#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-৩
লেখনীতে-তানিয়া শেখ
দরজার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে নিরুপমা। চোখে-মুখে বিতৃষ্ণা। খানিক বিস্ময়ও রয়েছে। জীবনে প্রথমবার দেখছে ঠোঁটের কোণে জ্বলন্ত সিগারেট গুঁজে সামনে ভাত-তরকারি নিয়ে বসে আছে কেউ। সেই কেউ ওই খু* নিটা। শুধু কি খু* নি? নিরুপমাকে ভয় দেখিয়ে জবরদস্তি এখানে আসন গেড়ে বসেছে! একটা অবলা মেয়ে পেয়ে বল খাটানো!
“অমানুষ, অমানুষ, অমানুষ।” মনে মনে এই একটা শব্দেই আপাতত তিরস্কার করল। পরে আবার নতুন কোনো শব্দ ব্যবহার করবে। যদি প্রকাশ্যে বলতে পারত শব্দগুলো! ওর চোখ গেল রক্তমাংসের ছায়ামানবের পাশের ধাতব বস্তুটার ওপর। বড়োসড়ো ঢোক গিললো। আরেকটু পিছিয়ে দাঁড়ায়। ও একা হলে এতক্ষণে এখান থেকে পালিয়ে যেত, যেভাবেই হোক। এখন তা সম্ভব না।
“আমি মাছ খাই না।” নাক কুঁচকে বলল এহসাস। নিরুপমা দাঁতে দাঁত কামড়ায়। মনে মনে বলে,
“আহা! কত আহ্লাদের কথা। জনাব মাছ খান না রাত দুপুরে তার জন্য কাচ্চি রাঁধব আমি। আমার ঠেকা পড়েছে না! জোরপূর্বক মানুষের বাসায় থাকা আবার খাই না খাই না করা হচ্ছে।”
কিন্তু মুখ নির্বিকার করে বলল,
“মাছ ছাড়া আর কোনো তরকারি নেই। মেইন রাস্তার পাশে একটা হোটেল আছে। সারারাত খোলা থাকে। সেখানে গেলে আপনার মনমতো সব পেয়ে যাবেন।”
এহসাস এবার ওর দিকে তাকালো। সিগারেট দুআঙুলে ঠোঁট থেকে সরিয়ে বলল,
“গোরুর গোশত ভুনা, মোরগ পোলাও আর একটা স্পাইট। আপাতত এতেই হবে।”
“হু?”
“এগুলো নিয়ে আসুন গিয়ে সেখান থেকে।”
“আমি!”
“হ্যাঁ, আপনিই তো হোটেল প্রমোট করলেন। আপনি গেলেই ভালো হবে।”
“আমি কোথাও যাব না।”
“তাহলে হোটেল প্রমোটার হওয়া থেকে বিরত থাকুন মিস অমাবস্যা।”
“নিরু_”
“চুপ!” চাপা গলায় এহসাস ধমকে উঠতে নিরুপমা চুপসে যায়। সিগারেট দ্রুত টান দিতে দিতে চুলে আঙুল চালাতে লাগল এহসাস। খিদে পেটে মেজাজ এমনিতেই ঠিক নেই। আর এই মেয়ে আছে নাম শুধরাতে৷
“ডিম ভেজে নিয়ে আসুন।” বলল এহসাস। নিরুপমা মাথা দোলায় দুদিকে।
“ডিম নেই।”
এহসাস এবার সত্যি রেগে গেল। গলা চড়ে গেল একটু।
“ডিম নেই! সামান্য একটা ডিম থাকে না আপনার ঘরে? আজব! এখন আমি খাব কি আপনার মাথা?”
সিগারেট পায়ে পিষে এগিয়ে গেল নিরুপমার দিকে। নিরুপমা আরও পিছিয়ে যায়। ভয় ও লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে রইল ওর সামনে। এহসাসের বোধোদয় হলো যেন ওই মুখে চেয়ে। সরে এলো ওর সামনে থেকে। খাটের ওপর বসে অস্থিরভাবে পা নাড়াতে লাগল। নিরুপমার চোখ ছলছল করছে। চেনা নেই জানা নেই এই লোক ওকে কেন এভাবে ধমকাবে? কী অধিকার আছে? শুধুমাত্র মায়ের কথা ভেবে চুপ করে আছে। নয়তো আচ্ছা মতো কথা শুনিয়ে দিতো। মরবে বলে ভয় করে না কি। নির্লজ্জ লো….
“সরি! মাছ খাওয়ার অভ্যাস নেই আমার। কোনো মাছই খেতে পারি না। বমির উদ্রেক হয়। জানি, উইয়ার্ড সাউন্ড করছি। কিন্তু আমি এমনই। খিদে আমি বরদাস্ত করতে পারি না। সকাল থেকে কিছু খাইনি।” থামল এহসাস। তারপর বিছানায় উঠে পা ছড়িয়ে খাটে হেলান দিয়ে শ্রান্ত গলায় বলে,
“খিদে পেটে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। কিছু মনে করবেন না। এই খাবারগুলো নিয়ে যান। এগুলো আমার গলা দিয়ে নামবে না। আজ রাতে কষ্ট করে আপনার মায়ের রুমে গিয়ে ঘুমান। কাল সকালেই আমি চলে যাব।”
বলেই চোখ বন্ধ করল। নিরুপমার কাছে ওর এই নরম, অবসন্ন গলা অপ্রত্যাশিত ছিল। ভেতরে জ্বলে ওঠা চাপা ক্রোধ এবার একটু কমে যেন। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে খাবারগুলো বিছানা থেকে তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে প্রস্থান করে। তরকারি ফ্রিজে রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল পাশেই। লোকটা কালই চলে যাবে। যাক বাঁচল ও। সে চলে গেলে আগামীকাল গরিবকে বিশ টাকা…না আরও বেশি সদকা দেবে। এত বড়ো বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়ার খুশি ও এখনই টের পাচ্ছে। নিঃশব্দে মায়ের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। বহুদিন মায়ের পাশে শোয় না। মা একাই শুতে পছন্দ করেন। তাছাড়া মাঝে মাঝে এমন কিছু কান্ড ঘটান যে বাধ্য হয়েই দেড় রুমের বাসা নিতে হয়েছে। নয়তো একরুমেই বেশ চলত। নিরুপমা হাঁপ ছাড়ে। পাশ ফিরতে নিজের রুমের দিকে চোখ পড়ল। দরজা ভেজানো। ভেতরে ফ্যাকাশে আঁধার। লোকটার শেষ কথাগুলো মনে পড়ছে। বাবার মৃত্যুর পর নিরুপমাও অনেকদিন খিদে পেটে থেকেছে। অপছন্দের খাবারগুলো জোর করে খাওয়ার অভ্যাস করা কতটা কষ্টের ও খুব জানে। জানে বলেই লোকটার জন্য ওর মন নরম হয়। কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর উঠে ফ্রিজের কাছে যায়। মাঝারি সাইজের একটা টিফিন বাটি বের করে ফ্রিজটা আবার বন্ধ করল। গত পরশু বাড়িওয়ালার নাতির আকিকা ছিল। নিরুপমাকে খাইয়ে বাটিতে করে কিছু বিরিয়ানি ওর মায়ের জন্য দিয়েছিলেন বাড়িওয়ালি। ওর মা পরে খাবে বলাতে নিরুপমা ডিপফ্রিজে রেখে দিয়েছিল। এই দুইদিনে মা একবারো বিরিয়ানির নাম মুখে নেয়নি। হয়তো মনে নেই কিংবা খাবেই না।
নিরুপমা বিরিয়ানি গরম করে প্লেট হাতে নিজের রুমের দরজা সরালো। এখন এই লোক ওর কাছে খুনীর চেয়ে একজন ক্ষুধার্ত আগন্তুক বেশি। ক্ষুধার্তকে অন্ন দিলে আল্লাহ তাআ’লা খুশি হন।
“শুনছেন?” ফিসফিস করে বলল ও। কিন্তু সাড়া এলো না। নিরুপমা সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছে। ওর পেট মুচরে ওঠে এই গন্ধে। মাথা ধরে। মানুষ এমন একটা বাজে জিনিস কেন যে খায়! নিরুপমা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে। ঠিকই ভেবেছিল, ওই তো খাটের ওপর পা ছড়িয়ে একমনে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। বয়স তো বেশি না লোকটার। নিরুপমার বয়সী? হতে পারে আবার কমও হতে পারে। বেশি হবে না কেন? উফ! নিরুপমা মনে মনে নিজের ওপর বিরক্ত হয়। এই লোক সিগারেট টানতে টানতে হৃদপিণ্ড জ্বালাক না ক্যান্সারে মরুক তাতে ওর কী! কাল এখান থেকে চিরতরে বিদায় হলেই নিরুপমা বাঁচে।
“ফ্রিজে এইটুকুই ছিল।”
প্লেটটা এহসাসের সামনে রেখে নিরাপদ দুরত্বে সরে দাঁড়ায়। এহসাস চোখ খুলে একবার প্লেটে আরেকবার ওর মুখে তাকালো শান্ত চোখে। মুখে তাকিয়েই রইল। নিরুপমার অস্বস্তি হয়। ঘুরে দরজার কাছে যেতে খাবার মুখে এহসাসকে বলতে শুনল,
“ধন্যবাদ নীড়।”
নিরুপমার ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি ফুটে ওঠে। অবশেষে লোকটার মুখ থেকে অমাবস্যা নামটা তো সরেছে। কিন্তু নীড়ই বা বলবে কেন? অচেনা লোকের মুখের নিজের নামের কাটছাঁট অংশ শুনতে কেমন যেন লাগল। ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে কপাল কুঁচকে যায়।
মায়ের পাশে এসে আবার শুয়ে পড়ে। রাত পোহালেই ওর সকল দুশ্চিন্তা দূরীভূত হবে। চলে যাবে ওই আগন্তুক। নিরুপমার ক্লান্ত চোখে আস্তে আস্তে ঘুম নেমে এলো।
ফজরের আজান আজ শুনতে পেল না নিরুপমা। নামাজ কাযা গেল। কে যেন খুব জোরে ছাঁদের দরজা ঠেলে খুলতে ঘুম ভেঙে গেল সেই শব্দে। ছেলেটা নিশ্চয় চলে গেছে! পাশ ফিরে দেখল ওর মা এখনও ঘুমিয়ে আছে। নিরুপমা খুশি মনে তাড়াতাড়ি উঠে নিজের রুমে যায়। খাটের ওপর তাকাতেই ওর সকল আনন্দ উবে গেল। ছেলেটা উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে খাটের ওপর। উন্মুক্ত পিঠ। নিচে জিনস। নিরুপমা চোখ সরিয়ে নেয়। খাটের নিচে গতরাতের এঁটো প্লেট আর গ্লাস পড়ে আছে। তার পাশে একগাদা পোড়া সিগারেট আর ছাই। পুরো রুমে সিগারেটের গন্ধে শ্বাস নেওয়ার জো নেই। ভীষণ রাগ হচ্ছে নিরুপমার। মিথ্যাবাদিদের ও মোটে সহ্য করতে পারে না। একটা খুনীর কাছে সত্যবাদিতা আশা করেছিল! নিজের সরলতাকে ধিক্কার দিলো।
এঁটো প্লেট আর গ্লাস হাতে তুলে ইচ্ছে করেই শব্দ করল। এহসাস ঘুমের মধ্যে বিরক্ত হয়ে ওর দিকেই ফেরে। নিরুপমা রাগে দাঁত কামড়ে আরও জোরে শব্দ করতে ঘুম ঘুম চোখে রেগে তাকায় এহসাস।
“কী সমস্যা?” রূঢ় কণ্ঠে বলে ওঠে। নিরুপমার সঞ্চিত সাহস একটু নিঃশেষ হয়। কিন্তু ঠাঁই নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে রইল ও। রাগ রাগ মুখেই বলল,
“আপনি এখনও কেন এখানে? রাতে বলেছিলেন তো সকাল হলেই চলে যাবেন।”
“বলেছিলাম না কি?” বিরক্তির ভাজ এখনও কপালে। অন্য পাশ ফিরে বলে,
“কথার কথা কত কী বলে মানুষ। সবকিছু সিরিয়াসভাবে নিতে নেই। বেলা বারোটার আগে আর আমাকে ডাকবেন না মিস অমাবস্যা। নাও গেট আউট ফ্রম মাই রুম।”
“আপনার রুম! এটা আমার রুম। জোর করে_”
এহসাস লাফ দিয়ে বিছানার ওপর উঠে পি* স্তল হাতে নেয়। তাক করে নিরুপমার দিকে। ভয়ে জমে গেল ও।
“আর একটা শব্দ বের করুন তো দেখি। বকবক, বকবক.. সকাল সকাল মেজাজটাই খারাপ করে দিয়েছে। আউট।”
নিরুপমা বাধ্য হলো পিছু হটতে। দরজার কাছে যেতে শুনল,
“আপনি ছাড়া যদি কাকপক্ষীতেও এই রুমে আমার উপস্থিতি টের পায় তবে আপনাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে না মিস অমাবস্যা। চারপাশে আমার লোক পাহাড়ায় আছে। আমাকে বিপদে ফেলতে গেলে নিজেও পড়বেন। তাছাড়া খু* নীর জন্য একটা খু* নও যা তিনটে খু* নও তাই।”
নিরুপমা আরও দু পা এগোতে বিড়বিড় করতে শুনল,
“ঘুম থেকে উঠলে নান আর সবজি সামনে দেবেন। শালা! গতকাল সকালে খিচুড়ি খেয়ে সারাদিন পেট চিনচিন করেছে। ওমিপ্রাজল একপাতা এনে রাখবেন তো। দুবেলা বিরিয়ানি খেয়ে পেটের অবস্থা নাজুক…”
আরও কিছু বলছিল নিরুপমা শুনল না। রান্নাঘরে এসে শব্দ করে গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেললো বেসিনে। কাঁচের গ্লাস ভেঙে দু’টুকরো হলো। এই লোক ওকে মিথ্যা বলেছে গতরাতে। নিরুপমাকে বোকা বানাতে পেরে মনে মনে হাসছে নিশ্চয়! হাতের প্লেট সজোরে বেসিনে ফেলতে গিয়েও থেমে যায়। ক্রোধে কাঁপছে রীতিমতো। এই লোকটাকে খু* ন করতেও ওর বাধবে না এখন। কিন্তু সবার দ্বারা সবকিছু হয় না। নিরুপমার দ্বারা মানুষ খু* ন হবে না বোধহয়। কিন্তু ভবিষ্যৎ কে দেখেছে। রাগে হাতের প্লেট আছরে ফেললো বেসিনে। ঠিক তখনই সদর দরজার বাইরে বাড়িওয়ালা কড়া নাড়লেন,
“নিরুপমা মা, জেগে আছো?”
চলবে,,,,
পর্ব -২ একটু এডিট করা হয়েছে। পড়ে নেবেন আবার।