অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ১৯.

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১৯.

[ সতর্কতা : এই পর্বে খু নে র বিবরণ রয়েছে। তাই সকলে নিজ দায়িত্বে পড়বেন। ]

অতীত,

আর কিছুক্ষণের অপেক্ষা। তারপরই দেখা মিলবে সেই কাঙ্ক্ষিত চূড়ার। যেখানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখার জন্য রাদিফ সূদুর বাংলাদেশ থেকে ৯২৫০ কি.মি ভ্রমণ করে মরক্কো এসে ৪১৬৭ মিটার উঁচু পর্বত হাইকিং করছে। উদ্দেশ্য একটাই। একটা পারফেক্ট সুন্দর সান রাইজিং দৃশ্যের ক্লিক।

রাতের শেষ প্রহর এখন। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোরের আলো ফুটতে শুরু করবে। অ্যাটলাস শৃঙ্গের চূড়ায় পা রাখতেই রাদিফের চরিত্রে সর্বপ্রথম যা পড়ে তা হলো চূড়ার একপাশে টাঙানো তাবু এবং তার অপর পাশেই দাঁড়ানো একজন যুবতী। একা একটি মেয়েকে এভাবে চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাদিফ অবাক হয়। পরমুহূর্তেই ভাবে হয়তো তার মতোই কোনো ভ্রমণ পিপাসু মানুষ। রাদিফ কিছু না বলে চূড়ার একপাশে গিয়ে কাধের ব্যাগটা নামিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বসে পড়ে। শীতকাল না হলেও পর্বতের চূড়ায় ভালোই ঠান্ডা পড়েছে৷

তার থেকে কয়েক হাত দূরে রমণী তাকে লক্ষ্য করে। কিছুক্ষণ তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এরাবিকে প্রশ্ন করে,

” আপনি ফোটোগ্রাফার? ”

রাদিফ মেয়েটার দিকে তাকায়। মেয়েটা যে তার হাতের ক্যামেরা দেখিয়ে কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছে বুঝতে পারে। কিন্তু কি জিজ্ঞেস করেছে তা সে বুঝতে পারে না। তাই ইংরেজিতে বলে উঠে,

” আমি আপনাদের ভাষা পারি না। ”

মেয়েটা কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে এবার ইংরেজিতে প্রশ্ন করে,

” আপনি মরক্কান না? ”

রাদিফ মাথা দুলিয়ে না জানায়। মেয়েটার চেহারায় আগ্রহ দেখা যায়৷ সে কৌতূহলী স্বরে প্রশ্ন করে,

” কোন দেশের আপনি? ”

” বাংলাদেশ। ”

উত্তর দিয়ে রাদিফ আবার নিজের মতো সামনের দিকে তাকিয়ে রয়। মেয়েটা বুঝতে পারে এই পুরুষ বেশ স্বল্পভাষী। কিছুক্ষণ ভেবে সে বলে,

” আমি আমাল শ্রিকি। আপনার জন্য একটা অফার আছে। ”

রাদিফ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়। সাথে সাথে মেয়েটা বলে,

” আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যোদয় হবে। আপনি কি সেই মুহুর্তে আমার কিছু ছবি তুলে দিতে পারবেন? আমি পে করে দিবো আপনাকে। ”

প্রস্তাবটা শুনে রাদিফের ভ্রু কুচকে আসে। আল্লাহর রহমতে তার অর্থ সংকট নেই কোনদিক দিয়ে। সে কেন এই মেয়ের জন্য টাকার বিনিময়ে ছবি তুলে দিবে? তবুও সে ভদ্রতার সুরে বলে,

” আমার টাকার প্রয়োজন নেই। ফার্স্ট সান রাইজের কিছু ছবি তুলে আপনাকে ছবি তুলে দেবো। সমস্যা নেই। ”

মেয়েটা যেন তার কথায় বেশ খুশি হয়। তার থেকে কিছুটা দূরে বসে মেয়েটা আপন মনে তার সাথে গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যেই গল্পের মূল বিষয়বস্তু ছিলো যে সে কতটা ভ্রমণ পিপাসু এবং তার এই ভ্রমণ অভিযাত্রায় তার পরিবারের পক্ষ থেকে বাধা৷ রাদিফ উপলব্ধি করে মেয়েটা বেশ কথা বলতে পারে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দূর পর্বতের গা ঘেঁষে সূর্য ধীরে ধীরে উঁকি মারা শুরু করে। রাদিফ সাথে সাথে ক্যামেরা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার পাশে দাঁড়ানো আমালও উচ্ছ্বাস নিয়ে সূর্যোদয় দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে তুলতে আচমকা রাদিফ লক্ষ্য করে আমাল নামক মেয়েটা তার ক্যামেরার ফোকাসে এসে পড়েছে। রাদিফ অপেক্ষা না করে ক্লিক করে। সাথে সাথে সে দেখে একটা চমৎকার ক্যান্ডিড ছবি সে ধারণ করেছে। রাদিফ এবার ক্যামেরা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকায়। তখনই সে উপলব্ধি করে পাহাড়ের গা ঘেঁষে আড়াল হতে উঁকি দেওয়া সূর্যের তুলনায় এই আমাল নামক মেয়েটির সৌন্দর্য কয়েকগুণ বেশি। মরক্কান ঐশ্বরিক সৌন্দর্য। রাদিফ বরাবরই সৌন্দর্যের পূজারি। জগতের সকল সুন্দর জায়গা এবং দৃশ্যকেই সে ভালোবাসে। সেই মুহুর্তে জগতের সুন্দর একটা মেয়েকেও সে ভালোবেসে ফেলে।

__________

রাদিফ আর আমালের প্রণয়ের পর তাদের সর্বপ্রথম যে বাধার সম্মুখীন হতে হয় তা হলো আমালের পরিবার। শেষে অন্য কোনো পথ না পেয়ে আমাল নিজের পরিবার ত্যাগ করে রাদিফের হাত ধরে বাংলাদেশে পাড়ি জমায়। আমালের নিজের প্রতি ভালোবাসা দেখে রাদিফ বরাবরই মুগ্ধ হতো। প্রাণোচ্ছল আমাল রাদিফের জীবনে নতুন রঙ এনে দিয়েছিলো। যেই মেয়ে রাদিফের জন্য নিজের পরিবারও পর্যন্ত ছেড়ে আসতে পারে সেই মেয়ের ভালোবাসার গভীরতা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না রাদিফের। কিন্তু সে কখনো এটা উপলব্ধি করে নি, যেই মেয়ে তার জন্য নিজের আপন পরিবার ছেড়ে আসতে পারে সে কোনোদিন তাকেও ছেড়ে যেতে পারে।

আমাল ঘর ছেড়ে যাওয়ার পর তার পরিবার তার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। কিন্তু সেই কষ্ট বেশিদিন আমালকে জড়িয়ে রাখে নি। বিয়ের পর দুই বছর পর্যন্ত সে আর রাদিফ দেশ বিদেশ বিভিন্ন জায়গায় একসাথে ঘুরে বেড়ায়। তাদের বিয়ের বিছর তিনেকের মাথায় কোনো এক মধ্যরাতে জন্ম হয় এক কন্যা সন্তানের। মেয়ের মাঝে আমালের চেহারার ছাপ দেখে বেশ খুশি হয় রাদিফ৷ দু’জনে মিলে মেয়ের নাম রাখে ল্যায়লা।

ল্যায়লার বয়স যখন ছয় মাস তখন ভ্রমণ পিপাসু রাদিফ আবার ভ্রমণ যাত্রায় বেড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এবার সে একা। আমাল ঘরে থেকে ল্যায়লার দেখাশোনা করতো। প্রথম প্রথম সব ঠিক থাকলেও একটা সময় দুজনের মধ্যে বিভিন্ন সমস্যা শুরু হয়। একা মেয়ে নিয়ে এতো বড় ঘরে থাকতে থাকতে আমাল বিরক্ত হয়ে পড়ে। না সে নিজে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারছে আর না রাদিফকে সে ঘরে বেধে রাখতে পারছে। এর জেড় ধরে প্রায়ই রাদিফ আর তার ঝগড়া লেগে থাকতো।

ধীরে ধীরে আমাল ল্যায়লাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। তার মনে হতে থাকে তার জীবনের সকল সমস্যার জন্য দায়ী ল্যায়লা। ল্যায়লার জন্মের পর থেকেই সে নিজের স্বাধীনচেতা জীবন হারিয়ে ফেলেছে। এজন্য সে প্রায়ই বিক্ষিপ্ত হয়ে ছোট ছোট বিষয়ের জন্যই ল্যায়লাকে মারধর করতো। বাচ্চা ল্যায়লা তখন সবে ৬ বছরের। না সে করতে পারতো প্রতিবাদ আর না তাকে মার খাওয়া থেকে বাঁচানোর জন্য কেউ আসতো। তবে এটুকু সে বুঝতে পারে তার মা তাকে খুব ঘৃণা করে।

ল্যায়লার বয়স যখন ৮ বছর তখন একদিন রাদিফ জানতে পারে আমাল পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে। এটা জানতে পেরে রাদিফের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সে ভাবতো যতই তাদের মধ্যে ঝগড়া হোক না কেন আমাল কেবল তাকেই ভালোবাসে। রাদিফ যখন আমালের কাছে এই বিষয়ে জবাবদিহিতা চায় তখন আমাল তাকে জানায় সে এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চায়। রাদিফ প্রথমে এই নিয়ে প্রচুর রাগারাগি করলেও পরে বুঝতে পারে সে চাইলেও জোর করে আমালকে এই সম্পর্কে আর বেধে রাখতে পারবে না। তাই পরে সে আমালকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। ডিভোর্সের কিছু দিনের মধ্যেই আমাল তার প্রেমিক ফারদিন আহসানকে বিয়ে করে ফেলে।

এতসব কিছুর মাঝখানে ল্যায়লার কাস্টাডি রাদিফকেই দিয়ে দেয় আমাল। প্রথম প্রথম মোটামুটি ল্যায়লার খেয়াল রাখলেও ধীরে ধীরে রাদিফও ল্যায়লার প্রতি বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। ল্যায়লার দিকে তাকালেই তার আমালের বিশ্বাসঘাতকার কথা মনে পড়ে যেতো। তখন ল্যায়লার প্রতি সে রূঢ় আচরণ করতো। ৯ বছর বয়সে ল্যায়লা উপলব্ধি করে কেবল তার মা না বরং তার বাবাও তাকে ঘৃণা করে।

আমালের সাথে ডিভোর্স হওয়ার পরই রাদিফ হতাশায় ভুগতে শুরু করে। ভ্রমণ, ফোটোগ্রাফি সবকিছু থেকেই তার মন উঠে যেতে থাকে।

__________

একদিন সকালে কলিং বেলের তীক্ষ্ণ আওয়াজে ল্যায়লার ঘুম ভাঙে। ল্যায়লা ঘুম ছেড়ে উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল ৭ টা বাজে। এই সময় তাদের কাজের বুয়া আসে। ল্যায়লা দ্রুত নিচে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই কাজের বুয়া এসে রান্নাঘরে চলে যায় নাস্তা বানাতে। ছোটবেলা থেকে মা এবং বাবা দুজনের কাছ থেকেই অবহেলার শিকার হওয়ার ফলে ল্যায়লা ধীরে ধীরে নিজের সব কাজ একা করতেই শিখে যায়। তাই সে একাই স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে নিচে চলে যায়। কাজের বুয়া এসে ল্যায়লাকে বলে তার বাবাকে গিয়ে ডেকে নাস্তার জন্য নিয়ে আসতে।

ল্যায়লা মাথা নেড়ে উপরে চলে যায়। তার বুঝ হাওয়ার পর থেকে সে সবসময়ই এই রুমে প্রবেশ করতে ভয় পায়। আগে যখন তার মা ছিলো তখন প্রায়ই এই রুম থেকে তার মা বাবার ঝগড়ার আওয়াজ ভেসে আসতো। ভয়ে তখন ল্যায়লা গুটিসুটি মেরে নিজের রুমে এক কোণে বসে থাকতো। আর তার মা চলে যাওয়ার পরে সে খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া এই রুমে আসে না বললেই চলে।

ল্যায়লা দুবার দরজার বাহির থেকে নক করে। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সে ধীরে ধীরে দরজার নব ঘুরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। রুমে প্রবেশ করতেই ল্যায়লা নিজের জীবনের সবথেকে ভয়ংকর এবং বিভৎসকর দৃশ্যের সাক্ষী হয়। সে দেখে রুমের মাঝ বরাবর থাকা ফ্যানের সাথে তার মায়ের একটি শাড়ি গলায় পেচানো অবস্থায় তার বাবার নিথর দেহ ঝুলছে। তার বাবার পায়ের কাছে একটি চেয়ার ফ্লোরে পড়ে আছে৷ এই সম্পূর্ণ দৃশ্যের সবথেকে ভয়ংকর অংশ হচ্ছে তার বাবার জিভ মুখের বাহিরে বের হয়ে ঝুলছে আর চোখ দুটো খোলা। দেখে মনে হচ্ছে যেন ল্যায়লার দিকেই তাকিয়ে আছে।

কেবল নয় বছরের একটা বাচ্চা মেয়ের জন্য এই দৃশ্য সহ্য করা অসম্ভব ছিলো। এরকম এক বিভৎসকর দৃশ্য দেখে ল্যায়লার মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপের একটি আকস্মিক এবং অনিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটে। সাথে সাথে তার খিঁচুনি উঠে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। চোখ খোলা অবস্থায় সম্পূর্ণ শরীর ঝাঁকুনি দিতে দিতে তার মুখ দিয়ে ফ্যানা বের হতে থাকে।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here