#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি
৮.
এক মগ গরম কফি হাতে ছেলের রুমে ঢুকলেন শাকিলা। আয়াজ তখন ল্যাপটপের স্ক্রিণে তাকিয়ে ভিষণ মনোযোগ দিয়ে অফিসের কিছু ফাইল দেখছে। কফির মগটা পাশে রেখে ছেলের পাশে বসলেন তিনি। পরম স্নেহে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
‘বেশি চাপ পড়ে যাচ্ছে বাবা? ক্লান্ত লাগছে তোমাকে। এত প্রেশার এখনি কেন নিতে গেলে?’
আয়াজ শুকনো করে হাসলো। ল্যাপটপ কোল থেকে নামিয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে বাচ্চাদের মতো করে গুটি মেরে শুয়ে পড়লো। ক্লান্ত কন্ঠে বলল,
‘এই সামান্য কাজ আমাকে দুর্বল করার ক্ষমতা রাখে না মা। তোমার বৌমার নিরব আঘাত আমাকে ভেঙে দিচ্ছে। তোমার উচিত বৌমাকে শাসন করা। তোমার একমাত্র ছেলেকে সে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে এর শাস্তি কি হওয়া উচিত?’
শাকিলা বিস্ময় নিয়ে ছেলের দিকে চাইলেন। কোন বৌমার কথা বলছে আয়াজ? সে তো কোনো বৌমাকে চেনে না। ছেলেকি তাদের না জানিয়ে বিয়ে করে নিল? শাকিলা গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইল,
‘তুমিকি আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করেছ?’
‘উহু।’
‘তাহলে বৌমা কে?’
‘যাকে আমি বিয়ে করবো।’
‘তুমিকি মেয়ে ঠিক করে ফেলেছ?’
‘চার বছর পূর্বে।’
‘তোমাদের সম্পর্ক এতদিনের আর আমাকে জানালে না!’
‘তার পর্যন্ত পৌঁছাতে আমাকে এখনো এক সাগর পরিমাণ পথ পারি দিতে হবে মা। খুব পাষাণ হৃদয়ের মানবী সে মা। এই দেখ আমি কতটা পুড়ছি তার জন্য কিন্তু আজ দুদিন ধরে সে তার সাথে যোগাযোগের সব মাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছে।’
বাচ্চাদের মতো করেই একের পর এক অভিযোগ করে চলল আয়াজ। শাকিলা চুপ করে ছেলের অভিযোগ শুনলো। আয়াজ ছোট থেকেই গম্ভীর। খোলামেলা ভাবে কথা বলেনা সে কখনো। নিজের মাঝে সবটা লুকিয়ে রাখতেই সে পছন্দ করে। আজ তার ছেলেটা কতটা কষ্ট পেয়ে তার সাথে সব শেয়ার করছে ভেবেই তির চোখ ছলছল করে উঠলো। মেয়েটাকে সামনে পেলে সে অবশ্যই এর জবাব চাইবে। শাকিলা স্বযত্নে ছেলের মাথায় হাত ছোঁয়াল।
__________
প্রিয়তা আজ নীল রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। হাতে নীল রেশমি চুড়ি। খোঁপায় ফুটন্ট গন্ধরাজ ফুল। চোখ ভরা কাজল। আর লালে রাঙানো ঠোঁট। বাতাসের তালে তালে কানের ঝুমকো জোড়া দুলছে। কপালের দুপাশে নেমে আসা সরু চুলগুচ্ছ বারবার বাতাসে নিজের স্থান থেকে নড়ে যাচ্ছে। প্রিয়তা বিরক্ত হলেও খুব যত্ন নিয়ে তা গুছিয়ে নিচ্ছে। বাসস্টপে দাঁড়িয়ে বিরষমুখে আশপাশে নজর বুলাল প্রিয়তা। তার এত যত্ন করে সাজা কি ব্যর্থ হলো? প্রিয়তার সুন্দর মুখটা মুহূর্তেই মলিন হয়ে এলো। রাগ হলো ভিষণ। এ মুহূর্তে নিজের গালে কষিয়ে দুটো থাপ্পর লাগাতে পারলে কিছুটা হলেও শান্তি লাগত। নিজের থেকে ছোট কোনো ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে এরকম সেজেগুজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মোটেই তাকে সোভা পায় না। কিন্তু সে ষোল বছরের এক কিশোরীর মতো প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করছে। বারবার ব্যস্ত চোখে প্রেমিককে খুঁজছে। এগুলো নেহাত বোকামি ছাড়া অন্য কিছু নয়।
আয়াজ এলো ঠিক দু ঘন্টা পর। এলোমেলো চুল, চোখের নিচে কালচে ছাপ আর অগোছালো পোশাকে আয়াজকে দেখে প্রিয়তার বুকের ভিতর হাহাকার করে উঠলো। এতক্ষণ জমিয়ে রাখা রাগটা যেন নিমিষেই উদাও হয়ে গেলো। আয়াজের দিকে এগিয়ে আসতেই আয়াজ ব্যথাতুর কন্ঠে শুধাল,
‘আমায় কষ্টের মাঝে রেখে আপনার এ সাজ কার জন্য প্রিয়? সে কি আমার থেকেও বেশি ভালোবাসে আপনাকে?’
আয়াজের চোখ ছলছল করে উঠলো। এই কঠিন ছেলেটার চোখে পানি দেখে প্রিয়তা চমকাল। পরমুহূর্তে ভিষণ ভালোলাগা কাজ করলো। এই অতিব সুদর্শন পুরুষটা যে কেবল তার উইল সে হাতে পেয়ে গিয়েছে। প্রিয়তা মুচকি হেসে জবাব দিলো,
‘এক বাচ্চা প্রেমিকের অপেক্ষায় ছিলাম। অলরেডি তিনি আমাকে দু ঘন্টা অপেক্ষা করিয়েছে। আর এখন নিজেই কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে।’
প্রিয়তা একটু থেমে আবারও বললো,
‘এসব বাচ্চা সামলানো ভিষণ কষ্টের বুঝলে? কখন না কেঁদে দেয়! মানুষ কি ভাববে বলোতো?’
আয়াজ হেসে ফেলল প্রিয়তার কথা বলার ভঙ্গি দেখে। সাথে প্রিয়তাও হাসলো। আয়াজ হাসলে ডান গালে গভীর খাদের সৃষ্টি হয়। যা এই প্রথম প্রিয়তার নজরে এলো। সে মুগ্ধ হয়ে তার ছোট্ট প্রেমিকে দেখলো। নিঃসন্দেহে ছেলেটা ভিষণ সুন্দর। আগে কেন নজরে এলো না?
__________
‘আপনার পাশে আমায় বড্ড বেমানান লাগছে প্রিয়।’
ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল আয়াজ। প্রিয়তা বিরোধিতা করলো। বলল,
‘তোমায় উদাস প্রেমিকের মতো লাগছে আয়াজ। সুন্দরী প্রেমিকার পাশে উদাস প্রেমিকের কম্বিনেশন সবথেকে সুন্দর। বেমানান লাগার কোনো প্রশ্নই আসে না। আমি যতবার শাড়ি পড়ব তুমি এমন অগোছালো ভাবেই আমার পাশে হাঁটবে।’
আয়াজ মাথা নাড়িয়ে হাসলো। সূর্যের সরু আলো প্রিয়তার মুখে পড়ছে। চমৎকার লাগছে দেখতে। আয়াজ হাত দিয়ে আড়াল করলো সূক্ষ সে রশ্মিকে। অভিযোগ করে বলল,
‘আমি ছাড়া আপনাকে কেউ ছুলে আমার ভিষণ হিঃসা হয় প্রিয়। সূর্যের ও জানা উচিত আপনি কেবল আমার। আপনাকে ছোঁয়ার সাহস দেখানো তার মোটেই উচিত নয়।’
প্রিয়তা খিলখিল করে হেসে উঠলো। আয়াজ মুগ্ধ হয়ে তা দেখলো। প্রেয়সীর এ রূপ তার প্রথম দেখা। প্রিয়তাকে এভাবে প্রাণখুলে হাসতে আগে কখনো সে দেখেনি। ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো মন।
____________
প্রিয়তা বাড়ি ফিরল সন্ধ্যা করে। পুরোটা দিন সে আজ বাড়ির বাহিরে কাটিয়েছে। ড্রয়িংরুমে বসে জাহিদ প্রিয়তার ফেরার অপেক্ষা করছিল। প্রিয়তা ড্রয়িংরুমে মামাকে দেখেও না দেখার মতো করে রুমে চলে যাচ্ছিল কিন্তু বাঁধা দিল জাহিদ। গম্ভীর কণ্ঠে ঢাকে বলল,
‘এখানে এসে বসো। কথা আছে।’
প্রিয়তা দ্বিরুক্তি করলো না। চুপচাপ মামার দেখানো সোফায় বসলো। জাহিদ প্রিয়তার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
‘কোথাও গিয়েছিলে?’
‘হুম।’
‘সারাদিন বাসায় ফেরোনি। তুমি এখন যথেষ্ট বোঝ। এভাবে সারাদিন বাসার বাহিরে থাকা কি সোভা পায়?’
প্রিয়তা মাথা নিচু করে রইল। উত্তর দিলো না। জাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পরপর বলল,
‘তাহলে তোমার মামি আমাকে যা কিছু বলেছে সব সত্যি? তুমি সত্যিই কারো কথা শুনছ না?’
প্রিয়তা এবারো কোনো কথা বলল না। তার ভিষণ অভিমান হলো। সে তো মাত্র আজ একদিন বাহিরে ছিল। মামা কিভাবে মামির সবকথা বিশ্বাস করে নিল?
প্রিয়তার নিস্তব্দতা জাহিদের পছন্দ হলো না। তার মনে হলো অতি আদর দিয়ে প্রিয়তাকে সে চরম বিয়াদপ বানিয়ে ফেলেছে। বাড়ির মেয়ে কাউকে না জানিয়ে সারাদিন ঘরের বাহিরে থাকছে এটা মানুষ জানলে কত কথা রটাবে! তিনি আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘তোমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তোমার বয়সের মেয়েরা সংসার করে খাচ্ছে। তোমার আপত্তি থাকায় এতদিন আমি তোমায় কিছু বলিনি। কিন্তু সবকিছুর একটা নিয়ম আছে। আমি চাই খুব শীঘ্রই ভালো কোনো পাত্র দেখে তোমায় তার হাতে তুলে দিতে। আশি করি তোমার কোনো আপত্তি নেই।’
‘যদি থাকে?’
প্রিয়তার পশ্নে জাহিদ ভিষণ রকম বিরক্ত বোধ করলো। কপাল কুঁচকে তিনি কঠিন কন্ঠে বলল,
‘এখনো তুমি বলতে চাইছ তোমার আপত্তি আছে? আমার ঘরেও একটা মেয়ে আছে। আমার একটা সংসার আছে এটা ভুলে যেও না। আমি চাইনা তোমাকে নিয়ে এ সংসারে আর কোনো ঝামেলা হোক। এখন সিদ্ধান্ত তোমার হাতে।’
কথাগুলো বলে জাহিদ গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন। প্রিয়তা ঠাঁয় বসে রইল। জাহিদের বলা কথাগুলো বারবার তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ মামাও তাকে বলতে চাইল সে এই পরিবারের অশান্তির কারণ! প্রিয়তা উঠে দাঁড়ালো। টলমলে পায়ে এগিয়ে গেল নিজের রুমের দিকে। তার নিজেকে ভিষণ একা লাগছে। এলোমেলো অবস্থায় বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়ল। তাকে একটা চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। আর কত অবহেলা সইবে সে? এ বাড়ির কেউ তাকে মানুষ ভাবে না। তার যে একটা মন আছে সেটাই সবাই ভুলে বসেছে।
চলবে……….#অপ্রিয়_শহরে_আপনিটাই_প্রিয়
#লাবিবা_আল_তাসফি
৯.
প্রিয়তার জীবনে বন্ধুর সংখ্যা খুব সীমিত। এত বছর জীবনে হাতে গোনা কয়েকটা বন্ধু হয়েছে তার। অনেক খুঁজে নীরার নাম্বার বের করলো সে। ভার্সিটির জীবনে নীরাই ছিল তার সবথেকে ঘনিষ্ঠ। কিন্তু অনার্স শেষ করার পূর্বেই তার বিয়ে হয়ে যায়। পড়িশোনা টাও শেষ করা হলো না মেয়েটার। বিয়ে হতেই পরিবর্তন আসলো নীরার। সব মেয়েরাই বুঝি পরিবর্তন হয়?
এতদিন বাদে কল দিতে একটু সংকোচ অনুভব হলেও প্রয়োজন এর খাতিরে বাধ্য হয়ে কল করতে হলো। তার উপর রাত এখন দশটার বেশি। এত রাতে কাউকে কল দিয়ে বিরক্ত করা মোটেই শোভনীয় কাজ নয়। প্রিয়তার ভিষণ অপছন্দের তালিকায় থাকা অন্যতম কাজ এটি। দুবার রিং হতেই ওপাশ থেকে পুরুষ কন্ঠ ভেসে এলো।
‘কে বলছেন?’
প্রিয়তা আমতা আমতা করে বলল,
‘জ্বি এটা নীরার নম্বর?’
‘হ্যাঁ। কি চাই?’
‘নীরাকে।’
‘ওর কাছে কি চাই?’
প্রিয়তা বিরক্ত হলো এমন প্রশ্নে। ওর কাছে কি চাই সেটা না হয় ওকেই বলবো। তোর তাতে কি ভাই? কিন্তু প্রিয়তা এমন কিছু বললো না। সে ভিষণ বিনয়ের সুরে বলল,
‘ওকে একটু দরকার ছিল। আমি ওর ফ্রেন্ড প্রিয়তা। একটু যদি ওর কাছে ফোনটা দিতেন ভিষণ উপকৃত হতাম।’
লোকটার প্রতিক্রিয়া ঊ্এপাশ থেকে প্রিয়তা বুঝলো না। কিন্তু যতটুকু অনুমান করলো লোকটা ভিষণ রকম বিরক্ত হয়ে ফোনের দিকে চেয়ে আছে।
‘হুম অপেক্ষা করুণ। ও বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে।’
‘জ্বি অবশ্যই।’
প্রিয়তা ফোন কানে অপেক্ষা করলো। পাক্কা তিন মিনিটের মাথায় নীরার কন্ঠ ভেসে এলো।
‘হ্যালো! প্রিয়তা বলছিস?’
প্রিয়তা ভিষণ বিরক্ত বোধ করলেও হাসগ মুখে বলল,
‘হ্যাঁ। কেমন আছিস? কতদিন বাদে তোর সাথে কথা বলার সুযোগ হলো।’
প্রিয়তার কথা বলার ধরণ এমন যেন সে নীরার সাথে কথা বলতে পেরে ভিষণ আনন্দিত। কিন্তু বাস্তবিক ভাবে সে প্রচন্ড রকম বিরক্ত। নীরার হাসবেন্ড শুরুতেই তার মেজাজের দফারফা করে ফেলেছে। টুকটাক কথা শেষে প্রিয়তা মলিন কন্ঠে বলল,
‘একটা হেল্প করতে পারবি?’
‘হুম বল।’
‘একচুয়ালি আমার একটা বাসা দরকার। ছোট একটা ফ্লাট। আমার একার থাকার মতো।’
‘আচ্ছা আমি তোকে জানাব।’
‘ধন্যবাদ।’
প্রিয়তা ফোন রাখল। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে সে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ফোনের দিকে তাকাতে দেখলো আয়াজ ম্যাসেজ করেছে। প্রিয়তার রিপ্লাই দিতে মন চাইলো না। তার এখন ভিষণ ঘুম পাচ্ছে। ভিষণ বলতে ভিষণ। প্রিয়তা ফোন সাইলেন্ট করে টেবিলে রাখল। সে জানে কিছুক্ষণ বাদে আয়াজ কল করবে। একবার নয় দুবার করে টানা একঘন্টা কল করবে। অতঃপর প্রিয়তা ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে সুন্দর করে একটা ম্যাসেজ পাঠাবে। এই ছেলেটার জাবতীয় কাজ এখন প্রিয়তার মুখস্থ হয়ে গেছে।
__________
প্রিয়তা একটা বাসা খুঁজে পেয়েছে। এক বেডের ছোট্ট একটা ফ্লাট। ছয় হাজার টাকায় এর থেকে ভালো বাসা পাওয়া অসম্ভব। নীরার মামা শ্বশুরের বাড়ি হওয়ায় অল্প ভাড়ায় সহজে বাসাটা পেয়ে গেছে সে।
সকালে খাওয়া দাওয়া শেষ হতে প্রিয়তা কোনো ভনিতা ছাড়াই বলল,
‘আমি এ মাসেই শিফট করছি।’
জাহিদ অবাক চোখে তাকালো। বোকা চোখে তাকিয়ে বলল,
‘শিফট করছো মানে?’
‘এটস সিম্পল। আপনাদের সংসারে আর কতদিন? তাছাড়া আমার জন্য আপনাদের কম ঝামেলা সহ্য করতে হচ্ছেনা। এখন যেহেতু আমি নিজেই চলতে পারি। নিজেকে চালাতে পারি তাই আমি আমার মতো করে থাকতে চাই। বলতে পারেন নিজের বাকি জীবনটা নিজের মতো করে চালাতে চাই। আপনাদের ও ছুটি দায়িত্ব থেকে।’
কত বড় একটা কথা কত সহজেই বলে ফেলল প্রিয়তা। প্রিয়তার গলা ধরে আসতে চাইছে কিন্তু সে শক্ত হয়ে বসে রইল। জাহিদ নির্বাক হয়ে প্রিয়তার মুখের দিকে তাকালো। সে কল্পনায়ও ভাবতে পারেনি প্রিয়তা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিবে। সে তো সবসময় প্রিয়তাকে নিজের মেয়ের মতো করেই দেখেছে। তার চোখের কোণে পানি জমলো। মুচকি হেসে সে বলল,
‘তুমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছ এখানে আমার আর কি বলার! তুমি বড় হয়েছ। নিজের সিদ্ধান্ত তুমি নিজেই নিতে পার। তোমার সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত।’
তিনি উঠে চলে গেলেন। সুজলা কোনো কথা না বলে স্বামীর পিছু পিছু রুমে চলে গেল। তুলি অনেক আগেই খেয়ে শুয়ে পড়েছে। প্রিয়তা টেবিলে বসে রইল। সবাই চলে যেতেই রত্না দৌড়ে এলো।
‘আপা আপনে সত্যিই চইলা যাবেন?’
প্রীয়তি মাথা নাড়াল। রত্না মন খারাপ করলো একটু। পরক্ষণে বলল,
‘এতদিনে আপনি একটা সঠিক কাজ করছেন আপা। একটু খারাপ লাগলেও আমি খুশি হইছি। আপনি চিন্তা করবেন না। দুইদিন পরপর আমি আপনারে দেখতে যামুনি।’
প্রিয়তা হেসে ফেলল। কিছু ভালোবাসা হয় নিঃস্বার্থ। এই যে রত্নার তার প্রতি ভালোবাসা। কতটা নিঃস্বার্থ ভাবে মেয়েটা তাকে ভালোবাসে। এই ভালোবাসা আপন মানুষদের কাছ থেকেও পাওয়া যায় না।
দুদিনের মাথায় প্রিয়তা নতুন বাসায় উঠলো। রত্না পুরোটা দিন প্রিয়তার হাতে হাতে ঘর গুছিয়ে দিলো। প্রিয়তা ওর মামার বাড়ি থেকে কিছুই আনেনি। টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিস সব নিজেই কিনে নিয়েছে। যদিও জাহিদ অনেক জোরাজুরি করেছিল কিন্তু প্রিয়তা সাফ মানা করে দিয়েছে। সুজলা প্রিয়তাকে কঠিন ভাবে বলে দিয়েছে সে যেন আর এ বাড়িতে ফিরে না আসে। উত্তরে প্রিয়তা মুচকি হেসে বলেছিল,
‘চিন্তা নেই মামি। আপনাদের মুক্তি দেওয়ার শপথ যখন করেছি সেটা পরিপূর্ণ ভাবেই সম্পন্ন করবো।’
তুলি ভিষণ কেঁদেছিলো। বারবার প্রিয়তাকে না যেতে বলছিল। প্রিয়তা ওকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে ছিল। তার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানিও ঝড়েনি। কষ্ট পেতে পেতে তার হৃদয় পাথর হয়ে গেছে।
বিকেল হওয়ার পূর্বেই রত্না চলে যায়। প্রিয়তা সব গুছিয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। সূর্য হেলে পড়েছে। লাল রাঙা আকাশে কয়েকটা কাক উড়তে দেখা যাচ্ছে। প্রিয়তা বিষন্ন মনে আকাশের দিকে তাকালো। চোখের কোণে জলরাশির দেখা মিলল। ধরে আসা গলায় বলল,’সব খারাপ কেন আমার সাথেই হয়? আমাকেই কেন সব হারাতে হয়?’
__________
‘কেন ইগনোর করছেন প্রিয়তা?’
আয়াজের কন্ঠের গভীরতা অনেক। সাধারণত আয়াজ তাকে প্রিয়তা বলে ডাকে না। এটা তখনই ডাকে যখন আয়াজ খুব রেগে থাকে কিংবা যখন খুব বেশি কষ্ট পায়। প্রিয়তা তপ্ত শ্বাস ফেলল। শান্ত ভাবে বলল,
‘তোমার পড়াশোনায় ফোকাস করা উচিত আয়াজ। আমিতো পালিয়ে যাচ্ছি না।’
‘যেতে চাইলেও যেতে দিব না।’
‘দিও না। তবুও পড়াশোনায় ফোকাস কর।’
আয়াজ হাসলো। প্রিয়তার নাক টেনে দিয়ে বলল,
‘আপনি প্রোফেশনাল টিচারের মতো ব্যাবহার করছেন প্রিয়।’
প্রিয়তা চমকালো। আজকাল সে একটুতেই চমকে যায়। এই ছেলেটার তাকে চমকে দেওয়ার বিশেষ রকম ক্ষমতা রয়েছে। প্রিয়তা মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো। কন্ঠে তেজ এনে বলল,
‘তুমি এভাবে যখন তখন আমায় ছুঁবে না আয়াজ।’
আয়াজ ব্যাথিত হলো। হাত গুটিয়ে নিয়ে ছোট করে জবাব দিলো,’স্যরি।’
ইতিমধ্যে পার্কে অনেক কপোত কাপতির ভীড় জমেছে। ব্যস্ত হয়ে উঠেছে ঝিমিয়ে থাকা পার্কটি। প্রিয়তা আড় চোখে আয়াজের দিকে তাকায়। কালো রঙের শার্ট উজ্জল শ্যামলা দেহে দারুণ মানিয়েছে। হঠাৎ করেই প্রিয়তার মন খারাপ হলো। সে উদাস হয়ে বলল,
‘পিচ্চি! কেন তুমি আমার বড় হলে না?’
প্রিয়তার কথায় আয়াজ গম্ভীর হলো। প্রিয়তার দিকে গম্ভীর হয়ে তাকালো। কাঠকাঠ গলায় বলল,
‘আমাকে আর কখনোই পিচ্চি সম্মোধন করবেন না। এর শাস্তি দিতে আমি কৃপণতা করবো না।’
প্রিয়তার মনে হলো সে এই পিচ্চি ছেলেটাকে ভয় পাচ্ছে। তার ভয় পাওয়া উচিত না কিন্তু সে পাচ্ছে। এই শীতল গলার স্বর তাকে জমিয়ে দিচ্ছে। সে চেয়েও পারছে না আয়াজের কথার অমান্য করে তাকে পিচ্চি বলে ডাকতে। কিন্তু সে বলতে চাইছে,’পিচ্চি! আমাকে ধমকানোর আগে পাঁচ বার ভাববে। কেননা আমি তোমার থেকে গুনে গুনে পাঁচ বছরের বড়।’
চলবে…………