#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_২২ (আমার না-রওয়া মানুষটা তোমার হোক)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
“উনি এখন অনেকটা এগিয়ে, তাই ভাবছেন? নাহ! আসলে উনি এখনও এই ‘আপনি’-তেই থমকে আছেন। এই যে, এত সব কাহিনি আপনার অজানা!”
ওই মুহূর্তে সিদ্দিক গুমোট পরিবেশে মুখ খুলে ভারি আওয়াজে বলে উঠল, “জানি সবটাই।”
শুদ্ধ অবাক হলো, “জানতেন?”
সিদ্দিক বলল, “বললাম না? যখন জানতে পেরেছিলাম, তখন পরিস্থিতি আমার বিপরীতে ছিল; আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।”
শুদ্ধ অবুঝপানে তাকিয়ে রইল। সিদ্দিক দম নিয়ে বলা শুরু করল, “আমি আশাকে ওভাবে মেনে নিতে পারিনি। আমার সময় লেগেছিল। যখনই আশার কাছাকাছি যেতাম, তখনই সেই মায়াবী মুখটা ভেসে উঠত। এক ঘরে, এক বিছানায় বছর খানেক থেকেও, আমি ওকে ছুঁতে পারিনি। কীভাবে ছুঁতাম? সেখানটায় একজনের স্মৃতি ছিল তো!”
শুদ্ধর গা শিরশির করে উঠল এটা ভাবতেই। সিদ্দিক বলল, “আমি পারতাম না। আমিও মানুষ, তাই-না? মা যেভাবে ওর ব্রেইনওয়াশ করেছে, আমারও ব্রেইনওয়াশ করেছিল। মা আমার মাথায় সেট করে দিয়ে গিয়েছিল, ‘আমার বউ অন্য পুরুষের হাত ধরে পালিয়েছে।’ আর আমি তাই-ই মেনে নিয়েছিলাম।
অনেক চেষ্টা করেছি, আশার সাথে একটা স্বাভাবিক লাইফ লিড করার। এমনও হয়েছে, অফিস থেকে ফেরার আগে ওকে কল দিয়ে বলতাম—সেজে-গুজে থাকতে। ও বুঝে নিত, খুশি হতো। তখন ও আর জব করত না। বাড়িতেই থাকত।
ও প্রতিবার রেডি হয়ে থাকত। বাড়ি ফিরে আমি ওর কাছাকাছি গেলেই যেন অদৃশ্য কোনো শেকলে আটকে যেতাম। এগোতে পারতাম না। তারপর ওকে রুমে রেখেই ছাদে হাঁটাহাঁটি করে সিগারেটের প্যাকেট খালি করতে থাকতাম।
ওর ধৈর্য্য, সহনশক্তি, ভালোবাসা দেখে এক সময় আমার মনেও পুরোনো প্রেম জেগে ওঠে। ওর কাছাকাছি যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করি, সফল হই। আমাদের মাঝের দাম্পত্য জীবনটা ধীরে ধীরে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
এরপর একদিন অফিশ্যিয়াল পার্পাজে, আনন্দমোহন কলেজের একটা ফাংশনে এটেন্ড থাকি আমি। সেখানে দীর্ঘ তিন বছর পর আমি ওকে দেখতে পাই। কেমন যেন শুকিয়ে গেছে, চুপচাপ কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে আছে একা; কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল আমার। আমি ওর খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, হলেই থাকে ও।
বাকি খোঁজ নেওয়ার জন্য কল লাগাচ্ছিলাম একজনকে। সেই মুহূর্তে আমার ফোনে আশার কল আসে। ও খুব খুশি। ঠিকমতো কথাই বলতে পারছিল না খুশির চোটে। অর্ধ-স্পষ্ট বুলিতে এ-ই বুঝলাম—আশা প্রেগন্যান্ট। প্রচণ্ড খুশি হলাম আমি। সেই খুশি হাওয়ায় মিইয়ে গেল একজনকে পেয়েও কাছে টেনে না নেবার ব্যর্থতায়। আমি আর তার খোঁজ নিলাম না। দ্বিতীয়বার সেই কলেজের ধারের কাছেও গেলাম না, সেই শহরেই গেলাম না। সেই বছর থেকে ওর কোনো চিঠি আমি পড়লাম না ভুল করেও। ও কত বড়ো ভুল করেছে, তা কি আদতে বুঝতে পারছে? আমার কী দোষ ছিল? আমাকে কেন এরকম ভাবে দোটানায় ফাঁসিয়ে দিলো? ইশ! যদি সামনে আসত একবার, ট্রাস্ট মি, খুন করে ফেলতাম আমাকে এভাবে শাস্তি দেওয়ার অপরাধে। যেখানে আমার কোনো দোষই ছিল না!”
শুদ্ধর কেন যেন এই সিদ্দিককে আর ঘৃণ্য লাগছে না, নিজের মতোই অসহায় লাগছে। হয়তো সিদ্দিকের অসহায়ত্ব শুদ্ধর চেয়েও কয়েক হাজার গুন বেশি!
সিদ্দিক এত বছরে এই প্রথম কারো সামনে নিজেকে এতটা খোলামেলাভাবে উপস্থাপন করেছে। পুরোটা বলা শেষে সে বলল, “তবুও তনুজার খোঁজ আমার কাছে প্রতিদিনই আসতে থাকে। তোমার ব্যাপারটাও জানি, শুধু চিনতে পারিনি প্রথমে। তুমি বললাম, কিছু মনে কোরো না। আমার অনেক ছোটো তুমি.. ২০ বছরের ছোটো! আ’ম ফোর্টি টু নাও..”
শুদ্ধ কেশে উঠল! পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিক হলেও শুদ্ধ অপ্রস্তুতভাবে বলে উঠল, “এতটাও লাগেন না! বড়ো জানতাম, কিন্তু এতটা!”
সিদ্দিক হেসে উঠল। শুদ্ধ নিজেও হাসল, সময় নিয়ে শুধাল, “তনুজার জন্য আপনার মনে এখনও অনুভূতি আছে?”
সিদ্দিক না ভেবে বলে বসল, “অনুভূতিহীন হৃদয় আমার। ওর জন্য ঘৃণাটাও যোগ্য নয়। যদি এর উর্ধ্বে কিছু থাকত, তবে তা-ই বরাদ্দ হতো।”
“যদি সুযোগ আসে ওনার কাছে ফেরার?”
“আমি সেই সুযোগকে নিজ হাতে ফিরিয়ে দিতে কার্পণ্য করব না।”
“কেন?”
“সে অতীত!”
“যদি বর্তমানে ফিরতে চায়?”
“আমি দূরে থাকব। আমার স্ত্রী-সন্তান আছে। তার চেয়েও বড়ো হচ্ছে শাস্তি। ও বলেছিল, ভুল বুঝবে না। ও বলেছিল, আমাকে ছাড়বে না। অথচ কী করল?”
শুদ্ধ বলার ভাষা পেল না, নীরব রইল। সিদ্দিক আবার বলল, “জানো, ও বলেছিল আমাদের বিয়ের রাতে—বিশ্বাসঘাতকদের ও নিজের জীবনে জায়গা দেয় না। তাই আমিও ওকে আমার জীবনে জায়গা দেবো না।”
“বিশ্বাসঘাতকতার কী করেছেন উনি?”
“নিজেকে ভেঙে-চূরে ওর কাছে উপস্থাপন করেছিলাম, বিনিময়ে আমার মনটাকেই ভেঙে দিলো।”
“তাঁকে এখনও ভালোবাসেন?”
“ভালোবাসা ফুরোয় না। যাকে একবার মনে জায়গা দেওয়া হয়, তাকে মন থেকে বের করা যায় না। কিন্তু আমরা সেই মানুষটাকে ছাড়া থাকতে অবশ্যই পারি। বেশ ভালোভাবেই থাকতে পারি। শুধু মাঝে মধ্যে একাকী অবস্থায় বুক ফেটে কান্না পায়, এই আর কী!”
শুদ্ধ তাকাল সিদ্দিকের দিকে, “আপনাকে দেখে খুব স্ট্রং লাগে!”
সিদ্দিক কেবল হাসল, “ইয়েস, আই অ্যাম স্ট্রং!”
শুদ্ধ নিজেও হেসে উঠল, “এতটাই স্ট্রং যে এতগুলো কথার মাঝে দ্বিতীয়বার তনুজার নামটা উচ্চারণ করেনি। আমি স্পষ্ট খেয়াল করেছি, প্রথমবারের উচ্চারণে আপনার গলা কেঁপেছিল!”
“সবদিকে এত খেয়াল রাখা ভালো নয়, বুঝলে? পরে নিজেকেই ভুগতে হয়।”
“ভুগছিই তো।”
“আরও ভুগবে। সে পোড়াতে ভালোবাসে।”
“প্রতিনিয়ত পুড়ছি।”
সিদ্দিক বলল, “সে পাষাণ!”
শুদ্ধ মুচকি হেসে বলল, “আমিও তাই বলি।”
পরপরই শুদ্ধ আবার বলল, “আচ্ছা, আপনি তনুজার এত খবর কোত্থেকে পেয়েছেন?”
“ওটা সিক্রেট! তবে তোমাকে বলা যায়!”
“বলুন তবে।”
“শিফার থেকে।”
“শিফা কে?”
“তনুজার মামাতো বোন।”
“আপনি না তনুজার মামার ব্যাপারে কিছুই জানতেন না!”
“জানতাম না। পরে জেনে গিয়েছিলাম। ডিভোর্সের ৩ বছর পর শিফা অনেক খুঁজে নিজ থেকে আমার সাথে কন্ট্যাক্ট করে, আমাকে সব জানায়। ওর কাছেই সব জানতে পারি।”
“কল দিয়েছিল কেন?”
“তার বোনের পেইন নাকি সহ্য করতে পারছিল না। এরপর থেকে আমি না চাইতেও ওর সব ডিটেইলস আমাকে দেয়। আমি আমার মায়ের ব্যাপারটা আগে থেকে আন্দাজ করলেও, কিছু বলিনি। এতটা নিচুতে নেমেছিল, ভাবতে পারিনি। মা তো, তাই! নিজের মায়ের এত অধঃপতন যখন পুরোপুরি শিফার মাধ্যমে জানতে পারি, আমি অর্ষা আর আশাকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসি। অর্ষা তখন কোলের বাচ্চা ছিল, মাস ছয়েকের। এরপর থেকে আলাদা থাকি। মায়ের সাথে মাঝে মাঝেই কথা হয়, তাদের খরচ বহন করি। কিন্তু অর্ষার সাথে দেখা করতে দিইনি আর। আশা কখনই চায়নি আমাদেরকে আলাদা করতে। কিন্তু যখন একা হয়ে যাই, তখন ও চেয়েছে আমার জীবনে ফিরতে। অর্ষাকে আশা একদম তনুজার মতো করেই তৈরি করেছে, দুজনের অনেক মিল—বুঝলে? মাঝে মাঝে শিফা আশার সাথেও যোগাযোগ করে! এগুলো তনুজা জানে না কেবল।”
“আচ্ছা, ওয়েট! এর মানে এখন তনুজা কোথায় আছেন—জানেন?”
সিদ্দিক ছোট্টো করে বলল, “হুম!”
উদ্দীপিত হয়ে শুদ্ধ শুধাল, “কোথায়?”
“সিলেটে!”
“সিলেট?”
“হুম! লোকেশন আমি সেন্ড করে দিচ্ছি তোমাকে।”
অতঃপর অনেকক্ষণের নিরবতা। শুদ্ধর কেন যেন খুব অস্বস্তি লাগছে, অসহনীয় অনুভূতি লাগছে। বুকের মধ্যেখানেতে দলা পাকানো কষ্টেরা ভারি পীড়া দিচ্ছে। নিঃশ্বাসের সাথে যেন শোক প্রবেশ করছে।
সিদ্দিক তাকে দেখে বলল, “তোমার কাছে ভালোবাসা মানে কী?”
শুদ্ধ হালকা হাসল এবার। গভীর দুটো নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল, “উনি নিজেই।”
“কেন?”
“ভালোবাসা বলতে আমি ওনাকেই বুঝি, কারণ জীবনে প্রথমবার এমন অনুভূতি আমি তাঁর প্রতিই অনুভব করেছি। এর আগে এটা ছিল আমার জন্য সবচেয়ে আলাদা, সবচেয়ে অজানা।”
“আর আমার জীবনের দ্বিতীয় প্রেম হয়েও কেন একমাত্র ভালোবাসা ও হলো—বলতে পারো?”
শুদ্ধ তাকাল। সিদ্দিক বলতে লাগল, “আমার জীবনে প্রেম একবার না, বহুবার এসেছিল। কিন্তু প্রেমসন্ধি ঘটেছিল কেবল ওর সাথেই। তারপর আবার প্রেম এলো, তবে সেভাবে জড়াল না আমায় নিজের রঙ্গমঞ্চে। সবগুলোই ক্ষণিকের ছিল.. প্রেম তো তাই—যা ধীরে ধীরে আসে, অতি গোপনেতে থাকে, আবার হুট করে মুছে যায়। যেমনটা আমার থেকে মুছে গেল।”
“মুছে যায়?”
“হুম, যায় তো!”
“তবে, স্যার! আমি প্রেমে পড়িনি। পড়েছি মায়ায়। অ্যান্ড আই প্রমিস ইউ, মুছবে না এটা। না আমার দিক থেকে, তা তাঁর দিক থেকে। ইট উইল বি অ্যা মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং!”
“বাজে ভাবে হেরে যাবে, ছেলে!”
“গোটা মনটাই তো তার তরে হেরে বসে আছি!”
“এত জড়িয়ে যেয়ো না। বের হতে না পারলে কিন্তু এই প্রেমটাই, ফাঁসির দড়ি হয়ে তোমার গলায় পেঁচিয়ে যাবে। বাঁচতেও পারবে না।”
“চাই না এমন জীবন, যে জীবনে তিনি থাকবেন না।”
“তবে ভেঙে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। কেননা সৃষ্টিকর্তা তোমাকে এমনই এক জীবন দেবেন।”
“স্রষ্টা চাইলে তাই হোক!”
সিদ্দিক মলিন হাসল। উঠে দাঁড়িয়ে শুদ্ধর কাছে গেল। শুদ্ধও দাঁড়াল। সিদ্দিক তার হাতটি শুদ্ধর কাঁধে রেখে নয়নে দৃষ্টিবদ্ধ করল। বলে উঠল, “আমি তো পারলাম না, তুমি তার সাথে থেকো।”
শুদ্ধ সেই হাতটি দু-হাতে সংশ্লেষ করে নজর না সরিয়ে বলল, “আমৃত্যু থাকব।”
সেই এক কথায় সিদ্দিক ভরসা পেল। আবার বলল, “তোমাকে বিশ্বাস করলাম। ম্যাচিউর তুমি। বয়সটা কম হলেও, স্টেবল হবার চেষ্টা করো। বাকিপথ তোমার জন্য সহজ নয়।”
“কঠিনও নয়।”
“জীবন দেখোনি।”
“মরণ দেখেছি। তাকে ছাড়া নিজেকে অস্তিত্বহীন হতে দেখেছি।”
সিদ্দিক হেসে দিলো, “কখনও ভরা আসরে হাসতে হাসতে বুকে চিনচিনে ব্যাথা হয়েছে? আচ্ছা, বেদনার অশ্রুকে হাসির ফল হিসেবে বহিঃপ্রকাশ করেছ? কিংবা কখনও এমন সিচুয়েশনে পড়েছ, যেখানে কান্না করার স্কোপটাও তোমার নেই।”
“না।”
“আমি অনুভব করেছি এসব। জীবন ছোটো, খুব শিগগিরই একই অনুভূতি তোমার নিজস্ব হবে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর কী!”
“কী করে বলতে পারছেন?”
“তোমার মাঝে আমি নিজেকে দেখতে পারছি।”
শুদ্ধ নতমুখী হয়ে বলল, “আপনার ভাগ্য আমার না হোক!”
সিদ্দিক হাসল, “আমার না-রওয়া মানুষটা তোমার হোক।”
শুদ্ধ দু-ধারে মাথা নাড়ল, ইতিবাচক জবাবটা এ-ই ছিল, “তবে তাই হোক!”
চলবে…
শব্দসংখ্যা- ১৫১২