেডে না শুয়েও জীবন যুদ্ধে লড়াইয়ে কাতরাচ্ছে। কার কষ্টটা বেশি? যে সেন্সলেস অবস্থায় যুদ্ধ করছে নাকি যে সবার মাঝে দাঁড়িয়ে হিতাহিত জ্ঞানসহ যুদ্ধ করছে?
অতলের মনের মাঝে ভীষণভাবে নাড়া দিচ্ছে এই কথাগুলো। আর বুকের ভেতর থেকে আসছে এক একটা দীর্ঘশ্বাস।
এদিকে আনিস খন্দকার ছোট ছেলে তিহানের সুস্থ জীবনের অপেক্ষা করলেও ভুলে যায়নি পাশে তার আরও একটি ছেলে রয়েছে। যে হাজারো কষ্টের মাঝে নিজের ব্যাথাকে প্রকাশ করতে পারে না, পারে না নিজের কষ্টকে মেলে ধরতে সবার সামনে। কেবল দীর্ঘশ্বাসই হয় তার সে সময়ের সাথী। তাই নিজের অস্থিরতাকে কিছুটা পাশে রেখে একবুক দম নিয়ে এগুলো বড় ছেলে অতলের কাছে।
এদিকে মাথায় কারো হাতের স্পর্শ অনুভূত হলে চোখ তুলে তাকায় অতল। আর দেখতে পায় তার বাবাকে। যার হাতের স্পর্শে , চোখের ভাষায় অতলকে বলে দিচ্ছে, ” আমি আছি তো! তোর বাবা। কিসের এতো ভয়? ভয় করিস না। দেখিস বাবা সব ঠিক করে দিব। ”
বাবার মুখে কিছু না শুনেও একবুক সাহস
যেন অতল পেয়ে গেল। সেই সাথে পেয়ে গেল এক ভরসা স্থান। এমন সময় ওটির দরজা খুলতেই অতল ও বাবা দৌঁড়ে গেল। ডক্টরের সামনে দাঁড়িয়ে অতল বলল,
” তিহানের..মানে রোগীর কি অবস্থা? সুস্থ আছে তো?ওর কিছু হয়নি তো? ”
ডক্টর বললেন,
” দেখুন মিঃ…”
” অতল…অতল খন্দকার। ”
” তো মিঃ অতল, আমরা চাইলেও অনেক কিছু করতে পারি না। কিংবা বলতে পারেন আমাদের সাধ্যের মাঝে থাকে না। তো সেরকমই এখানে হয়েছে। ”
” কি হয়েছে? আপনি খোলাখুলি বলুন প্লিজ।” ভ্রু কুচকে বলল অতল।
” হুম খোলাখুলি বলছি। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি আপনার ভাইয়ের শরীর থেকে বিষের প্রতিক্রিয়া ধ্বংস করতে। ”
” আপনারা চেষ্টা করেছেন তবে সফল হোন নি। তাই তো? ”
” আহা! আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? আমার কথাগুলো শেষ করতে দিন। ”
” জ্বি বলুন। ”
” আমরা চেষ্টা করেছি আপনার ভাইয়ের শরীর বিষ মুক্ত করতে তবে তার বিষক্রিয়া এতটাই দ্রুত ছড়িয়ে ছিল যে, এখনো আমরা আশংকামুক্ত হতে পারছি না। বেশ সময় লাগতে পারে। তাই উনার জ্ঞান ফেরার আগ পর্যন্ত আমরা কিছুই শিউর দিয়ে বলতে পারছি না। শুধু একমাত্র উনার জ্ঞান ফেরার উপরই সব নির্ভর করছে। ”
“জ্ঞান কি ফিরবে ডক্টর?”
“আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করেছি বাকিটা উপরওয়ালার হাতে।”
কথাটি বলেই ডক্টর তার চেম্বারে চলে গেল। কেবল দাঁড়িয়ে রইলো অতল আর বাবা। অতল মুখে কিছু প্রকাশ না করলেও ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। আর বাবা আনিস খন্দকার সেতো নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে ডক্টরের কথা শুনে।
.
সুন্দরী একটা মেয়ে এই মাঝরাতে মেইন রোড দিয়ে এলোমেলো চুল নিয়ে পাগলের মতো কাঁদছে আর দৌঁড়াচ্ছে। এই দিশেহারা মেয়েটি যে অন্য কেউ নয়, এই মেয়েটিই তানহা। তিহানের ভালোবাসা আর অতলের স্ত্রী। আশেপাশের মানুষজন হা হয়ে তাকিয়ে আছে তানহার দিকে কিন্তু সেদিকে তার বিন্দুমাত্র হুশ নেই। তার লক্ষ একটাই কখন সে হসপিটাল পৌঁছাবে আর কখন তার তিহানকে সে নিজের চোখে দেখবে।
তানহা তিহানকে দেখার জন্য এতটাই উতলা হয়ে গিয়েছিল যে, গাড়ি তো দূরে থাক একটি রিকশা পর্যন্ত নেয়নি। দৌড়ে দৌড়েই হসপিটাল খুঁজে বেড়াচ্ছে। এখন এই মানুষকে জিজ্ঞেস করেছে তো তখন অন্য মানুষকে এভাবে করেই সে হসপিটালের পথ ধরে এসেছে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একসময় তার কাঙ্ক্ষিত হসপিটালের সামনে এসে দাঁড়াতেই তার বুকের মাঝখানে যেন ধুকপুক করতে লাগলো। এতক্ষণ মনের জোর নিয়ে এই পর্যন্ত দৌঁড়ে আসলেও এই মুহূর্তে তার পা আর চলছে না। পা দুটো যেন একবারে অসাড় হয়ে আসছে। সেই সাথে থরথর করেও কাঁপছে। যদি তার তিহানের কোনো বাজে খবর শুনতে হয় সে ভয়ে! তবুও আল্লাহর নাম নিয়ে চোখ মুখ মুছে নাক টানতে টানতে হসপিটালের ভেতর যায় সে। আর খুঁজতে লাগে তিহানের ফ্লোরটি। এক তলা, দু’তলা এভাবে তিন তলা অবধি তন্নতন্ন করে খুঁজেছে তানহা। কিন্তু না, কোত্থাও সে পায় নি। একপর্যায়ে তানহা নিরাশ হয়ে যায়।ভেঙে পড়ে আদৌ সঠিক হসপিটালে এসেছে কি না সে ভয়ে!
তানহা ধাপ করে বসে পড়ে হসপিটালের ৩য় তলার লবির মেঝেতে। আর চোখের জল অনবরত ফেলতে লাগে কিন্তু সেসময় তার হারানো ভরসা ফিরে পায় এক পুরুষ কন্ঠের আওয়াজ শুনে। যে আওয়াজটি খুব কাছ থেকে না আসলেও বেশ দূর থেকেও আসছে না। চোখের জল মুছে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো তানহা। আর পেছনে ফিরে দেখল ৪র্থ তলা থেকে নার্সেরের সাথে কথা বলতে বলতে অতল নিচে নেমে আসছে। তাই তানহা সময় নষ্ট না করে দৌঁড়ে যায় অতলের কাছে।
এদিকে অতল এতো রাতে তানহাকে এই অবস্থায় তাও হসপিটালে দেখে পুরো শকড হয়ে যায়। অতল তার চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। আর বিশ্বাস করবেই বা কি করে! এই মুহুর্তে তার সামনে যে তানহা দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সাথে যে তার বিয়ে করা বউ তানহাকে একদমই মিলাতে পারছে। এ দু’য়ের মাঝে যেন অনেক ব্যবধান। পুরোই আকাশ পাতাল তফাৎ যাকে বলে।
তানহার এ বিধ্বস্ত মুখটা দেখে অতলের অন্তরের অন্তস্থের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠলো। এক অজানা ভয় যেন অতলকে ঝেঁকে ধরেছে। তবে অতল বেশ বুঝতে পারছে তানহার এ বিধ্বস্ত মুখ তাকে কি যেন বলতে চাচ্ছে! তবে কোনো এক দ্বিধা তাকে আঁকড়ে ধরছে তাই মুখ ফুঁটে কিছুই বলতে পারছে না। অতল নিজেকে বেশ খানিকটা শক্ত হয়ে শান্ত গলায় তানহাকে বলল,
” এতো রাতে তুমি এখানে! কে নিয়ে এসেছে তোমায়? মিরাজ কাকা! ”
তানহা কী বলবে বুঝতে পারছে না। তারপরও চোখ জোড়া বন্ধ করে বলল,
” তিহান…আমি তিহানকে দেখতে এসেছি। ”
তানহার মুখে তিহানের নামটি শুনে অতল চমকে গেল! তার চেয়েও বেশি চমকালো তানহার মুখে তিহানের নামটি বলার ধরন দেখে। তানহা নামটি খুব সহজ ভাবেই বলেছে তবে মনে হচ্ছে,এর পেছনে লুকিয়ে আছে হাজারো না বলা কথা। লুকিয়ে আছে কিছু না বহুত দীর্ঘশ্বাস।
অতল কিছুটা বিষ্ময়কর ভাবে বলল,
” তিহান ! তুমি চেনো তিহানকে? ”
সন্ধ্যা আমতা আমতা করে বলল,
” না মানে…. আমি কী করে চিনব। মাত্র কিছুক্ষণ আগেই তো আপনাদের বাড়ি এলাম। এর মাঝ তার সাথে তো দেখাও হয়নি। তাহলে কি তাকে আমার চিনার কথা?”
” তা ঠিক। তবে… তোমায় কেমন যেন অন্যরকম দেখাচ্ছে তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
” অন্যরকম দেখানোটাই কি স্বাভাবিক নয়? নতুন জীবন, নতুন ঘর, নতুন সংসারে কিছুক্ষণ আগেই পা রেখেছি। ঘন্টাখানেকও হয়নি তারমাঝেই এরকম একটি দূর্ঘটনা। মানুষ শুনলে কি বলবে? আর বললেও আপনাদের বলবে না বলবে আমাকে। ”
” তোমাকে আবার কি বলবে? ” ভ্রু কুচকে বলল অতল।
” তেমন কিছু না শুধু বলবে অপয়া। ”
” তোমার মাথা ঠিক আছে তানহা ? আমরা ১৯৬০ সালে বাস করি না, ২০১৯ সালে বাস করি। এই যুগে এসব বলার মানুষ খুবই কম। ”
” তবুও যাদের বলার তারা ঠিকই বলবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমরা মানুষ। তাই মানুষ হয়ে মানুষের বিপদে আসব না এরকম শিক্ষা আমি পাইনি। ”
” তবে এতো রাতে এ শিক্ষাটা প্রয়োগ না করলেও পারতে। ” কিছুটা রাগী স্বরে বলল অতল।
অতলের কথা শেষ হওয়ার আগেই অতলের ফোন বেজে উঠল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে বাড়ি থেকে মিরাজ কাকার ফোন। রিসিভ করতেই মিরাজ কাকা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
” হ্যালো। অতল বাবা! ”
” হ্যাঁ মিরাজ কাকা বলুন। আর আপনার ভয়েস এরকম শোনাচ্ছে কেন? মা ঠিক আছে তো? ”
” হ্যাঁ। ভাবী ঠিক আছে। তবে….”
” তবে কি? ”
” তুমি নতুন বউকে রেখে গিয়েছিলে ভাবীকে সামলাতে। ভাবীকে কোথাও যেতে না দিতে। কিন্তু নতুন বউ নিজেই হুট করে যেন কোথায় দৌঁড়ে চলে গেল। আশেপাশে অনেক খুঁজেছি কিন্তু কোত্থাও খুঁজে পাচ্ছি না। ”
” তুমি নতুন বউয়ের জন্য ভেবো না। সে এখন আমার কাছেই আছে। ”
” তোমার কাছে! ”
” হুম, আমার কাছে। এখন ফোন রাখছি। আর মায়ের দিকে খেয়াল রেখো।”
” আচ্ছা। ”
ফোন রেখে তানহার দিকে তাকালো অতল। তানহার মাঝে অস্থিরতা বিরাজ করছে কি না দেখার জন্য। কিন্তু না, তানহা একেবারেই শান্ত। কিছুক্ষণ আগের মতো অস্থিরতার ছাপ এখন আর তার মুখ জুড়ে দেখা যাচ্ছে না। তাই অতল মনে মনে ভাবল,
” হয়তো সে নিজেই একটু বেশি ভেবে ফেলেছিল। তা না হলে মুহূর্তের মাঝেই তো কারো মাইন্ড চেঞ্জ হওয়ার কথা না! হয়তো তানহা মেয়ে টাই এরকম! কারো দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে পারে না। আর তিহান তো সে জায়গায় তানহার আপন দেবর। আবার ছোট ভাইও বলা যায়। তাহলে তার কষ্ট কিভাবে সহ্য করবে? তাই হয়তো নিজেকে সামলাতে না পেরে এই অবধি চলে এসেছে! ”
কথাগুলো ভেবে অতল নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। আর যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক করে তানহা কে বলল,
” এদিকে এসে একটু বসো।তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ”
” না না, আমি ঠিক আছি। আপনি অযথা এই সময়ে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হবেন না। ”
” তোমাকে বলেছি এদিকে আসতে, এসো।”
কথাটুকু বলেই তানহার হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে নিজেও তানহার পাশে বসল। হাতটি ছেড়ে সোজা হয়ে বসে বলল,
” এতো রাত করে যে একা বের হয়েছ ভয় করেনি? তারউপর এদিকের কিছু তো তুমি চেনোও না। যদি কোনো বিপদ হয়ে যেতো! ”
” আসলে বিপদের কথা শুনে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। তাই আর কি… ”
.
.
চলবে….