অপ্রেমের প্রিয় অধ্যায় পর্ব -০৫

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_৫ (তনুজার বিয়ে)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

বিছানায় শুয়ে শুয়ে জ্বর আসার দিনটা শুদ্ধর খুব করে মনে পড়ছে। সেদিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে তনুজার কলোনিতে চলে গিয়েছিল শুদ্ধ। অ্যাপার্টমেন্টটি ঠিক চিনতে পারেনি। গেইটের ভেতরে দারোয়ান ঢুকতেও দেয়নি। বাইরে দিয়েই ঘুরঘুর করতে করতে কী করবে—সেটা ভাবছিল। এমন সময় এক চার তলার বারান্দায় তনুজার দেখা মিলল। গ্রিলে হেলান দিয়ে বসে আছে। শুদ্ধ নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফোনের ক্যামেরা ওপেন করে জুম করল। সেখানটায় তনুজাকে থাকতে দেখেই সে তার নম্বরে কল লাগিয়ে বসে। প্রথমবার দুবার কেটে দেয় তনুজা। এরপর ব্লক করে রাখে। শুদ্ধ বুঝতে পেরেই সীমাহীন রাগে ফেটে পড়ল। তার একটাই কথা! রাস্তায় একটা কুকুর সামান্য ঘেউঘেউ করলেও, তাকে পাত্তা দেওয়া হয়। সেখানে কি সে একটা কুকুরের চেয়েও অধম!

কিছুক্ষণ পায়চারি করে রাগ কমিয়ে অন্য সিম দিয়ে কল লাগাল। তনুজা রিসিভ করে সালাম দিলো। শুদ্ধ সালামের জবাব দিয়ে বলল, “ভুলেও কল কাটবেন না, ম্যাম। আমি কিছু একটা করে ফেলব।”

তনুজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কী করবে তুমি?”

“আমি সিনক্রিয়েট করব।”

“বাদ রেখেছ?”

“শুরুই করিনি!”

“তোমার জন্য আপার্টমেন্টের প্রতিটি ফ্লোরে রটে গেছে—আমি এক হাঁটুর বয়সী ছেলেকে ডেইট করছি।”

“ম্যাম, যা রটে, কিছু তো বটে। এখন আপনি চাইছেন না বলে—এই ‘কিছু’-টাকে সম্পূর্ণ সত্যি করতে পারছি না।”

“শুদ্ধ! তুমি সুধরাবে না? আমাকে বলো, কী করলে তোমার থেকে মুক্তি পাব!”

“ম্যাম, এ-জনমে না।”

“দেখো, এমনিতে আমার লাইফে কম কম্পলিকেশন নেই। তার উপর বাড়িয়ে দিচ্ছ তুমি। বলি—শান্তিতে বাঁচতে দেবে না আমায়?”

“আমাকে ছাড়া আপনি শান্তি-শাস্তি কোনোটাই পাবেন না।”

“শুদ্ধ! প্লিজ, বোঝার চেষ্টা করো। তুমি যেভাবে লেগে আছ—আমার ভার্সিটি ছাড়তে হবে। আর এটা ছাড়া কিন্তু আমার কোনো আর্নিং মেথোড নেই। আমার সিচুয়েশন বোঝো!”

“ম্যাম, এতটা হাইপার হচ্ছেন কেন? আমি কি একবারও আমার সাথে রিলেশনে যেতে বলেছি? আমি জাস্ট প্রপোজ করেছি অ্যান্ড আপনি এক্সেপ্ট করে নিন। এরপর কিছুটা সময় নিয়ে বিয়ে করে নেব আপনাকে। আমার ফ্যামিলিতে কোনো সমস্যা নেই। আপনাকে বিয়ে করেই বাবার বিজনেসে নেমে পড়ব। তারপর আর আপনার মনে হবে না যে—আপনার বর কিছুই করে না। বুঝলেন, মিস?”

“শুদ্ধ! লাইফটা এতটাও ইজি নয় যে, শুকনো কথা দিয়ে কেটে যাবে। তোমার চেয়ে ৮ বছরের বড়ো আমি। ভেবেছিলাম—কেবল এটুকুই। কিন্তু তুমি এত বেশি ইমম্যাচিওর, আমি বুঝিনি।”

“ম্যাম, আপনার জন্য সবচেয়ে বেশি ম্যাচিউর ছেলেও হয়ে যাব আমি।”

“ম্যাচিউরিটি বললেই আসে না। অভিজ্ঞতা লাগে। এদিকে তুমি তো মাম্মা’স বয়! জেদ ছাড়ো।”

“পৃথিবীর স-বচেয়ে জেদি ছেলেটির পাল্লায় পড়েছেন, ম্যাম।”

“শু..”

“ম্যাম, একটু ডানে ঘুরুন। ওদিক দিয়ে ঠিক দেখতে পারছি না।”

তনুজা অবাক হলো। চেহারায় দারুণ বিস্মিত ভাব নিয়ে ডানে মুড়ল। চোখ গেল গেইটের বাইরে। শুদ্ধ রাস্তার ওপাশটায় দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে বুঝতে পারেনি অবশ্য। কিন্তু একটু খেয়াল করতেই এই ছেলেটিকে চিনে ফেলেছে। যাই হোক, কোঁকড়াচুলো শুদ্ধকে হাজার মাইল দূর থেকেও যে নারী চিনতে ভুল করবে, সে অনুভূতিহীন, সে পাষণ্ড। তবে শুদ্ধর পাষাণমূর্তি ম্যাম কী করে চিনতে পারল? মনে প্রেম-বীজ উঁকি দিচ্ছে নাকি? সে-তো হওয়ার নয়!

তনুজার হতভম্ব দৃষ্টি উপেক্ষা করে শুদ্ধ বলল, “ম্যাম? একটু বের হবেন?”

তনুজার ঘোর কাটল। ইশ! বয়সটা যদি কম হতো! জীবনটাকে নিশ্চয়ই তনুজা আরও একটা সুযোগ দিত। আরও একবার নিজেকে বলত, “আরেকটাবার প্রেমে পড়েই দেখি, ক্ষতি কী?”
কিন্তু তা কী করে হয়? বয়সে যে বিস্তর ফারাক! অথচ, একসময় এই তনুজাই এমন এক প্রেমিক-পুরুষের স্বপ্নে নির্ঘুম রাত কাটাত। আচ্ছা! প্রথম প্রেম সচরাচর ভুল সময়ে, ভুল মানুষের জন্য আসে কেন?

তনুজা নিজের এমন ভাবনাকে ধিক্কার জানিয়ে ভালোমতে নড়েচড়ে বসে শুদ্ধকে বলল, “রাস্তা থেকে একটু এগিয়ে দাঁড়াও। আসছি আমি।”

শুদ্ধ যেন হাওয়ায় ভাসা শুরু করল। ফোন কানে নিয়েই এক লাফ দিয়ে উঠল। হাওয়ায় এক ফ্লাইং কিক ছুঁড়ে চুলগুলোয় হাত চালাল। তনুজা সেটা দেখে কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মিনিট দশেকের মাঝেই বের হলো। শুদ্ধকে ম্যাসেজে একটু দূরে দূরে হেঁটে এলাকাটা ক্রস করতে বলল। শুদ্ধও তনুজার কথা শুনছে। হাঁটতে হাঁটতে বার বার আড়চোখে তনুজাকে দেখছে। একটা কাঁচা হলুদ রঙের গোলজামা, ওড়না চাদরের মতো পেচানো। কপালের সামনের দুগাছি চুল বারবার মুখের সামনে আসছে। তনুজা ঠোঁট কামড়ে রাস্তা দেখে হেঁটে যাচ্ছে। কিছুটা যেতেই তনুজা শুদ্ধকে বলল, ওভার ব্রিজের উপরে গিয়ে দাঁড়াতে। শুদ্ধ যাওয়ার মিনিট দুয়েকের মাঝে তনুজাও চলে এলো।

পশ্চিমাকাশে সূর্য হেলে পড়েছে। সূর্যের লালচে মিষ্টি আলোয় সবকিছু মোহনীয় লাগছে। মোহাচ্ছন্ন লাগছে স্বয়ং তনুজাকেও। শুদ্ধ চোখ ফেরাতে পারছে না। সেভাবেই তাকিয়ে রইল। তার ঘোর কাটল তনুজার একটা বাক্যে।

“শুদ্ধ! আমার ফ্যামিলি নেই।”

“মানে?”

শুদ্ধ ভারি অবাক হলো। ফ্যামিলি নেই বলতে কী বোঝাচ্ছে তনুজা? বুঝে আসল না শুদ্ধর। আবার শুধাল, “ম্যাম, বুঝলাম না। বুঝিয়ে বলবেন?”

তনুজা হেসে বলল, “আমার মা-বাবা নেই।”

“কেন, ম্যাম? কই গিয়েছেন ওঁরা?”

“মা ছোটো থাকতে আমার মৃত বোনকে জন্ম দিতে মারা গিয়েছিল, বাবা আমার তেরোতম জন্মদিনে গিফট কিনতে গিয়ে রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়।”

শুদ্ধর এসব শুনতে হাঁসফাঁস লাগল। বাবা-মা ছাড়া সে এক মুহূর্তও কল্পনা করতে পারে না। সেখানে তনুজা গোটা কৈশোর দুজনকে ছাড়াই কাটিয়েছে! ভাবতেই গলা শুকিয়ে এলো। মিনমিনে কণ্ঠে কেবল বলল, “ম্যাম, আ..আমি জানতাম না। স্যরি।”

“ইউ ডোন্ট নিড টু বি স্যরি, শুদ্ধ।”

শুদ্ধ নির্বাক তাকিয়ে রইল। তনুজা এবার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে শুদ্ধর দিকে মুড়ে বলল, “এক তনুজার গল্প শুনবে?”

শুদ্ধ কিছু বলল না। তনুজা জবাবের অপেক্ষা না করেই বলা শুরু করল, “আমার মা মারা যাওয়ার পর, বাবা আমাকে আগলে রাখে। খুব খু-ব ভালোবাসে। আমার বাবা একজন স্কুল টিচার ছিল। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে আমি আর বাবা! আমরা দুজনই! জানো, শুদ্ধ? বাবা আমাকে কখনই দুঃখ চিনতে দেয়নি। আমাকে.. আমাকে কষ্টের সামান্য ছোঁয়াও পেতে দেয়নি। কী আদুরে ছিলাম! কী আহ্লাদী ছিলাম! স্কুল, বান্ধবীরা, পড়াশোনা আর বাবা! এই ছিল আমার পুরো জীবন। রান্নাটাও বাবা করত। ঘরের সব কাজ বাবা করত। আমি তো পানি অবধি ভরে খেতাম না। তো বোঝো!”

এটুকু বলেই তনুজা খিলখিল করে হেসে উঠল। শুদ্ধ তনুজাকে এর আগে এভাবে হাসতে দেখেনি। বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে শুদ্ধর। তনুজা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, “সেবার জন্মদিনে বাবার কাছে আবদার করে বসি, আমার জন্য চন্দ্রমল্লিকা ফুল এনে দিতে। খুব প্রিয় আমার। বাবা আনতে যায়। আর ফেরে না। গেল তো গেলই, আমার ভাগ্যের সব সুখগুলো নিয়ে গেল। সে ফিরল না আর, অথচ একরাশ কষ্ট-যন্ত্রণা আমাকে পাঠিয়ে দিলো।”

তনুজা লম্বা একটা শ্বাস টেনে আবার বলা শুরু করল, “সে-থেকে শুরু হলো আমার লড়াই। এক এতিম মেয়ের জীবন নিশ্চয়ই মোটেও সুখকর ছিল না! কোর্ট থেকে আমাকে আমার চাচার কাস্টডিতে রাখা হয়। চাচা-চাচির সাথে বাবার মতো আমারও সম্পর্ক ভালো ছিল না। কিন্তু ওই যে! আমার লিগাল গার্ডিয়ান তখন তারাই। থাকতে-পড়তে-খেতে দিচ্ছিল, এই অনেক। বিনিময়ে একটু কথাই না হয় শুনতাম, একটু খাঁটুনিই না হয় খাঁটতাম! নট অ্যা বিগ ডিল! মাঝে মাঝে অতিষ্ঠ হয়ে পালিয়েও যেতে চাইতাম। পথ খোলাই ছিল। কিন্তু যাব কই? যাওয়ার তো জায়গা নেই। আমার একূল-ওকূল, দুকূলই শুন্য হয়ে গিয়েছিল, শুদ্ধ! শুন্য হয়ে গিয়েছিল।”

শুদ্ধর বুকটা কাঁপছে। খুব কাঁপছে। চিৎকার করে বলতে চাইছে, “ম্যাম! আর বলবেন না, পায়ে পড়ি। আমি আপনার কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। পুরো পৃথিবী ছিঁড়ে ফেলতে মন চায় আমার।”

বলতে পারল না। তনুজা এক পলক শুদ্ধকে দেখে বলল, “বোকা ছেলে! এটুকুতেই নুইয়ে পড়লে! এরপরের ধাক্কাটা নিতে পারবে?”

শুদ্ধর বুকে হাতুড়ি পেটা হচ্ছে। সে অনিমেষনেত্রে তাকিয়ে রইল। তনুজা বলল, “সেই দুঃখের সময়ে আমি সুখ খুঁজতে লাগলাম। যেদিকে তাকাই, সেদিকেই সুখের সন্ধ্যান করলাম। উম.. এই ধরো, স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তাটা অনেকটা সময় ধীরে ধীরে হেঁটে আসতাম। সবটা কী সুন্দর লাগত! বাড়ি ফেরার পথে একটা শিমুলগাছ আছে। সেটায় তাকিয়ে থাকতাম। ছায়ায় বসে থাকতাম। আবার মাঝরাতে ছাদে, বারান্দায় বসে থাকতাম। আমার ‘লিগাল ফ্যামিলি’ তখন না থাকার মতোই ছিল। একটু কথা শোনাত, এই যা! আর কিছু না। চাচাতো ভাইও একটু অন্য নজরে দেখত, সেটাও কিছু না। বাড়িতে বলা যেত নাকি? যেত না। বাকিটা আমি আমার মনমর্জি মতোই চলতাম। না খেয়ে পড়ে থাকলেও কেউ এগিয়ে আসত না। ওহ্ হ্যাঁ! সকালে উঠে সবার চা-টা নিয়ে না গেলে, তখন আমার রুমে এসে দেখত—বেঁচে আছি নাকি আপদ মরে গেছি।”

তনুজা এটুকু বলে আবারও হাসল। হাসতে হাসতে বলল, “বুঝলে শুদ্ধ! ভাইয়াকে আমার মোটেও পছন্দ ছিল না। ধীরে ধীরে সে লাগামহীন হয়ে ওঠে। আমি চাচিকে জানাই। উনি উলটো আমাকে দোষারোপ করে। এই দোষারোপের মাঝে তখন একটা কাজ আমার কাছে ভালো লেগেছিল। কী জানো? আমার বিয়ে ঠিক করা। দেখতে আসে দুদিনের মাথায়। চেহারাটা ভালো থাকায় বাপ-মা নিয়ে লাগেনি ওরা, যৌতুকের দাবিও ছিল না। সপ্তাহের মাঝেই ঘরোয়া ভাবে ষোড়শী তনুজার বিয়ে হয় এক আটাশ বছরের যুবকের সাথে। আর আমি আমার বরের প্রেমে পড়ে যাই। মজার না?”

শুদ্ধ অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বলল, “ম্যাম, মজা করছেন?”

“আশ্চর্য! তোমার সাথে আমার মজা দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক? অবশ্যই না।”

“তবে, ম্যাম? ভার্সিটির রেজিস্টারে আপনার ইনফোতে সিঙ্গেল কেন দেওয়া?”

“সেটা আমার ব্যাপার, শুদ্ধ। তাছাড়া আমি শুরু থেকেই তোমাকে পেছোতে বলছি। তুমি শুনছই না! এদিকে আমি আমার প্রোফেশনাল আর পার্সোনাল লাইফটা আলাদা রাখি বলে কাউকে জানাতে চাইনি। দুটো আলাদা দুটো জায়গায় রেখেই হ্যাপি ছিলাম। কিন্তু তুমি যা শুরু করেছিলে না! উফফ!”

“ম্যাম, আপনি আমার থেকে পিছু ছাড়ানোর জন্য এটা বলে থাকলে—তিন সত্যি, ভালো হবে না বলে রাখছি!”

শুদ্ধর এই বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্ককে শান্ত করে দেওয়ার জন্য তনুজা বলে উঠল, “শুদ্ধ! তুমি কি ভেবেছ—একটা ঊনত্রিশ বছর বয়সী বাঙালি নারী অবিবাহিত থাকে?”

শুদ্ধ বড়ো বড়ো চোখে তাকাল। তনুজা ফোন বের করে পুরোনো ফোটো অ্যালবাম থেকে ক্লিক করা ছবিগুলো শুদ্ধর সামনে তুলে ধরল। লাল বেনারসি পড়া তনুজা! সাথে একটা লোক! তনুজা মিষ্টি হেসে বলল, “মা..মাই ম্যান! আমি আর আ..আমার মিস্টার। এটা হচ্ছে তনুজা আর তার সিদ্দিকের বিয়ের ছবি।”

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here