অপ্রেমের প্রিয় অধ্যায় পর্ব -২৮ ও শেষ

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_২৮ (অন্তহীন অধ্যায়)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“কেউ কাউকে ছাড়া মরে না। বেঁচে থাকাটাও কঠিন কিছু নয়। চরিতে এমন অসংখ্য সংঘর্ষ ঘটে থাকে, যা আমাদের হাতের বাইরে। প্রেমটাও তেমনই। ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
কিছু মানুষের প্রতি না চাইতেও চলে আসে মনের সুপ্ত স্থানের সকল চিত্তাকর্ষক অনুভূতিগুলো। আবার চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে সে-সকল অনুভূতি আনা যায় না। সহজ ভাষায় বললে—সে অনুভূতির নাম প্রেম। প্রতিটি মানুষই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে গিয়ে কারো না কারো প্রেমে নিগূঢ়ভাবে ডুবে পড়ে। হোক সেটা মনুষ্যজাতির প্রতি কিংবা চারু প্রকৃতির উপর। বিপরীতের ব্যক্তিদের প্রতি অনাকর্ষিত ব্যক্তিরা পড়ে নিজের প্রেমে। তবে প্রেমে অবশ্যই পড়ে।
গল্পটা এক তনুজার। তনুজা অর্থ কী—জানো?”

রূপম কান্না থামিয়ে ফেলেছে এতক্ষণে। হা করে সামনে বসা এই আধ-বয়স্ক মহিলার কথা শুনছিল। মহিলাটির বাচনভঙ্গি চমৎকার। পরনে ছাঁই রঙা তাঁতের শাড়ি। মুখে প্রসাধনীর ব্যবহার একদমই নেই। চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকমের স্থির। হাসিটা মিষ্টি, তবে অতিপ্রাকৃত। ফিটনেস দেখে বয়সের আন্দাজটা রূপম একদমই পারছে না। এই তার মিষ্টত্বতে মনে হচ্ছে, বয়স ত্রিশের কোঠায়, আবার পোশাকে-অভিব্যক্তিতে মনে হচ্ছে—সে চল্লিশোর্ধ্ব। তাঁর প্রশ্ন করে থেমে যাওয়াতে রূপম উত্তর দিলো, “তনুজা শব্দের অর্থ তো মেয়ে।”

“হ্যাঁ। সে মেয়ে ছিল বটে। তবে এর পরিবর্তে তাকে নিষ্ঠুর, পাষণ্ড, পাথর, নির্জীব, অনুভূতিহীন, সেলফিশ বলে বেশি চেনা যেত। মেয়েরা হয় কোমলমতি, আবেগী! অথচ সে বাইরে থেকে শক্ত খোলসে নিজেকে ঢেকে নিয়েছিল।”

“স্পেসিফিক কোনো কারণ ছিল কি?”

“ছিল তো! তুমি কাঁদতে পারলে, পৃথিবী তোমায় কাঁদাবে। তুমি হাসলে পৃথিবী তোমায় হাসাতেই থাকবে। তুমি যা দেখাবে, প্রকৃতি তারই এক্সপেরিমেন্ট তোমার উপর করবে। তাই সে নিষ্ক্রিয় থাকত, বিনিময়ে প্রকৃতি তার অনুভূতি নিয়ে খেলার ইচ্ছে প্রকাশ করত না।”

“উনি কে?”

“এক নন্দিনী, কষ্টপরী।”

“হঠাৎ ওঁর কথা বলছেন?”

“তোমার অবস্থা দেখে বলছি। এই-যে, হোস্টেলের ছাদ থেকে লাফ দিতে যাচ্ছিলে। আমি না এলে তো, যে-কোনো কিছু হয়ে যেত। তুমি মারাও যেতে পারতে।”

“আমি কী করব, বলুন? ভালোবেসেছিলাম। ভুল তো করিনি! কেন ছেড়ে গেল! শালা আমার লাইফটাই বরবাদ করে দিলো!”

ভদ্রমহিলা ক্রুর হাসলেন। তারপর বললেন, “কী এমন হয়েছে—যার জন্য সুইসাইডাল সিচ্যুয়েশন ক্রিয়েট হলো!”

“আমি ভালোবেসেছিলাম। তারপর ওই জারজের বাচ্চা আমার সাথে ব্রেক-আপ করল। ওর নাকি এখন আমাকে ভাল্লাগে না। আমাদের নাকি বন্ডিং ভালো না। এগুলো কোনো এক্সকিউজ হলো—বলুন?”

“তো তুমি তার ছেড়ে যাওয়াতে কষ্ট পেয়ে মরতে যাচ্ছিলে?”

“একদমই না। আমি আসলে নিজের এমন বাজে চয়েজের উপর রেগে গিয়ে এসব চিন্তা করে ফেলেছিলাম, যেটা একদমই উচিত হয়নি। জাস্ট ভাবুন! যেই আমি পরনের পোশাকে একটা ছোট্ট দাগ পড়লেও সেটা রিপিট করি না, সেই আমিই এক আবর্জনায় পরিপূর্ণ ডাস্টবিনের প্রেমে পড়েছিলাম। মানা যায় তা?”

“নাহ্! একদমই যায় না।”

“সেজন্যই তো, মরতে যাচ্ছিলাম। এবার আপনি বলুন তনুজার গল্প। খুব আগ্রহ হচ্ছে।”

“শুনবে?”

“অবশ্যই।”

“বেশ! তনুজা ছিল এক নরম-চঞ্চল মেয়ে, যে ভালোবাসা বোঝার আগেই নিজের মাকে হারিয়েছে; মায়ের ভালোবাসা তার ভাগ্যে জোটেনি। যে ভালোবাসার সাথে পরিচিত হতেই বাবাকে হারিয়েছে; যেই বাবা তাকে তার জীবদ্দশায় সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিল। এতিম বাচ্চা মেয়েদের এই সমাজে টিকে থাকার অনেক গল্প থাকে, ভয়ানক গল্প। তাদের পদে পদে নিজেকে রক্ষার লড়াই চালিয়ে যেতে হয়, এই লড়াই অস্তিত্বের লড়াই, সম্ভ্রম রক্ষার লড়াই।
আমাদের চঞ্চল তনুজা ধীরে ধীরে নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে। একগুঁয়ে, অন্তর্মুখী হয়ে যায়। স্বভাব পরিবর্তন কিন্তু এত সহজ নয়। এইটুকুন বয়সে সে বাস্তবতা চিনেছে। টিকে থাকার লড়াইয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে। ও জানে তখন—কী করলে কী প্রতিরূপ পাবে।
সেই সময় গিয়ে সে দ্বিতীয়বার কোনো ভরসার স্থান পায়, স্বামী সোহাগি হয়। তার স্বামী তাকে নিজের ব্যক্তিত্বের মতন ভালোবাসত। তনুজা অবাক হতো কেবল, তারপর নিজের এত বছরের কষ্টকে ভুলে গেল অজান্তেই। তার শুধু মনে হতো, একজন আছে.. এই একজন তার নিজের মানুষ। নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারে না আর। প্রথম ভালোবেসেছিল তার বাবাকে, যে তাকে বাস্তবতার সাথে পরিচয় করিয়েছে। অন্যমনস্কভাবেই প্রথমরাতে তনুজা তার স্বামীকে বলে ফেলে—সে হবে তনুজার লাইফের দ্বিতীয় পুরুষ, যে তাকে নিষ্ঠুরভাবে বাস্তবতার সাথে পরিচয় করাবে।

হলোও তাই। বিয়ের ক’বছর পর জানতে পারে, সে যত ভালো স্ত্রীই হোক না কেন, মা হতে পারবে না। ভেঙে যায়। পারিবারিক প্রতিবন্ধকতায় সে আর টিকতে পারে না। রিমেমবার ওয়ান থিং—তার স্বামী তাকে অগাধ ভালোবাসত। ভালোবাসাময় সংসার কেটেছে ৪-৫ বছর। সেই ৪-৫ বছর কানায় কানায় ভালোবাসা দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল। পরিচিত প্রায় সব মানুষেরাই তাদের ভালোবাসাকে মুগ্ধ হয়ে দেখত। অথচ ডিভোর্স হয়েই গেল। নজর লাগা বলতে একটা শব্দ অবশ্যই এক্সিস্ট করে। যেই পুরুষটা একসময় তাকে বুকে না নিয়ে ঘুমাতেও পারত না, সেই পুরুষটাই পাশে শুয়েও তাকে ছুঁয়ে দেখত না, পর পর কতগুলো মাস! আর ডিভোর্স! এর একমাসের মাথায় অন্য বউ আনে নিজের ঘরে।”

“ওহ্ শিট! বেঁচে আছেন তনুজা?”

ভদ্রমহিলা কিছু বললেন না, রূপম দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধাল, “এরপর?”

“এরপর যা হয়! মামার বাড়ি গিয়ে থাকে। সেখানে থাকা-খাওয়ার সমস্যা ছিল না, অর্থের সংকট ছিল না, ভালোবাসার অভাব ছিল না। ছিল প্রিয় পুরুষের সেই উন্মাদ করা আদরের, আগলে রাখা বুকের। দূর থেকে তনুজা প্রিয় পুরুষের বুকে তখন অন্য নারীর উন্মত্ত সুখ দেখতে পেত।”

“আমি হলে মরেই যেতাম! কিন্তু উনি?”

“সে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়। পিএইচডি করে ভালো একটা ভার্সিটির বাংলা ডিপার্টমেন্টের যোগদান করে। খুব অল্পসময়েই সাবলম্বী হয়ে যায়। তারপর ভার্সিটি এরিয়ায় একটা অ্যাপার্টমেন্টে একা থাকা শুরু করে। অ্যা ডিভোর্সী’স লাইফ ইজ নট দ্যাট মাচ ইজি! প্রায় জায়গায় কথা শুনতে হয়েছে, কু-প্রস্তাব পেয়েছে, আড়চোখা চাহনির অস্বস্তিতে পড়েছে। এত কিছুর পরও একা নারী হিসেবে নিজেকে সেইফ রেখেছে।
তার বছর খানেক যেতেই ফার্স্ট ইয়ারের নিউ ব্যাচের ক্লাস পায়। এক অসম্ভব রকমের দুষ্ট কোঁকড়াচুলোর প্রেমে পড়ে যায়, প্রথম দেখায়।”

“ওহ্ ওয়াও! লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট?”

“সেরকমই বলা চলে।”

“ওঁর লাইফে দ্বিতীয় প্রেম আসে, তাই-তো? ইশ! এরপর?”

“আসে ঠিকই। কিন্তু তনুজা তো অভাগী। সে মনের বিরুদ্ধে গেছে। কখনই তা বিশ্বাস করতে চায়নি যে, সে আবারও প্রেমে পড়তে পারে। নিজের অনুভূতির সাথে লড়ে এসেছে শেষ অবধি।
বছর দুয়েক পর যখন সেই ছেলেটা নিজ থেকে এসে প্রপোজ করল, তখনও তনুজা তাকে ঠুকরেছে। কত বাহানা দিয়েছে! বার বার বলে এসেছে—এক পুরুষে আসক্ত রমনী অন্যত্র সুখ পায় না। অথচ, সে নিজেই দ্বিতীয়বার মন হারিয়েছে এক শুভ্রাঙ্গের চঞ্চলতার উপর। আর তনুজা নিজেকেও তা বুঝতে দিতে নারাজ। বাচ্চাটা বাজেভাবে রিজেক্ট হলো।”

“ইশ! মিস তনুজা তা করলেন কেন?”

“কজ উই লিভস ইন অ্যা সোসাইটি!”

“এরপর?”

“এরপর ছেলেটা পাগলামো শুরু করে। পৃথিবীর এমন কোনো পাগলামি বাদ রাখেনি, যাতে করে তনুজাকে পটানো যায়।”

“আব্… সব?”

“না না! তুমি যা ভাবছ, তেমনটা নয়। সেই ছেলেটা সবসময় তনুজার থেকে একহাতের দূরত্ব রাখত। এটাকে সম্মানের দূরত্ব বলে। কিন্তু তনুজা তা চাইছিল না। ছেলেটাকে নিজের থেকে দূর করার জন্য সব করে। কান্নাটাও করে একসময়। তারপর সে সত্যিই দূরত্ব বাড়িয়ে নেয়।
যাওয়ার আগে শুধু বলেছিল, ‘এর চেয়ে আপনি আমার কাছে আমার জানটাই চাইতেন! কিন্তু চাইলেন দূরত্ব। বেশ! দিয়ে দিলাম।’
ছেলেটা ভেঙে পড়ে। খুব বেশি এলোমেলো হয়ে যায়। তারপর মানিয়ে নেয়। এইবার তনুজা প্রথমবারের চেয়েও বাজেভাবে ভেঙে পড়ে।”

“আমি বলব—তনুজার এতে দোষ ছিল। এত মাতব্বরি করতে বলেছিল কে? আরে ভাই! যাকে বিয়ে করব, তাকে আমি কেন ছাড়ব? সে হাজার দোষ করলে, তাকে মারব। মারতে মারতে মেরেই ফেলব। তাও কেন ছাড়ব? আচ্ছা, ছাড়লাম না হয়! এরপর আবার কেউ ভালোবাসলে কেন ফিরিয়ে দেবো? আমিও তো ভালোবেসেছি, তাই না? হোক সেটা বয়সে ছোটো। এজ-ডিফারেন্সে কি বিয়ে হয় না? কত হয়! আমার চাচিও তো চাচুর চেয়ে ৪ বছরের বড়ো ছিল। তবুও বিয়ে হয়েছে, সংসার হয়েছে। আমার চাচাতো বোনেরাও আমার সমান প্রায়। তনুজা একাকিত্বই ডিজার্ভ করে।”

“একটা বয়সে এসে গেলে মানুষ যা চায়, তা করতে পারে না। আর যা করতে হয়, তা সে কখনই চায় না।”

“ডু ইউ মিন দ্যাট—বয়সের দোষ সব?”

“নয় কি? তনুজা মা হতে পারবে না, এটা কোনো ম্যাটারই না। ছেলেটা তার ছোটো, তা-ও কোনো ম্যাটার নয়। সম্পর্কে তারা টিচার-স্টুডেন্ট। পরিণতিতে মানসিক অশান্তি পেত। ভাবো একবার।”

“কোনটা?”

“তুমি তনুজার জায়গায়। তুমি একজন লেকচারার। তোমার ডিপার্মেন্টের একজন স্টুডেন্টের প্রেমে পড়ে গেছ। সেই ছেলেটাও তোমায় ভালোবাসে। পাগলের মতো ভালোবাসে। অথচ, তোমার মনে রাখতে হবে—সে শুদ্ধ পুরুষ আর তুমি বন্ধ্যা তালাকপ্রাপ্য নারী। সে তোমার নিজের স্টুডেন্ট! এসব তো কল্পনাতে আনাও পাপ! তুমি সেই পাপ করলে। সেই ছেলেটাও একই পাপ করল। তারপর তুমি সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে যখনই সেই ছেলের কাছে যেতে চাইলে, তখনই খেয়াল করলে পেছনের দুই পুরুষের কথা। দুজনকেই ভালোবেসেছিলে, বিনিময়ে দুইজনেই বাস্তবতার সাথে লড়তে শেখাল। তৃতীয় জনের জায়গা কি সেই বাচ্চা ছেলেটাকে দেওয়া যায়, যে এখনও দুনিয়াদারির বাইরে? আচ্ছা, তুমি জানো—প্রকৃতি তোমাকে একা রাখতে পছন্দ করে। তারপরও কি কারো সাথে জড়ানোর সাহস পেতে?”

মাথা দুইহাতে চেপে রূপম চিল্লিয়ে উঠল, “চুপ করুন! প্লিজ, চুপ করুন! আমি পারব না। মরে যাব, মরেই যাব।”

এতক্ষণে হেসে উঠলেন ভদ্রমহিলা। হাসতে হাসতে বললেন, “এক নারী বার বার দুনিয়ার সকল সুখ হাতের মুঠোয় পেয়েও হাত ফসকে হারিয়ে ফেলল। তার কি বাঁচার কথা?”

“উনি কি মারা গেছেন?”

“মজার বিষয় এখানেই। সে একবারও সুইসাইড এটেম্পট করেনি। বরং বেঁচে থাকার যুদ্ধ করে গেছে। জানো? বেঁচে থাকার জন্য কোনো সম্বল লাগে না। জানটা থাকলেই হয়।”

“সেই স্বামীর খবর কী?”

“স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আছে।”

“সেই ছেলেটা?”

“তার কোনো খোঁজ নেই। যতদূর জানি—সে এখনও বিয়ে করেনি।”

“আর তনুজা?”

“তনুজা? তনুজারা তো সর্বত্র ছেয়ে আছে। অসংখ্য নারীর মাঝে এক-একটা তনুজার বাস। যারা সংকোচে সদা ঝুঁকে থাকে। প্রিয় চাঁদে হাত বাড়াতে গিয়ে দেখে, দ্বিধার জুড়ি নেই।”

“আচ্ছা! তনুজা কি কখনও সুযোগ পেলে তার কাছে ফিরবে?”

“সেটা তনুজা নিজেও জানে না। সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা তলানিতে। যদি পেয়েই যায়..”

“তবে?”

“তবে এবার বোধহয় অন্য কিছু হবে।”

“কী হবে?”

“সেটা আমি বলব না।”

“আচ্ছা, না বললেন। আপনি কি জানেন—আমাকে একটা কথা শিখিয়েছেন আজ!”

“কোনটা?”

“নিজেদের জায়গা ছাড়তে নেই, ছাড়লে তনুজাদের জন্ম হবে। আমি আমার জায়গা ছাড়ব না। আপাতত কোনো একভাবে এক্সকে শিক্ষা দেবো। এককাজ করি! আগে সেটেল হয়ে নিই, ওকে? তবে আমি যদি আমার লাইফে তনুজার মতো দ্বিতীয় কাউকে পাই, ফেরাব না। কারণ ভালোবাসা প্রতিবার প্রেম-দুয়ারে উঁকি দেয় না।”

বিপরীতে হাসলেন সে। রূপমের মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় নিয়ে ছাদে থেকে নিচে নেমে গেলেন, এরপর একটা ট্যাক্সি নিয়ে কলেজ রোড, শতরূপা হাউজিং, তালতলা, আবেসিকা, রিদম গ্রাউন্ড দিয়ে ঘুরলেন রাতের সাড়ে দশটা অবধি। এরপর বাস স্টপেজে চলে গেলেন। এগারোটার বাসে ফিরতে হবে তাঁকে। বছরে অন্তত দুই-তিনবার আসা হয়, এভাবেই ঘোরা হয়। নির্দিষ্ট কোনো দিন নেই। যান্ত্রিক জীবনটা ভারি হয়ে গেলেই এক ঝলক স্মৃতিচারণের উদ্দেশ্যে এখানে আসাটা হয়। কত স্মৃতি আছে! সেসব ভোলা অসম্ভব।

তাঁর প্রস্থান ঘটাতেই রূপমও দৌড়িয়ে হোস্টেলের রুমে ঢুকল। দেখল—বান্ধবীর হাসি-খুশি মুখখানা। যদিও সবসময়ই এভাবে থাকে।
রূপমকে আসতে দেখেই বলল, “সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছিলাম! সকালে গেছিস আর ফিরতে এতক্ষণ!”

সকালেই তো আশিক ডেকে নিয়ে গিয়ে ব্রেক-আপ করল। তারপর মন শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে বিভিন্ন ধরনের উলটা-পালটা কথা ভেবেছিল। তারপর হোস্টেলের ছাদে এসেছিল বিকেলে। ভেবেছিল, “আজ আমার শেষ হওয়ার দিন। একটা রিকুয়েস্ট, পৃথিবী! একটু পর যখন আমার ডেডবডির ফোটোগ্রাফি হবে, তখন যেন আমায় দেখতে বিশ্রী না লাগে। ব্যাপারটা আমার জন্য লজ্জাজনক হবে।”

এসব ভাবতে ভাবতে যখনই ঝাঁপ দেবে, তখনই পাশ থেকে এক অসম্ভব রূপবতী মহিলা বলে ওঠেন, “এই, মেয়ে! কী করছ কী?”

তারপর রূপম তাকে জানাল, “আজ আমার শেষদিন। নিজের বোকামোতে আমি লজ্জিত। এই লজ্জা নিয়ে বেঁচে থাকার মানেই নেই। আজ আমার ব্রেকআপ ডে।”

“তো সেলিব্রেট ইট!”

রূপম অবাক হয়ে তাকায়। তখন তিনি তাকে নিয়ে এক বেঞ্চিতে বসে মাইন্ড ডাইভার্টের চেষ্টা করেন। তিনি জানতেন, ‘দুনিয়া অন্যের কষ্টকে কতটা ভালোবাসে! যখনই কোনো মানুষ দেখে—কেউ তার চেয়েও বেশি কষ্টে আছে, তখন তার ব্যাথাটা আপনা-আপনিই কমতে লাগে।’
বিষয়টা রূপমের ক্ষেত্রে কাজে লাগান, লেগেও যায়। আর সেটা রূপম ধরতেও পেরেছে।

ক্ষণিকে বিষয়গুলো ভেবে মনটা জুড়িয়ে নিল। এরপর আসল ঘটনা এড়িয়ে গেল প্রিয় বান্ধবীর সামনে, “হ্যাঁ, রাস্তায় এক ছোকড়াকে দেখে ডুবে গেছিলাম। উঠতে উঠতে এত দেরি!”

“বুঝি বুঝি! মনে মনে যে মনকলা খাচ্ছ, বুঝি!”

“ছাতার মাথা বুঝিস। এবার বল তো, এত খুশি কেন?”

“তোকে বলেছিলাম না? আমার এইটিনথে তনুমা আসবে। কাল তো আসতে পারেনি। তাই আজ এসেছিল।”

“সত্যিই?”

অর্ষা বলল, “হ্যাঁ, ঘন্টা খানেক আগেই গেল। ইশ! তুই আরেকটু আগে এলে দেখা করিয়ে দিতাম। আমার তনুমা বেস্ট! তার মতো কেউ না। সবাইকে যে কী সুন্দর বোঝে!”

তনু! ত-নু! মনে মনে নামটা দু’বার আওড়াল রূপম। এবার খটকা লাগল তার, “ওয়েট! তোর তনুমা কি ছাঁই-রঙা তাঁতের শাড়ি পরে এসেছিল?”

“হ্যাঁ, দেখা হয়েছে?”

“তার নাম কী?”

“তনু।”

“পুরো?”

“তনুজা।”

হুট করেই রূপমের মস্তিষ্কে ভেসে এলো সামনে কিছু পাঁকা চুল নিয়ে বসে হাসতে থাকা মধ্যবয়স্কার কিশোরী, দূরন্ত রূপ। কানে কানে কেউ যেন ফিসফিসিয়ে গেল, “কেউ কাউকে ছাড়া মরে না। প্রকৃতি সুন্দরভাবে বাঁচতে শিখিয়ে দেয়। ঝরে পড়া পাতাদের ভুলে গিয়েও গাছে নতুন পাতার জন্ম হয়। আচ্ছা! মৃত্যু কি এতই সহজ?”

জবাবে অদৃশ্য কেউ বলে ওঠে, “দুনিয়ার সবচেয়ে সহজ কাজ হলো বেঁচে থাকা। কঠিন তো মৃত্যু।”

কেউ চাইলেই বেঁচে থাকতে পারে। অথচ, মৃত্যুর চিন্তা করতে গেলেই আসে হাজারও পিছুটান। সেই টানে পিছে তাকালেই, দেখতে পারে—কেউ তার অপেক্ষায় দিন গুনছে, তাকে একটু ছুঁতে না-পারার জন্য প্রাণ-প্রিয় গিটারটাকে ছোঁয়নি আজ বারো বছর।

________
পরিশিষ্ট:

শুদ্ধ একা বাঁচতে শিখে গেছে। বারোটা বসন্ত একা কাটিয়ে ফেলেছে। এই বারো বসন্তে জীবনে প্রেম আসেনি আর। প্রেমবসন্ত তো ছিল সেই তনুময় বসন্তগুলো; এখন তনুজাও নেই, প্রেমও নেই।

শুদ্ধর আর খারাপ লাগে না। বয়সটা সাঁইত্রিশের কোঠায় এসেছে না? এখন মনে হয়—তনুজা যা করেছিল, ঠিকই করেছিল। সব প্রেমের পূর্ণতা পেতে নেই। কিছু প্রেম আসেই জীবনে অপূর্ণতা সঙ্গে নিয়ে। সেই অধ্যায়গুলো আবার ভারি সুন্দর হয়। শুদ্ধ চোখ বুঁজলেই বছর বারো আগের সেই সংঘর্ষগুলো পরিষ্কার দেখতে পায়।

সুভা বেগম প্রতিদিনই একবার করে বলেন—বিয়ে করতে। শুদ্ধ জবাবে শুধু একটা মুচকি হাসি দেয়। সে-ও যদি বিয়ে করে নেয়, তাহলে সিদ্দিক আর তার মধ্যে পার্থক্যটা রইল কই? সে বিয়ে করেনি, অপেক্ষা করছে। জীবনের শেষদিনটাতে যদি তনুজা সব ভুলে যায়, সব ভুলে তার কাছে চলে আসে! শুদ্ধ দু-হাত বাড়িয়ে আপন করে নেবে। হোক সেটা মুহূর্তের জন্য!

সে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে—এই শহরেরই কোনো এক কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে হুট করেই তাদের দেখা হয়ে যাবে; পৃথিবীটা বড্ড ছোটো, দেখা হতেই হবে। তনুজা তখন ঝাঁপিয়ে পড়বে তার বাহুবন্ধনীতে—সে শক্ত করে আঁকড়ে ধরবে, ইহজীবনের তরে। একবার ধরতে পারলে, আর ছাড়বে না। তনুজা বুকে মুখ গুঁজে হাসবে, শুদ্ধ তখন কাঁদবে। এই-যে, বিগত বারো বছরের জমানো এত কান্না! এই কান্নাগুলো সেই দিনটায় কাঁদবে, তাছাড়া নয়।
সে শুধু বিশ্বাসই করে না, জানেও অবশ্য—অলকানন্দা তার শুদ্ধপুরুষকে একদিন ভালোবাসবে, ভালোবাসা প্রকাশও করবে। শুদ্ধ সেই দিনটার অপেক্ষায় আজও একা।

উঁহু! একা নয়। তার বুকেতে আস্ত এক তনুজার বসত।

~সমাপ্ত~

শব্দসংখ্যা-২৩৫১

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here