#অশ্রুমালা
part–35
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
আবেগ হাটু গেড়ে বসে পড়ে মেঝে তে। চোখ দিয়ে যন্ত্রণার ফোটা বইসে। গা থরথর করে কাপছে। বুকটা কষ্ট-হাহাকারে ফেটে যেতে চাইছে। চোখের সামনে যা দেখছে তা মানতে চায় না আবেগ। সব যেন ভ্রম হয়! দুঃস্বপ্ন হয়ে পালিয়ে যায়৷
মেঘ আবেগের কাছে এসে তার কাধে হাত দিয়ে বলে, শক্ত হ আবেগ। এতো তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়লে কিভাবে চলবে?
আবেগ মাথা নিচু করে ফেলে। চোখ অসম্ভব লাল হয়ে গেছে। চোখ ভর্তি পানি। বুকের মধ্যে মনে হচ্ছে কেউ পাথর নিক্ষেপ করছে। আল্লাহ এতো কষ্ট কেন হচ্ছে তার।
ততোক্ষনে রোদেলাকে একটা স্ট্রেচারে করে তোলা হয়ে গেছে। গোডাউনের বাইরে নেওয়া হলো রোদেলাকে। সম্ভবত গাড়িতে তোলা হচ্ছে।
আবেগ উঠে দাড়ালো বহুত কষ্টে। তার কোন দিক-দিশা ঠিক নাই। বলতে গেলে দিশেহারা হয়ে পড়েছে সে।
আবেগ রোদেলার কাছে যেতে চাইলে মেঘ তাকে আটকে দিয়ে বলে, তোকে কিছু প্রশ্ন করব। সেগুলোর ঠিক ঠিক উত্তর দিবি। তারপর রোদেলার কাছে যাবি৷
আবেগ হতম্ভব হয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে, এই অবস্থায় কি জানতে চাস তুই আমার কাছে?
মেঘ নরম গলায় বলে, তুই এতোটাও নাদান না যে রোদেলার সাথে কি হয়েছে তা এতোক্ষনেও বুঝিস নি। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিস ওর সাথে কি কি হয়েছে।
আবেগ চোখ বন্ধ করে ফেলে কষ্টে। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে নিচে পড়ল৷
মেঘ কাপা গলায় বলে, এখন আবেগে ভেসে রোদেলার কাছে যাবি। ওকে মিথ্যা আশার আলো দেখাবি। এরপর তোর মা এসে বলবে রোদেলা চরিত্রহীন। ওমনি তুই সুরসুর করে মায়ের কথা শুনে রোদেলাকে ছেড়ে চলে গিয়ে রোদেলাকে জিন্দা লাশ বানায় রাখবি এটা আমি সহ্য করব না আবেগ! তার চেয়ে এখনি ঠিক কর, এই মূহুর্তে সিদ্ধান্ত নে, আজীবন রোদেলার সাথে থাকবি? নাকি মাঝ সাগরে ফেলে চলে যাবি।
আবেগ মেঘের দিকে তাকালো। মেঘের চোখও লাল। বেদনার ছাপ।
মেঘ আবারো বলল, রোদেলা কে আজকের এই মর্মান্তিক ঘটনার পর ও কি সবসময় আগলে রাখতে পারবি? পারবি ওকে ভালোবাসতে? নাকি ঘৃণা লাগবে? যদি ভালোবাসতে পারিস তাহলে আয় আমার সাথে। আর না পারলে প্লিজ চলে যা। কেউ তোকে জোড় করবে না।
আবেগ নিশ্চুপ থাকল। উত্তর টা এতো জটিল কেন? কেন তাদের সাথে এমন হলো? কি এমন পাপ করেছে সে?
মেঘ উত্তর না পেয়ে আর কিছু বলল না। শুধু বলল, তোর উপর কেউ জোর করবে না। তুই নিশ্চিত থাক। আংকেলও তোকে জোরজবরদস্তি করে এই সংসার টিকিয়ে রাখতে আর কোন দিন আদেশ দিবে না।
আবেগ মাথা নিচু করে ফেলে এবং বলল,আমার কাছে রোদেলার সুস্থতাই সবার আগে। আমি ওকে ভালোবাসি। আমার জন্য ওর সুস্থতাই যথেষ্ট।
মেঘ আর কিছু বলল না। পরিস্থিতি ও তাদের প্রতিকূলে। গোডাউনে রোদেলাকে পাওয়া গেলেও রিশাদ পলাতক। কি যে হবে সামনে? কে জানে?
হাসপাতাল পৌছে রোদেলাকে ইমার্জেন্সিতে নেওয়া হলো। ঢাকা মেডিকেলে শিফট করা হয়। রোদেলার কোন জ্ঞান নাই৷ পুরোটা সময় জুড়ে আবেগ রোদেলার হাত ধরে ছিল। বিধ্বস্ত রোদেলার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। আবেগ তার আগুল দিয়ে রোদেলার ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা রক্ত মুছে দেয়। রোদেলা কে ভেতরে ঢুকানো হলো। এবার আর আবেগ ঢুকতে পারল না ভেতরে। সে বাইরে দাড়িয়ে প্রহর গুনতে লাগলো। কি থেকে কি হয়ে গেল?
সব এভাবে শেষ না হলেও পারত!
মেঘ আবেগের কাছে এসে বলে।,আবেগ?
–হুম?
–আমি আবারো জিজ্ঞেস করছি পারবি সবকিছু সামলাতে? রোদেলা কে যদি তুই এখন আপন করে নিস, তাহলে ভবিষ্যতে কিন্তু অনেক কিছু সহ্য করতে হবে। ঝড় যাবে তোর উপর দিয়ে! পারবি সামলাতে?
–বারবার এক কথা বলার কোন মানে দেখি না আমি।
— রোদেলা কে ভালোবাসিস?
–অনেক।
–এখনো ভালোবাসতে পারবি সব জানার পরও?
–আগের চেয়ে এখন আরো বেশি ভালোবাসব। মানুষ ভুল বারবার করে না। মেঘ।
–দাড়িয়ে থেকে লাভ নেই। বস। রেস্ট নে।
মেঘ আবেগকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। দুইজনই চুপ।চারপাশে পিনপিন নিরবতা৷ আজকের নিরবতার মাঝেও এক ধরনের আহাজারি বিরাজ করছে।
আবেগ চেয়ারে হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে চোখ ডলছে। আসলেই কিভাবে এতো বড় ধাক্কা সামাল দেবে সে? আর যাইহোক না কেন আর ছাড়বে না সে রোদেলার হাত এই জনমে!
আবেগের বাসায় মেঘ ফোন দিয়ে জানিয়ে দেয়। কিছুক্ষনের মধ্যে বাড়ির সবাই চলে আসে। ইভানা, ইমতিয়াজ রহমান আর জাবেদা খাতুন।
ইভানার কোলে ছিল সমুদ্র। ইভানার চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। আবেগ তাদেরকে আসতে দেখে দাঁড়িয়ে যায়।
ইভানার কোলে সমুদ্রকে দেখতে পেল আবেগ। বাচ্চাটা শুধু মাত্র একদিন মায়ের আদর পায় নি তাতেই কেমন রোগা রোগা হয়ে গেছে। সমুদ্র কান্না শুরু করে দিল। এই কান্নায় মায়ের প্রতি অভিযোগ আছে। মা কেন এতোক্ষন ধরে তার থেকে দূরে আছে?
ইভানা কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সমুদ্র কেদেই যাচ্ছে তা দেখে আবেগ গিয়ে সমুদ্র কে কোলে নিল। সমুদ্র আবেগের কোলে গিয়ে কান্না থামালো। চুপ হয়ে গেল সে। মায়ের কমতি সে বাবার কাছ থেকে পূরন করে নিচ্ছে। আবেগ চুপচাপ সমুদ্রকে কোলে নিয়ে বসে রইল। সমুদ্র কিছুক্ষনের মধ্যে ঘুমিয়ে যায়। আবেগ অসংখ্য বার সমুদ্রের কপালে চুমু খায়।
★★★
ভোরের দিকে একজন নার্স এসে বলে, আপনাদের মধ্যে আবেগ কে?
আবেগ সারারাত রোবটের মতো বসে ছিল৷ কিন্তু নার্সের এই কথায় তার টনক নড়ে। সে উঠে দাড়িয়ে বলে, আমি।
–পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে৷ আপনার সাথে দেখা করতে চায়৷
আবেগ বিড়বিড় করে বলে, আলহামদুলিল্লাহ
তারপর নার্সের সাথে রোদেলাকে যেই কেবিনে রাখা হয়েছে সেখানে গেল।
রুমে ঢুকতে ই আবেগের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে।রোদেলা বেডে শুয়ে আছে। হাতে এখনো ক্যানেল লাগানো৷ রক্তের ব্যাগ ঝুলছে। রোদেলার ব্লাড গিয়েছিল অনেক। তাই তিন ব্যাগ ব্লাড লেগেছে। একটা সিজারের সিলাই ছিড়ে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে জ্ঞান ফিরলেও সুস্থ নয় রোদেলা।
আবেগ রোদেলার মাথার পাশে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। রোদেলা চোখ বন্ধ করেই নিস্তেজ বলে উঠে, আবেগ!
আবেগ কিছু না বলে রোদেলার মাথায় হাত বুলাতে লাগে৷ রোদেলা হুট করে হুহু করে কেদে দেয়৷
আবেগ রোদেলাকে কাদতে দেখে প্রচন্ড ভেঙে পড়ে। তার ও বুকটা দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগলো। সে ফিসফিস করে বলে, কাদবে না রোদেলা। আমি আছি তো তোমার পাশে!
একথা শুনে রোদেলার কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায়৷
রোদেলা নিস্তেজ গলায় বলে, আবেগ! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
আবেগ রোদেলার আরো একটু কাছে বসে বলে, ঠিক হয়ে যাবে।
–আমাকে স্পর্শ করো না। আমি অপবিত্র যে! তুমিও অপবিত্র হয়ে যাবে,,,,,,,,,,
আবেগ একথা শোনামাত্র রোদেলা কে ঝাপ্টে ধরল। তারপর বলল, চুপ করো প্লিজ!
রোদেলা মৃদ্যু কথা কন্ঠে বলে, আমি মনে হয় না আর বাচব। মরে যেতে চাই আমি।
–একদম কোন কথা বলবে না।
–তুমি গ্রামে থাকতে বলেছিলে না আমার একটা ইচ্ছা পূরণ করবে? মনে আছে সেই কথা?
–এখন কেন এসব বলছো? প্লিজ তুমি রেস্ট নাও।
–বল আমার কথা রাখবে? প্লিজ?(করুন গলায়)
আবেগ রোদেলার কথা উপেক্ষা করতে না পেরে বলে, আচ্ছা বল!
রোদেলা কাপা গলায় বলে, আমি যদি আজকে এই মূহুর্তে মারা যাই, তাহলে আমার ছেলেটাকে একা ফেলে দিও না। নিজের সঙ্গে রেখো। বেশি কিছু দিতে হবে না শুধু তিন বেলা ভাত আর কাপড় দিও। এর বেশি কিছু লাগবে না ওর।
আবেগ একথা শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। রোদেলার বুকের উপর ঝাপ্টে পড়ে কেদে দিল। রোদেলাও কাদতে লাগলো।
আবেগ প্রলাপ করে বলতে লাগলো, ভালোবাসি আমি তোমাকে রোদেলা। আজকে তোমার কিছু হলে আমিও বাচব না।
কাচের বাহির থেকে মেঘ সবটা দেখে সরে আসে। আবেগকে নিয়ে চিন্তিত সে। আবেগ মানুষ হিসেবে চমৎকার! কিন্তু কখন কি সিদ্ধান্ত নিতে হবে এসব বুঝে না। তাই জীবনে অনেক ভুল করে বসে। তবে এই প্রথম আবেগ নিযে থেকে সঠিক কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মেঘ তার চোখ মুছল। সে খুব টেনশনে আছে। রিশাদকে পাওয়া যায় নি। নিশ্চয়ই সেইভ জোনে চলে গেছে৷ রিশাদ যদি আবার কিছু করে বসে? এসব ভাবতেই গা ঠান্ডা হয়ে এলো তার। যা করার তাকেই করতে হবে। আবেগ এখন এসব সামাল দেয়ার পরিস্থিতি তে নেই৷ খুব ভেঙে পড়েছে ও।
মেঘ সরে এসে করিডোরে হাটছে।রিশাদকে আইনের আওতায় না আনলে ঝুঁকি কমবে না। রোদেলার উপর এখনো ঝুকি আছে। হুট করে তার ফোন বেজে উঠল। মেঘ ফোন হাতে নিয়ে দেখে অথৈয়ের কল। সে বিচলিত হলো না৷ ফোন ধরতেই অথৈ কান্না করতে করতে বলে, রোদেলার এখন কি অবস্থা?
–তুমি কিভাবে জানলে?
–ইভানা জানিয়েছে৷
–ও।
–বল না ও কি ঠিক আছে এখন?
–তোমার জেনে লাভ কি? নিজেকে রোদেলার ফ্রেন্ড বলবে না কোন দিন৷ ওর সাথে তো কথাই বল না। এখন কেন কল করেছো?
ওপাশ থেকে অথৈ কান্না করছে আর বলছে, আমি এক্ষুনি আসব রোদেলা কে দেখতে।
মেঘ ফোন কেটে দিল। তার সবপ্রথম কাজ রিশাদের বিরুদ্ধে কেস ফাইল করা।
#অশ্রুমালা
part–36
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
আবেগ বলে উঠে, এসব কি বলছো তুমি? সমুদ্র আমার ছেলে। নিজের থেকেও ওকে ভালোবাসি আমি! আর কোন দিন এভাবে বলবে না! আমার খুব কষ্ট হয়! সমুদ্র আমার ই ছেলে।
রোদেলা চোখ বুজে ফেলে। চোখ বেয়ে টপটপ পানি পড়ছে তার। আবেগ সেই চোখের পানি মুছে দিয়ে রোদেলা কে আকড়ে ধরে। আবেগের চোখের পানিতে রোদেলার হাতে ভিজে যাচ্ছে। কিন্তু দুইজন ই নির্বিকার। দুজনেই নিরবে চোখের পানি ফেলছে। কারো মুখে কোন কথা নেই৷
আচমকা আবারো রোদেলা শব্দ করে কেদে দিল। আবেগ রোদেলাকে থামালো না।
কাদুক। কেদে বুক ভাসাক আজকে। এরপরে আর কোন দিন কাদতে দিবে না রোদেলাকে।
রোদেলা কাদতে কাদতে অস্ফুটস্বরে বলে, এতো সব কিছু হওয়ার পর ও আমি তোমার সাথে থাকতে চাই। তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চাই না আবেগ। এতো বড় দুর্ঘটনার পর আমি চাই তুমি আমাকে ভালোবাসো! তারপর একদন্ড থেমে রোদেলা নিস্তেজ হয়ে পড়ে আর আস্তে করে বলে, আমি অনেক লোভী তাই না? খুব স্বার্থপর আমি! এজন্যই আল্লাহ বারবার আমাকে শাস্তি দেয় তাও আমি শুধরাই নি। বারবার লোভ করে গেছি। তোমার ভালোবাসা পাওয়ার লোভ সামলাতে পারি নি৷ আমি খুব খারাপ তাই না?
–চুপ কর প্লিজ!
–কথায় আছে না, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু! আমিও লোভ করেছি, পাপ করেছি, এখন ভুগছি! লোভ করার শাস্তি আল্লাহ নিজ হাতে দিয়ে দিলেন আমাকে।
আবেগ রোদেলার মাথা বুলাতে বুলাতে বলে, ভালোবাসার লোভটাই পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটা পাপ যেই পাপের মধ্যে পূন্য লুকিয়ে আছে। তুমি কোন পাপ করো নি রোদেলা। আর যা হয়েছে এতে তোমার কোন দোষ নেই। সব দোষ আমার! আজকে আমার জন্য তোমার এই অবস্থা!
শেষের কথা গুলো রোদেলা শুনে নি। সে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছিল রোদেলাকে যার দরুন এখন নিশ্চিতে ঘুমাচ্ছে রোদেলা। সব কিছু ভুলে ঘুমিয়ে গেল।
এজন্যই বুঝি ঘুমকে অর্ধেক মৃত্যু বলে! এই যে কতো যন্ত্রণা পুষছে মেয়েটা তার বুকে কিন্তু এখন এই মূহুর্তে সব যন্ত্রণা বিদায় নিয়েছে তার কাছ থেকে। ঘুম ছুটে গেলেই ঝড়ের গতিতে দুঃখরা আবারো চলে আসবে।
আবেগের চোখ ভেজা। কোথাও যেন পড়েছিল ছেলেদের নাকি কাদতে হয় না! তাদের কাদা বারং! যে ব্যক্তি এই নিয়ম বানিয়েছেন তাকে গিয়ে আবেগের বলতে ইচ্ছা করছে, আবেগের জায়গায় তিনি থাকলেও কি একই নিয়ম বানাতেন! নাকি নিয়ম পালটে অন্য এক প্রথা চালু করতেন! যেই প্রথায় ছেলেরা কষ্ট পেলেই কাদতে পারবে!
ঘুমন্ত রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে আবেগ। একদিনের ব্যবধানে চেহারার এতো পার্থক্য! সেদিন ই তো কতো সুন্দর লাগছিল রোদেলাকে! ঝলমলে চুল, কাজল পড়া চোখ, মিস্টি হাসি!
আর আজকে এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুল, চোখের নিচে কালি, ঠোঁটের বাম দিকে থেকে গাল বরাবর কাটা দাগ! এইসবের সাথে বহু দূরে হারিয়ে গেছে সেই বিখ্যাত মিস্টি হাসিটা!
রোদেলার পাশেই বসে আছে আবেগ। রোদেলাকে এক মূহুর্তের জন্য নিজের থেকে দূর করতে মন চাচ্ছে না তার! মনে হচ্ছে সে সামান্য কিছুক্ষনের জন্য রোদেলার কাছ থেকে দূরে গেলেই আবারো সেই নরপিশাচটা এসে তার রোদেলা কে ছিনিয়ে নিবে।
যুগ যুগ ধরে সবসময় ভালো মানুষের সাথেই খারাপ কিছু হয় এটাই বুঝি নিয়ম! খারাপের শক্তি সবসময়ই কি বেশি হতে হবে? কি হত যদি ভালোর শক্তি বেশি হত! আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রাখলো সে। হাশরের ময়দানে প্রতিটা হিসাব সে নিবে! এক চুল পরিমাণ ছাড় দিবে না সেই নরপিশাচ কে।
যুগ যুগ ধরে যে ভালোর সাথে খারাপ হয় এটার প্রমাণ তো স্বয়ং আমার নবীজি (সঃ)! কতো শত কাটা, লজ্জা, যন্ত্রনা সহ্য করেছিলেন তিনি।আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি হওয়ার পর ও কষ্ট সহ্য করেছেন কতো নবীজী(সঃ)। দিনশেষ ঠিকই তো বিনা রক্তপাতে সেই মক্কা জয় করেছেন যেই মক্কা ছেড়ে আল্লাহর নির্দেশে তাকে চলে যেতে হয়েছিল।
আবেগ ও আল্লাহর উপর সব ছেড়ে দিয়েছে। যা করার সব আল্লাহ পাক করবে৷ তবে সে হাত গুটিয়ে থাকবে না। রিশাদকে তার প্রাপ্য শাস্তি দিয়েই ছাড়বে৷ ততোক্ষন অব্দি লড়বে যতোক্ষণ অব্দি রিশাদ শাস্তি পাচ্ছে না।
রোদেলার কেবিনে ইতিমধ্যে আবেগ একা নয়। ইভানা, ইমতিয়াজ রহমান আর জাবেদা খাতুন আছেন। মেঘ বাইরে গিয়েছে। রোদেলার পাশে রাখা চেয়ারে আবেগ সমুদ্র কে কোলে নিয়ে বসে আছে। সকাল হয়ে গেছে৷ সাড়ে দশটা বাজে।
ইভানা একটু পর পর এসে রোদেলাকে দেখে যাচ্ছে। কিন্তু রোদেলার পাশে বসার শক্তি হচ্ছে না তার। রোদেলার চেহারাটা দেখলেই তার কান্না পাচ্ছে। সে এই মূহুর্তে কেদে ভাইয়াকে আরো দুর্বল বানাতে চায় না।
জাবেদা খাতুন চুপচাপই বসে আছেন। এই অবস্থায় কিছু বলছেন না সে। তার ছেলের করুন অবস্থা দেখে সে ভয় পেয়ে গেছে। এক রাতেই আবেগের এই অবস্থা দেখে সে মনে মনে ভয়ে আছেন। ছেলেটাকে দেখে পাগল পাগল লাগছে। চুল এলোমেলো হয়ে গেছে। শার্টের হাতা গুটানো। চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে।
মেঘ খাবারের প্যাকেট নিয়ে ফিরল। তারপর সবাইকে খেতে বলল। কারোই খাওয়ার ইচ্ছা নেই তাও জোর করে খেয়ে নেয়৷
আবেগকে এক প্রকার জোর করে খাওয়ানো হলো৷
সেই সময় রোদেলার ঘুম ভেঙে যায়।রোদেলাকে চোখ খুলতে দেখে মেঘ মৃদ্যু হেসে দিল।
রোদেলা চোখ ফিরিয়ে আবেগের দিকে তাকালো। আবেগের কোলে সমুদ্র কে দেখে রোদেলা সমুদ্র কে কোলে নিতে চাইল।
মেঘ আস্তে করে রোদেলাকে উঠে বসিয়ে দিল। সমুদ্র কে কোল নিয়ে বেশ কয়েকটা চুমু খেল রোদেলা। সমুদ্র ও যেন এতোক্ষন পর মাকে পেয়ে খুব তৃপ্তি পাচ্ছে। প্রশান্তি তে চোখ ঘুরিয়ে মাকে দেখছে।
রোদেলার চেহারায় হুট করে ভয়ের আভা ফুটে উঠল। সে ছটফট করতে লাগলো কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারছে না। সম্ভবত ঘুম থেকে মাত্র উঠেছে জন্য এমনটা হচ্ছে!
আবেগ রোদেলার আরো কাছে গিয়ে বলে, কি হয়েছে? এমন কেন করছো?
রোদেলা সমুদ্রকে বুকের সাথে চেপে ধরে ব্যথা জর্জরিত গলায় বলে, ইভু কোথায়? ও কোথায়?
মেঘ হতভম্ব হয়ে যায়। ইভানাকে দেখার জন্য এতোটা বিচলিত হচ্ছে কেন রোদেলা?
রোদেলা আবারো মেঘকে জিজ্ঞেস করে, ইভু কি ঠিক আছে? ওর কি হয় নি তো? চুপ করে আছো কেন? বল না! ইভু ঠিক আছে কিনা?
এমন সময় ইভানা দৌড়ে রোদেলার কাছে চলে আসে। মেঘের খটকা লাগতে শুরু করে। কিন্তু এই মূহুর্তে কিছু বলল না রোদেলাকে।
ইভানাকে দেখে স্বস্তি পায় রোদেলা। যাক! ওর তো এট লিস্ট কিছু হয় নি! আজকে রিশাদ ইভানাকে কিছু করে ফেললে এখন যতোটা কষ্ট পাচ্ছে সে তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেত রোদেলা!
ইভানা রোদেলাকে জড়িয়ে ধরে কেদে দেয়। হুট করে রোদেলার চোখের পানি হাওয়া হয়ে গেল। কেন যে সে কাদতে পারছে না। কিন্তু রোদেলা খুব শক্ত করে ইভানাকে জড়িয়ে ধরে।
কিছুক্ষন পর রোদেলা ইভানাকে ছেড়ে দেয়। তখন মেঘ রোদেলাকে প্রশ্ন করে, ইভানার জন্য এতো ব্যতিব্যস্ত হচ্ছিলে কেন রোদেলা?
রোদেলা অসহায় চোখে আবেগের দিকে তাকালো।
আবেগ মেঘকে থামিয়ে দিয়ে বলে,প্রশ্ন পরে করিস মেঘ। আগে ওকে সুস্থ হতে দে।
মেঘ আরো কিছু বলবে তার আগেই রোদেলা নিজ থেকে বলে, আমিই সুস্থ আছি। এর চেয়ে সুস্থ আর কোন দিন আমার পক্ষে থাকা সম্ভব হবে না।
রোদেলার কথা শুনে আবেগের বুকটা ছ্যাত করে উঠে।
তারপর রোদেলা বলে উঠে, রিশাদ আমাকে ফোন করেছিল,,,,,,,
মেঘ মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল। এই সময় ইমোশনাল হলে চলবে না। সবার আগে রোদেলার সেফটি দরকার। তাই সবটা জেনে একশন নিতে হবে।
রোদেলা আবারো বলল, রিশাদ আমাকে ফোন করে ব্লাকমেইল করেছিল।
মেঘ প্রশ্ন করে, কি বিষয়ে ব্লাকমেইল করেছে?
–ইভু তখন বাইরে বেরিয়েছিল ওর ফ্রেন্ডের সাথে। বাসায় ছিল না। রিশাদ ফোনে বলেছিল আমি যদি এক মিনিটের মধ্যে নিচে না নামি তাহলে ওর লোক ইভানাকে তুলে নিয়ে যাবে। প্রথমে আমি এইকথা বিশ্বাস করি নি। এরপর রিশাদ ম্যাসেঞ্জারে ইভানার ছবি পাঠায়। আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম৷ ইভানার যেন কোন ক্ষতি না করে তাই নিচে নেমে পড়ি৷ বাসার সামনে কাউকে ই দেখতে পাই নি৷ তাই ফিরে আসতে চেয়েছিলাম সেই সময় পেছন থেকে কে যেন আমার মুখ চেপে ধরে। আমি ইচ্ছা করেই ফোনটা একটু দূরে ফেলে দিয়েছিলাম। এর পর কিছু মনে নেই। জ্ঞান আসার পর নিজেকে একটা অন্ধকার রুমে আবিষ্কার করলাম। তারপর,,,,,
মেঘ বলে, আর কিছু জানতে চাই না আমি।
ইভানা রোদেলার কাছে গিয়ে বলে, তোমার এতো বড় ক্ষতিটা শুধু মাত্র আমার জন্যই হয়েছে ভাবী। আমার ভুলের জন্য আজকে তোমার এই অবস্থা!
রোদেলা কিছু বলল না শুধু ইভানার হাতট শক্ত করে চেপে ধরে।
রোদেলার সব কথা ইমতিয়াজ রহমান আর জাবেদা খাতুন শুনে ফেললেন।
জাবেদা খাতুনের মাথা ভোভো করছে। রোদেলার জায়গায় যদি আজকে তার নিজের মেয়ে থাকত? আল্লাহ না করুক! তার মেয়েটা এসব মোটেও সহ্য করতে পারত না! কি হত তার মেয়ে থাকলে?
ইমতিয়াজ রহমান ছুটে গিয়ে রোদেলাকে জড়িয়ে নেন। রোদেলা চোখ বন্ধ করে নিরবে কাদতে থাকে।
ইমতিয়াজ রহমান নিজেও কাদছেন। তবুও সান্ত্বনাস্বরুপ রোদেলাকে জড়িয়ে রেখে তার মাথায় হাত দিয়ে বলে, কাদিস না রে মা। তোরা কাদলে আমার খুব কষ্ট হয় রে! কাদিস না। আমরা আছি তো তোর সাথে। তোর এই বুড়া মামা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোর সাথে আছে রে মা।
রোদেলা আরো বেশি জোরে শব্দ করে কাদতে লাগে।
আবেগ উঠে রোদেলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আবেগকে আসতে দেখে ইমতিয়াজ রহমান রোদেলাকে ঠিক ভাবে বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়ে নিজে ও রোদেলার মাথার কাছে দাড়িয়ে রইল।
রোদেলা চোখ তুলে আবেগের দিকে তাকালো। তখনো রোদেলা শক্ত করে সমুদ্রকে ধরে আছে। আবেগকে দেখতেই তার বুকটা দুমড়েমুচড়ে যেতে লাগলো। লোকটার চেহারায় বিধ্বস্ততার ছাপ! এই লোকটার কথা ভেবেই তো কালকে রাতের সব অত্যাচার সহ্য করেছিল। শুধু একবার মরনের আগে সে আবেগকে দেখতে চেয়েছিল! ছুয়ে দিতে চেয়েছিল। ছুটে আসতে চেয়েছিল এই মানুষটার বুকে! মুখ-মনে শুধু তার ই নাম জবর কাটছিল! এটাই কি ভালোবাসা?
অপবিত্র হওয়ায় পর ও সে চায় একটা পবিত্র হাত থাকে আকড়ে রেখে অজস্র ভালোবাসা দিয়ে তার সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয় — এটাই কি তবে ভালোবাসার দাবি?
আচ্ছা! রোদেলা কি আবেগের ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার হারিয়ে ফেলেছে? তার কি আর সুখ পাওয়ার অধিকারটা নেই? আবেগ কি কেবল তার বাইরের অপবিত্রতা দেখবে নাকি মনের পবিত্রতা টাকে খুজবে? সে যে এখনো ভেতর দিয়ে ফুলের মতো পবিত্রই আছে তা কি জানে আবেগ? রোদেলার পবিত্রতা উপলব্ধি করতে পারবে তো আবেগ?
আবেগ রোদেলার দিকে জুসের গ্লাস বাড়িয়ে দিল এবং বলল, একটু খাও।
–উহু।
–প্লিজ!
বলে রোদেলার মুখে গ্লাস ঢুকিয়ে দিয়ে জোড় করে এক গ্লাস জুস খাইয়ে দিল।
কিছুক্ষন পর ডাক্তার এসে রোদেলাকে চেকআপ করে আবেগের সাথে কথা বলতে চাইলো৷
ডাক্তার সাহেব আবেগকে নিয়ে কেবিনের বাইরে এস বলে, আপনি কি পেশেন্টের হ্যাসবেন্ড?
–হ্যা৷
–উনি এখন মোটামুটি সুস্থ। সিলাই খুলে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। আমরা পর্যাপ্ত সুচিকিৎসা করেছি। এখন আর ভয়ের কিছু নেই। উনি মেবি কিছুদিন আগেই সিজারিয়ান অপারেশন করেছেন। এজন্য ই এতো ক্ষতি হয়েছিল। যাইহোক আমরা সিজারিয়ান অপারেশনের পর দম্পতিকে বারবার শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারে সচেতন থাকতে বলি,,,,,,,
–আমি ডাক্তার!
–ওহ! তাহলে আর ডিটেইলে বললাম না। আপনি তো সব জানেন ই৷ চাইলে পেশেন্ট কে বিকেলের পর বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন৷
–আচ্ছা!
–আরো একটা কথা!
–বলুন৷
–আই এম রিয়েলি প্রাউন্ড অফ ইউ ডক্টর! আমার জীবনে দেখা একজন বাস্তবিক বীরপুরুষ আপনি! সত্যি আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
আবেগ ওই ডাক্তারটার দিকে তাকালো কিন্তু কিছু বলল না।
★★★
রিশাদ বিশাল বড় একটা বেডরুমে বসে আছে। চারিপাশে বড়লোকদের আভিজাত্যপূর্ণ আসবাবপত্র! রিশাদের চোখের সামনে লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির আকা মোনা লিসা ঝুলছে৷ মোনা লিসার রহস্যময় হাসির দিকে তাকিয়ে রিশাদ নিজেও হেসে দিল। তার হাতে বেনসনের একটা সিগারেট জ্বলছে। সে আয়েস করে সিগারেটে ফুক দিয়ে মোনা লিসা চিত্রাঙ্কনটার দিকে তাকিয়ে বলে, এই বেডিও তো দেখতে সুন্দর!
সে সিগারেট খাওয়া শেষ করে হাতে ওয়াইনের বোতল নিল। আপাতত সে তার বিসনেস পাটনারের বাসায় বসে আছে আরাম করছে৷ কালকে তার বিসনেস পাটনার ই তাকে ইনফর্ম দিয়েছিল যে গোডাউনে গোয়ান্দা বিভাগ এটাক করবে। রিশাদ তো রোদেলাকে নিয়ে পালাতে চেয়েছিল কিন্তু তার বুদ্ধিমান বিসনেস পাটনার তাকে একা পালাতে বলে।
রিশাদ বেডে আয়েস করে শুয়ে পড়ল৷।। কিছুক্ষন পর একজন এসে রিশাদকে ডাক দিল রুমের বাইরে থেকে ।
রিশাদ গেট খুলে একটা হাসি দিয়ে বলে, আরে ভাই আপনি!
–হুম।
–কোন কাজ ছিল?
–আর কয় দিন আমার বাসায় থাকবেন রিশাদ?
–এইতো সাত দিন৷
–ও।
লোকটা যেতে চাইলে রিশাদ তাকে আটকিয়ে বলে, রোদেলার ফোনটা কই রেখেছেন?
–ওর বেডরুমে রেখে দিয়ে এসেছিলাম৷
–আপনি ওর বাসাও চিনেন?
— শেখ প্রাচুর্য চেনে না এমন জিনিস খুব কম আছে এই বাংলাদেশে। নিচে খাবারের ব্যবস্থা করা আছে। সাত দিন জাস্ট সাতদিন পর আমার বাসা থেকে আউট হবেন৷
–ওকে। ওকে।
চলবে।
চলবে।
[ রিশাদকে কোন ধরনের শাস্তি দেওয়া যায়? সবার মতামত দিলে সুবিধা হয় কারন আমি নিজেই কনফিউজড কি শাস্তি দিব রিশাদকে বুঝে পাচ্ছি না। আমাকে একটু হেল্প করুন সবাই। ]