অপ্রেমের প্রিয় অধ্যায় পর্ব -২৩

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_২৩ (মৃত্যুতেও পিছু নেব)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

দুদিন পর, সকাল সকাল শুদ্ধ পৌঁছে গেল সিলেটের একটা রিসোর্টে। এখান থেকে তনুজার এপার্টমেন্টটা খুব একটা দূরে নয়। শুদ্ধ নিশ্চিন্ত হয়ে সকালটা কাটাল। সে চাইছে না, তনুজার বাসার ভেতরে ঢুকতে। তাই আপাতত তার বের হবার অপেক্ষায়।
একটা কফির কাপ হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। বাঁ হাতটিতে ফোন, ওপেন করা আছে সিদ্দিকের ইনবক্স। একটু পর পর তার সাথে কথা হচ্ছে। মূল বিষয়বস্তু—তনুজা।

অনেকক্ষণ যাবত শুদ্ধর মনের মাঝে একটা প্রশ্ন কিলবিল করছে, সিদ্দিককে তা শুধানোর আগে নিজ থেকে উত্তর মেলানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। অবশেষে পারল না আর। কৌতুহলী মন নিয়ে সিদ্দিককে একটা টেক্সট পাঠাল, “উনি চরিত্রহীনা কী করে হলেন?”

সিদ্দিক দেখল ম্যাসেজটি। রিপ্লাই দিতে সময় নিল। অ-নে-ক-টা সময় পর সিদ্দিক রিপ্লাই লেখা শুরু করল। শুদ্ধর কফি শেষ। কাপটি ব্যালকনি টেবিলের উপর রেখে আবার ফোনের দিকে তাকাল। একটা বিশাল আকারের ম্যাসেজ মাত্রই সেন্ড হওয়ায় নোটিফিকেশনের সাউন্ডটা এলো!

“ওটা রাগের তেজে, মস্তিষ্কের ভারসাম্য হারিয়ে বলে ফেলেছিলাম; অ্যা কাইন্ড অব্ গালি। চরিত্র শব্দের অর্থ হচ্ছে—বৈশিষ্ট্য, স্বভাব, আচরণ, ধর্ম! বলো—কার নেই এগুলো?”

শুদ্ধ রিপ্লাই করল, “ওই শব্দটা খুব বাজে, স্যার!”

“আমি নিজেও বাজে মানুষ। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দিব্যি আছি। ওদিকে একটা মানুষ আমার থেকে আলাদা হয়েও সম্পূর্ণ আমার হয়ে আছে।”

“তনুজাকে নিয়ে আমি কথা বললে, আপনার খারাপ লাগে না?”

“লাগে না বলছ?”

“লাগে বোধহয়!”

“লাগে অবশ্যই। ওর সাথে আমার অন্তরাত্মার প্রেম হয়েছে। একসময় যার পাশে নিজের ছায়াকেও সহ্য হতো না, আজ নিজ হাতে তাকে তোমার করে দেওয়ার পাঁয়তারায় মেতেছি।”

“প্রেম ভয়ঙ্কর!”

“প্রেম মৃত্যুতুল্য ভয়ঙ্কর সুন্দর।”

______
বিকেলের দিকে তনুজা শিফাকে নিয়ে বেরোল। শুদ্ধ সিদ্দিকের মাধ্যমে তা জানতে পারল। সে নিজেও তৈরি হয়ে বেরোল। তনুজার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে শুদ্ধ পিছু পিছু হাঁটতে লাগল। কিছুক্ষণের ঘোরাঘুরির পর তনুজা গিয়ে একটা কফিশপে ঢুকল। শুদ্ধও গেল।

শিফা আর তনুজা মিলে একটা টেবিলে বসতেই শুদ্ধ তাদের পাশের চেয়ারে দুম করে এসে বসে পড়ল। তনুজা চকিতে চাইল। চোখ-মুখ প্রবল উৎকণ্ঠিত। মুখ দিয়ে বেরোল একটাই শব্দ, “তুমি!”

শুদ্ধ নতমুখী হয়ে চুলে হাত দিয়ে চুলকে হাসল। সেই হাসিতে ঘায়েল হলো তনুজা। রাগে শরীর কাঁপছে তার, কণ্ঠে অস্বাভাবিকতা প্রকাশ পেল, “এখানে কী করছ তুমি?”

শুদ্ধ একবার পাশ ফিরে শিফার দিকে তাকাল। তাতে শিফা নিজের ফোন হাতে নিয়ে, ফোনের দিকে দৃষ্টিবদ্ধ রেখেই ওখান থেকে প্রস্থান ঘটাল। শুদ্ধ আনমনে হেসে উঠল। তনুজা শিফার এভাবে উঠে যাওয়া দেখে তেতে উঠল, “এই, এই তুমি কী করলে এটা? ও চলে গেল কেন? হ্যাঁ?”

জবাবে শুদ্ধ বলল, “আব্! হিপনোটিজম ছিল, ম্যাম!”

“মজা নিচ্ছ আমার সাথে?”

শুদ্ধ চোখ মেরে বলল, “খানিকটা!”

“তুমি আমার এড্রেস পেলে কোথায়?”

“আসলে, সেদিন স্বপ্নে আপনি এসেছিলেন। উফফ! কী সুন্দর ওয়েদার, কী সুন্দর সিচুয়েশন, কী সুন্দর আপনি! এরপর কানে কানে এসে বললেন, ‘শুদ্ধ, আমি এখানে থাকি। জলদি এসো তো! এসে আমার মনটা চুরি করে নিয়ে যাও’। তারপর আমি চলে এলাম এখানটায়।”

“অসহ্য কথাবার্তা না বললে, চলছে না?”

“কী অসহ্য কথাবার্তা বললাম? আপনিই তো আপনার এড্রেস জানালেন আমাকে। হুহ! সব দোষ এখন আমার, তাই-না?”

অতিষ্ট হয়ে তনুজা বলল, “তোমার কোনো দোষ নেই, তুমি আগা টু গোড়া একটা দোষ! আমার কপালে এসেছে জুটেছে এই দোষ। শান্তিতে থাকতে দেবে না, তাই-না?”

“আমি-হীনা শান্তি আপনার না হোক। অশান্তিও যদি আমি হয়ে থাকি, তবে তাই আপনার হোক।”

তনুজা গভীর নিঃশ্বাস ফেলল। হালকা ঝুঁকে টেবিলের উপর দু-হাত ঠাস করে ফেলল। অধৈর্য স্বরে বলে উঠল, “তুমি কি সত্যিই বুঝতে পারছ না—আমি তোমায় চাইছি না?”

“আপনি আমায় চাইতে ভয় পাচ্ছেন।”

“কীসের ভয়?”

“আছে না কিছু.. বলা বারণ!”

“আমার কোনো ভয় নেই। তোমার জন্য আমার হাজারটা সমস্যা হচ্ছে, সে-কারণে জায়গা পরিবর্তন করলাম। আর তুমি এখানটাতেও চলে এলে!”

“আপনাকে ছাড়া থাকতে পারছিলাম না তো!”

“এদিকে আমি তোমার সামনে থাকতে পারছি না। আমার প্রবলেমেটিক লাইফে তুমি আগুন হয়ে এসেছ। প্রবলেমের সাথে আমাকেও জ্বালিয়ে ছাড়ছ। বেঁচে থাকা যেন দিনকে দিন দুষ্কর হয়ে উঠছে আমার জন্য।”

“ম্যাম, আপনি বুঝলেন না—আপনাকে ছাড়া আমি কতটা অসহায়!”

“আর তুমি আমায় বুঝলে না—তোমার সামনে হেসে-খেলে মায়া না বাড়িয়ে কেন আমি দূরে থাকার সিদ্ধান্তে এলাম। এতটাও ইজি ছিল না আমার জন্য।”

শুদ্ধ চুপ রইল। তনুজা আবার বলা শুরু করল, “নতুন জায়গা, নতুন মানুষ.. শুধু এক পুরোনো কথাগুলো, সদৃশ আঘাতগুলো। অ্যা ডিভোর্সি’স লাইফ ইজ নট সিম্পল! অনেক কম্পলিকেশন ফেইস করতে হয়, শুদ্ধ! অ-নে-ক! আর আমি জেনে-বুঝেই এই লাইফটা চুজ করেছি।”

“আপনি চাইলেই কিন্তু লাইফটা আরও বেটার হতে পারে!”

“অথচ, আমি এই লাইফেই থাকতে চাই। এখানটায় আমার সিদ্দিকের স্মৃতি আছে।”

“উনি তো অন্য কারো বর!”

“ছিল তো একসময় আমারও!”

“আজ নেই।”

“ছাড়েনি।”

“একসাথে নেই আপনারা।”

“আলাদাও হইনি।”

“আর ডিভোর্স?”

“একপাক্ষিক.. সিদ্দিক সাইন করেনি।”

শুদ্ধর জন্য গত দুদিনের এতগুলো চমকের মাঝে এটা ছিল সর্বোর্ধ্বস্থ। চমকের রেশ যায় না, কথা বলতে পারে না। তনুজা শুদ্ধর এই অবস্থা দেখে শান্ত হলো। চেয়ারে হেলান দিয়ে গা ছেঁড়ে বসে বলল, “তুমি যে আমার ব্যাপারে কতটুকু জানো—শিখা আমাকে বলেছে, এ-নিয়ে বেশি ভাবতে হবে না। আর, সিদ্দিক সাইন করেনি—কী করে জানলাম জানো?”

শুদ্ধ তাকাল তনুজার চোখের মণি পানে। তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তনুজা বলল, “আশা বলেছে। আশার সাথে আমার যোগাযোগ হয় বছর কয়েক আগে। ওর সাথে হঠাৎ দেখা। তখন আমি খুব অপ্রস্তুত হলেও, ও স্বাভাবিক ছিল। একটা কফিশপে বসি। ও আমাকে সব জানায়। তারপর থেকে আর অন্যত্র জড়ানোর সাহস পাইনি, বুঝলে?”

শুদ্ধ ছলছল চোখে তাকাল, “কোনো ওয়ে নেই?”

তনুজা ডানে-বাঁয়ে বড্ড আস্তে-ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু! নেই..”

“সিদ্দিক স্যার যদি ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দেন?”

“করবে না ও।”

“কেন?”

“আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেলে আমি ওর সাথে কনট্যাক্ট করতে পারব না আর। ওকে দেখতে পারব না। অল্প ক-বার হলেও, আমি লুকিয়ে ওকে দেখেছি, দেখতে গিয়েছি আর যাই, যাব। এ-ই নিয়েই বেঁচে আছি। ও আমার এটুকু চাওয়া অপূর্ণ রাখবে না। ও আমাকে শাস্তি দিতে চায়। মরে গেলেই তো সব থেকে মুক্ত হয়ে যাই। ও আমাকে মরতে দেবে না। ও আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে, আস্তে-ধীরে তীব্র ভাবে মরণ যন্ত্রণা অনুভবের জন্য।”

“বেঁচে থাকার অবলম্বনটা কি আমি হতে পারি না?”

তনুজা হাসল, “তুমি আমার প্রেম নও, শুদ্ধ। তুমি আমার প্রিয়তম নও।”

“চাইলেই হতে পারি।”

“অথচ, ও না চাইতেও অনেকটা হয়ে গিয়েছিল। তারপর.. আর কাউকে দেওয়ার মতো বুকের গভীরে অনুভূতি নেই।”

“ট্রাস্ট মি, ম্যাম! আমার কিচ্ছু লাগবে না। শুধু আপনি হলেই চলবে।”

এই পর্যায়ে শুদ্ধর গলা কেঁপে উঠল। তনুজার খুব খারাপ লাগল। মনের গভীরে কোথাও একটা খুবই সূক্ষ্ম পীড়া অনুভব হলো। ঠিক এটা চাইছিল না বলেই তো ট্রান্সফার নিল। অথচ তাই হলো! খুব জলদি হলো, খুব সুন্দর মতো হলো।

মলিন হেসে তনুজা শুদ্ধকে বলল, “সবার কিছু একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছে থাকে। এবং পুরণের সম্ভাবনা তলানিতে ঠেকে থাকে। সেই ইচ্ছেগুলো কখনই মুখ ফুঁটে উচ্চারণ করা হয় না, পাছে না আমাদের নিজেদেরই কান তা শুনে ফেলে! সেই ইচ্ছেগুলো সর্বসম্মুখে কৌতুক হয়ে আর গোপনে আমাদের বুকফাটা আর্তনাদ রূপে প্রকাশ পায়। সেই ইচ্ছেগুলোর নামে এক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলাও পাপ।”

অন্যমনস্ক হয়ে শুদ্ধ বলে উঠল, “অপূর্ণ সেই ইচ্ছেগুলো আমার জীবনে একটিই আছে। তার নাম আপনি। আপনি আখ্যাত সেই ইচ্ছেটির জন্য আমার কেবল অনুশোচনাই হয়, অলকানন্দা!”

“অনুশোচনা ভালো।”

“আপনার বেলায় আমি প্রাপ্তি চাইছিলাম।”

“জীবন মানেই না-পাওয়া। সব পেয়ে গেলে কি জীবনের স্বাদ পাওয়া যায়? কিছু থাকে অপূর্ণতার অভিমুখে। যাকে পাওয়ার আশায় মনটা আঁকু-পাঁকু করে সারাটাক্ষণ। এটা জেনেই যে, তাকে আমাদের আর এজনমে পাওয়া হবে না। অথচ, মন চেয়ে যায়। তাদেরকে আমার ভাষ্যমতে কী বলি—জানো?”

“কী?”

“প্রিয় প্রতীক্ষা। যেমনটা আমার সিদ্দিক!”

“আমার জন্য কি তবে আপনি?”

“হয়তো তাই!”

“আমি তো তা চাইনি!”

“আমিও তো তোমায় চাইনি।”

“তবুও কি জড়িয়েছেন?”

“বোধ করি—হ্যাঁ।”

“কতটা?”

“খানিকটা।”

“পরিমাপে?”

“অনুভূতির পাল্লায় মাপতে গেলে, মায়া নামক বাটখারাটা বেশ ভারি হয়ে পড়বে।”

“প্রেম?”

“কেবল সিদ্দিক।”

“আর আমি?”

“আমার মায়া।”

“আপনার?”

“নয় কি?”

ছলছলে দৃষ্টিতে শুদ্ধ ঠোঁট কামড়ে কোনো এক প্রাপ্তি পেয়ে হাসল। ক্রমাগত মাথা উপর-নিচ করে বলল, “আমি গোটাটাই আপনার, ম্যাম।”

জবাবে তনুজা বলল, “আর আমি আংশিক নিজের।”

“বাকিটা?”

“সিদ্দিকের।”

“আমার জন্য কি কিছুই নেই তবে?”

“আছে না!”

“কী?”

“আফসোস! তুমি আমাতে না জড়ালে বেশ স্বাভাবিক একটা জীবন পেতে।”

“অস্বাভাবিকত্ব সুন্দর! একদম আপনার মতোই।”

“আচ্ছা, আজ যেভাবে খুঁজে পেলে..”

“হুম?”

“এভাবে যদি আবার হারিয়ে যাই?”

“আবার খুঁজব, আবার পাব..”

“চিরতরে গেলে?”

“আমিও পিছু নেব।”

“মরনেও?”

“পরকালেও।”

শুদ্ধ একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তনুজা মাথা নিচু করে ফেলল। বিরবির করে কেবল বলল, “আল্লাহ তোমায় সুখী করুক, শুদ্ধ। খুব সুখী করুক। আমাকে ছাড়াই..”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here