অস্পষ্ট সে পর্ব ৭

গল্পঃ #অস্পষ্ট_সে (৭ম পর্ব)
লেখায়ঃ #তাজরীন_খন্দকার

তার বুক ধুকধুক করছে। এবার কিভাবে এখান থেকে পালাবে!

চিত্রা নিজেকেই বকতে লাগলো, কেন যে পাকামো করতে গেলো সে!
দ্বীপের হাতে এতগুলো থাপ্পড় খেলে একদম হাড্ডি ভেঙে যাবে। চিত্রা দশমবার হাত না দিয়েই উঠে দাঁড়ালো। দ্বীপ ভ্রু কোচকে বললো..
___ আর একটা ম্যাডাম,বসেন। খেলা রেখে উঠা যাবেনা। নিয়ম লঙ্ঘন করা গুরুতর অপরাধ।

চিত্রা তোতলাতে তোতলাতে বললো..
___এ-স-ব বাজে খেলা আমি খেলিনা। থাপ্পড় খাওয়া কোনো খেলা হয় নাকি। খেলবো না আমি।

চিত্রা সেখান থেকে চলে যেতে চাইলো, তখন দ্বীপ হাতে টেনে ধরে বলল..
___ খেলা তোমাকে শেষ করতেই হবে। আগেই বলেছিলাম পারবে না। কিন্তু খুব তো আসছো, পারবে বলে। এখন পালানো চলবেনা। আসো বসো বসো।

বলেই দ্বীপ চিত্রাকে জোর করে বসালো। চিত্রা কাঁপা কাঁপা হাতে শেষবার হাত রাখলো। তবে দ্বীপ হয়তো ইচ্ছে করেই সেবার কোনো চালাকি করলো না এবং চিত্রা হাত উঠিয়ে নিতে পারলো। তাতে কি হবে? ৭ টা থাপ্পড় যে খেতেই হবে।

এবার শাস্তির পালা, চিত্রা একেবারে চুপসানো মুখে দ্বীপের দিকে তাকালো। দ্বীপ জয়ের হাসিতে যেন ফেটে পড়ছে। চিত্রা আস্তে করে বললো..
___ মাফ করে দেওয়া যায়না?

___খেলাতে এসব নেই। হাত পাতো এখন, আমাকেও তো দিছিলা মনে নেই?

চিত্রা কাঁদো কাঁদো চোখে হাত পেতে দিলো। দ্বীপ রেডি বলে থাপ্পড় দেওয়ার সাথে সাথে চিত্রা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো, ১০ সেকেন্ড চলে গেলো কিন্তু দ্বীপ থাপ্পড় দিলোনা। তখনি সে চোখ খুলে দেখলো, দ্বীপ বসে বসে হাসছে। চিত্রাও একটা হাসি দিয়ে বললো..
___ওহহ তাহলে মাফ করে দিয়েছেন। ধন্যবাদ ধন্যবাদ! ওহহ কতো ভালো আপনি।

___ জ্বী না, মাফ করিনি। তবে সামান্য দয়া করবো। শুনো ৭ টা থাপ্পড় মাফ করে দিবো, তুমি আমাকে ৭ টা পাপ্পি দিলে। রাজী থাকলে হাত তুলে ফেলো, আর ত্যাড়ামি করার ইচ্ছে থাকলে আমিও মাফ করছিনা।

___ সুযোগ পেয়েছেন তাইনা? দিবোনা আমি। দেন থাপ্পড় দেন।

বলেই চিত্রা হাত আবার পাতলো। দ্বীপও একদম বাধ্য ছেলের মতো থাপ্পড় দিতে যাবে তখনি চিত্রা এলোপাতাড়ি হয়ে হুড়মুড় করে দ্বীপকে জড়িয়ে ধরলো। চিত্রার কান্ডে প্রথমত দ্বীপ হাঁ হয়ে গেলো। পরবর্তীতে সেও চিত্রাকে ধরে হাসতে বললো,
___যাও মাফ!
চিত্রা এবার দ্বীপকে ছেড়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলতে লাগলো.
___খারাপ মানুষ আপনি, নতুন বউকে কেউ শাস্তি দিতে চায়?

দ্বীপ হাসতে হাসতে বলল..
___তোমার তাই মনে হয়েছিল? আমি সত্যি দিবো?

___ তো কি? দিয়েই তো ফেলছিলেন প্রায়।

___ আরে তখন আমিই থেমে যেতাম, তার আগেই তুমি এভাবে জড়িয়ে ধরলে। যাক ভালোই হলো, বিয়ের পরে এই প্রথম একটা উপায়ে বউয়ের একটু ভালোবাসা পেলাম। হেহেহেহে।

চিত্রা দ্বীপের অদ্ভুত হাসি আর কথায় লজ্জা পেলো। ধ্যাত এভাবে ধরা তার উচিত হয়নি। এখন দ্বীপ কি ভাব্বে?
কাল থেকে রাগ দেখাচ্ছে আর আজকে কিনা নিজে থেকে এই কাজটা করে ফেললো চিত্রা।
ওহহো কি মারাত্মক সিচুয়েশন!

চিত্রার চুপ থাকা দেখে দ্বীপ কি ভেবে যেন শান্ত গলায় বলতে থাকলো..

___ আমি জানি আমাকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন তোমার।
এসবের কোনো জবাব তোমার বিশ্বাসযোগ্য লাগবেনা। তাই আমিও অযথা বলবোনা, তবে সময় দিচ্ছি তুমি নিজে থেকেই আমাকে বুঝো এবং চিনো। আর শুনো কালকের রাতে কিংবা এখন পর্যন্ত যা হয়েছে সবকিছুই দুষ্টামী ছিল, আমি কখনোই তোমার সাথে জোরপূর্বক কিছু করবোনা। তবে এসব বলে আমি এটা বুঝাতে চাচ্ছিনা আমি ভীষণ ভালো মানুষ , জাস্ট তোমার প্রতি সম্মানবোধটা বললাম। বাকিটা তুমিই যাচাই করবে। আর শুনো, তোমার ওইসব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘুমানোর দরকার নেই ওকে?

বলেই দ্বীপ হাসতে লাগলো।

এই কথা শুনে চিত্রা আবারো লজ্জা পেলো। দ্বীপের কথার জবাবে অথৈ এর ব্যাপার নিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনি দ্বীপের মোবাইলে একটা ফোন আসলো।
দ্বীপ ফোন রিসিভ করে ওপাশের কথা শুনার একটু পরে বলতে লাগলো,
___ আরে আমি প্রথমবার শশুড় বাড়িতে বেড়াতে এসেছি, আর এখান থেকে আমি কাল সকাল ৯ টার মধ্যে কিভাবে যাবো? কালকে বিকেলে হলেও পারবো, এভাবে বউকে না নিয়ে গেলে মানুষ কি বলবে?
বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করা উচিত তাইনা?

তারপর কি যেন বলে ফোন কেটে দিলো।

চিত্রা অবাক হয়ে গেলো। কি এমন দরকার তাকে নাকি ৯ টার মধ্যে যেতে হবে। চিত্রা আর অথৈকে নিয়ে প্রশ্ন না করে জিজ্ঞাসা করলো

___ কে ফোন দিয়েছিলো।

দ্বীপ কিছুটা কাচুমাচু হয়ে জবাব দিলো

___আমার ফ্রেন্ড, জরুরী দরকারেই। এসব পরে বলবো তোমাকে।

চিত্রা দ্বীপের কোনো ব্যাপারই বুঝতে পারেনা। সবকিছু পরে বলবে, আস্তে আস্তে বুঝে নিতে হবে। কি এমন কাহিনী আছে যা কিনা তার বলতে সমস্যা!
আবার বলে এসব নাকি বিশ্বাসযোগ্য মনে হবেনা।
বিয়ের আগ থেকে এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র জামাইকে নিয়ে এতো টেনশন আর অদ্ভুত সব কান্ডকারখানার মতো পরিস্থিতিতে চিত্রা জীবনেও শিকার হয়নি।
সে জানেনা কবে এর থেকে পরিত্রাণ পাবে।

এর মধ্যে রাতের খাবারের জন্য ডাক আসলো। তারা খেয়েদেয়ে এসে শুয়ে পড়লো। দ্বীপ চিত্রার আগেই ঘুমিয়ে গেছে কিন্তু চিত্রার মাথায় আকাশসমান একটা পাথর, কোনো কিছুর হিসেব মিলাতে পারছেনা। তবে তার কেন জানি মনে হচ্ছে দ্বীপ অথৈ এর সাথে কোনোভাবেই থাকতে পারবেনা বলেই নিজের ইচ্ছেতেই তাকে বিয়ে করেছে। তবে এটাই মাথায় যাচ্ছেনা কি এমন কারণ যার জন্য সেই মেয়েকে একেবারে ছেড়ে আসতে তার এতো সমস্যা? হাজার হাজার মিথ্যা বলে সেই মেয়েকে সে খুশি রাখতে চায়, কিসের জন্য? কি এমন কারণ?

.
.
পরদিন একদম ভোর হওয়ার সাথে সাথেই দ্বীপ আগে আগে উঠে চিত্রাকে ডাকতে লাগলো। চিত্রা উঠেই দেখে দ্বীপ রেডি হচ্ছে। সে চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে জিজ্ঞাসা করলো..
___ কি ব্যপার? এতো সকালে কোথায় যাবেন?

___প্রশ্ন করো না। আমার দরকার আছে তাই এখনি আমাদের বাসায় যাবো। তারাতাড়ি রেডি হও যাও।

___আরে বললেই হলো, আম্মু দিবেনা তো।

___ গিয়ে দেখো আম্মু নাস্তা রেডি করে ফেলেছে। আমি বলেছি আমার কাজ আছে দুইদিন পর আসবো আবার। এখন কথা না বাড়িয়ে জলদি যাও তো।

চিত্রা বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা করে বোরকা হিজাব পরে নিলো। এতো সকালে সাজসজ্জা করে যাওয়ার সময় নেই। তারপর বিদায় জানিয়ে রওয়ানা দিলো। চিত্রা এখনো জানেনা দ্বীপ কেন এতো তারাহুরো করে চলে যেতে চাইছে। তাকে প্রশ্ন করতে বারণ করেছে তাই আগ বাড়িয়ে কোনো ফোর্স করতে গেলোনা।

গাড়ী ছেড়ে দেওয়ার কিছুক্ষণ পরই চিত্রা ঘুমে ঢলতে লাগলো। স্বভাবত চিত্রা এতো সকালে কখনোই উঠেনা,যার জন্য তার ঘুম যেন ছাড়তে চাইছেনা। দ্বীপ হাত দিয়ে চিত্রাকে ধরে নিজের কাঁধে রাখলো।
চিত্রার এইদিকে কোনো খেয়াল নেই।

হঠাৎ গাড়ীর ব্রেক কষলো এবং চিত্রা তড়িঘড়ি করে চোখ খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে সামনে তাকাবে তখনি তার চোখ আবার বায়ে ফিরে তাকালো। সে আবার চোখ কচলে ভালো করে একটু দূরে তাকালো।
হ্যাঁ তার চোখ ভুল দেখছেনা, এটা অথৈ! দ্বীপের গার্লফ্রেন্ড। কিন্তু এতো সকালে তার সাথে এই ছেলেটা কে? অথৈ সেই ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ওপাশে । চিত্রা দ্বীপের দিকে তাকিয়ে দেখলো দ্বীপ অন্যদিকে তাকিয়ে আছে, সামনে একটা ট্রাক থেমে আছে যার জন্য গাড়ী আগাতে পারছেনা। চিত্রা হাত টেনে দ্বীপকে আঙুল দিয়ে রাস্তার ওপাশে অথৈকে দেখালো,

দ্বীপ সেইদিকে তাকিয়ে চিত্রার দিকে বড় চোখ করে অবাক হয়ে তাকালো। অথৈ এর পাশে অন্য ছেলেকে দেখে নয়, চিত্রা অথৈকে কিভাবে চিনে সেটা ভেবে! এবার চিত্রাকে কিভাবে সামাল দিবে তার মাথায় কাজ করছেনা। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে চিত্রা কি করে চিনতে পারে অথৈকে? যদি চিত্রা জেনে যায় অথৈর ব্যাপারে তার এতো দূর্বলতার কারণ কি? তাহলে চিত্রাকে তো বুঝাতে পারবেই না, উল্টো পরিবারের কাছে জবাবদিহিতায় তাকে বাসা ছাড়তে হবে!
দ্বীপ এবার ভয়ে ঘামতে শুরু করেছে!

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here