অবিশ্বাস পর্ব ৬

‘অবিশ্বাস’
সাবিহা আফরিন

৬.

আশফাক দরজায় দাড়িয়ে। তার মুখ রক্তশূণ্য। ছেলে আবার সব শুনে ফেলেনি তো? রাহেলা বেগম ভয়ে একটা শুকনো ঢোক গিলল। খানিকটা হাসার চেষ্টা করে বললেন, ‘আ…আ..আশফাক বাবা তুই?’

‘কার সাথে কথা বলছিলে?’ শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল আশফাক। আশফাকের কন্ঠস্বর ভয়ংকর রকমের ঠান্ডা।

‘ক.. কা..কার সাথে আবার ঐ ইয়ের সাথে আর কি!’ রাহেলা বেগম কি বলবেন খুঁজে পাচ্ছে না। তার দৃষ্টি অস্থির।

‘ইয়েটাকে?’ এবার আশফাকের গলা আগের চাইতেও অত্যাধিক শীতল তবে দৃঢ় শোনালো।

রাহেলা বেগম ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললেন,’ঐ ইয়ে মানে আমার এক বান্ধবীর সাথে।’

‘তোমার আবার বান্ধবী কে যে এত হেসে হেসে কথা বলছিলে?’ প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করে যেতে লাগল আশফাক।

রাহেলা বেগম ঘামতে লাগলেন। শাড়ির আঁচল দিয়ে বারবার কপালের আর গলার ঘাম মুছতে লাগলেন। তার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। অাশফাক ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বলল,’একি এসি রুমেও তুমি ঘামছো যে? কি ব্যাপার?’

রাহেলা বেগম ঢোক গিলে বললেন,’না মানে খুব গরম পড়েছে তো তাই হয়তো। তাছাড়া এসিটাও না আজকাল ঠিকঠাক কাজ করছে না। মেকানিক ডেকে এটাকে ঠিক করাতে হবে।’

‘তাই নাকি? কই আমার তো তেমন কিছুই মনে হচ্ছে না। এসি তো দিব্যি চলছে।’

রাহেলা বেগম ছেলের জেরায় খানিকটা ঘাবড়ে গেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করে বললেন,’আহ! ছাড় না ওসব। তা তুই এই অসময়ে এলি যে? আহারে আমার ছেলেটা রোদে ঘামে ভিজে গেছে একেবারে একাকার হয়ে গেছে। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে দেখ। তুই বস আমি তোর জন্য এক্ষুণি লেবু শরবত নিয়ে আসছি।’

‘শরবতে আবার ঘুমের ঔষুধ মিশিয়ে দেবে না তো?’ কথাটা বলতে গিয়ে আশফাকের ঠোঁটের কোণ বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠল।

রাহেলা বেগম স্তব্ধ হয়ে গেলেন। আশফাক সব শুনে ফেলেছে। তিনি ঢোক গিলে খানিকটা হাসার চেষ্টা করলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,’ম..মানে?’

আশফাক এবার ভয়ংকর শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে শীতল কণ্ঠে বলল, ‘ আর কত নাটক করবে তুমি মা?’

রাহেলা বেগমের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। তিনি না বোঝার ভান করে আবারও খানিকটা হাসার চেষ্টা করে বললেন, ‘ক..কি নাটক করেছি? কি সব আবল তাবল বলছিস কিছুই তো বুঝতে পারছি না।’

‘বুঝতে পারছো না তাই না? তুমি কিছু বুঝতে পারছ না?’ কথাটা বলতে গিয়ে ধীরে ধীরে আশফাকের হিংস্র রূপ বেরিয়ে এল। তারপর আকস্মিক আশফাক রাহেলা বেগমের দু’বাহু শক্ত করে চেপে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,’বল কতদিন ধরে তোমরা এই ষড়যন্ত্র করছ? বল কতদিন ধরে?’

‘কি..কিসের ষড়যন্ত্র?’ রাহেলা বেগম থরথর করে কাঁপছে, দরদর করে ঘামছে। তবুও এমন ভাব করলেন যেন তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না।

আশফাক এবার চিৎকার করে উঠল,’কেন করলে মা? কেন করলে এমন? কেন আমার এত বড় সর্বনাশ করলে? কি ক্ষতি করেছিল নীরা তোমার? কি ক্ষতি করেছিলাম আমরা যার জন্য তুমি এভাবে আমাদের বিচ্ছেদ ঘটালে? এভাবে নীরাকে চরিত্রহীনা সাজিয়ে আমার জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলে? বল কেন?’

আশফাকের চিৎকারে রাহেলা বেগম কেঁপে উঠলেন। কাঁপতে কাঁপতে বললেন,’কিসব বলছিস? আমি কেন নীরাকে চরিত্রহীনা সাজাতে যাব?’

আশফাক ঘেন্না মেশানো গলায় বলল,’আর কত মিথ্যে বলবে তুমি মা? আর কত? আমার ভাবতেও ঘেন্না হচ্ছে যে তুমি আমার মা।’

এ কথা শোনার পর রাহেলা বেগম আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেন না। চিৎকার করে উঠলেন তিনি,’ হ্যা হ্যা আমিই সব করিয়েছি। কারণ ও আমার থেকে তোকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল। তাই আমি এমনটা করেছি,বেশ করেছি। আর এটার জন্য আমার কোনো আক্ষেপ নেই, কোনো অনুশোচনাও নেই।’

আশফাক যেন স্তব্ধ হয়ে গেল,’কি বলছ এসব? ও কেন তোমার কাছ থেকে আমাকে কেড়ে নিতে যাবে? নীরা এমন কি করেছিল যার কারণে তোমার এমনটা মনে হল?’

‘কি করেনি সে? কি করেনি? যে ছেলের জন্মের আগে তার বাবা মারা যায়, সেই ছেলেকে একা জন্ম দিয়ে তিল তিল করে মানুষ করে তোলা কতটা কষ্টসাধ্য তা কেবল একজন মা’ই বলতে পারে। কেউ পাশে এসে দাড়ায় নি সেদিন। যার কাছেই গেছিলাম তারা প্রত্যেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল।’

তারপর দু’হাত আশফাকের চোখের সামনে তুলে ধরে বলতে লাগলেন, ‘নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়ে এই দু’হাতে.. এই দু’হাতে আমি উপার্জন করে এই নোংরা সমাজের নোংরা মানুষদের মধ্যে থেকে কতটা লাঞ্ছনা সহ্য করে তোকে বড় করছি তা শুধু আমিই জানি। কখনো নিজের সুখের কথা ভাবিনি।’

তারপর শাড়ির আঁচল তুলে ধরে বললেন,’যে ছেলেকে এই আঁচলের নিচে রেখে বড় করে তুলেছি। যার গায়ে সামান্য আঁচড় পর্যন্ত লাগতে দিই নি। যে ছেলের মুখের দিকে তাকি নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়েছি। যাকে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ভেবে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছি। যে ছেলে সারাদিন মা মা করে পেছন পেছন ঘুরে বেড়াতো। বিয়ের আগে যে ছেলে মা ছাড়া কিছু বুঝতো না। বিয়ের পর সে ছেলেই কিনা জন্মদাত্রী মাকে ছেড়ে দু’দিনের আসা একটা অন্য মেয়ের হয়ে গেল?’

আশফাক আগের মতোই বলে উঠল,’নীরা কি কোনোদিনও তোমার সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করেছিল যার জন্য তুমি এতটা কষ্ট পেয়েছ?’

রাহেলা বেগম ঝেঁঝে উঠে বললেন,’না সে করেনি, করেনি সে। কিন্তু এর চেয়েও জঘন্য অপরাধ করেছে সে আমার কাছ থেকে তোকে দূরে সরিয়ে দিয়ে।’

আশফাক স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো মায়ের দিকে। রাহেলা বেগম বলে চললেন,’মনে আছে তোর? বিয়ের আগে তুই সব সময় অফিসে যাওয়ার পূর্বে এবং অফিস থেকে ফেরার পরে আমার সাথে দেখা করতিস। সেখানে বিয়ের পর নীরা ছাড়া তোর এক মুহূর্তও চলতো না। অফিসে যাওয়ার আগে এমনকি অফিস থেকে ফেরার পরও তুই শুধু নীরাকেই খুঁজতি।’ গর্জে উঠলেন রাহেলা বেগম।

একটু থেমে ফুঁসতে ফুঁসতে আবার বলতে লাগলেন,’মনে আছে তোর?একদিন তুই অফিস থেকে ফেরার পর নীরা রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত থাকায় অসুস্থ থাকা সত্বেও আমি এসে দরজা খুলে দিয়েছিলাম। খুব আশা করেছিলাম আমার ছেলে আমাকে দেখেই মিষ্টি হাসি দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলবে মা আমি এসে গেছি। আমার শরীরের খবরা-খবর জানতে চাইবে। কিন্তু তার পরিবর্তে তুই কি করলি? দরজার সামনে আমাকে দেখেই তোর মুখের হাসি মুছে গেল। চোখ মুখ অন্ধকার করে বলেছিলি, ‘তুমি? তুমি কেন দরজা খুলেছ? নীরা কোথায়?’ তারপর তুই চিৎকার চেঁচামেচি করে সারা বাড়ি মাথায় তুললি। নীরা আসলে ওকে ইচ্ছে মতো বকলি যাতে এরপর থেকে তুই এলে ও ছাড়া আর কেউ যেন দরজা না খোলে। বিশ্বাস করবি সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম মনে, খুব কষ্ট।’

আশফাক আহত দৃষ্টিতে তাকালো মায়ের দিকে। রাহেলা বেগম বলেই চললেন,’তারপর তুই যখন খুটিনাটি বিষয়গুলোতেও নীরা নীরা করতি তখন আমি এগিয়ে তোকে জিজ্ঞেস করতাম তোর কি লাগবে? আর তুই বিরক্ত হয়ে বলতি আমি পারব না নীরাকেই লাগবে। অথচ নীরা আসার আগে তোর সূক্ষ্ম থেকে অতি সূক্ষ্মতর বিষয়গুলোও আমাকে হ্যান্ডেল করতে হতো। যেখানে তুই অসুস্থ হলে আমি তোকে খাইয়ে দিতাম সেখানে তুই নীরার হাতে খাবি বলে বায়না ধরতি। এমনকি তুই অসুস্থ হলেও আমাকে তোর কাছেও ঘেঁষতে দিতি না। সারাদিন শুধু নীরা নীরা করতি। আমি লক্ষ্য করেছি নীরা তোর জীবনে আসার পর থেকে তুই কেমন বদলে গেলি। আমার সাথে কেমন দূরত্ব বজায় রেখে চলতে লাগলি। আমি সহ্য করতে পারলাম না। এই সব কিছুর জন্য শুধুমাত্র নীরাকেই দায়ী মনে হতে লাগল। নীরাকে সরানোর জন্য আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম। আর একদিন উপায় পেয়েও গেলাম। তোর বন্ধু আসাদের বিয়ের দিন হাটতে হাটতে পার্টি সেন্টারের একটা নিরিবিলি জায়গায় চলে এলাম। আর তখনই দেখতে পেলাম নীরাকে বাজে প্রপোজাল দেওয়ার জন্য নীরা মিজানকে চড় মেরে আঙুল তুলে শাসাচ্ছে। ওদের দেখে আমি সাথে সাথেই সেখান থেকে লুকিয়ে পড়ি। লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের সব কথা শুনে ফেলি। নীরা চলে যাওয়ার পর আমি মিজানের সাথে দেখা করি। ওকে সঙ্গ দিই। আমাদের মধ্যে ডিল হয় নীরাকে তোর জীবন থেকে সরিয়ে ফেলার। আমার দরকার ছিল তোকে,আমার আগের আশফাককে, আমার মা পাগল ছেলেকে। আর মিজানের দরকার ছিল প্রতিশোধ আর নীরা দু’টোকেই। হঠাৎ জানতে পারলাম নীরা প্রেগন্যান্ট। আমি দমে যেতে লাগলাম। কিন্তু মিজান আমায় সাহস যোগালো, আমায় বোঝাল। আমরা দু’জনে মিলে দ্রুত পদক্ষেপ নিলাম। পাছে যদি দেরি হয়ে যায়। তারপর দু’জনে মিলে প্ল্যান করে সেদিন ঐ কাহিনী ঘটিয়ে ছিলাম। যাতে তুই নিজ চোখে দেখে বিশ্বাস করিস আর নীরাকে ডিভোর্স দিস। কিন্তু আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম যখন দেখলাম তুই নীরাকে ছাড়তে রাজি নস তখন শরীয়ত বিরোধী হওয়া সত্বেও আমি ঐ অবস্থাতেই নীরাকে ডিভোর্স দেওয়ানোর জন্য উঠে পড়ে লাগলাম। আমি ক্রমশই ভয় পাচ্ছিলাম এই ভেবেই যে যদি তোর মন ঘুরে যায়! যদি তুই আবার নীরাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসিস! তাহলে তো এতসব কাহিনী করার কোনো মানেই থাকবে না। এমনটা হলে আমি তোকে সারাজীবনের মতো হারিয়ে ফেলবো। আর আমার আগের আশফাককে ফিরে পাবো না। তাই আমি ইচ্ছে করে নীরার পেটের বাচ্চাকে মিজানের বলে তোর কানে বিষ ঢালতে লাগলাম। তুই সব শুনেও হজম করলি। শেষমেশ উপায় না পেয়ে আমার কসম দেওয়ালাম। অবশেষে আমি তো সফল হয়েই গেছিলাম। কিন্তু মিজান এখনো নীরাকে বিয়ে করতে পারেনি।’

আশফাক রাহেলা বেগমের দু’বাহু চেপে ধরে ঝাঁকি দিয়ে করুণ সুরে বলতে লাগল,’একি করলে তুমি মা? একি করলে? শুধুমাত্র আমি নীরাকে ভালোবাসতাম বলে তুমি ওকে এভাবে অপবাদ দিয়ে আমার জীবন থেকে বের করে দিলে। তুমি আমার মা আর নীরা আমার স্ত্রী। তুমি কেন বুঝলে না মা আমি তোমাদের দু’জনকেই খুব খুব ভালোবাসি। আমার জীবনে তোমরা দু’জনেই সমান গুরুত্বপূর্ণ। নীরা আসার পর ও নিজের কাঁধে সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল বলে তোমাকে আমি বিরক্ত করতাম না। আমি তো জানতাম তুমি আমার জন্য সারা জীবন কতই না কষ্ট করেছ। নিজে না খেয়ে আমার মুখে খাবার তুলে দিয়েছ। নীরা আসার পর আমি ভেবেছিলাম এইবার বুঝি তুমি অবসর পেলে। জীবনে তো আর কম কষ্ট করো নি। তাই এখন থেকে তুমি স্বাধীন। তোমার আর কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তাছাড়া বড় থেকে শুরু করে অত্যান্ত ছোট ছোট ব্যাপারগুলোও নীরা খুব সূক্ষ্মভাবে সামলাতো। সব কিছুতেই ওর নজরদারি ছিল। তাই যেকোনো খুঁটিনাটি বিষয়েও আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইতাম না। চাইতাম না তোমাকে বিরক্ত করতে। সেজন্য আমাকে সবসময় নীরার দারস্থ হতে হতো। আমি অসুস্থ হলে নীরা রাত জেগে আমার সেবা করতো, আমাকে খাইয়ে দিত। তোমাকে তখন কিছু করতে দিতাম না কেন জানো? ভাবতাম তোমার বয়স হয়েছে আগের মতো রাত জাগতে পারবে না। তোমার শরীর খারাপ হবে, কষ্ট হবে। তাছাড়া সেদিন অনেকবার বেল বাজানোর পর যখন তোমায় ছুটে এসে দরজা খুলে দিতে দেখলাম তখন আমার নীরার ওপর ভীষণ রাগ হয়েছিল। কেন জানো? কারণ তুমি সেদিন ভীষণ অসুস্থ ছিলে। তোমার গায়ে একশো দুই ডিগ্রি জ্বর ছিল। ভেবেছিলাম অসুস্থ অবস্থায় তুমি রেস্ট নিচ্ছিলে আর নীরার জন্য তোমাকে একশো দুই ডিগ্রি জ্বর নিয়ে কষ্ট করে ছুটে আসতে হল। ও থাকা সত্বেও কেন আমার মাকে কষ্ট করতে হল? এই ভেবে সেদিন খুব রাগ হয়েছিল আমার। তাই ইচ্ছে মতো বকেছিলাম নীরাকে। সব সময় নীরাকে তোমার খেয়াল রাখতে বলতাম। প্রতিদিন অফিস যাওয়ার সময় ওকে একটাই কথা বলতাম,’আমার মা তোমার কাছে আমানত রেখে গেলাম তুমি তাকে দেখো। এমন কিছু করো না যাতে আমার মা মনে কষ্ট পায়।’ আর নীরা সবসময়ই আমার সে কথা রেখেছে। কিন্তু তুমি ভুল বুঝে একি করলে মা?’

রাহেলা বেগম ছেলের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। আশফাক বলেই চলল, ‘তোমার জন্য আমি আমার পবিত্র স্ত্রীকে দুশ্চরিত্রা অপবাদ দিয়েছি। তোমার জন্য এই প্রথম তার গায়ে হাত তুলেছি। তাও সে যখন প্রেগন্যান্ট ছিল। তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছি শুধু মাত্র তোমার জন্য। আমার অনাগত সন্তানকে অস্বীকার করেছি। তুমি জানতে নীরাকে ছাড়া আমার পক্ষে অসম্ভব তাই তুমি নিজ থেকে ডিভোর্সের সমস্ত কাগজপত্র রেডি করে ফেললে। আমাদের শরীয়াতে গর্ভাবস্থায় তালাক হয় না এটা জেনেও তুমি শুধুমাত্র আধুনিকতার দোহাই দিয়ে দিয়ে আমাকে ফুসলাতে লাগলে। তারপরও যখন আমি রাজি হলাম না তখন তুমি আমাদের নিষ্পাপ সন্তানকে জড়িয়ে নীরার বিরুদ্ধে আমার কানে বিষ ঢালতে লাগলে। একসময় আমাকে তোমার কসম দিয়ে ঠিক সই করিয়ে নিলে। আর আমায় বুঝ দিলে আমাকে তুমি এভাবে আর দেখতে পারছো না। আমার কষ্ট তোমার সহ্য হচ্ছে না। আমাকে আবার আগের মতো স্বাভাবিক করার জন্যই তুমি এমনটা করেছ। তোমার প্ররোচনায় শেষ পর্যন্ত আমি নীরাকে ডিভোর্স দিয়েছি। জেনে শুনে তুমি আমাকে দিয়ে এত বড় পাপ করালে। আমাকে স্ত্রী’র ভালোবাসা আর সন্তান সুখ পাওয়া থেকে বঞ্চিত করলে। তুমি নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য আমার জীবনটাকে শেষ করে ফেললে মা। আমায় ধ্বংস করে দিলে। এই অপরাধের কোনো ক্ষমা হয় না। কোনো ক্ষমা হয় না।’

আশফাক তার মা’কে ছেড়ে দিয়ে উদভ্রান্তের মতো বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘আমাকে যেতে হবে। আমাকে এক্ষুণি নীরার কাছে যেতে হবে।’
আশফাক আর একটা কথাও বলল না। সোজা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

‘আশফাক আশফাক.. কোথায় যাচ্ছিস বাবা?’ পিছু ডাকলেন রাহেলা বেগম।

সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে আশফাক একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে বলল,’পাপের প্রায়াশ্চিত্ত করতে।’

আশফাক সোজা বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। রাহেলা বেগম ছুটে এলেন ছেলের পিছু পিছু, ‘শোন বাবা আমার কথা শোন?’ কিন্তু ততক্ষণে আশফাকের গাড়ি বেরিয়ে গেছে।

এটা ঠিক যে নীরা কোনোদিনও তার অযত্ন করেনি। যতবার তিনি অসুস্থ হয়েছিলেন নীরা সারারাত জেগে তার ঘরে তার মাথার কাছে বসেছিল। তাকে সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিল। নীরা একরকম শাশুড়ী বলতে অজ্ঞান ছিল। সারাদিনে সহস্র বার মা মা ডেকে ডেকে মুখে ফেনা তুলে ফেলতো। যেন শাশুড়ী মা ছাড়া তার চলেই না। সব সময় নিজের মায়ের মতো ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছিল তাকে। কখনো তার সাথে সামান্য উঁচু গলায়ও কথা বলেনি নীরা। রাহেলা বেগমও ভীষণ ভালোবেসেছিল নীরাকে। কিন্তু ছেলের অমন বৌ প্রীতি আচরণ মনে মনে নীরার প্রতি ক্ষুব্ধ করে তোলে তাকে। ক্রমেই তার মনে হতে লাগল নীরা তার থেকে তার ছেলে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, কেড়ে নিতে চাইছে। মনটা এক অজানা আক্রোশে ভরে উঠল। তিনি ভাবতে লাগলেন কিভাবে নীরাকে তার ছেলের জীবন থেকে সরিয়ে ফেলা যায়। আর একসময় তা পেয়েও গেলেন তিনি। মিজানের সাথে হাত মিলিয়ে নীরার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে লাগলেন গোপনে। সব সময় ছেলে আর ছেলের বৌয়ের সাথে ভালো ব্যবহার আর তাদের সামনে মুখে হাসি নিয়ে ঘুরে বেড়ালেও কেউ জানতেও পারলো না তার মনে মনে কি ভয়ংকর পরিকল্পনা চলছে। ছেলেকে পাবার আশায় তিনি এতটাই জ্ঞানশুন্য হয়ে পড়েছিলেন যে নিজের অনাগত নাতি-নাতনীর কথা একবার চিন্তাও করলেন না। তবে এটাও সত্যি যে নীরাকে বের করে দেওয়ার পর নীরার পেটের সন্তানের প্রতি হঠাৎই অসম্ভব টান অনুভব করলেন তিনি। হাজার হোক ঐ বাচ্চাটা তো তারই রক্ত। যদিও মিজান বলেছিল বাচ্চাটার সমস্ত দায়িত্ব সে নেবে। তবুও তিনি তা মানতে পারলেন না। তাই মিজানকে না জানিয়েই তিনি মনে মনে ছক কষে ফেললেন। নীরার ডেলিভারি টাইম তার আগে থেকেই জানা ছিল। এরই মাঝে তিনি আশফাকের জন্যও পাত্রী ঠিক করে ফেললেন। বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে কিন্তু সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম বিধায় স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তিনি ভেবেছিলেন বাচ্চাটা জন্মাবার সাথে সাথে তিনি বাচ্চাটাকে যেকোনো ভাবেই হোক চুরি করে তার কাছে নিয়ে আসবেন। তারপর দত্তক নেওয়ার নাম করে তুলে দেবেন আশফাকের হাতে। সন্তান জন্মদানে অক্ষম হওয়ায় আশফাকের মতো মেয়েটাও অজান্তেই আশফাকের সন্তানকে কাছে টেনে নিবে। এতে বাচ্চাটাও তার বাবা মা পাবে। আর তার রক্ত তার কাছেই থাকবে হোক সেটা সবার অজান্তে। তাছাড়া বন্ধ্যা বিধায় ঐ মেয়েটাকেও তিনি দমিয়ে রাখতে পারবেন। তার ইশারায় পুতুলের মতো নাচাতে পারবেন। এভাবে তার ছেলেও আজীবন তারই থাকবে।

আশফাক জানে না ডিভোর্সের ঠিক দু’দিনের মাথায় এক ঝড়ের রাতে নীরার বাবা এসে উপস্থিত হয়েছিল তার দ্বারে। তার হাতে পায়ে ধরে খুব কেঁদে ছিল। আশফাককে শুধু একটিবারের জন্য ভিক্ষা চেয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন সবটাই হয়তো তাদের চাল। কারণ বাচ্চা ডেলিভারি হতে তখনো আরও দু’মাসের মতোন বাকি ছিল। নইলে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবার দু’দিনের মাথায়ই নীরার বাবা আসবেন কেন? তাই তিনি নীরার বাবাকে আগের বারের মতোই অপমান করে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

আজ এতোদিন পর সমস্ত ভুল ভেঙে গিয়ে
এক অজানা পাপবোধ এসে জেঁকে ধরলো তাকে। নিজের কৃতকর্মের জন্য নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগলেন। এটা সে কি করল? নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ছেলের জীবনটাকে এভাবে শেষ করে দিল? মা হয়ে সে কি করে পারলো? সত্যিই এ অপরাধের কোনো ক্ষমা হয় না। কোনো ক্ষমা হয় না। ফ্লোরে বসে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন রাহেলা বেগম।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here