#অবেলায়_ভালোবাসি
#লেখনিতে_সাবরিন_জাহান
[২+৩]
#পর্ব_০২
** হসপিটালের সামনে দাড়িয়ে আছে আয়ুশী,সীমা আর ইভা। ভেবেছিলো ছুটির পর আসবে,কিন্তু আজকে কোনো ক্লাসই ঠিক ভাবে হচ্ছে না।তাই আর না থেকে বেরিয়ে এসেছে।এমনিতেও ছুটি হতে হতে দুপুর !তাই আগে আগেই চলে এসেছে!আসার পথে একটা ছোট্ট ফুলের বুকেট নিয়ে এসেছে!ভিতরে গিয়ে রিসিপশনের মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“মিস্টার বেলাল আহমেদ এর কেবিন নং টা বলা যাবে?”
রিসিপশনের মেয়েটি একটু ঘেঁটে বললো,”তিন তলায়, তিনশো চার নাম্বার কেবিন!”
“ধন্যবাদ!”
অতঃপর ওরা চলে গেলো কেবিন ৩০৪ এর উদ্দেশ্যে!
কেবিন তিনশো চারের সামনে এসে দাড়িয়ে রয়েছে ওরা! আয়ুশী দরজায় নক দিয়ে মাথা সামান্য ভিতরে ঢুকিয়ে বললো,”আসতে পারি স্যার?”
বেলাল সাহেব তখন সবে চিন্তা করতে বসেছেন স্টুডেন্টদের নিয়ে!কারোর আওয়াজ শুনে মাথা তুলে তাকালেন!
“আরে আয়ুশী মামনি!এসো এসো!”
ওরা তিনজন ভিতরে আসলো।
“কি ব্যাপার!তোমরা এখানে?ক্লাস তো এখনও শেষ হয়নি!”
সীমা তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,”আসলে স্যার,আপনাকে দেখতে আসলাম!কেমন আছেন আরকি!”
এর মাঝেই ইভা বলে উঠলো,”আর আজকে ক্লাস গুলোও ঠিক করে হচ্ছে না,তাই ভাবলাম বাসায় চলে যাই।সামনে পরীক্ষা!”
“সেই সাথে আপনি এ’ক্সি’ডে’ন্ট করেছেন,তাই দেখতে এলাম আরকি!”
বেলাল সাহেব হাসলেন!
ওরা কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গেলো! সীমা লিফটের কাছে যেতে নিবে তার আগেই আয়ুশী ওকে টেনে সিঁড়ির কাছে নিয়ে গেলো।
“কিরে তুই লিফটে উঠলি না কেনো আয়ু?”
“মাত্র তিন তলায় আমরা আর তুই এইটুকু পথের জন্য লিফটে উঠবি? তাও এত লম্বা লাইন ঠেলে!হাঁটতে শিখ!দেখ তোর পেট বাড়ছে !”
বলেই নামতে লাগলো নিচে ও!ইভা আগেই নেমে যাচ্ছে!আয়ুশীর লিফটে উঠতে ভালো লাগে না!তখন সীমা আর ইভার জন্য লিফট দিয়ে উপরে এসেছে!তাতেই মাথা কেমন ভন ভন করছে ওর!কিছুক্ষণের জন্য চোখ বুঝলো ও!কিন্তু এর জন্যই ঘটলো আরেক বিপত্তি!চোখ বন্ধ করে নামতে চেষ্টা করায় সিঁড়ির উপরে থাকা কলার খোসায় পা পড়তেই পড়ে যেতে নেয়!নিজেকে সামলানোর জন্য সামনে থাকা ইভাকে ধরতে যায়!কিন্তু ইভা হুট করে এমন হওয়ায় টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়।আর আয়ুশী পড়ে যেতে নিয়েও কেউ সামনে আসায় তাকে ধরে নিজেকে সামলে নেয়!শেষের দুই সিড়িতে এমন হওয়ায় ইভা ব্যাথা না পেলেও আয়ুশীর পা মচকে গেছে!সীমা এতক্ষণে কি হলো কিছুই বুঝলো না।যখন বুঝলো তখন দৌড়ে আগে ইভাকে উঠালো!
“তুই ঠিক আছিস ইভা?”
ইভা মাথা নেড়ে ড্রেস ঝাড়তে লাগলো।ওদিকে আয়ুশী পায়ের জন্য দাড়াতে পারছে না!এতক্ষণ যে কাউকে ধরে দাড়িয়ে আছে এটা ওর খেয়ালে নেই!
“এক্সকিউজ মি!”
পরিচিত আওয়াজ কানে আসতেই চোখ তুলে তাকালো ও!চোখ গুলো আপনাআপনি ই বড় হয়ে গেলো।
“আপনি?”
আয়ান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।আয়ুশী তড়িঘড়ি করে ওকে ছেড়ে দাড়াতে যেতেই আবার পরে যেতে নিলে আয়ান ওর এক হাত টেনে ধরে!
“ই’ডি’য়ে’ট! আস্তে!”
সীমা আর ইভা এসে আয়ুশীকে ধরলো।
সীমা এবার খোঁচা মে’রে বললো,”লিফটে গেলে এসব কিছুই হতো না!”
আয়ুশী চোখ ছোট ছোট করে তাকালো!মানে কি?ওর এই মুমেন্টে এসব ভাবার ইচ্ছে হলো?সীমা আর ইভা ওকে ধরে সিড়ির এক কোণায় বসালো। আয়ান ওদের পাত্তা না দিয়ে উপরে চলে গেলো।
“এই আয়ু,পায়ে কি খুব ব্যাথা করছে?”,চিন্তিত কণ্ঠে বলল ইভা।
“মনে হয় পা ম’চ’কে গেছে,পা রাখতে পারছি না!”
“কে বলেছিল তোকে সিড়ি দিয়ে নামতে?লিফটে গেলে এমন কিছুই হতো না!এই সীমার কথা মাঝে মাঝে শুনা উচিত!”
আয়ুশী মুচকি হেসে সীমাকে বলল,”তোর ওই লিফটে উঠার জন্যই আমার এই অবস্থা!আর একটা কথা বললে এই হসপিটালের তোকে অ্যাডমিট হতে হয় এমন ব্যাবস্থা করে যাবো দেখিস!বক বক না করে আমায় ধরে উঠা! গেট পর্যন্ত যেতে পারলেই রিকশা নিবো!”
সীমা আর ইভার কাঁধে ভর করে উঠে দাড়ালো ও! পায়ে হালকা প্রেসার দিতে ব্যাথায় চোখ মুখ কুচকে এলো ওর!না এভাবে নামতে পারবে না!আবার ওকে বসিয়ে দিলো ওরা!
“আন্টিকে ফোন দিবো?”(ইভা)
“হ্যাঁ,ফোন দে আর এসে আমাকে নেয়ার বদলে হসপিটালে ব’কা’ব’কি শুরু করুক!”(আয়ুশী)
“তাহলে তুই যাবি কিভাবে?”,বলেই সীমা ওর পাশে বসে পড়লো।
হুট করেই কেও গম্ভীর গলায় বললো,”এটা কি আড্ডা দেয়ার জায়গা?”
সীমা আওয়াজ শুনেই তড়িঘড়ি উঠে দাড়ালো!একসাইড এ দাড়িয়ে তাকে যাওয়ার রাস্তা দিল!সাদা অ্যাপ্রন পরিহিত যুবকটি ভ্রু কুঁচকে আয়ুশীর দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চোখের ভাষা বুঝতেই ইভা বলে উঠলো,”আসলে ও নামতে গিয়ে পা ম’চ’কে ফেলেছে!তাই দাড়াতে পারছে না!”
যুবকটি এবার নিচে নেমে আয়ুশীর পায়ের দিকে তাকালো।কিছু ভেবে ওর পায়ের কাছে বসলো। পায়ে হাত দিতে যাবে তার আগেই আয়ুশী বললো,”কি করছেন!”
লোকটি অভয় দিয়ে বললো,”আমি একজন ডক্টর।আমায় দেখতে দিন!”
“কিন্তু আমার কাছে তো টাকা নেই!”
লোকটি ভ্রু কুঁচকে তাকালো!
“হোয়াট?”
“আব.. আপনিই তো বললেন,আপনি ডক্টর! ভিজিট ছাড়া কি পেশেন্ট দেখবেন?”
লোকটি কিছু না বলে আবার পায়ে হাত দিল।একটু চাপ দিয়ে বললো,”ব্যাথা করছে?”
আয়ুশী মাথা নাড়লো,চাপ দেয়ায় কোনো প্রকার ব্যাথা হচ্ছে না যতটা দাড়াতে গিয়ে হয়!
“আচ্ছা,এবার আপনাকে বলি!এটা হসপিটাল..তো চিৎকার করে হসপিটালের পরিবেশ নষ্ট করবেন না!”
আয়ুশী ভ্রু কুঁচকে বললো,”মানে..”
আর কিছু না বলেই উনি পা টা উল্টো দিকে মোচড় দিলেন(সাধারণত জানি না ওটাকে কি বলে – লেখিকা)..আয়ুশী চিৎকার দিতে নিবে তার আগেই ইভা দৌড়ে গিয়ে ওর মুখ চেপে ধরে!
“আয়ু বেবি,এটা হসপিটাল!কুল কুল!”
লোকটি একজন নার্সকে বললো ব্যাথার স্প্রে নিয়ে আসতে।কিছুক্ষণ বাদেই নার্সটি এনে দিলো।লোকটি আয়ুশীর পায়ে স্প্রে করে দিলো।পুরোপুরি না কমলেও আগের তুলনায় অনেকটাই কম এখন!লোকটি চলে যেতে নিলেই আয়ুশী বলে উঠলো,”ফী নিবেন না?”
লোকটি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।
“ফী দিতে চান বুঝি?”
“ফ্রীতে কেউ ডাক্তারি করে নাকি?”
লোকটি বুকে হাত গুঁজে বললো,”বেশ দেও দুই হাজার টাকা!”
আয়ুশীর চোখ বড় বড় হয়ে গেলো!
“দুই হাজার?”
“হুমম!আমার ভিজিট ফী পাঁচশো আর ব্যাথা দুর করার ফী পনেরশো!যান আপনি এক হাজারই দিয়েন!”
আয়ুশী এবার আস্তে করে উঠে দাড়ালো!চোখ ছোট ছোট করে বললো,”যদি না দেই?”
লোকটি মুচকি হেসে বললো,”জে’লে দিয়ে দিবো!”
“এক হাজার টাকার জন্য জেলে দিবেন আমায়?”
“ফী দিতে তো আপনিই চেয়েছেন,তাই না?”
আয়ুশী মাথা চুলকালো!লোকটি আবার মুচকি হেসে বললো,”ডোন্ট ওয়ারি!আমি এমনেই বলেছি!সব সময় টাকার জন্য কাজ করি এমনটা ভাববেন না!মানবতা বলতেও কিছু আছে!”
বলেই চলে গেলো।
আয়ুশী মনে মনেই আওড়ালো,”কি অদ্ভুত পৃথিবী!একই দিনে দুই ভিন্ন মানবের সাথে আলাপ হলো।একজন সামান্য ব্যাপারে মিসবিহেভ করলে!আরেকজন বিনা কারণে সাহায্য করলো!বোঝাই যায় ,পৃথিবীতে সব তো আর এক না!”
এক রাশ চিন্তা ভাবনা নিয়েই আস্তে আস্তে নেমে বাইরে আসলো ওরা!প্রথমে আয়ুশীকে নামিয়ে সীমা ওরা নিজেদের হোস্টেলের দিকে গেলো।
______________
বাবার সাথে বসে টিভি দেখছে আয়ুশী।দেখছে কম ভাবছে বেশি!
“কি হয়েছে মামনি?আজ এত ভাবুক মেয়ে হয়ে বসে আছো যে?”
বাবার কথায় লাফিয়ে উঠলো ও।এখনই কথার ঝুড়ি নিয়ে বসবে টা মোশাররফ সাহেব ভালোই বুঝেছেন!তাই টিভি অফ করে দিলেন!সবার আগে তার মেয়ে…তারপর অন্য কিছু!
“জানো বাবা আজকে না আমি নতুন এক অভিজ্ঞতা নিলাম!”
“কি রকম?”
“পৃথিবীতে সবাই এক রকম হয় না ,এটাই!”
“তা তোমার কি দেখে মনে হলো?”
আয়ুশী বেখায়ালে সব বলে দিলো ওর বাবাকে!
“সব বুঝলাম,কিন্তু মামনি তোমার তো একটা ভুল হয়েছে?”
“আরও মাথায় তুলো ওকে!”,বলতে বলতেই ওদের কাছে এলেন মরিয়ম!
আয়ুশীর এবার নিজের গালে নিজেই মা’র’তে মন চাচ্ছে!বলবে না, বলবে না করেও সব বলে দিলো।এবার শুনো ব’কা!
“আহ..আমি কথা বলছি তো!”
“তুমি চুপ করো!এসব কি আয়ু?এভাবে রাস্তায় এমন করাটা কি তোর ঠিক হয়েছে?”
আয়ুশী নিশ্চুপ!মরিয়ম এবার তার সামনে বসে বললেন,”আমরা তোর বাবা – মা আয়ু!পরিবারের লোক..তোর দুরন্তপনা,দু’ষ্টু’মি,ম’জা, বাচ্চামো!সব আমাদের সামনে করিস,সমস্যা নেই!কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখিস!বাইরে সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে হবে তোকে!স্ট্রং থাকতে হবে তোকে।আমাদের সামনে এসব করলে আমরা কিছু ভাববো না,কারণ আমরা জানি তুই কেমন!কিন্তু ভিন্ন লোকের সাথে ,যে তোকে চেনে না ,জানে না তার সাথে এমন করলে নির্ঘাত বে’য়া’দ’ব ভাববে!আর পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে! মাঝ রাস্তায় তোর কথা অনুযায়ী ছেলেটাকে যেহেতু কোনো দিক থেকেই ফল বিক্রেতা লাগেনি!সেহেতু তাকে এমনটা বলে অপমান করা হয়! ভরা রাস্তায় তুই যেমনটা করলি সেও তেমনটাই ফেরত দিয়েছে!যদিও একটু বেশি কিন্তু তাও…ব্যাপারটা তোকে বুঝতে হবে!”
আয়ুশী মাথা নিচু করে রইলো।
“এখন তোর প্রথম কাজ তাকে আবার কখনো দেখলে সরি বলা!”
“আমি কেনো সরি বলবো?উনিও তো মিসবিহেভ করেছে!”
“দোষটা আগে কার ছিল?”
আয়ুশী নিরুত্তর!
“সরি বললে কেউ ছোট হয় না!আর তুই এমনটা না করলে সেও কিছুই বলতো না!তাই তোমার সরি বলা উচিত!বুঝলে?”
আয়ুশী সম্মতি জানালো!
“আর খবরদার আবার যদি কথা লুকিয়েছিস আমার থেকে!”
এবার মোশাররফ গলা ঝেড়ে বললেন,”ভাষণ শেষ হলে আমরা কি এবার ডিনার করতে পারি মহাশয়া!”
মরিয়ম বেগম তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো! তাই দেখে বাচ্চাদের মত বলে উঠেন,”খিদা লাগছে তো!”
আয়ুশী ফিক করে হেসে দেয়!মরিয়ম মুচকি হেসে খাবার আনতে যায়!আয়ুশী এবার বুঝতে পারে আসলেই সে যেমন অপমানিত ফিল করছিল উনিও তো করেছে!সরি উনার প্রাপ্য!সারাদিনের কথা ভেবেই আনমনে হাসলো!কি অদ্ভুত ছিল আজকের দিনটা!
#চলবে
#অবেলায়_ভালোবাসি
#লেখনিতে_সাবরিন_জাহান
#পর্ব_০৩
“জানিস আজকে বেলাল স্যারের ছেলে ক্লাস করাবে! “,বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল সীমা।
“কিভাবে জানলি? “(ইভা)
“সকালে অনেকে বলাবলি করছিল যে দিন বেড রেস্টে আছে ওই কয়দিন তার ছেলে ক্লাস করাবে…শুনেছি তার ছেলে নাকি খুব কিউট!”,বলেই গালে হাত দিয়ে আনমনা হয়ে বসে রইলো সীমা।
ইভা বিরক্তির সহিত তাকালো, মূলত সীমার এইরকম বিহেভিয়ার ওর একদম পছন্দ না।পাশে আয়ুশীকে আনমনে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো ওর!আর দিনের তুলনায় আজ একটু বেশিই চুপচাপ ও!
” কি হয়েছে আয়ু?”,চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো ইভা।
ইভার কথায় সীমাও তাকালো আয়ুশীর দিকে।এখন মূলত বেলাল স্যারেরই ক্লাস।বাট উনার ছেলে নিবে তাই হয়তো গুছিয়ে আসতে দেরি হচ্ছে।তাই ওরাও বকবক করছে।কিন্তু আয়ুশী নিশ্চুপ!আয়ুশীর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কালকের কান্ড!মায়ের বুঝানোর পর কিছুটা অ’প’রা’ধবোধ কাজ করছে!যদিও ওই লোকটিরও দোষ আছে..কিন্তু তাও!ভুল তো তারই প্রথমে ছিলো।এখন সরি না বলা অবদি মন শান্ত হবে না!
“আয়ু!”, বেশ খানিকটা চিল্লিয়ে বলল সীমা!
আয়ুশী একটু কেঁপে উঠলো।
” হু?কি হয়েছে?”
“তোর কি হয়েছে?কখন থেকে ডাকছি!উত্তর দিচ্ছিস না…কি ভাবছিস?”(ইভা)
আয়ুশী কিছু বলবে তার আগেই একজন সিনিয়র টিচার আসলো, সাথে এক সুদর্শন যুবক!যার ফেস দেখা মাত্রই ওদের তিনজনের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।আয়ুশী নিজের ভ্রম ভেবে আবারও চোখ কচলে সামনে তাকালো।না ভুল দেখছে না ও!মুখ থেকে আনমনেই বের হলো,” মিষ্টার খা’রু’শ !”
সিনিয়র টিচার সবাইকে বললো,এক মাসের জন্য স্যারের ছেলে ক্লাস নিবে।যেহেতু তিনি বেড রেস্টে এবং ওদেরও সামনে পরীক্ষা তাই এই ব্যবস্থা! আরও কিছু লেকচার দিয়ে চলে গেলো।যুবকটি মাউথ স্পিকারের সামনে গিয়ে,”ডিয়ার স্টুডেন্ট,আই এম আয়ান মাহতাব!তোমাদের সাময়িক কেমিস্ট্রি লেকচারার!”
আয়ুশী এখনও শকে!সবাইকে যে বসতে বলা হলো তাতে ওর ধ্যান নেই!সীমা আর ইভা দুইজন দুদিক দিয়ে টেনে ওকে বসালো।আপাতত উনার নজরে পড়তে চায় না!যেহেতু এমনেই আজ লেট তাই আয়ান টুকটাক আলোচনা করে সবার সাথে পরিচিত হচ্ছে….সবাই একে একে নিজের নাম বলছে। আয়ুশীদের বেঞ্চে আসতেই,সীমা নিজের নাম বললো।এরপর আয়ুশী দাড়াতেই আয়ান চমকালেও প্রকাশ করলো না।আয়ুশীর গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না।ভয়ে হৃদস্পন্দন মনে হয় এক সেকেন্ডে ডাবল ডাবল বিট হচ্ছে!
“এক্সকিউজ মি!এভাবে থম মে’রে থাকলে আর সবার ইন্ট্রোডাকশন নিবো কিভাবে?”, বেশ বিরক্ত নিয়ে বললো আয়ান!
এবার আয়ুশী নিজের নাম বলতে নিবে তার আগেই টাইম শেষ হয়ে গেলো।
” ওকে স্টুডেন্টস! টাইমস আপ..এমনেও সবার নাম আমার মনে তো আর থাকবে না!তাই এতটুকুই আজকে।কালকে থেকে ক্লাস হবে।”
বলেই বেরিয়ে গেলো।ব্রেক টাইমের আগ অবদি আয়ুশী শকের মাঝেই ছিলো।ব্রেক টাইমে তিনজন ক্যান্টিনের উদ্দেশ্য বের হলো!
“ভাই রে ভাই,উনি বেলাল স্যারের ছেলে?দেখে তো শান্ত মনে হলো।তাহলে ওইদিন আয়ুশীকে চ’র মারলো কেনো?”(সীমা)
“আচ্ছা স্বাভাবিক ভাবে ধর তোকে এখন কেও এসে বললো যে তুই ওদের বাড়ির কাজের লোক। এখন তোর রিয়াকশন কেমন হবে?” (ইভা)
“মানে কি?আমাকে দেখে কাজের লোক লাগে নাকি?” (সীমা চটে গিয়ে বললো)
“তাহলে স্যারকে কোনদিক দিয়ে ফল বিক্রেতা লাগছিলো?”(ইভা)
সীমা ভাবুক ভঙ্গিতে বললো,” যুক্তি আছে!”
“আর যাদের শান্ত লাগে দেখতে তাদের রাগ বেশি হয়!আর রাগ করে কোনো ছেলে তো চ’র মারার বদলে চুমু দিবে না তাই না?তাছাড়াও অনেকের ধৈর্য্য কম!তাই হয়তো এমনটা করলো!”(ইভা)
সীমা দুষ্টু হেসে বললো,” চু’মু দিলে ব্যাপারটা জোস হতো!”
থেমে গেলো আয়ুশী!রাগী চোখে সীমার দিকে তাকাতেই সীমা মেকি হেসে বললো,”মজা করছিলাম!”
“তোর এই কচুর মজার জন্য আমার ওই অবস্থা হয়েছিলো!না তুই ডেয়ার দিতি।না কিছু হতো….!”
বলেই হাঁটতে লাগলো।
“আরে আয়ু দাড়া!” (ইভা)
“এই দেখ দেখ!”, সীমা উৎসাহ নিয়ে বললো।
আয়ুশী আর ইভা ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
” স্যারের নাম আর আয়ুশীর নামে কত মিল!”(সীমা)
আয়ুশী বিরক্তিতে ঘুরে হাঁটতে লাগলো। মূলত সীমার এই ফা’ল’তু মজা ওর ভালো লাগছে না!ব্যাগ হাতড়ে পানির বোতল বের করে হাঁটতে হাঁটতেই পানি পান করতে লাগলো ও।আজকে আর ক্লাস করার ইচ্ছা নেই!তাই ব্যাগ নিয়েই এসেছে!
ইভা এবার ধমক দিয়ে বললো,”তুই চুপ করবি?”
সীমা থামলো না।
“আরে দেখ না,আয়ুশী আর আয়ান!শর্ট কাটে…আয়ু!”
শেষের কথাটা বেশ জোড়ে বলায় বাঁধলো আরেক বিপত্তি!ওই মুহুর্তে আয়ান বের হচ্ছিলো আরেক ক্লাস থেকে।সীমার আয়ু বলে ডাকায় ভ্রু কুঁচকে ওদের দিকে ঘুরে তাকালো ও!কেওই প্রস্তুত ছিলো এই মুমেন্টের জন্য।আয়ুশী মুখের পানি গিলতেও ভুলে গেলো।তিনজনই ভয়ে দাড়িয়ে রইলো।
আয়ান গম্ভীর গলায় বললো,”আয়ু বলে কে ডাকলো?”
বলতে দেরি কিন্তু আঙ্গুল তুলে সীমাকে দেখাতে ওদের দেরি হলো না!সীমা বেচারি কাঁদো কাঁদো ফেস করে তাকিয়ে রইলো।
“টিচারদের সাথে কি রকম বিহেভ করতে হয় জানো না?”
সীমা আমতা আমতা আমতা করে বললো,”স্যার আসলে..”
“এখন স্যার বলছো,তখন আমার নাম ধরে ডাকলে কেনো?”
সীমা তড়িঘড়ি করে আয়ুশীকে দেখিয়ে বললো,”স্যার আমি ওকে ডাকছিলাম…ওর নাম আয়ুশী আফরোজ!আমরা শর্ট কাটে আয়ু বলে ডাকি!আপনাকে কেনো নাম ধরে বলতে যাবো!ছি ছি…”
আয়ান একবার সীমা তো একবার আয়ুশীর দিকে তাকালো…অতঃপর আয়ুশীকে উদ্দেশ্য করে বললো,”বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে মুখে পানি নিয়ে বসে আছো কেনো?”
চটপট পানি গিলে ফেললো আয়ুশী!আয়ান কিছু না বলেই হাঁটতে লাগলো আবার।আয়ুশীর মনে হলো এখনই উনাকে সরি বলে ফেলা দরকার।স্যার বলে ডেকেই একটু এগিয়ে যেতে কলার খোসায় পা পড়ায় আবার পা পিছলে গেলো।নিজেকে সামলাতে গিয়ে বোতল সামলাতে পারলো না ও!ওই মুহুর্তেই আয়ান আয়ুশীর ডাকে ঘুরে দাড়িয়েছিলো।পাশের ওয়াল ধরে আয়ুশী পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচলেও,বোতলের পানি সব ছিটকে সব আয়ানের শরীরে পড়লো।আয়ান কি রিয়াকশন করবে বুঝতে পারলো না!এদিকে আয়ুশীর মুখে কান্না কান্না ভাব!এবার আয়ান রেগে উঠলো।আশেপাশের সবাই ওর দিকে তাকিয়ে।ও বুঝতে পারলো না যখনই মেয়েটা আসে তখনই ওকে হ্যারেজ কেনো করে।বেশ ধমকে বলে উঠলো,”ইডিয়েট!এটা কি করলে?”
আয়ুশী কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো, “সরি, স্যার!ওই পা পিছলে…”
আর কিছু বলার আগেই আয়ান ধমকে বললো,”জাস্ট কিপ ইউর মাউথ শাট!”
আয়ুশী চুপ করে গেলো।আয়ান রে’গে নিজের কেবিনের দিকে গেলো।আয়ুশী লম্বা শ্বাস নিলো।বুঝে উঠতে পারলো না,সব সময় এই লোকটা থাকলেই ও উলোটপালোট কাজ কেনো করে..সীমা আর ইভাকে নিয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে বসে পড়লো ও!যা চায় তার উল্টো হওয়া এত জরুরি কেনো?মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো ও।
“হ্যালো মিস মিনি পান্ডা!”,বলেই ওর সামনে সেদিনের ডাক্তার লোকটি বসলো।
আয়ুশী অবাক হয়ে বললো,” আরে আপনি?”
“ওহ চিনেছো তাহলে!কেমন আছো?পায়ের ব্যাথা আছে না গেছে?”
“ব্যাথা নেই কিন্তু আপনি এখানে?”
“একজনের সাথে দেখা করতে এসেছি!”
সীমা লাফিয়ে বলে উঠলো,”জিএফ নিশ্চয়ই? ”
লোকটি হেসে বললো,”আরে না!”
“তাহলে কার সাথে?” (আয়ুশী)
“আপনার!” (লোকটি)
আয়ুশী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। লোকটি আবারও হেসে বললো,”মজা করছিলাম।আমার এক ফ্রেন্ড।এখানেই আছে…ওর সাথেই দেখা করতে এসেছি!তো তোমরা কোন ইয়ারের স্টুডেন্ট? ”
“প্রথম বর্ষ !”(ইভা)
“ওহ আচ্ছা ,এখন আসি!কাজ আছে কিছু!”
বলেই উঠে যেতে লাগলো।আয়ুশী খেয়াল করলো লোকটি তার ফোন ফেলে গেছে!
“শুনছেন?”
লোকটি নিরুত্তর!
“আরে মিস্টার ডাক্তার!”
এবার লোকটি ঘুরে তাকালো!
“আমাকে ডাকছেন?”
“আপনার ফোন!”
“ওহ ধন্যবাদ!কিন্তু আমার নাম তো ডাক্তার না!”
“নাম না জানলে ডাক্তার কে ডাক্তার বলেই সম্বোধন করা উচিত!”
লোকটি হেসে বললো,”এতক্ষণ এত কথা বললাম,অথচ নামটাই বলা হলো না!আর না জানা হলো!আমি ফাহিন ইসলাম!আর আপনারা?”
“আমি আয়ুশী!ও সীমা আর ও ইভা!আর আমরা আপনার ছোট!তুমি করেই বলতে পারেন!”
“আচ্ছা বেশ!আজকে লেট হয়ে যাচ্ছে।পরে কখনো দেখা হলে জমিয়ে আড্ডা দিবো!”
আয়ুশী সম্মতি জানালো। ফাহিন বেরিয়ে গেলো!ভার্সিটির গেটে দাঁড়িয়ে ফোন করলো।
“কই তুই?ক্যান্টিনে কখন থেকে বসে ছিলাম,আসার নাম নেই তোর!আমার কাজ আছে ভাই!জলদি গেটের কাছে আয়।আঙ্কেলের রিপোর্ট গুলো দিয়েই চলে যাবো!”
বলেই ফোন কেঁটে দিলো।কিছুক্ষণ বাদেই আয়ান এলো।
“সরি ইয়ার,একটু ঝামেলায় পড়েছিলাম!”
“রাখ তোর সরি!নে রিপোর্ট গুলো…”
ফাহিন রিপোর্ট গুলো হাতে দিয়ে কিছুক্ষণ আলাপ করে চলে গেলো।…
________________
ভার্সিটি থেকে এসে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিল আয়ান!মেজাজ প্রচুর খারাপ বর্তমানে!আয়ুশী মেয়েটির উপর চরম বিরক্ত সে!তার উপর আজকে এমন কাণ্ড!আশেপাশের লোক কি ভাবলো ওকে?বরাবরই আত্মসম্মান মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ ও!এভাবে গন সম্মুখে হ্যারাসমেন্ট হতে কার ভালো লাগে।ছেলের জন্য লেবুর শরবত নিয়ে এলেন নাহার!ছেলেকে এমন বিরক্ত হতে দেখে চিন্তিত হলেন!
“আয়ান?”
“হুমম…”
“কি হয়েছে তোমার?”
“ভালো লাগছে না মা!”
নাহার শরবতের গ্লাস টা পাশে রেখে ছেলের কাছে বসলেন!মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,”আমি তো জানতাম আমার ছেলে কিছু নিয়ে চিন্তিত হলে আগে আমায় বলে!”
“চিন্তিত না মা,বিরক্ত আমি!”
“কেনো?ক্লাসে কোনো ঝামেলা হয়েছে?”
“ঝামেলা নিজেই ক্লাসের বাইরে চলে এসেছে!”
নাহার বুঝলেন না কিছুই। আয়ান তা বুঝতে পেরে শুরু থেকে বললো।
“কেউ ভুল বুঝে তোমাকে ফল বিক্রেতা ভেবেছে ,এই জন্য তুমি তার গায়ে হাত দিবে?”
“ভুল বুঝে হলে আমি এমনটা করতাম না কখনোই মা!কিন্তু মেয়েটার চোখ মুখেই স্পষ্ট ছিল সে জেনে শুনে আমাকে ওসব বলেছে!”
“আচ্ছা মানলাম ,কিন্তু তাই বলে অপরিচিত এক মেয়ের গায়ে হাত দিবে তুমি?এই বুঝি আমার শিক্ষা?”
আয়ান উঠে বসলো।মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”তুমি তো জানো মা,রাগলে আমার মাথা ঠিক থাকে না…আর প্রসঙ্গ যখন আত্মসম্মান তখন আরো বেশি এমন করি!”
বলেই নেমে টাওয়াল হাতে নিল।
“ফল বিক্রেতারা কি মানুষ না?”
নাহারের কড়া গলায় ঘুরে তাকালো ও।
“আমি সেটা কখন বললাম?”
“তাহলে আত্মসম্মান এর কি হলো?ফল বিক্রেতা হলেই কি মানুষের কাছে তুমি ছোট হয়ে যাবে?”
“আমি সেটা বলিনি মা!”
“তুমি এটাই বুঝাচ্ছো!”
আয়ান চুপ রইলো।
“মেয়েটির ভুল ছিল,মানলাম!কিন্তু অপরিচিত মেয়ের গায়ে হাত তুলে তুমি কতটা ঠিক কাজ করেছো?”
আয়ান নিশ্চুপ!
“তোমাকে আমি এই শিক্ষা দেই নি আয়ান! হ্যাঁ,রাগ উঠেছিল!তুমি ওকে কড়া কথা বলতে, বকতে বা বুঝাতে!হাত তুলার অপিনিয়ন টা কতটা যুক্তি সম্মত?”
“আই এম সরি মা! একচুয়ালি বাবার এ’ক্সি’ডে’ন্ট নিয়ে টেন্সড ছিলাম!তাই তখন একটু বেশি ই ওভার রিয়েক্ট করে ফেলেছি!”
“সরি আমাকে না বলে ওই মেয়েকে বলবে,সাথে এটাও বলবে এরকম যেনো আর না করে!”
“এখন আবার ওকে কেন সরি বলবো!আমি পারবো না”
“আয়ান!”
“চেষ্টা করবো!”
বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।নাহার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন!এই ছেলে যে সরি বলবে না ঢের বুঝতে পেরেছেন!বেচারি মেয়েটা !কে জানে কি ভেবেছে!হয়তো এটাই ভেবেছে মায়ের আদুরে দুলাল,তাই এমন কাজ!ভেবেই আবারও দীর্ঘশ্বাস নিলেন…
#চলবে
(প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে পাঁচটার মাঝে দেয়া হবে!তাই ওই সময়টাতেই অপেক্ষা করবেন সবাই!)