অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ১৭.

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৭.

বয়োবৃদ্ধ একজন লোক দু হাতে লাঠিতে মাথা ভর দিয়ে চোখ বুজে সোফায় বসে আছে। চেহারায় উনার বার্ধক্যের ছাপ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তবুও তার কাঠিন্য মুখভাব দেখে বুঝা যাচ্ছে সকলেই তার ভয়ে তটস্থ থাকে।

ইসাম বাসায় প্রবেশ করতেই সে সবার আগে লিভিং রুমের সোফায় বসে তার জন্য অপেক্ষারত হামিদ দাদাকে দেখতে পায়। ইসাম ভালো করেই জানে তার দাদা তার উপস্থিতি টের পেয়েছে। তাই সে চুপচাপ এগিয়ে গিয়ে সামান্য গলা ঝেড়ে সালাম দেয়। লোকটা সালামের জবাব দেয় না। উল্টো তার হাতের লাঠি দিয়ে ফ্লোরে দুই বার জোরে শব্দ করে। এতেই ইসাম ভয়ে চোখমুখ খিচে বন্ধ করে ফেলে। ততক্ষণে বাড়ি ভর্তি লোক এসে সেখানে উপস্থিত হয়ে গিয়েছে। ইসামের বাবা, মা, তার ছোট দুই ভাই আর তিনজন কাজের লোক।

হামিদ দাদা স্ব শব্দে বলে উঠে,

” আদিল! তোর ছেলেকে জিজ্ঞেস কর দেশে ফিরে এতোদিন কোথায় ঘুরে বেরিয়েছে? ”

ইসামের বাবা আদিল সাহেব আড়চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে শাসিয়ে বলে,

” এই নালায়েক! কোথায় ছিলি তুই এই কদিন? ”

ইসাম বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে ফেলে। ঘরভর্তি কাজের লোকের সামনে তাকে এভাবে নালায়েক ডেকে অপমান করা হচ্ছে। এটা ঘোর অন্যায়। ইসাম থমথমে মুখে জবাব দেয়,

” আমি ছিছাওয়াতে ছিলাম। ফাতিহও আমার সাথে ছিলো। ”

আদিল সাহেব আবার একই সুরে বলে উঠে,

” তুই দেশে এসে সবার আগে নিজের দাদার সাথে দেখা না করে, কাউকে কিছু না জানিয়ে এভাবে উধাও হয়ে যাস কি করে? আদব কায়দা সব ভুলে গিয়েছিস? ”

হামিদ দাদা এবার কিছুটা হুঙ্কার দিয়ে আদিল সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলে,

” বাদরের ঘরে তো বাদরই হবে। এই বয়সে তুই নিজেও তো এসবই করে বেড়াতি। তোর ছেলে আর ভালো কিছু কিভাবে শিখবে? ”

এই বয়সে এসেও এখনো দাদার কাছে নিজের বাবাকে ধমক খেতে দেখে বেশ মজা পায় ইসাম। সে ফিক করে হেসে দেয়। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা কাজের লোকরাও মিটিমিটি হাসছে। হামিদ দাদা সবার দিকে গরম চোখে তাকিয়ে ইশারা দেয় প্রস্থান করার জন্য। মুহুর্তেই সবাই সেখান থেকে কেটে পরে। কিছু সেকেন্ডের ব্যবধানেই ইসাম নিজেকে লিভিং রুমে তার দাদার সাথে একা আবিষ্কার করে। মুহুর্তেই তার মুখের হাসি উবে যায়।

হামিদ সাহেব ইসামকে চোখের ইশারায় কাছে ডাকে। ইসাম ভয়ে ভয়ে তার দাদার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে। হামিদ সাহেব গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করে,

” কোনো মেয়ে জড়িত ঘটনা ঘটে নি তো? ”

ইসাম সাথে সাথে মাথা নাড়িয়ে না বলে। হামিদ সাহেব একহাতে ইসামের ঘাড় শক্ত করে ধরে বলে,

” আমার মতের বিপক্ষে গিয়ে ফুটবল ক্লাবে ভর্তি হয়েছিলে, মাফ করেছি। কিন্তু ভুলেও যদি বাহিরের কোনো মেয়ের সাথে জড়িয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াও তাহলে কখনোই মাফ করবো না। এই বাসায় আমার পছন্দ করা মেয়েই একমাত্র তোমার বউ হয়ে আসবে। মনে থাকবে? ”

ইসাম নাথা নত করে বলে,

” জ্বি দাদা। ”

__________

দরজায় নকের শব্দ পেতেই ল্যায়লা শোয়া থেকে উঠে বসে। ফাতিহ দরজা সামান্য ফাঁক করে উঁকি দিতেই ল্যায়লা বলে,

” আসো। ”

ফাতিহ সামান্য মাথা চুলকে বলে,

” আই ওয়াজ জাস্ট চেকিং অন ইউ। এখন বেটার ফিল হচ্ছে? ”

ল্যায়লা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। ফাতিহ বলে,

” তাহলে তুমি রেস্ট নাও। কিছু প্রয়োজন হলে ডেকে নিও। ”

ল্যায়লা সাথে সাথে বলে উঠে,

” আই এম সরি। ”

ফাতিহ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই ল্যায়লা আবারও বলে উঠে,

” তোমাকে যতবার থাপ্পড় মেরেছি সেটার জন্য সরি। আমার সেটা করা উচিত হয় নি। ”

ফাতিহ অবাক হয়। ল্যায়লার মুখ থেকে আর যাই হোক সরি কখনো এক্সপেক্ট করে নি সে। বুঝতে পারে ল্যায়লা অনেকটা আনারসের মতো। বাহির থেকে শক্ত কাটাযুক্ত। কিন্তু মনের দিক থেকে তার বিপরীত। ফাতিহ সামান্য ভেবে বলে,

” বাহিরে যাবে? ”

ল্যায়লা একবার বাহিরের দিকে তাকায়। রাত প্রায় ১০ টার উপর বাজে। এখন কোথায় যাওয়ার কথা বলছে ফাতিহ? ল্যায়লাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফাতিহ বলে,

” চিন্তা নেই। এখন কোনো টুরিস্ট স্পটে নিয়ে যাবো না৷ দেয়ার ইজ এ স্পেশাল প্লেস দ্যাট আই ওয়ান্ট টু শো ইউ। ”

ল্যায়লা খানিকটা ভেবে বলে,

” আচ্ছা আমি রেডি হয়ে আসছি। ”

ফাতিহ সূক্ষ্ম চোখে ল্যায়লাকে পরখ করে নেয়। ব্যাগি জিন্স আর তার সাথে একটা ঢিলেঢালা হুডি পড়ে আছে। আর কি রেডি হবে এই মেয়ে? ফাতিহ এগিয়ে গিয়ে ল্যায়লার একহাত ধরে টেনে বের হতে হতে বলে,

” অলরেডি রেডি তুমি। নাও লেটস গো। ”

__________

বাইক দেখে ল্যায়লার চোখ কপালে। ফাতিহ ল্যায়লার মুখভাব দেখে বলে,

” আগে কখনো বাইকে রাইড করো নি? ”

ল্যায়লা মাথা নেড়ে না জানায়। ফাতিহ বলে,

” ভয় নেই। আমি আছি। ”

কথাটুকু বলেই ফাতিহ একটা হেলমেট ল্যায়লার দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজে আরেকটা হেলমেট পড়ে নেয়। বাইকে উঠে বসতে নিয়েই ফাতিহ দেখে ল্যায়লা এখনো হেলমেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে আর কোনো কথা না বলে ল্যায়লার হাত থেকে হেলমেটটা নিয়ে তাকে পড়িয়ে দিতে থাকে।

আচমকা ফাতিহ কিছুটা কাছে চলে আসাতে ল্যায়লা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। অনুভব করে তার বুকের ভেতর জোরে জোরে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছে। কি অদ্ভুত! এমন হচ্ছে কেন?

বাইকে উঠে বসতেই ফাতিহর দুই কাধে হাত রাখে ল্যায়লা। এই সামান্য নরম সংস্পর্শও তাকে অন্যরকম অনুভূতির সাথে পরিচয় করাচ্ছে। যেই অনুভূতির সঙ্গে ল্যায়লা পূর্ব পরিচিত নয়।

ফাতিহ বাইক স্টার্ট দেয়। রাবাত শহরের অংশ হওয়া সত্ত্বেও এই দিকটা অনেকটাই নিরিবিলি এবং জনমানবশূন্য। রাস্তার দু ধারে সারি সারি গাছ এবং ল্যাম্পপোস্টের আলো পিছনে ফেলে বাইক চলে যাচ্ছে ফরেস্ট এরিয়ার দিকে। কিন্তু ল্যায়লার সেদিকে ধ্যান নেই। তার সকল ধ্যান ফাতিহর দিকে। এই ফাতিহ আরাব নামক অপরিচিত ভীনদেশী মানুষটি তাকে অনেকগুলো অনুভূতির সাথেই পরিচয় করিয়েছে। যেমন : প্রথম সমুদ্র ভ্রমণ, প্রথম উটের পিঠে চড়ে ভ্রমণ, প্রথম বাইক রাইড সহ আরো অনেক নতুন নতুন অনুভূতি। কিন্তু এই সকল অনুভূতির মেলার মধ্যে কেবল একটি অনুভূতির নামই ল্যায়লার অজানা। সেই অনুভূতির নাম জানার আগ্রহও বোধ করে না সে। তাদের পথচলা কেবল আর ৪ দিনের। তারপর দুজনের পথই আলাদা হয়ে যাবে। এই কিছু মুহুর্তের পথ চলায় ফাতিহর পক্ষে ল্যায়লাকে বাঁচানো এবং ল্যায়লার পক্ষে ফাতিহকে ভালোবাসা দুটোই অসম্ভব।

__________

” এই জায়গায় ছোট বেলায় আমি আর ফারাহ আপু প্রায়ই আসতাম। এটা আমাদের সিক্রেট এরিয়া। ”

নিজের সাথে আনা ব্যাটারি চালিত ফেইরি লাইট গুলো চারিদিকে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিতে দিতে কথাগুলো বলে। ল্যায়লা একহাতে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট ধরে রেখেছে সেদিকে। অন্ধকারে চারিদিক এখনো সে স্পষ্ট দেখতে পারছে না। ফাতিহর কথা শুনে সে পাল্টা প্রশ্ন করে,

” তোমার বোন ফারাহ? ”

” হ্যাঁ। আমার থেকে দুই বছরের বড়। কানাডায় নিজের হ্যাজবেন্ড এবং ছয় বছরের ছেলের সাথে থাকে। ”

” তোমার মা বাবা? ”

” উনারা মাদ্রিদে আছেন। আগে এখানেই থাকতো। আমি মাদ্রিদে শিফট হওয়ার পর উনাদেরও সাথে নিয়ে যাই। বাট উনাদের ওখানে মন বসছে না। মেবি নেক্সট ইয়ারই আবার ব্যাক করবেন মরক্কোতে। ”

ল্যায়লা আর কোনো প্রশ্ন করে না। ফেইরি লাইটগুলো সেট করা শেষ হতেই ফাতিহ সুইচ অন করে লাইট গুলো জ্বেলে দেয়। মুহুর্তেই চারিদিক হালকা সোনালী আলোয় ঝলমলিয়ে উঠে। ল্যায়লা লক্ষ্য করে এখন আর জায়গাটা তেমন ভুতুড়ে মনে হচ্ছে না। উল্টো ফেইরি লাইটের নরম আলোয় চারিদিকটা তার কাছে কোনো ফেইরি টেলের সিক্রেট প্লেসের মতো মনে হচ্ছে। ল্যায়লা আনমনে ফাতিহর বাহুর দিকের জ্যাকেট একহাতে ধরে বলে উঠে,

” কি সুন্দর জায়গা! ”

ফাতিহ ল্যায়লাকে দেখে হাসে। গত দু’দিন কাসাব্লাঙ্কা কিংবা বৌজনিকা বীচে গিয়েও ল্যায়লার চোখেমুখে এমন খুশি সে দেখে নি। কি মায়াবী! সামনে একটি উঁচু গাছে শক্ত ১১ ফুট লম্বা দড়ি দিয়ে একটি দোলনার মতো ঝুলে আছে। ল্যায়লা এগিয়ে গিয়ে সেই দোলনায় বসে। তারপর নিজের পায়ের সাহায্যেই কিছুটা পিছনে গিয়ে দোল খেতে শুরু করে। তার থেকে কয়েক হাত দূরেই একটি গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখতে থাকে ফাতিহ। হাত ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পায় সবেমাত্র রাত ১১ টা বাজে। ১২ টা বাজলেই এক নতুন বছরের শুরু হবে। ফাতিহ একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে বলে,

” কাসাব্লাঙ্কা বীচে তোমার তোলা থাকা সেই ডেয়ারের কথা মনে আছে ল্যায়লা? ”

ল্যায়লা দোল খেতে খেতেই মাথা নেড়ে বলে,

” হু। ”

” আমি এই মুহুর্তে সেই ডেয়ারটা দিতে চাই। ”

ল্যায়লা ঠাট্টার স্বরে বলে,

” অন্ধকার জঙ্গল সম্পূর্ণটা একা ঘুরে আসার ডেয়ার দিবে নাকি? ”

” না। আমি তোমাকে ৩ টা প্রশ্ন করবো। সেই প্রশ্ন তিনটার উত্তর আমাকে দেওয়ার আগে এখান থেকে কোথাও যেতে পারবে না। ”

ল্যায়লা তেমন একটা তোয়াক্কা করে না। সে আপন মনে দোল খেতে খেতেই বলে,

” আপাতত আমি কোথাও যাচ্ছিও না। যা ইচ্ছা প্রশ্ন করো। ”

ফাতিহ নিজের শুষ্ক অধর সামান্য ভিজিয়ে নিয়ে সাহস সঞ্জয় করে প্রথম প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে,

” মরক্কোর সাথে তোমার যোগসূত্রের মাধ্যম কি? ”

প্রশ্নটা শুনতেই ল্যায়লা শক্ত করে দঁড়ি ধরে থেমে যায়। এই প্রশ্নের জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না। অন্তত এই মুহুর্তে মোটেই না।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here