অপ্রেমের প্রিয় অধ্যায় পর্ব -২৬

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_২৬ (আমাদের রঙিন স্বপ্নগুলোর মতন আপনাকে ভালোবাসুক)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“হ্যালো!”

শাওয়ার নিয়ে রুমে প্রবেশ করতেই ফোনে আশার নম্বর থেকে কল আসে। তনুজা দ্বিধা নিয়ে রিসিভ করল। তার স্বর শুনে ওপাশের পিচ্চি অর্ষা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠল, “তনুমা তুমি? কী মিষ্টি ভয়েস তোমার! মাম্মা ঠিকই বলত! তোমার সবকিছুই বেস্ট বেস্ট! একদম মাম্মা মাম্মা বেস্ট বেস্ট! হ্যালো! কথা বলছ না কেন?”

তনুজা বিস্মিত হয়ে একবার ফোনের স্ক্রিনে নাম্বারটা দেখে আবারও ফোন কানে তুলল। নাহ্! এটা তো আশারই নাম্বার। তবে কি?

কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে শুধাল, “ক..কে?”

“যাহ্ বাবা! আমি তো পরিচয় দিতেই ভুলে গেছি। আমি হচ্ছি অর্ষা! অর্ষা আবরার সিদ্দিক। আমার বাবাইয়ের একমাত্র প্রিন্সেস। মাম্মার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমার বয়স পাঁচ.. না না! ছয়। ক’দিন আগেই ছয় হলো। ডিএসএস-এ ক্লাস টু-তে পড়ি। রোল নং ২।”

এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে অর্ষা হাঁপিয়ে গেল। বুকে হাত রেখে দম ফেলে আবার বলল, “আর তুমি?”

তনুজা জবাব না দিয়ে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে পালটা প্রশ্ন শুধাল, “তুমি অর্ষা?”

“হ্যাঁ, বাব্বা! হ্যাঁ!”

“কল কী করে করলে?”

“মাম্মার ফোন থেকে।”

“মাম্মা কই?”

“এই তো, এখানেই আছে!”

“আ..আমাকে কল করলে..”

“হ্যাঁ, গো! মাম্মা তোমার কথা খুব বলে। আমারও তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল, মাম্মা বলিয়ে দিলো। ইউ নো না—শি ইজ দ্যা বেস্ট মাম্মা ইন হোল ইউনিভার্স!”

“আব্!”

“বলো বলো!”

“হ্যাঁ, তোমার মাম্মা বেস্ট!”

“মাম্মাম বলল—তুমি নাকি লুকিয়ে পড়েছিলে! আচ্ছা, কেন লুকোলে বলো তো! তুমি না লুকোলে আজ আমরা একসাথে থাকতাম না? আমার কত্ত ইচ্ছে তোমাকে সামনে থেকে দেখার। কত্ত ইচ্ছে তোমাকে ছুঁয়ে দেখার!”

তনুজা কথা বলতে পারছে না, শব্দ হারিয়ে ফেলেছে। ওপাশে অর্ষা বলতেই থাকল, “জানো? আমার তোমাকে কী যে ভালো লাগে! কত্ত সুন্দর দেখতে তুমি। মাম্মা ছবি দেখিয়েছে। তুমি একটা ল্যাভেন্ডার শাড়ি পরে ছিলে। একদম আমার পরীমা পরীমা লাগছিল তোমায়। আচ্ছা শোনো! আমিও শাড়ি পরব। আমার শাড়ি পরতে খুব ভালো লাগে। বাবাই আমাকে আটটা শাড়ি কিনে দিয়েছে। তো, আমিও তোমার ওইরকম একটা শাড়ি পরব। তুমিও পরবে। ঠিকাছে? দুজনে একরম করে সাজব। তারপর এত্ত এত্ত জায়গায় ঘুরব। বাবাই ড্রাইভ করবে, পাশে তুমি বসে থাকবে আর আমি তোমার কোলে! ওহ্ না! তাহলে মাম্মা কই থাকবে! উমম.. আইডিয়া! আমি-তুমি-মাম্মা পিছে বসব। বাবাই হবে আমাদের ড্রাইভার! কী মজা!”

তনুজার চোখ গড়িয়ে অশ্রু ঝরল। জলদি করে জল মুছে নিল। দু’বার শ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল, “কেমন আছ, সোনাই?”

“ভালো ভালো ভালো, খুব ভালো আছি। ইশ! কী সুন্দর করে ডাকলে তুমি! আমার খুব ভালো লেগেছে।”

“তাই?”

“হ্যাঁ, তাই?”

“কী করছ? খেয়েছ সকালে?”

“নাহ্! মাত্র উঠলাম। তুমি খেয়েছ?”

“না তো!”

“আচ্ছা, একসাথে খাব। তুমি আমাদের বাড়িতে এসো।”

“আমি তো আসতে পারব না!”

“কেন?”
প্রশ্ন করেও থামল অর্ষা। এই কেন-এর কারণ তো একটু আগেই আশা তাকে বুঝিয়েছে, আর সে বুঝেছেও। তাই বলল, “ওহ্! আচ্ছা সমস্যা নেই। আমি যাব, কেমন? মাম্মা বলেছে, বড়ো হলে যেতে। আমি জলদি জলদি বড়ো হয়ে যাব। তারপর তোমার সাথে খুউব খেলব।”

“আচ্ছা, ঠিকাছে।”

“ভিডিয়ো কলে আসো।”
এই বলে অর্ষা ক্যামেরা অন করে ফেলল। তনুজাও ভালো মতো চোখ মুছে কল রিসিভ করল। অর্ষা তনুজাকে দেখেই মিষ্টি করে হাসল, “হায় আল্লাহ্! তুমি কী মিষ্টি গো দেখতে!”

অর্ষার হাসিমুখের হাসি তনুজাতেও ট্রান্সফার হলো। সে-ও হেসে বলল, “তোমার চেয়ে কম নয়।”

“এহ্! জানো? জানো? আমি কাল রাতে তোমার ছবি দেখে অনেক কিছু মিলিয়েছি। এই যেমন, আমাদের হেয়ার কালার! দুজনেরই ব্রাউন। আমাদের গায়ের রঙ, দুজনেরই সেম সেম। আমাদের হাসিও একই রকম। শুধু আমার চোখটা মাম্মার মতো বিড়ালচোখী। মাম্মা বলে—আমার রাগও নাকি তোমার মতো, কাঁদিও তোমার ধরনেই। তাই আমি গোটাটাই তোমার মতন হতে চাই। আমি হব আমার তনুমায়ের জুনিয়র ভার্সন, সুন্দর না?”

“আমার মতো হতে চাও?”

অবাক হয় তনুজা। ওপাশে অর্ষার পেছনে আশাকে দেখা যাচ্ছে। আশা অর্ষার কাছ থেকে ফোন নিয়ে অর্ষাকে এক হাতে আগলে তনুজাকে দেখে হেসে বলল, “তোমার অপূর্ণতা ও পূরণ করছে, তোমার মতোই। সবাইকে বোঝে, সবার খেয়াল রাখে। ওর বাবাইয়ের উপর রাগ করে, অভিমান করে। একদম তোমার মতোই।”

তনুজা মলিন হাসল, “ওকে আমার মতো না বানালেও পারতেন, আশা আপু।”

আশা ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবল কিছু। এরপর অর্ষাকে বলল, “ফ্রেশ হয়ে এসো। মাম্মা তোমার তনুমার সাথে কথা বলবে, প্রিন্সেস! পার্সোনাল!”

“ওকে, মাম্মা!”
অর্ষা দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। আশা ফোন নিয়ে ব্যালকনিতে প্রবেশ করল। ফোনটা সামনে এনে বলল, “বিশ্বাস করো, আমার কোনো দোষ ছিল না। আমি ভেবেছিলাম—তুমি আর আসবে না। ওদিকে আবরারকে একা দেখে বুকটা কাঁদছিল খালি। মাঝে লোভ জেগেছিল—ওকে আরেকবার নিজের কাছে পাওয়ার। তাই আমি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। যদি জানতাম—তুমি ফিরবে…”

কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে তনুজা বলে উঠল, “তবে আমার ফেরার রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে হলেও আপনি ওকে নিজের করে নিতেন।”

ছলছলে চোখে তাকাল আশা। তনুজা বলল, “ভালোবাসা একটা মহামারীর নাম। শহরজুড়ে এই মহামারীর রাজত্ব। কেউ মরে, কেউ জ্বলে, কেউ পোড়ে, কেউ ছাঁই হয়; আবার কেউ-বা হয় ফিনিক্স বার্ড। আপনাদের রিলেশনের সময়—সিদ্দিক বা আপনি, কেউ-ই সিরিয়াস ছিলেন না। সিদ্দিকের দিক দিয়ে যা-ও একটু-আধটু ছিল, আপনার দিক থেকে তা সম্পূর্ণই শূন্যের কোঠায়। তাই আপনি ওর চেয়ে বেটার কাউকে পেয়ে, সেদিকে ঝুঁকলেন। আর মানুষ হারালেই তার মর্ম বোঝে, যদি না তার প্রেক্ষিতে পাওয়া জিনিসটা বেটার হয়। আপনি দেখলেন—আপনার স্বামীর চেয়ে সিদ্দিকের কাছে আপনি বেশি ভালো থাকতেন। আস্তে-ধীরে এত দিনের একসাথে থাকা সম্পর্কের উজ্জ্বল দিনগুলো আপনার চোখে ভাসতে থাকে। আপনি স্বীয় স্বামীর স্থানে, প্রাক্তন প্রেমিকের প্রেমে পড়তে থাকেন। তারপর এতটাই ডুবে যান যে, তালাক সেই সম্পর্কের শেষ পরিণতি হয়। এরপর ভাবলেন—ফিরে আসবেন। তখন দেখলেন—সিদ্দিক বিয়ে করে নিয়েছে। তারপর..”

তড়িঘড়ি করে আশা বলল, “তারপর আমি হতাশ হয়েছি আর জাস্ট বন্ধু হয়ে থাকতে চেয়েছি। ট্রাস্ট মি—নাথিং এলস!”

“আই ট্রাস্ট ইউ। আপনি জাস্ট ফ্রেন্ড হয়েই থাকতে চেয়েছিলেন, থাকতেন। ইমম্যাচিওর ছিলাম আমিই, তাই বুঝতে পারিনি। আমি আমার লাইফে ভালোবাসা বলতে কেবল আমার বাবাকেই বুঝতাম। তাকে হারিয়ে ফেলার পর, আমার লাইফের সবচেয়ে বড়ো শূন্যতা ছিল—ভালোবাসায়। আমি ভালোবাসার জন্য হাহাকার করতাম। চাচিকে খুশি করার জন্য কী না কী করতাম! তা-ও আমায় ভালোবাসতেন না। তারপর সিদ্দিককে পেলাম, যে আমাকে ঠিক আমার বাবার মতোই ভালোবাসত। তাকে পেয়েই যেন আমি আমার গোটা দুনিয়া পেয়ে গেলাম।”

থামল তনুজা। আশার দিকে তাকাল, সে কাঁদছে। তনুজা তা দেখে মলিন হেসে বলল, “কাঁদছেন কেন?”

জবাবে আশা কিছু বলতে পারল না। তনুজা হাসি নামিয়ে বলল, “কাঁদবেন না। আপনার সব কান্না মেঘেরা শুষে নিক, নীলাকাশের মতো হাসুন আপনি। আসলে, বেশি সুখ আমার কপালে সয়নি। যখনই আমি নিজেকে সর্বসুখী রূপে জনসম্মুখে প্রকাশ করলাম, তখনই আমার অপারগতার গল্প দেয়ালে দেয়ালে ছাপানো হলো। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো অপারগতার গল্প বোধহয় বন্ধ্যাত্বের গল্প, তাই-না? আমি এদিক থেকে হেরে না গেলে কখনই সিদ্দিককে ছাড়ার মতো অসহনীয় কাজ করতে পারতাম না। খুব বেশিই ইনসিকিউরড ফিল করতে থাকি ওকে নিয়ে। মনের মাঝে দলাপাকানো কষ্টেরা আমাকে মাঝে-মধ্যেই বলতে থাকত—তনু, সিদ্দিক তোকে ফেলে দেবে, খুব শিগগিরই! আমি মানতেই পারতাম না। আমার মাথা কাজ করত না। আমাদের দাম্পত্যটা অশান্তিতে যাচ্ছিল। বার বার মনে হচ্ছিল—আপনি আমার সিদ্দিককে আমার থেকে কেড়ে নেবেন। আমি আবার একা হয়ে যাব। দিনকে দিন আপনাকে অসহনীয় লাগতে থাকে, আপনার কথাগুলোকেও অসহ্য লাগতে শুরু করে। ওদিকে সিদ্দিকের মা ওর জন্য মেয়ে দেখছিলেন। কতটা অপমানের, বুঝতে পারছেন? রাগে-দুঃখে সিদ্দিকের সাথে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। তারপর আর চেয়েও ফেরার পথ পেলাম না।
কিছুদিন পর দেখলাম, আপনার বিয়ে হলো! আপনি সিদ্দিককে একা দেখে কষ্ট না, শান্তি পেয়েছিলেন। ফিরে পাওয়ার স্কোপ পেয়েছিলেন যে! এরপর নিয়ে নিলেন তাকে নিজের করে। ভালোবাসা মানুষকে এতটাই নির্বোধ বানিয়ে দেয়। অন্যের সংসার ভেঙে নিজেরটা গড়তে শেখায়। আপনার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই আমার। সত্যি! কোনো অভিযোগ নেই। আমার সিদ্দি.. স্যরি! সিদ্দিক! সিদ্দিককে আর ওর মেয়েকে হ্যাপি রাখুন, তাহলেই হবে।”

“তুমি কি আমায় অভিশাপ দিয়েছিলে, তনুজা?”

“আপনি কি অশান্তিতে আছেন? আমার অভিশাপ লাগে খুব। চাচাতো ভাইকে দিয়েছিলাম, সে পঙ্গুত্বকে আপন করেছে। এলাকার এক দুশ্চরিত্র লোককে বউ পেটাতে দেখে দিয়েছিলাম, তার ক’দিন পরেই ক্যান্সার হয়েছিল, মারা গেছে। আর কাউকে দিইনি। আপনাকে দিলে, এখনও আমার সাথে কথা বলার অবস্থায় থাকতেন না। আমার অভিশাপ আপনাতে লাগলে, আপনি শান্তিতে থাকতে পারতেন না, আপু।”

“আমি শান্তিতে নেই। আমার সব আছে। বর আছে, ঘর আছে, সন্তান আছে; শান্তি নেই।”

তনুজা লম্বা একটা শ্বাস টেনে বলল, “কারো সংসার ভেঙে স্বীয় সংসার গড়া রমনী সুখী হয় না। কিন্তু, আপনার বেলায় উলটো হোক। আমার স্বামীর বুকে আপনি শান্তিতে থাকুন। যান, দোয়া করে দিলাম। আমার অভিশাপের মতো দোয়াটাও খুব লাগে।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে আপনমনে বিরবির করে উঠল, “যেই মানুষটার পাশে নিজের ছায়াকেও আমার সহ্য হতো না, সেই মানুষটার বুকে আপনার জায়গা হওয়ার জন্য আমি সর্বক্ষণ সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে যাব। সিদ্দিক আপনায় ভালোবাসুক..আমাদের একসাথে দেখা রঙিন স্বপ্নগুলোর মতো ভালোবাসুক।”

___
ভার্সিটি থেকে ফিরতে ফিরতে আজ তনুজার সন্ধ্যে হলো। বাসায় এসেই দেখতে পেল—দরজা খোলা। অপ্রস্তুত হয়ে রুমে প্রবেশ করল। নাহ্! কোনো সন্দেহবাতিক চিহ্ন চোখে পড়ল না। খটকা লাগল—রুমের দরজার সামনে গিয়ে। ভেতরটায় তাকাতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে এলো। পুরো রুম অগোছালো হয়ে আছে, যেন কেউ চিরুনি তল্লাশি চালিয়েছিল। তারপরই দরজায় লাগানো স্টিকি পেপারে চোখ গেল। হাতের লেখা তার বড্ড পরিচিত।

তনুজা সেটি পড়ল। ভালো মতো পড়ল। হলুদ কাগজটিতে গুটি গুটি শব্দে লেখা আছে,

—“জীবনের মতো রুমটাও এলোমেলো করার জন্য, স্যরি। দুটোই গুছিয়ে নেবেন।
~ইমতিয়াজ তালুকদার শুদ্ধ”

চলবে?
শব্দসংখ্যা-১৫১০

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here