অন্তরালের কথা পর্ব ৯

#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৯
.
.
” আচ্ছা, বাদ দাও। তবে এরকম ভুল আর কখনো করো না। দিন কাল যা পড়েছে! কোথা থেকে কী হয়েছে বুঝা বড্ড দায়। ”
” জ্বি আচ্ছা। ”
পাশাপাশি বসে রয়েছে দু’জন মানুষ। কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নেই। তানহা মনে মনে ভাবছে,
” এতো কিছুর পরেও সে কি করে স্বাভাবিক আছে? কিভাবে পারছে তিহানের এতটা কাছে এসেও ওর কাছে না গিয়ে এখানে বসে থাকতে? আচ্ছা, মেয়েরা কি তাহলে সত্যিই সব পারে? তা নাহলে যে তানহা এখানে বসে থাকতে পারতো না। আগের মতো ছুটে যেত তিহানের কাছে আর নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরত পরম ভালোবাসা দিয়ে কিন্তু যেটা এখন সে পারছে না। এভাবেই দিন দিন পারার তালিকাটা হয়তো ভারী হতে থাকবে। অপরদিকে না পারার তালিকাটা নিঃস্ব পড়ে রবে। তবে এটা শুধু সাংসারিক ক্ষেত্রে। যেখানে তার কাছে নিজের ইচ্ছার কোনো প্রাধান্য নেই। সবকিছুই করতে হবে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তবে তার ব্যাক্তিগত জীবনে না। তার ব্যাক্তিগত জীবন যে পুরোই শূন্য। সেখানে যে না পারার তালিকাটাই ভারী। ”
কথাগুলো ভেবেই ভারী নিঃশ্বাস বয়ে গেল তানহার বুক জুড়ে।
তানহা নিজের অজান্তেই মুখ ফসকে অতলকে বলে ফেলল,
” তিহানকে কি একটিবার দেখা যাবে? ”
” আমার জানা মতে সম্ভব না। কারণ ওর এখনো জ্ঞান ফেরেনি। তাই বিপদ টাও কমেনি। এখন এই মুহুর্তে ওকে দেখতে অনুমতি দেবে কি-না জানি না।
“একবার অনুরোধ করে দেখতে পারবেন?”
কথাটি বলেই তানহার হুশ ফিরল। তারপর ব্যাপারটাকে সামাল দিতে বলল,
” আসলে মা বাসায় একা তো তাই বলছিলাম। যদি একবার দেখতে দেয় তাহলে আমি এক ঝলক দেখে না-হয় বাড়ি ফিরে যাবো। ”
” হুম, কথাটি ভুল বলোনি। আচ্ছা দাঁড়াও দেখি কিছু করতে পারি কি-না! ”
ডক্টরকে অনেক অনুরোধ করে অতল মাত্র পারমিশন পেল ভেতরে যাবার। তবে ডক্টর একজনকে অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু অতলের সেই পারমিশন ভালো লাগেনি। তাই নার্সের হাতে ৫০০ টাকা দিয়ে তানহার সাথে অতলও ঢুকেছে তিহানের কেবিনে।
এদিকে তানহা কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই বুক ফেটে যাচ্ছিল। এরকম দিন ও কি তার দেখার ছিল!
কথাটি ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল তানহা।
যত সামনে এগুচ্ছে ততই যেন তানহার শরীর অবস হয়ে আসছে। মাথা বেয়ে চিকন ঘাম ঝড়ছে। হাত পা থরথর করে কাঁপছে। আর চোখের জল তো উপচে পড়ার উপক্রম। অতল পাশে না থাকলে তানহা কেঁদে নিজের মনকে কিছুটা হালকা করতে পারতো কিন্তু যেটা এখন সে পারছে না। আর তাই হয়তো তানহার এতো বেশি কষ্ট হচ্ছে। কারণ নীরবতার মাঝে যে কষ্টের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
এদিকে অতল তানহাকে অন্যমনস্ক দেখে বলল,
” তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে কিংবা কোনো কারণে অস্থির তুমি? ”
” হুম! না মানে..আসলে… শরীরটা একটু দূর্বল লাগছে এই আর কি ! ”
” ওহ্! তাহলে তো তোমার বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নেয়া দরকার। ”
” হুম, তাই করতে হবে। আপনার ভাইকে দেখেই চলে যাবো আর দেরি করবো না।”
কথাটি বলেই তানহা তাকালো বেডে শুয়ে থাকা এক বিশাল দেহের মানবের দিকে। অর্থাৎ তার তিহানের দিকে। চোখ দুটো যেন তার আটকে রয়েছে। এরকম পার্সোনালিটির ছেলেরও এ হাল হতে পারে বুঝতে পারেনি তানহা। তার কান্নায় বুক ফেটে আসছে কিন্তু সে কান্না করতে পারছে না। পাথর হয়ে আছে সে। যাকে বলে ” অতি শোকে পাথর হওয়া। ”
তবে তানহা খুব করে চাচ্ছে তিহানের হাতটি একটি বারের জন্য স্পর্শ করতে কিন্তু অতলের জন্য পারছে না। অতল যে তার একেবারে সাথেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। কী করে ধরবে সে তিহানের হাত?
এদিকে অতল স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তানহার দিকে। আর ভাবছে,
” একটি মেয়ে মানুষের মাঝে আল্লাহ কত গুনই না দিয়ে থাকে! তা না-হলে তানহার কি আজ এখানে থাকার কথা! কখনোই না। চার দেয়ালের মাঝেই বধূ বেশে বসে থাকার কথা। আজই সে এসেছে এ বাড়ির বউ হয়ে। কাউকেই ঠিক মতো চিনেও না। এমনকি যার হাত ধরে এসেছে অর্থাৎ তাকেও চিনে না। তারপরও কত সহজেই না আপন করে নিয়েছে সবাইকে। এমনকি যেই তিহানকে সে চোখে দেখেনি তাকেও। তাই তো তিহানের বিপদ শুনে ছুটে চলে এসেছে এখানে। এইভাবে আপন করে নেওয়াটাই কি মেয়েদের সবচেয়ে বড় গুনের মাঝে একটি না! তবে এই গুনটাই যে সব মেয়ের মাঝে থাকে না। বর্তমানের যুগে খুব কম সংখ্যক মেয়ে আছে যাদের মাঝেই এই ব্যাপারটি লক্ষ করা যায়। তার ভাগ্য বেশ ভালো তাই তো এরকম মন মানসিকতার একজন মানুষকে সে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে।”
মনের মাঝে কথাগুলো আওরাতেই মুচকি হাসলো অতল।
অতল একহাত দিয়ে নিজের চুলগুলো নাড়তে নাড়তে বলল,
” হয়েছে দেখা ? ”
” হুম। ” শান্ত গলায় বলল তানহা।
” তাহলে চলো। কিছুক্ষণ পরেই ডক্টর রাউন্ড দিতে আসবে। এসে যদি দেখে দুজন কেবিনে বেশ রাগারাগি করবে। ”
” হুম। ”
” এসো তাহলে। ”
তানহা আর কিছু বলল না। কেবল মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বোধক সম্মতি জানালো। আর ভাবল,
” তিহানকে ছুঁয়ে দেখা হলো না তার। সময় যে শেষ। আর হয়তো ছোঁয়া হবেও না। ”
কথাটুকু ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল তানহা। ঠিক সেই মুহূর্তে অতল বলল,
” তোমার ওড়না…. ”
তানহার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে অতল আবারও বলল,
” তোমার ওড়না বেডের ওই বারতি অংশ টার সাথে লেগে আছে। টান দিলেই ওড়না ছিরে যাবে। ”
” ওহ্! ”
” হুম, দাঁড়াও আমি ঠিক করে দিচ্ছি। ”
” না, না লাগবে না। আমি নিজেই ছাড়িয়ে নিতে পারবো। ”
” আচ্ছা। ”
তানহা ওড়না ছাড়ানোর জন্য বেডের দিকে ঝুঁকতেই তার মন যেন খুশিতে ভরে উঠলো। মনে মনে যে আল্লাহ কে কত শুকরিয়া জানাচ্ছে সেটা কেবল তানহাই জানে।
কারণ ওড়নার পাশেই যে তিহানের হাত ঝুলে আছে। বেড থেকে ওড়না ছাড়িয়ে নেয়ার বাহানায় না’হয় তিহানের হাত টুকুও সোজা করে দেবে। এতে তিহানের হাতও সোজা ভাবে রাখা হবে আর তার তিহানকে ছুঁয়ে দেবার বাসনাও পূরণ হবে।এদিকে অতলও সন্দেহ করবে না।
তানহা খানিকটা ঝুঁকে নিজের ওড়না ছাড়িয়ে তারপর তিহানের হাত আলতো করে স্পর্শের পরিবর্তে শক্ত করে ধরে হাতটিকে সোজা করে দিল। যদি সে এই হাত আর কোনোদিন ধরতে না পায় সে ভয়ে! তিহানের হাতটি তার ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না, তারপরও ছাড়তে হলো। তানহা যে বাস্তবতার কাছে দায়বদ্ধ।
দুটি হাত আলাদা হতেই তানহার চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। তবে এ জলের স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ রইলো না। একদিক দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তেই অন্যদিক দিয়ে তানহা মুছে ফেলল। পুরো অনুভূতি টাই রয়ে গেল অতলের দৃষ্টির অগোচরে।
তানহাকে সোজা হতে দেখে অতল বলল,
” এবার তাহলে যাওয়া যাক! ”
” কোথায়? ”
” কোথায় আবার বাড়িতে। ”
” আপনি এখন বাড়ি চলে গেলে তিহানকে মানে..উনাকে দেখবে কে? ” ভ্রু কুচকে বলল কথাটি তানহা।
” তাহলে কি তোমায় একা ছেড়ে দিব? ”
” সমস্যা তো দেখছি না। এসেছিলাম তো একা না’হয় যাবও একা। আমায় নিয়ে ভাববেন না। আমি ঠিক চলে যেতে পারব।”
” প্রথমত, তোমায় এতো রাতে আমি কখনোই ছাড়বো না। দ্বিতীয়ত, তোমার সমস্যা না থাকলেও আমার আছে। আর তৃতীয়ত, তোমায় নিয়ে না ভাবলে আমার ভাবার আর কোনো অপশনও নেই। তারউপর নিজের বউকে নিয়ে না ভাবলে কাকে নিয়ে ভাববো? ”
অতলের মুখে “নিজের বউ” কথাটি শুনে তানহার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। এই শব্দটি যে তার কাছে কত পরিচিত একমাত্র সেই জানে। বিগত কয়েক বছরে সে এই শব্দটি কত বারই না শুনেছে তিহানের মুখে। গুনে দেখলে হয়তো হিসাবেও উলোটপালোট হবে।
এদিকে তানহাকে নীরব থাকতে দেখে অতল বলল,
” কোথায় হারিয়ে গেলে? ”
” না কিছু না। ”
” কী না বলছ? আমি তো না শুনার মতো কোনো প্রশ্নই করিনি! ”
” ওহ্! আচ্ছা।”
” হুম, এবার এসো। ”
” জ্বি। ”
অতলের সাথে সাথে তানহাও চলে যাচ্ছে। কিন্তু একটি বার ফিরে তাকাতে পারছে না তার তিহানের দিকে। অন্যের বউ বলে কথা! ভেতরে ভেতরে পিছুটান থাকলেও উপরিভাগে কোনোপ্রকার পিছুটান না দেখিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল তানহা।
এদিকে তানহার ছোঁয়া পেয়ে যে তিহানের অঙ্গ, তিহানের মন কিছুটা সাড়া দিয়েছিল,বাঁচার আকুতি জানিয়েছিল সেটা রয়ে গেল সবার আড়ালে অজানার খাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে ।
.
রাত ৩:৪৫। অতল আর তানহা বাড়ি ফিরেছে ঘন্টা খানেক হবে। এতটা সময় মা’কে বুঝিয়ে কান্না থামাতে পার করেছে। মায়ের মন সে কি আর এতো সহজে মানে! সময়তো একটু লাগবেই।কেবলই ঘুমের ঔষধ দিয়ে মা’কে ঘুম পারিয়ে নিজেদের রুমে ফিরল অতল ও তানহা।
অতল রুমে ঢুকে দরজাটি লক করতেই তানহার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। ভয়ে যেন দম যায় যায় অবস্থা। এতো ভয়ের মাঝেও তিহানের কথাই যেন তার মাথায় ঘুরঘুর করছে। মন থেকে যাচ্ছেই না। তাই ঘরে ঢুকেই অতলকে বলল,
” আপনার বাড়িতে আসাটা একেবারেই উচিৎ হয়নি। বাবা একা মানুষ কি করে সবকিছু সামাল দিবে? আর আপনার ভাইও তো যুবক ছেলে। এখন তার সমস্যা যদি ক্রিটিকাল পর্যায়ে চলে যায়,বাবা কি পারবে তাকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে? ”
” আজকে এসেই সবার জন্য এতো চিন্তা! জীবন তো পরেই আছে। তখন কি করবে? আর তোমাকে কে বলেছে বাবা একা? আমি কি পাগল বাবাকে একা রেখে আসব ! ”
” কিন্তু আসার সময় যে বাবাকে একাই দেখে এলাম! ”
” হুম তখন একা ছিল। তবে এখন একা নয়। বাবার সাথে মিরাজ কাকা রয়েছে।”
” মিরাজ কাকা! তাকে না বাড়িতে এসে দেখতে পেলাম? ”
” হুম, আমরা বাড়িতে আসার পরেই মিরাজ কাকা কে পাঠিয়েছি। ”
” ওহ্ আচ্ছা। ”
” হুম। ”
তানহা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমে যেতেই অতল তানহার হাত ধরে ফেলল। আর বলল,
” সবাইকে নিয়ে এতো ভাবতে যেয়েও না। কিছু ভাবনা আমার জন্যও বাঁচিয়ে রেখো। না’হয় দেখা যাবে আমাকে নিয়ে ভাবার জন্য কিছুই খুঁজে পাবে না। ”
অতলের কথার পরিপ্রেক্ষিতে তানহা কিছুই বলল না। কেবল মৃদু হেসে নিজের হাত অতলের হাত থেকে মুক্ত করে ওয়াশরুমে চলে গেল।
তানহার হাসি দেখে অতলও মুচকি হাসল।মাথার চুল নাড়তে নাড়তে এগুলো আলমারির কাছে।আলমারি থেকে একটা টি-শার্ট ও থ্রি কোয়াটার প্যান্ট হাতে নিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। আর মনে মনে ভাবল,
” অতল ছোট থেকেই অনেকের কাছে শুনেছে বিবাহ বন্ধন একটি পবিত্র বন্ধন। এমনকি ইসলামিক বইতেও সে পড়েছে। তবে আজ সেই কথার প্রমাণ পেল অতল। লাইফে তো বহু মেয়েকেই সে দেখেছে। তবে কোনোটিই তার গার্লফ্রেন্ড ছিল না। সে যে কোনোদিন প্রেমের ধারের কাছেও ভিড়েনি। তবে অতলের সুঠাম দেহ , সৌন্দর্য আর পার্সোনালিটির জন্য কত মেয়েরাই না তার পেছনে ঘুরঘুর করেছে।তাও আবার আগুন সুন্দরী যাকে বলে।আর তাদের হাসি, উফ্! সে কি মারাত্মকই না ছিল কিন্তু সে হাসিতে অতল কোনোদিন পবিত্রতা, মায়া, সরলতা,শান্তি খুঁজে পায়নি। যেটা আজ তানহার হাসির মাঝে খুঁজে পেয়েছে। এর মানে কি এটাই দাঁড়ায় না বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াতেই সে আজ তার সন্ধানকৃত অনুভূতি গুলো খুঁজে পেয়েছে। তাও এতো ছোট হাসির মাঝে। ”
.
.
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here