অরূপ জ্যোৎস্না পর্ব -১০

#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-১০
লেখনীতে-তানিয়া শেখ

আযানের সুললিত ধ্বনিতে ঘুম ভাঙে ইকরাম আজাদের। ঘরের ভেতরে ক্ষীণ আলো। পাশ ফিরে ক্যামেলিয়ার মুখটা দেখতে পান। প্রথম প্রথম বেশ অস্বস্তি হতো। এখন অবশ্য অভ্যাস হয়ে গেছে। অভ্যাস হয়ে গেছে বলেই কি দীর্ঘক্ষণ ওর ঘুমন্ত মুখে চেয়ে থাকেন? নির্মল ভোরের প্রকৃতির মতো যেন মুখখানা। চোখ প্রশান্ত করে। কিন্তু মনটাতে বিপরীত অবস্থা। সে অবস্থা অব্যক্তই ভালো।

ক্যামেলিয়াকে ইকরাম আজাদ বহুদিন থেকে চেনেন। কিন্তু সে চেনা আর আজকের চেনাতে কত তফাৎ। সেদিন ও ছিল পুত্রসম ভাতিজার বান্ধবী। আজ আপন স্ত্রী। কোনোদিন কল্পনা করেছিল এই কথা? না, কোনোদিন না। তাঁর কাজল তাঁকে চিরতরে নিঃস্ব করে চলে যাবে এও যে কোনোকালে ভাবেননি। নয়ত, এই বিছানায় তাঁর পাশে ক্যামেলিয়া আসবে কেন? এত শূন্যতা, সংকোচ ও অনুতাপ তৈরি হবে কেন বুক জুড়ে?

ক্যামেলিয়া ঘুমের মধ্যে উলটো দিকে ফেরে। দুজনের মাঝে অনেক দুরত্ব। ইকরাম শূন্যে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর শূন্য দৃষ্টিতে তখন মৃত স্ত্রীর জীবৎকালের ছবি। কী জীবন্ত অথচ, ধরাছোঁয়ার বাইরে! বুকের মধ্যে চিনেচিনে ব্যথা অনুভূত হয়। চোখ জোড়া ভীষণ জ্বলে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীরবে ওয়াশরুমে ঢুকলেন।

মসজিদে আজ একাই গেলেন। একাই তো এখন তিনি। মনসুরের খোঁজ করলেন না। সূর্য ওঠার আগ পর্যন্ত মসজিদে ইবাদত বন্দেগি করলেন। পরলোকগত স্ত্রীর জন্য দোয়া পড়ে তাঁকে স্মরণ করে সিজদাহ্য় দু’ফোটা চোখের পানি ফেললেন। নিখোঁজ ভাতিজার জন্য দু হাত তুলে প্রার্থনা করলেন। নাজাত চাইলেন এত বড়ো বিপদ থেকে। তাঁর চারিদিকে এখন বিপদ। একলা পারবেন কি সব বিপদ মোকাবিলা করে পরিবারকে রক্ষা করতে? কাজল থাকলে আজ এত চিন্তা করতে হতো না৷ এহসাস এমন হতো না। ঈপ্সা পর করত না।

অতীত আঁকড়ে থাকতে নেই। কাজল তো তাঁর অতীত না। কাজল তার তিনকালই। ওই মানুষটা ছাড়া ইকরাম আজাদ কিছুই না। সে নেই কিন্তু তার স্মৃতি তো আছে। শেষদিনগুলো ওই নিয়ে কাটিয়ে দেবেন৷ ওই তো বেঁচে থাকার শক্তি৷
ইকরামের ভগ্ন মনের বয়স দেহের বয়সের তুলনায় গত কয়েক বছরে বহুগুণ বেড়ে গেছে। দিনরাত তাঁর মন অশীতিপর বৃদ্ধের ন্যায় সদা মৃত্যু ভাবনায় মশগুল। এই যেন একমাত্র লক্ষ্য।

বাড়ির মুখে এসে মনসুরের সাথে দেখা হলে গেল। অস্থির দেখাচ্ছে ওকে। মাথার কাঁচা পাকা চুলগুলো এলোমেলো। চোখ ফোলা৷ একটু আগে ঘুম থেকে উঠেছে বোধহয়৷ সদর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিল ইকরাম আজাদের গলা শুনে চমকে যায়।

“রাতে কখন ফিরেছিলি?” তসবিহটা পকেটে পুরলেন ইকরাম। মনসুর তাঁর দিকে সরাসরি তাকাল না৷ বলল,

“এইমাত্র ফিরলাম।”

“এইমাত্র! সারারাত তবে কোথায় ছিলি?”

সরাসরি তাকালেন মনসুরের দিকে। তখনই খেয়াল করলেন মনসুরকে চিন্তিত দেখাচ্ছে।

“কী হয়েছে মনসুর?” তাঁর নরম গলাটা ভারী হয়ে ওঠে। মনসুর ঢোক গিললো। তারপর আস্তে আস্তে বলল,

“বাবাজানকে পেয়েছি।”

“কোথায় সে?” গমগম কণ্ঠে বলে উঠলেন ইকরাম। সদর দরজা খোলা ছিল। মনসুর সেদিকে তাকাতে ইকরামের চোখে মুখে ভয় খেলে গেল। মনে মনে যা একটু স্বস্তি পেয়েছিলেন সব নিমিষে হাওয়া হলো। মনসুরের ওপর ক্ষেপে গেলেন।

“তোকে নিষেধ করেছিলাম ওকে বাড়িতে না আনতে। পুলিশ জেনে গেলে কত বড়ো সর্বনাশ হবে জানিস না?”

“বাবাজান আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতে এখানে এসেছে। ঘুম ভেঙে তাকে না পেয়েই ছুটে এলাম। আপনি চিন্তা করবেন না। কেউ টের পাওয়ার আগে বুঝিয়ে সুজিয়ে এক্ষুণি নিয়ে যাব।”

মনসুর দরজার দিকে ঘুরতে ইকরাম থামিয়ে দিলেন।

“বুঝিয়ে সুজিয়ে নিবি কেন? ও কি এখনও বাচ্চা ছেলে আছে? দেখছি ওকে আমি।”

মনসুর থামানোর সময়টুকু পেল না। হনহনিয়ে লিভিং এড়িয়ে পেরিয়ে সিঁড়িতে উঠলেন। করিডোর ধরে চললেন পুব দিকে। ক্যামেলিয়া কুরআন শরীফ তেলাওয়াত শেষ করে রুম থেকে বেরোতে মনসুরকে দেখতে পেল। ফ্যাকাসে মুখে একবার তাকিয়ে সামনে চললো। তখনই ইকরাম আজাদের অগ্নিশর্মা রূপ দেখল ক্যামেলিয়া। মনসুরের পিছু পিছু ও নিজেও এহসাসের রুমের দিকে গেল। ভয় করছে ওর। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করছে। রাতভর এই একজনকেই ডেকেছে ও।

এহসাসের রুমের দরজা খোলা ছিল। ইকরাম ঢুকেই চড়া গলায় ডাকলেন,

“এহসাস!”

“হোয়াট অ্যা ফাকিং মর্নিং।”

এহসাস বেশিক্ষণ ঘুমায়নি। ছোটো চাচার চিৎকারে সহজেই ঘুম ছুটে যায়। বিরক্তি গোপন করে মাথা তুলে দাঁত বের করে হাসল৷ বিছানায় বসে বলল,

“মাই ডিয়ার চাচ্চু, গুড মর্নিং, ভেরি গুড মর্নিং। কাম অন, গিভ মি মর্নিং কিসি।” এহসাস গাল বাড়িয়ে দেয় ছোটো বাচ্চা ছেলের মতো। ইকরামের রাগ তাতে আরও বাড়ল। দাঁত কামড়ে বললেন,

“স্টপ দিস ননসেন্স এহসাস।”

“ইউ আর নো ফান চাচ্চু।” ঠোঁট উল্টে ফেললো।

“ফান! খুন ও ডাকাতির আসামি হয়ে খুব ফান করেছ তো না? নিজের জীবন, বংশের মর্যাদা এসব তো ফান তোমার কাছে। আমি ফান, ঈপ্সা ফান, আমাদের ফিলিংস সব ফান তোমার কাছে, সব! কেন এমন হয়ে গেলে তুমি? কেন করলে? হোয়াই এহসাস হোয়াই?”

রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন। মনসুর তাঁকে শান্ত করতে ব্যর্থ হয়। এহসাস চুপ করে রইল। ইকরাম ওর টিশার্টের কলার চেপে ধরে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করান। এহসাস ছোটো চাচার চাইতে দু ইঞ্চি লম্বা। সেই পার্থক্য ওর ঘাড় নুইয়ে কমালেন ইকরাম।

“আমার চোখে তাকিয়ে বল কী কমতি রেখেছিলাম যার জন্য এই অধঃপতন তোর! বল এহসাস জবাব দে।”

ইকরামের গলা কাঁপে। ক্যামেলিয়া আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। মাথায় ওড়না।

“আপনি শান্ত হন প্লিজ। ডাক্তার আপনাকে উত্তেজিত হতে নিষেধ করেছে৷”

ইকরাম আজাদ যেন ধাতস্থ হলেন এতক্ষণে। এহসাসের কলার ঢিলে করেন। বড্ড দুর্বল লাগছে৷ ক্যামেলিয়া মনসুরকে ইশারা করল ইকরামকে ধরতে। কিন্তু ইকরাম মনসুরকে স্পর্শ পর্যন্ত করতে দিলেন না। এত বড়ো অনাচার করে এহসাস কী করে এমন নির্লিপ্ত হতে পারে৷ ভয় নেই, অনুশোচনা নেই, বিবেকের দংশন নেই। এই এহসাসকে তো তিনি পেলেপুষে বড়ো করেননি৷ এই এহসাস তাঁর এহসাস না। ইকরাম বুকে চাপ অনুভব করেন। ক্যামেলিয়া শক্ত করে তাঁর হাত চেপে ধরেছে। ছাড়াতে চাইলেন। কিন্তু শক্তি তো নেই। মেয়েটা কি বুঝতে পারছে তাঁর যন্ত্রণা?

এহসাস চাচা ও ক্যামেলিয়াকে দেখছিল। ওর নির্জীব চোখ ক্রুর হয়ে ওঠে। সেই ছায়া ঠোঁটের কোণেও বিস্তৃত হয়।

“কী চমৎকার দম্পতি! একজনের কষ্ট আরেকজনের সহ্য হচ্ছে না। আহা! সুখবর শীঘ্রই দিচ্ছিস তো লিয়া? ওহ! তোকে তো আর তুই বলা যাবে না। আপনি বলতে হবে, তাই না মহামান্য চাচিজান ওরফে আমার এক্স বান্ধবী অথবা রা..”

“এহসাস, খবরদার!” ইকরামের ধমকানি কানেও তোলে না এহসাস। ক্যামেলিয়া লজ্জায় মুখ নুয়ে ফেলে। ছেড়ে দেয় ইকরামের হাত। সরে যায়। ইকরামের খারাপ লাগে। এহসাস স্পষ্ট দেখতে পায় ক্যামেলিয়ার অশ্রু। চোয়াল শক্ত হয়। আগুন চোখে ঘুরে তাকায় চাচার দিকে।

“তুমি বললে হোয়াই এহসাস হোয়াই? সত্যি জানো না? না কি সবটা নাটক। আমার জীবন এলোমেলো করে এখন জিজ্ঞেস করো হোয়াই এহসাস হোয়াই? মনে পড়ে যখন মনিমার মৃত্যুর বছর না গড়াতে নিজের চেয়ে অর্ধেক বয়সের মেয়েকে বউ করে ঘরে আনলে এই একই প্রশ্ন তোমায় করেছিলাম। জবাব দাওনি। কী করে দেবে! শঠ, লম্পটদের কাছে তো জবাব থাকে না। অথচ, ওই মানুষটাকে না কি ভালোবাসতে তুমি। ভালোবাসতে! বছর না ঘুরতে সেই ভালোবাসা ধুয়েমুছে ফেলতে তোমার বাধেনি। ভাতিজার মৃত বন্ধুর যুবতি বউকে বিয়ে করতে বাধেনি তোমার। হোয়াই এহসাস হোয়াই, হ্যাঁ?”

ক্যামেলিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,

“লিয়া, মনে পড়ে সেদিনের কথা? রাহাতের নামের মেহেদী তখনও শুকায়নি তোর হাতে। ওর কবরের মাটি তখনও ছিল ভেজা। তোর তো বৈধব্যদশা বাকি ছিল। কিন্তু ওসব মানার সময় কই? দরকারই কী, তাই না? মানুষ মরলে তাকে কে মনে রাখে, কেই বা আর ভালোবাসে! এককালে ভালোবাসি বলে যা বলা হয়েছিল সবই মিথ্যা হয়ে গেল মানুষটার শ্বাস বন্ধ হতো৷ কী সহজে রাহাতকে ভুলে তুই এই ইকরাম আজাদকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে নিলি। কী সহজে! সেদিন আমি একই প্রশ্ন করেছিলাম, হোয়াই লিয়া হোয়াই?”

“এহসাস!” ক্যামেলিয়ার ঠোঁট কেঁপে ওঠে। এহসাস সামনের ফ্লাওয়ার ভাজ আছরে ফেলে চিৎকার করে ওঠে,

“নাম নিবি না ওই পাপী মুখে। তোদের দুজনকেই আমি ঘৃণা করি। ঘৃণা করি, ঘৃণা করি। এত ঘৃণা নিয়ে তো বাঁচা যায় না। আবার আত্মহত্যাও কাপুরষতা। তাহলে মরব কী করে?”

হঠাৎ সদর দরজার ডোরবেল বেজে ওঠে। এহসাস হাসে। মনসুর শঙ্কিত। ইকরাম স্তব্ধ। এহসাসের অপমানজনক, বিদ্বেষপূর্ণ এক একটা শব্দ তাঁকে মূক করে দিয়েছে। ক্যামেলিয়া ফুঁপিয়ে কাঁদে। এহসাস ওদের আঙুল দিয়ে ইশারা করে বলে,

“ওই যে আমার মৃত্যুর ঘন্টা বেজে উঠল। দুয়ারে দাঁড়িয়ে পুলিশ। আমি আত্মসমর্পণ করব আজ। আমার গলায় ফাঁসির দড়ি টানানো হবে। তারপর সকল যন্ত্রণা থেকে, লজ্জা থেকে মুক্তি আমার। চমৎকার মৃত্যুর প্লান। আর..আর.. তোমাদের দুজনের জন্য উপযুক্ত শাস্তি।”

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here