অরূপ জ্যোৎস্না পর্ব -১১

#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-১১
লেখনীতে-তানিয়া শেখ

শুধু মিনি নয়, এহসাসকে আরেকজনও নিঃস্বার্থ ভালোবাসে। সে ওর নানুমনি। এহসাস তাঁর কথা কী করে ভুলে গেল! সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ঠিক জীবনটার মতো। নানুমনি দরজার মুখে দাঁড়িয়ে। বাজ পড়লে মানুষ যেমন আঁতকে ওঠে, থম মেরে যায় তাঁর মুখেও তেমন দশা। অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ফ্যামিলি ড্রামা শুরু হবে এখন। উফ! ভাগ্যকে মনে মনে কষলো। নানুমনিকে উপেক্ষা করা, অমান্য করা এহসাসের জন্য দুঃসাধ্য। অন্তত এখন তো তাই মনে হচ্ছে।

মায়ের মানবীয় মুখ এহসাসের স্মৃতিতে বড্ড ধূসর। কাগজের ছবিতে দেখা মায়ের স্থির মুখ আর নানুমনির মুখ ও এখন আর আলাদা করতে পারে না। ইনারই তো মেয়ে ওর মা। মায়ের মা। ইনাকে অমান্য করার সাধ্য কোথায় পাবে এহসাস!

“নানুমনি!”

“তুমি কী করছ ভাই!”

সজল চোখজোড়া আর্ত জোবেদা চৌধুরীর। নিজের কানে শোনা কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। এহসাস দরজা থেকে পিছিয়ে যায় ভেতরে। সদর দরজায় অনবরত ডোর বেল বাজছে। কেউ খুলছে না কেন? একবার এই রুম থেকে বের হতে পারলে ও সব কটা কাজের লোককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেবে।

“কথা কও না ক্যান ভাই? কী করছ তুমি?”

জোবেদা চৌধুরী রুমে ঢুকলেন। ইকরাম আজাদ ও ক্যামেলিয়ার আহত নত মুখের দিকে তাকিয়ে অবুঝের মতো বললেন,

“ও বাপজান, ও নয়া বউ, আমার নাতি এসব কী কয়? তোমরা কথা না ক্যান?”

শেষটায় প্রৌঢ়ার গলা বসে এলো। তাঁর পা কাঁপছিল। পুলিশ এসেছে শুনে ঈপ্সা ওপরে এসেছিল। শব্দ পেয়ে দৌড়ে এলো এ রুমে। নানুমনি পড়ে যাবে যাবে ভাব। ঈপ্সা জড়িয়ে ধরল।

“নানুমনি, কী হলো তোমার?”

“আপনি শান্ত হন খালাম্মা। ক্যামেলিয়া উনাকে অন্য ঘরে নিয়ে যাও।” ইকরাম নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন। এখন তাঁকে শক্ত থাকতে হবে। সৈয়দ বাড়ির ভিত নড়বড় করছে। এ সময় দুর্বল হলে চলবে না। ক্যামেলিয়া তাকাল না তাঁর দিকে। অপ্রত্যাশিত আঘাতে বিহ্বল মানুষের মতো এগিয়ে গেল জোবেদা চৌধুরীর কাছে। বড়ো চিন্তা হলো মেয়েটার জন্য ইকরামের। এহসাস না জেনে ওর ব্যথা বাড়িয়ে দিলো। সব সত্য ওকে জানাবেনই বা কী করে! মানুষ মাঝে মাঝে পরিস্থিতির কাছে অসহায়। সঠিক সময়ের অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না।

“আমি কোনোখানে যাব না। আগে আমার কথার জবাব দেও তোমরা। ও ক্যান কইলো ফাঁসিতে ঝুলব? কেন কইলো পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করব? আমারে আর ধাঁধার মধ্যে রাইখো না।”

“ও..ও মিথ্যা বলছে। আপনি তো ওকে চেনেন খালাম্মা। মিথ্যা বলে মানুষকে বোকা বানিয়ে ও মজা পায়। এখনও তাই করছে। আপনাক আমাকে ভয় পাইয়ে দিতে এমনটা করছে ও। তাই না ঈপ্সা?”

ইকরাম আজাদ মেয়েকে ইশারায় পরিস্থিতি বুঝাতে চেষ্টা করেন। জোবেদা চৌধুরী ঈপ্সার দিকে তাকালেন। ঈপ্সা সত্যি বা মিথ্যা জানে না। ও নিজেও নানুমনির মতো ধাঁধায় আছে। হঠাৎ দাদাভাইয়ের বলা রাতের কথা মনে পড়ল। ও যা বিশ্বাস করে ওর দাদাভাই তাই।

“হ্যাঁ, আব্বু ঠিক বলছে। দাদাভাই খারাপ কিছু করতেই পারে না।”

“আমি খুন করেছি মিনি।”

ঈপ্সা বজ্রাহতের ন্যায় চেয়ে রইল দাদাভাইয়ের মুখের দিকে। বিশ্বাসভঙ্গের জ্বালা কী অসহ্য! দাদাভাই ওকেও ঠকালো শেষমেশ! ফর্সা গালদুটো অশ্রুতে ভেসে গেল। এহসাস নিষ্ঠুরের মতো চোখ সরিয়ে চাচার দিকে তাকায়। ক্ষুব্ধ, নির্মম চাহনিতে ইকরাম আজাদকে জ্বালিয়ে মারতে চাইল। তাতেও ওর শান্তি নেই। তিক্ত গলায় বলল,

“তুমি যা শুনেছ সব ঠিক, সব সত্যি। পুলিশ আমাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে নানুমনি। কেন জানো? কারণ আমি খুনি। খুন করেছি আমি। তোমার নাতি খুন করেছে। সে ফাঁসিতে ঝুলবে। খুনিদের তো এটাই নিয়তি। কষ্ট পেয়ো না। আদরূপ তো আছে। ও শালা, ইমোশনলেস সাইকো হলেও তোমাকে ভালোবাসবে। আমি মরলে আরও বেশি বাসবে। মনে থাকবে না আমাকে তোমার। বিশ্বাস করো।”

“স্টপ ইট এহসাস।”

ইকরাম আজাদ ভাতিজার গলার টিশার্ট চেপে ধরেন।

“ফর গডস সেক স্টপ ইট।”

“তুমি আমাকে চুপ থাকতে বলছো চাচ্চু? তাহলে ডিভোর্স দাও ওকে, পারবে?”

ইকরাম আজাদের শক্ত মুষ্টি হালকা হতেই এহসাস কাষ্ঠ হাসল।

“পারবে না তো? জানতাম৷ তোমার কাছে সবকিছুর চাইতে ক্যামেলিয়া বড়ো। আমরা মূল্যহীন, কিছুই না। ক্যামেলিয়া সব। পরিবার, বংশের মান, সমাজে নিজের মর্যাদা সব উপেক্ষা করে এই ক্যামেলিয়াকে আপন করেছ তুমি। তবে থাকো ওকে নিয়ে। আমি চললাম।”

রাগে চোয়াল শক্ত করে চাচার পাশ কাটিয়ে ফের একবার দরজার দিকে পা বাড়ায়। নানুমনি ও ঈপ্সা থামানোর আগেই পালাতে হবে। ওরা কাঁদছে। পৃথিবীর মায়া ত্যাগকারীরা সকল মায়ার জাল ছিন্ন করে। এহসাসও করেছে। নিষ্ঠুর, নির্মম ও নির্দয়! এই তো বলে তাদের লোকেরা। মামাতো ভাই আদরূপকে আজ ওর ভাগ্যবান বলে মনে হয়। ওর এসব ভান করতে হয় না। ওর কষ্ট নেই।ছোটো থেকেই আদরূপকে ও ঠাট্টা করে নাম দিয়েছে “প্যাথেটিক ডেডপ্যান”

এহসাস করিডোরে পা দিয়ে হাসে। নির্মোহ হাসি। এই তো জিতে যাচ্ছে। ওই তো সদর দরজা।

“মনসুর!”

ইকরাম আজাদের বজ্র কণ্ঠে সৈয়দ বাড়ির করিডোর ধমকে যায়। করিডোর! না, এহসাস নিজে। ওর হাসি ভয়ে কোথাও মিলিয়ে গেল। বহুকাল তো শোনেনি এই কণ্ঠ। কিন্তু এহসাস নির্ভীক দাঁড়িয়ে রইল। নানুমনি কাঁদছে না, ঈপ্সাও কাঁদছে না। ওরা জানে এখন এহসাস হারবে। ইকরাম আজাদ জিতবে। বরাবরের মতো জিতবে। তিনি কখনো হারেন না। কী গর্ব নিয়ে একদিন উচ্চারণ করত এই কথা এহসাস। কিন্তু আজ সেই গর্বকে ও ঘৃণা করে। প্রচন্ড ঘৃণা করে। হঠাৎ উপলব্ধি করে মাথার পেছনের আঘাত। ভোঁতা একটা যন্ত্রণা আস্তে আস্তে ওর সমস্ত শরীর অবশ করে দেয়। এহসাস বিদ্রোহ করতে চায়, মনসুরের বাহুজাল থেকে নিজেকে ছাড়াতে চায়। এত তো শক্তি ওর গায়ে ছিল। এই হাতে এলাকার তাগড়া তাগড়া মাস্তানগুলোকে একচেটে বেধড়ক মেরেছে। ছেলে ছোকরার দল ওকে কুর্নিশ করে চলে ভয়ে। আর সেই ও একজন চল্লিশোর্ধ্ব, চুলে পাক ধরা লোকের সাথে পেরে উঠছে না! এহসাস সামনে নেমে আসা অন্ধকারে প্রার্থনা করে,

“শক্তি দাও, শক্তি দাও…. নয়তো মুক্তি দাও।”

কিন্তু পেল কেবল ঘোর অমানিশা।

চলবে,,,,

আচ্ছা, আদরূপ নামটা কয়েকবার এসেছে এই পর্বে। তার অবশ্য কারণ রয়েছে। “জোছনার ছায়া” যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই কিছুটা বুঝতে পেরেছেন। আর যারা পড়েননি তাদের জন্য বলছি আদরূপ আমার লেখা চরিত্রদ্বয়ের থেকে একেবারে ভিন্ন চরিত্র, সমালোচিত। খুব সংক্ষেপে জোছনার ছায়ায় ওকে নিয়ে লিখেছিলাম। প্লান ছিল এবং আছে বড়ো করে সবিস্তারে লিখব। ইন শা আল্লাহ লিখব। একেবারে নতুন প্লটে, পুরাতন ছায়া ও আদরূপকে নতুন ছাঁচে গলিয়ে। কিন্তু… চরিত্র বৈশিষ্ট্য আমি অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করি। কেমন হয়ে গেল না? নতুন ছাঁচে আবার চরিত্র বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রাখব! আছে আছে… যা হোক, মূলকথা হলো, এই গল্পের কয়েক স্থানে আদরূপ সাহেবের কথা থাকবে হয়তো। তার মানে এই নয় ও এই গল্পের চরিত্র। আর হ্যাঁ, ওকে আর জোছনার ছায়ারটাকে এক ভাববেন না(যদিও একই ওরা)। এখানে যা একটু বলা হয়েছে বা হবে তা কেবল ভবিষ্যৎ “জ্যোৎস্নার ছায়া” গল্পের আদরূপের কথা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here