অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ১৮.

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৮.

” আমাল শ্রিকি। আমার জন্মদাত্রী মরক্কোর ছিলো। ”

ল্যায়লার উত্তর শুনে ফাতিহ তার মুখভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করে। জবাবটা দেওয়ার সময় তার চোখমুখ শক্ত আর ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছিল।

ফাতিহ এবার দ্বিতীয় প্রশ্নটা করে,

” তোমার সুইসাইড করতে চাওয়ার পিছনের রিজন কি? ”

সাথে সাথে ল্যায়লা এক লাফে দোলনা থেকে নেমে ব্যস্ত পায়ে সামনের দিকে যেতে যেতে বলে উঠে,

” আমার কাছে তোমার আর কোনো প্রশ্নের উত্তর নেই। ”

কথাটা বলতে বলতেই অসাবধান বসত ল্যায়লা একটা পাথরের সাথে হোঁচট খেয়ে পরে যায়। ভাগ্য ভালো ছিলো বিধায় কোনো ব্যাথা পায় নি। কেবল হাতের তালু আর প্যান্ট কিছুটা ময়লা হয়ে যায়। একটা প্রবাদ আছে, অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়। ল্যায়লার মনে হয় তার ভাগ্যের সাথে এই প্রবাদ একদম যথাযথ। সে উঠতে নিবে তখনই দেখে ফাতিহ তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ল্যায়লা সেই বাড়িয়ে দেওয়া হাত প্রত্যাখ্যান করে নিজেই উঠে দাঁড়ায়। আবার সামনের দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই ফাতিহ তার হাত ধরে থামায়। পরপরই সে দেখে ফাতিহ তার সামনে এক হাঁটু গেড়ে বসে তার জুতোর ফিতে বাধছে। ফাতিহ বাধতে বাধতে বলে উঠে,

” জুতোর ফিতে আজীবন শক্ত করে বাধবে। নাহয় প্রতি কদমেই হোঁচট খেয়ে পরবে। ”

ল্যায়লা সেই কথা শুনে। অর্থ বোঝার চেষ্টা করে। আর বুঝতে পেরেই সাথে সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।

__________

কাগজের নাম্বার অনুসরণ করে একই ডিজিট ফোনে তুলে ডায়াল করে ইসাম। ফোনের অপর পাশে দুবার কল বেজে উঠতেই তা রিসিভ হয়। সকালের ঝাঁঝালো স্বরের বদলে একটি মিষ্টি স্বরে সালাম শুনতে পায় ইসাম। ইসাম নিঃশব্দে সামান্য হাসে। অপর পাশ থেকে এবার প্রশ্ন আসে,

” কে? ”

” আমি ছাড়া আর কারো কল আসার কথা ছিলো বুঝি? ”

নাহাল চিনতে পেরেছে এমন ভঙ্গিতে বলে উঠে,

” ওওও আপনি! দ্যাট হেল্পিং গাই। ”

ইসাম বিরক্ত হয়। হেল্পিং গাই? এটা আবার কেমন টাইটেল? হ্যান্ডসাম ডাকলে তাও মানা যেতো। কিন্তু এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। ইসাম প্রতিবাদী সুরে বলে উঠে,

” আমার নাম ইসাম। ইউ ক্যান কল মি দ্যাট। ”

” আমি জানি আপনার নাম। কিন্তু আপনাকে কি বলে ডাকবো সেটা নিশ্চয়ই আমার ডিসিশন হবে? ”

ইসাম বসা থেকে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তারপর বলে,

” আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছিলে আজকে। আই নেভার থট যে ইউ আর ইন্টারেস্টেড ইন মি। ”

” ইন্টারেস্ট তো এখনো খুব দূরের বিষয় ফুটবলার ইসাম সাহেব। আমি তো কেবল আপনাকে ঘেটে দেখছি। ”

ইসাম একলাফে এবার শোয়া থেকে উঠে বসে। বিস্মিত সুরে প্রশ্ন করে,

” তুমি আমার পরিচয় জানতে? ”

” আপনাকে কে না চিনে? নিউজপেপারের ফার্স্ট পেপারে প্রায়ই আপনার ছবি প্রকাশিত হয়। আর ইন্টারনেটের কল্যাণেও বিভিন্ন মেয়ের সাথেই আপনার সম্পর্কে আর্টিকেল পড়া হয়েছে আমার ইতিমধ্যে। ”

” ইন্টারনেট তো বহু কিছুই বলে। সব যে সত্যি হবে এমন কোনো কথা আছে? ”

” ইন্টারনেট তো এটাও বলে যে ফুটবলার ফাতিহ আরাবের রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস সিঙ্গেল। কিন্তু আজ তো স্বচক্ষে তার স্ত্রীকেও দেখে নিলাম। ”

ইসাম এবার নিজের কথায় নিজেই ধরা খেয়ে যায়। সে আমতা আমতা করে কিছু বলতে নিবে তার আগেই অপর পাশ থেকে নাহাল বলে উঠে,

” কিন্তু এতটুকু নিশ্চিত যে উনারা একে অপরকে ভালোবাসে। ”

” তোমারও একই জিনিস মনে হয়েছে? ”

” জ্বি। ফাতিহ সাহেবের মিস ল্যায়লার প্রতি কেয়ার দেখেই স্পষ্ট বুঝা যায় যে হি লাভস হার। ”

ইসাম সামান্য হাসে। সবার চোখেই এটা পড়ছে। কেবল ফাতিহই এটা বুঝতে রাজি না। বুঝতে রাজি না নাকি ইচ্ছে করে নিজের চোখ বেধে রেখেছে? কে জানে? ফাতিহকে বোঝা কঠিন।

__________

মধ্যরাত। ফাতিহ এবং ল্যায়লা বাসায় ফিরেছে ঘন্টা খানেক আগে। ফিরে কেউই কারো সাথে কথা বলে নি। ল্যায়লা সোজা রুমে গিয়ে দরজা লক করে দিয়েছে। ফাতিহও নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়েছে। অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও ঘুমাতে পারছে না। চোখ বুঝতেই সেই এক বিভৎস দৃশ্য তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বছরের এই তুষার পাতের মতো ঋতুতেও সে তিরতির করে ঘামছে। সেই অতীত কি তার পিছু ছাড়বে না? অনুতাপের অনল তিলেতিলে তাকে শেষ করে তবেই কি দম নিবে?

ফাতিহ উঠে বসে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে তার। বেডসাইড টেবিলে থাকা পানির বোতলটা হাত বাড়িয়ে নিতেই দেখে পানি শেষ। কি আর করার। নিজেকে শান্ত করে লিভিং রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রুম থেকে বের হয় সে। নিচে যেতে নিয়েই সে লক্ষ্য করে ল্যায়লার রুমের দরজার নিচ দিয়ে কিঞ্চিৎ আলো দেখা যাচ্ছে। লাইট অন মানে নিশ্চয়ই ল্যায়লা এখনো ঘুমায় নি। ফাতিহ কিছু একটা ভাবে। সাথে সাথে সে ব্যস্ত পায়ে নিচে চলে যায়।

__________

বাড়ির পিছনের দিকের উঠোনে এসে ল্যায়লার রুমের বারান্দার দিকে তাকাতেই ফাতিহ যেই দৃশ্য দেখে তার তার মেরুদণ্ড বেয়ে এক হিমশীতল আতংকের ঢেউ খেলে যায়। সে কোনো শব্দ করতে নিয়েও নিজের মুখ চেপে ধরে। ধীর পায়ে আড়াল হয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতরে চলে যায়।

লিভিং রুমের কেবিনেটে কিছুক্ষণ খুঁজতেই সে এক গুচ্ছ চাবি পেয়ে যায়। ভাগ্য ভালো যে সে সব রুমের জন্য এক্সট্রা কি বানিয়ে রেখেছিলো। তাড়াতাড়ি কাঙ্ক্ষিত চাবি খুঁজে বের করে সে দ্রুত পায়ে উপরে ল্যায়লার রুমের দিকে যায়। মনে মনে দোয়া পড়তে পড়তে সে চাবি দিয়ে নিঃশব্দে দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে। ধীর পায়ে বারান্দায় যেতেই সে দেখে ল্যায়লা বারান্দার রেলিঙ টপকে অপর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দু’হাতে রেলিঙ ধরে রেখে সে চোখ বুজে কিছু একটা বিড়বিড় করছে। ভুল করে সামান্য পা পিছলে গেলেই সর্বনাশ!

ফাতিহ নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে একহাতে ল্যায়লার কোমর জাপটে ধরে তাকে টেনে রেলিঙের ভেতর নিয়ে আসে। সাথে সাথে ল্যায়লা হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে শুরু করে আর চিৎকার করতে থাকে। ল্যায়লা চেষ্টা করেও নিজেকে ফাতিহর শক্তহাতের বাধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না কিন্তু তার ছোটাছুটিতে ফাতিহ তাল সামলাতে না পেরে নিচে বসে পড়ে। তবুও ল্যায়লাকে ছাড়ে না।

চিৎকার করতে করতে একটা পর্যায় ল্যায়লা কান্না করতে শুরু করে দেয়। নিজের গলার কাছে থাকা ফাতিহর হাত নিজের দু’হাত দ্বারা শক্ত করে জাপ্টে ধরে সে কান্না করতে থাকে। ফাতিহ কিছু বলে না। না ল্যায়লাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। কেবল শক্ত হাতে তাকে আগলে রাখে। ল্যায়লা আচমকাই আর্তনাদ করে বলে উঠে,

” আমার দোষ কি ছিলো? ওরা আমাকে কেন এই জাহান্নামের আগুনে ফেলে দিলো? আমি না বেঁচে থেকে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি আর না আমি মরতে পারছি। এখন ওরা নিশ্চয়ই খুশি? ”

ফাতিহ একহাতে ল্যায়লার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত স্বরে প্রশ্ন করে,

” কারা? কাদের কথা বলছো তুমি? ”

ল্যায়লার চোখেমুখ মুহুর্তেই অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

” আমাল শ্রিকি এবং রাদিফ আমীর। ”

কথাটুকু বলেই ল্যায়লা ছটফট করা বন্ধ করে দেয়। পরক্ষণেই সে ফুসতে ফুসতে বলে উঠে,

” তারা নিশ্চয়ই এখন খুব খুশি? তাদের ঘৃণার আগুনে আমার সম্পূর্ণ জীবন পুড়ে গিয়েছে। প্রতি মুহুর্তে সেই আগুনে আমি জ্বলছি। আমার ঘৃণার আগুন এতো উত্তপ্ত নয় কেন? আমিও সবাইকে ঘৃণা করি। তবুও সবাই কিভাবে এতো সুখে আছে? আমার ঘৃণা তাদের সুখ ভস্ম করে দিচ্ছে না কেন? ”

ফাতিহ হতভম্ব এবং বিমূর্ত। ল্যায়লা যাদের নাম বলেছে তাদের মধ্যে একজন ল্যায়লার মা সেই সম্পর্কে সে নিশ্চিত। কিন্তু আরেকজন? সে কি ল্যায়লার বাবা? সারনেম তো একই দুজনের। কিন্তু কোনো মা বাবা তাদের মেয়ের সাথে কি এমন করে থাকতে পারে যে একটা মেয়ে সম্পূর্ণ ট্রমাটাইজড হয়ে তার লাইফ পাড় করছে? কিসের এতো ঘৃণা তাদের ল্যায়লার প্রতি? ফাতিহ তার বাহুডোরে লেপ্টে থাকা ল্যায়লাকে নিখুঁত চোখে পর্যবেক্ষণ করে। এমন নিষ্পাপ দেখতে মেয়েও কি কারো ঘৃণার কারণ হতে পারে?

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here