গল্পঃ #অস্পষ্ট_সে (৯ম পর্ব)
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার
দরজায় যেতেই সে আচমকা লাফিয়ে উঠলো, ভয়ে সে তারাতাড়ি কাগজগুলো লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করেও পারলো না।
চিত্রা তোতলাতে তোতলাতে বললো..
___আআপনি এতো তাড়াআতাড়ি চলে আসছেন?
দ্বীপ চিত্রার কোনো কথার জবাব না দিয়ে উৎসুক ভঙ্গিতে আগাতে লাগলো, চিত্রার পেছনে হাতের মধ্যে কি আছে দেখার জন্য! চিত্রাও পিছাচ্ছে।
পেছাতে পেছাতে হঠাৎ চিত্রা থেমে গেলো আর দ্বীপের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো..
___ কি ব্যপার এমন করছেন কেন? প্লিজ সরেন।
___ তোমার হাতে কি আছে দেখাও।
___ আমার হাতে কিছু নেই, সরেন তো।
চিত্রা দ্বীপকে ধাক্কা দিতে যাবে তখনি দ্বীপ হাত ঘুরিয়ে পেছন থেকে এক টানে কাগজের বান্ডেলটা সামনে নিয়ে আসলো।
কাগজের দিকে তাকিয়ে তার চোখ বড় হয়ে গেলো। চিত্রার দিকে তাকিয়ে বললো..
___ কোথায় পেয়েছো এগুলো? আর কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলে?
___ মানে বাবার কাছে, আমি বুঝতে পারছিলাম এসব কিসের দলিলপত্র।
দ্বীপ কপালে হাত দিয়ে পেছনে ঘুরে আবার সামনে তাকিয়ে জোরে ধমকে বললো..
___ ওহহহ গড, কি করতে যাচ্ছিলে তুমি? মেরে ফেলতে চাও আমাকে? তুমি যদি এসব নিয়ে বাবার কাছে যেতে আজকের পর আর আমাকে দেখার সুযোগ পেতে না। সময়মতো না আসলে কি যে হতো!
বলেই দ্বীপ ঘুরতে ঘুরতে বিরবির করতে লাগলো, কারণ সে যা ভয় পেয়েছিল তাই হতে যাচ্ছিলো, চিত্রাকেও কিছু বলতে পারছেনা, কারণ চিত্রা যদি সত্যি গিয়ে বলে দেয় এই সম্পর্কে তাহলে আর রক্ষা নেই । দ্বীপ কাগজ হাতে একটু পায়চারী করতে করতে মনে হলো যেভাবেই হোক চিত্রাকে ম্যনেজ করাটা জরুরী। সে ঠান্ডা গলায় চিত্রাকে বললো..
___ চিত্রা তুমি আসার পরে খেয়েছিলে?
___ রাখেন আপনার খাওয়া। এই কাগজে কি এমন আছে যার জন্য আপনাকে বাবা বাসা থেকে বের করে দিবে? কিসের জন্য আপনি দুইটা জীবনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে কোনো একূল ওকূল বুঝাতে চাচ্ছেন না? কেন ছাড়তে পারছেন না সেই মেয়েকে? আর এখানে দেখলাম ওই মেয়েকে নিয়েই এসব কাগজপত্র, কেন? কেন? আমাকে বলতেই হবে সব। নাহলে কাগজ না দিলে নাই, আমি বাবাকে এমনিতেই ফার্স্ট টু লাস্ট সব বলে দিবো। তারপর যা হবার হবে আল্লাহ ভরসা।
দ্বীপ চিত্রার হাতে ধরে অনুনয় করে বললো.
___ তুমিই একমাত্র পারো আমাকে ভরসা দিতে। প্লিজ আমাকে সময় দাও। কয়েকটা দিন পরে আমি তোমাকে সব বলবো প্রমিজ। তুমি দয়া করে বাবাকে কিছু বলো না। প্লিজ দয়া করো, প্লিজ চিত্রা।
চিত্রা দ্বীপের আকুতিতে হ্যাঁ সম্মতিতে না দিয়ে পারলো না।
চিত্রা দ্বীপের এসব ব্যপারে আর কোনো প্রশ্ন করলো না কয়েকদিন।
প্রায় ২০ দিন চলে গেলো। চিত্রা কিছু বলতে গিয়েও পারেনা। কারণ দ্বীপকে খুব বিমর্ষ দেখায়। এসব প্রশ্ন করতে চিত্রার আজকাল কেন জানি মুখে বাঁধে। খুব বড় ধরনের টেনশনে দ্বীপ অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে সেটা তাকে দেখলেই বুঝা যায়।
ঠিক একুশদিনের মাথায় বিকাল বেলা হঠাৎ করেই দ্বীপ তারাতাড়ি বাসায় ফিরলো। এবং হাসিমুখে চিত্রাকে বলল..
___ চিত্রা শুনো, আজকে অনেক সাজগোজ করবা। তোমাকে নিয়ে একটা জায়গায় ঘুরতে যাবো।
প্রথমত দ্বীপের হঠাৎ এমন কথায় চিত্রা অবাক হলো। তবে আজকে দ্বীপকে হাসিখুশি দেখে চিত্রার কেমন জানি ভালোলাগা কাজ করছে।
বিয়ের পরে এটা প্রথম, তার জামাই নিজে থেকে তাকে সাজতে বলেছে। তাই সেও দ্বীপ খেয়েদেয়ে আসার আগেই সেজেগুজে প্রস্তুত। রুমে এসে চিত্রাকে রেডি হয়ে যেতে দেখে দ্বীপ হেসে বললো..
___ মেয়েদেরকে কোথাও যাওয়ার কথা বললে নাকি তার ৫ মিনিট করতে করতে ৫ ঘন্টা পার করে দেয়। কিন্তু আমার বউয়ের এতো কম সময় কিভাবে লাগতে পারে?
___ লাগছে তো, পুরো আধ ঘন্টা। কেন দেরি করবো নাকি?
___ আরে আমি তোমাকে আধ ঘন্টায় রেডি হওয়ার কথা বললেও জামাল চাচাকে দুই ঘন্টা পরে রিকশা নিয়ে আসার কথা বলেছি। ভেবেছি অন্যদের মতো দেরি করবা, মেয়ে মানুষ তো সবাই এক তাইনা?
তার কথা শুনে চিত্রা প্রথমে হাসলেও পরে রেগে গেলো। নাক ফুলিয়ে তার সামনে অগ্রসর হতে হতে বললো..
___ মেয়ে মানুষ সবাই একরকম? একরকম সব মেয়ে মানুষ তাইতো?
দ্বীপ দুকদম পিছিয়ে বললো..
___ না মানে দেরির দিক থেকে সব মেয়ে একরকম সেটা বললাম। তবে চরিত্রের দিকে অসংখ্য ভিন্নতা।
যেমনটা আমার কাছে অথৈ এবং তোমার তফাৎ।
___ তা কেমন তফাৎ শুনি?
___ সেটা তুমিও জানো,, আচ্ছা চলো চিত্রা, চাচাকে ফোন দিলেই এখন চলে আসবে। তুমি গিয়ে আম্মু এবং আব্বুকে বলে আসো আমরা একটু বাইরে ঘুরতে যাচ্ছি।
চিত্রা দ্বীপের শার্টের কলারটা টান দিয়ে সোজা করে বললো..
___ আচ্ছা যাচ্ছি।
বলে সে পা বাড়াবে তখনি দ্বীপ চিত্রার হাতে ধরে ফেললো, চিত্রা ঘুরে তাকানোর পর মৃদুস্বরে বললো .
___তোমাকে শাড়ীতে অনেক সুন্দর লাগছে!
চিত্রা লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে দৌঁড়ে সেখান থেকে চলে গেলো। দ্বীপ হাসলো এবং সেও চিত্রার বেরুনোর পরে রুম থেকে বের হলো।
তারপর তারা দুজন রওয়ানা দিলো। রিকশায় উঠেই দ্বীপ চিত্রার কাঁধে হাত রাখলো। চিত্রা হাতের দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বললো..
___ হঠাৎ এতো রোমান্টিক হয়ে যাওয়ার কারণ কি?
___ ছোট্ট একটা কারণ অবশ্য আছে, নামার পরে বলবো।
দ্বীপদের বাসা থেকে তাদের জেলা শহরে যেতে ২৫-৩০ মিনিট সময় লাগে। তার আগেই একটা ছোট ক্যাফ। তারা সেখানে নামলো এবং পুকুরের সামনে টেবিলে বসলো। চিত্রা দ্বীপের দিকে তাকাচ্ছে, কিসের ছোট্ট কারণ যার জন্য তাকে এখানে নিয়ে আসছে। কতক্ষণ চুপ করে থাকার পর দ্বীপ বললো..
___আজকে যত কথা হবে, সেগুলো তুমি আর আমি ছাড়া যেন কেউ না জানে এবং আমাকে প্রমিজ করতে হবে?
___ বলার হলে সবাইকেই তো বলবো। না বলার হলে তো আর বলবো না।
___ চিত্রা এটার সাথে আমার ক্যারিয়ার সম্পৃক্ত সাথে তোমার বিশ্বাস এবং আমার সামনে এগিয়ে চলা।
___ আচ্ছা আমার বিশ্বাস হলে কাউকে বলবো না,, তবে মনগড়া ইতিহাস বলে ঠকবাজি করার চেষ্টা করলে আর সেটা যদি আমি ধরতে পারি তবে সবাইকে বলে দিবো।
দ্বীপ চিত্রার দিকে তাকিয়ে,তার হাতের ছোট ব্যাগটা থেকে একটা কাগজ বের করে সামনে রাখলো৷
চিত্রা সেটার দিকে তাকালো কিন্তু কিছু বুঝলো না। শুধু দেখলো এটা দ্বীপের কোনো ইনফরমেশন জাতীয় কিছু।
চিত্রা জিজ্ঞেস করলো,
___ এটা কি?
___ এটা আমার নতুন চাকরিপত্র। ওই চাকরিটা আমি ছেড়ে দিয়েছি। আর বিয়ের পর পর তোমাদের বাসা থেকে তারাহুরো করে আসার এটাই কারণ। সেদিন ইন্টারভিউ ছিল। অনেকদিন যাবৎ আমি আগের চাকরিটা থেকে মুক্তি পেতে প্রাণপণে চেষ্টা করেছি কিন্তু কোনো চাকরি পাইনি। ছেড়ে কারণটা আমাদের বিয়ের প্রথম রাতে বলেছিলাম তোমায়, তুমি বিশ্বাস করো নি। হ্যাঁ অথৈ আমাকে চাকরিটা দিয়েছিল, আর অনেক ভালো বেতনও পেতাম। কিন্তু চাকরির সাড়ে তিন বছরের উপর হয়ে গেলো কিন্তু নিজের ভবিষ্যতের জন্য কিছুই করতে পারিনি।
___ বুঝতে পারিনি, মানে এতদিন ধরে চাকরি করেও কোনো সঞ্চয় নেই আপনার?
___ হ্যাঁ সেটাই। কোনো সঞ্চয় নেই। বরং আরো ৪ মাস লেগে যাবে আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে। তবে বেলা শেষে আমি ফিরবো শূন্য হাতে।
কথাটা শেষ করেই দ্বীপ নিচু হয়ে চোখ ঢাকার চেষ্টা করলো। চিত্রা আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারছেনা।
সে আবারও প্রশ্ন করলো
___ বুঝিয়ে বলুন আমাকে। আপনি এতো অস্থির হয়ে যাচ্ছেন কেন?
দ্বীপ মাথা তুলে বলল..
___চিত্রা তুমি যে কাগজপত্রগুলো পেয়েছিলে, আর বলেছিলে বাবাকে বলে দিবে। সেগুলো কিসের জানো? আর শুনলে তুমি স্থির থাকতে পারবে তো?
চিত্রা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
___কিসের সেগুলো? বলুন কিসের?
চলবে….