অ্যাটলাস শৃঙ্গে লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান ২১.

অ্যাটলাস শৃঙ্গে
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
২১.

রাতের শেষ প্রহর তখন বিষণ্ণ, বিষণ্ণ ফাতিহর হৃদয়ও। ল্যায়লাকে এই মুহুর্তে কি বললে তার কষ্ট কিছুটা কম হবে তাও তার অজানা। ল্যায়লা বেশ অনেকক্ষণ আগেই কান্না থামিয়ে দিয়েছে। বোধহয় অশ্রু ফুরিয়ে গিয়েছে। এখন কেবল ফাতিহর বুকে মাথা এলিয়ে চোখ বুজে আছে।

ফাতিহ একহাতে ল্যায়লার বাম হাত ধরে হাতের কাটা জায়গায় আলতো করে আঙুল ছোঁয়ায়। এই দাগটাই কেবল দৃশ্যমান। কিন্তু ল্যায়লার মনের দাগ? সেই দাগ দেখার সাধ্য ফাতিহর নেই। কিন্তু এইটুকু সে জানে যে আজ যদি ল্যায়লা সত্যিই সুইসাইড এটেম্পটে সফল হতো তাহলে হয়তো সে আর কখনো স্বাভাবিক থাকতে পারতো না।

ফাতিহর ভাবনার মাঝেই ল্যায়লা শীতল স্বরে বলে উঠে,

” দয়া হচ্ছে আমার উপর? ”

ফাতিহ দেখে ল্যায়লা এখনো চোখ বুজে রয়েছে। সে শান্ত স্বরে জবাব দেয়,

” তোমার সাথে আমার দয়া কিংবা করুণার সম্পর্ক নেই। ”

এবার ল্যায়লা সোজা হয়ে উঠে বসে। ফাতিহর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে,

” তাহলে কোন সম্পর্কের খাতিরে আমাকে বাঁচাচ্ছো প্রতিবার? ”

ফাতিহ জবাব দিতে পারে না। এর উত্তর তার কাছে নেই। সে ল্যায়লার প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলে,

” তুমি যেটা করতে চাইছো সেটা সলিউশন না। এতে তাদের কারোই কষ্ট হবে না। যাদের কাছে তোমার জীবনের দাম নেই তাদের জন্য জীবন দেওয়াটা বোকামি না? ”

ল্যায়লা হাসে। বেশ শব্দ করেই হাসে। ফাতিহ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। ল্যায়লা হাসি থামিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,

” আমি শুধু ওদের না নিজেকেও ঘৃণা করি। নিজের অস্তিত্বকে ঘৃণা করি। ”

কথাটুকু বলেই ল্যায়লা একহাতে নিজের মুখে ধরে বলে,

” এইযে এই চেহারা। এই চেহারা আমাল শ্রিকির প্রতিচ্ছবি বহন করে। তাই এই চেহারাকে ঘৃণা করি আমি। আমার নামের শেষের যে সারনেম সেই সারনেমকেও ঘৃণা করি আমি। নিজের শরীরে বহমান রাদিফ আমিরের রক্তকেও ঘৃণা করি আমি। ”

কথাটুকু বলতে বলতেই ল্যায়লা নিজের হাত দিয়ে মুখ খামচে ধরে। ফাতিহ তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে ল্যায়লার হাত শক্ত করে ধরে ফেলে। চিন্তিত সুরে বলে,

” প্লিজ ল্যায়লা স্টপ ইট। ”

ল্যায়লা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ফাতিহর দিকে তাকিয়ে বলে,

” আমি তোমাকেও ঘৃণা করি ফাতিহ। তোমার বারবার আমাকে বাঁচানো, তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস, তোমার সাথে নিজেকে সেফ ফিল করা এই সবকিছুকেই আমি ঘৃণা করি। ডোন্ট বি সো গুড টু মি। এতো ভালো ব্যবহারের সাথে আমি অভ্যস্ত নই। অভ্যস্ত হতেও চাই না। কারণ দিনশেষে যে যার জীবনে ফিরে যাবো। তখন আমি সবার মাঝে তোমার ব্যবহার আর তোমাকে খুঁজে ফিরবো। কিন্তু দিনশেষে এসব কিছু না পেয়ে হতাশ হবো। আমি আর হতাশা চাই না। ”

ফাতিহ কিছু বলতে নিবে তার আগেই ল্যায়লা বলে উঠে,

” তুমি আমাকে এই ট্রিপে নিয়ে এসেছিলে যেন আমি নিজের সুইসাইড করার ইনটেনশন বদলে ফেলি, তাইতো? যাও, আই প্রমিজ ইউ আমি আর কখনোই সুইসাইড এটেম্পট করবো না। তুমি এতদিন আমার জন্য যা কিছু করেছো সেই সব কিছুর জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু আমি আর তোমাকে এক মুহুর্তের জন্য সহ্য করতে পারছি না। আমি কালকের ফার্স্ট ফ্লাইটেই নিজের দেশে ফিরে যেতে চাই। ”

ফাতিহ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে চেয়ে রয়। তার চিত্তজুড়ে অজানা এক বেদনা বয়ে যায়। মনে মনে ভাবে সে তো এটাই চাইতো। তাহলে এখন ল্যায়লার যাওয়ার কথা শুনে তার মনে বিষ ব্যাথা কেন হচ্ছে? ফাতিহ উঠে দাঁড়ায়। এক পলক ল্যায়লার দিকে তাকিয়ে বলে,

” আমি ফ্লাইট টিকেট বুক করে দিচ্ছি। তুমি যা চাও তাই হবে। বাট জাস্ট কিপ ইউর প্রমিস। ”

কথাটুকু বলেই ফাতিহ আর অপেক্ষা করে না। দ্রুত ল্যায়লার রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ল্যায়লা মাটিতে বসে রয়। সে ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে কাঁদছে। কাউকে বিশ্বাস করার ভুল সে করতে চায় না। সারাজীবন কাঁদার থেকে এই সাময়িক কান্নাই তার কাছে উত্তম মনে হয়।

__________

ফাতিহ নিজের রুমে এসে দরজা লক করে বিছানায় বসে পড়ে। দু’হাতে বিছানার চাদর খামচে ধরে সে চোখ বুজে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। নিজের রাগ সংবরন করতে না পেরে সে বেড সাইড টেবিল থেকে একটা কাঁচের শো পিস নিয়ে তা ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে। মুহুর্তেই সে শো পিসটা ভেঙে গুড়িয়ে যায়।

নিজের ফোনটা নিয়ে সে কাউকে কল দেয়। অপর পাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই ফাতিহ বলে,

” কালকে বাংলাদেশে যাওয়ার ফার্স্ট ফ্লাইট কোনটা এভেইলেবল আছে খোঁজ নাও। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে পাসপোর্টের ছবি পাঠাচ্ছি। বুক এ টিকেট ইমিডিয়েটলি। এন্ড মেক শিউর তার যেন জার্নিতে আলাদা খেয়াল রাখা হয়। ”

ফোন রেখে ফাতিহ চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।

__________

” দ্যা নাম্বার ইউ আর ট্রায়িং ইট’স কারেন্টলি আনরিচেবল। ”

ইয়াসির কল কেটে চুপচাপ বসে থাকে। আজ কতদিন ধরে এই নাম্বারে কল করে যাচ্ছে সে। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে কেবল একই উত্তর আসছে।

এতো বছর পর অবশেষে যখন সে সাহস সঞ্চয় করে ক্ষমা চাওয়ার জন্য দেশে ফিরে এসেছে তখন দেশে এসে সে শুনে কাঙ্ক্ষিত মানুষটাই আর দেশে নেই। ইয়াসির নিজের প্রতি রাগ হয়। সে হয়তো আরো কিছুদিন আগে এলে ল্যায়লার মুখোমুখি হতে পারতো। এখন ল্যায়লা যতদিন না ফিরবে তার এভাবেই অপেক্ষা করে যেতে হবে। অবশ্য ইয়াসির এতটুকু নিশ্চিত ল্যায়লা যেখানেই থাকুক না কেন অন্তত সেই জায়গা এই বাসার তুলনায় অধিক উত্তম। এই বাসায় খারাপ স্মৃতি ছাড়া আর কি-ই বা আছে তার জন্য? ইয়াসিরের মনে পড়ে যায় ৭ বছর আগের ঘটনা।

অতীত,

সাত সকালে যখন ইয়াসিরের ঘুম ভাঙে তখন নিজেকে ল্যায়লার রুমে দেখে সে অবাক হয়। মাথা বেশ ভারী হয়ে আছে তার। ইয়াসির মাথা ধরে সোজা হয়ে উঠে বসে। তখনই তার চোখ যায় নিজের পাশে। সাথে সাথে ইয়াসিরের চোখে মুখে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। সে এক লাফে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ায়। তখনই তার মনে পড়ে যায় গতরাতের ঘটনা।

ইয়াসির নিজের আব্বুর প্রতি ক্ষোভ থেকে ব্যাড বয় তকমা পাওয়ার জন্য যা যা করা যায় প্রায় সবই করে প্রতিনিয়ত। যেমন, মারামারি, সবার কথার পাল্টা জবাব দেওয়া, সিগারেট খাওয়া, কলেজ বাংক দিয়ে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি। সেজন্যই সে গতরাতে বন্ধুদের সাথে মিলে ড্রিংক করে। ভেবেছিলো এই অবস্থায় বাসায় ফিরলে নিশ্চয়ই সেই খবর তার আব্বুর কাছে পৌঁছে যাবে। কিন্তু নিজের হুশ জ্ঞান হারিয়ে যে সে ল্যায়লার সাথে এমন একটা জঘন্য ঘটনা করবে তা সে কখনো ভাবে নি। এমন নয় যে সে ল্যায়লাকে পছন্দ করে। কিন্তু তাই বলে এরকম ইনটেনশনও তার কখনো ছিলো না।

গতরাতের ঘটনা ভাবতে ভাবতেই ইয়াসিরের চোখ যায় আবার ল্যায়লার দিকে। সাথে সাথে তার টনক নড়ে উঠে। দৌঁড়ে গিয়ে ল্যায়লার হাত, পা আর মুখের বাঁধন খুলে দেয়। বারকয়েক ল্যায়লার নাম ধরে ডাকে। কোনো জবাব না পেয়ে আরও ভয় পেয়ে যায় সে। তার মনে আছে ল্যায়লা যখন প্রথম এই বাসায় আসে তখন সে অসুস্থ ছিলো। তার আব্বুর মুখে শুনেছিলো সিজার অ্যাটাক হয়েছিলো। আবারও কি সেইম কেস?

ইয়াসির ল্যায়লাকে পজাকোলে তুলে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে আসে। বাড়ির মেইন গেটের কাছাকাছি আসতেই সে দাঁড়োয়ান ওবায়দুল আংকেলের সম্মুখীন হয়। ওবায়দুল সাহেব ইয়াসির আর ল্যায়লাকে এমন অবস্থায় দেখে আতংকিত সুরে প্রশ্ন করে,

” কি হইছে ল্যায়লা আম্মার? ”

ইয়াসির ল্যায়লাকে গাড়িতে রেখে তাড়াতাড়ি ড্রাইভিং সিটে বসতে বসতে বলে উঠে,

” আমি ওকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি। আব্বুকে আর আমাল আন্টিকে আপাতত কিছু জানিও না। ওরা আরো পরিস্থিতি বিগড়ে দিবে। ”

কথাটুকু বলেই সে গাড়ি স্টার্ট দেয়। ওবায়দুল সাহেব হতভম্ব ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়। শান্ত শিষ্ট, চুপচাপ মেয়েটার রাতারাতি এই অবস্থা কিভাবে হলো?

__________

ল্যায়লাকে হসপিটালে নিয়ে যেতেই ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। ইয়াসিরও সাথে ভিতরে যায়৷ কয়েকজন নার্স তাড়াতাড়ি ল্যায়লার কাছে গিয়ে তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আরেকজন নার্স হাতে একটা বোর্ড আর তাতে একটা ফর্ম নিয়ে ইয়াসিরের দিকে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে,

” পেশেন্টের নাম? ”

ইয়াসিরের গলা আর বুক কাঁপছে। সে কাঁপতে থাকা গলায় জবাব দেয়,

” ল্যায়লা আমির। ”

” বয়স? ”

ইয়াসির ভাবে। কিছু একটা হিসাব করে জবাব দেয়,

” ১৪। ”

” মেডিক্যাল হিস্ট্রি? ”

” কয়েক বছর আগে ওর সিজার অ্যাটাক হয়েছিলো। হসপিটালাইজড ছিলো অনেকদিন। ”

” আপনি পেশেন্টের কে হন? ”

এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ইয়াসির বিপাকে পড়ে যায়। শান্ত ভঙ্গিতে জবাব দেয়,

” শি ইজ মাই ফ্যামিলি। ওর লিগ্যাল গার্ডিয়ান আপাতত দেশে নেই। ”

নার্স ভ্রু কুচকে ইয়াসিরের দিকে তাকায়। ছেলেটাকে দেখে মনে হচ্ছে সবে বিশ একুশ বয়স হবে হয়তো। নার্স আর এই বিষয়ে বেশি ঘাটে না। তিনি প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে চলে যায়।

ইয়াসির বেডে শুয়ে থাকা ল্যায়লার দিকে তাকায়। একজন নার্স কাঁচির মাথায় তুলা ধরে তার মুখের পাশে জমে থাকা ফ্যানা পরিষ্কার করছে। আরেকজন তার হাতে পালস অক্সিমেটরি লাগিয়ে মনিটরে কিছু একটা দেখছে। ডাক্তার আসতেই তিনি ইয়াসিরকে দেখে বাহিরে যেতে বলে।

ইয়াসির চুপচাপ মাথা নত করে বাহিরে গিয়ে একটা চারপায়ায় বসে পড়ে। নিজের এহেন কর্মকাণ্ডে সে লজ্জিত। কার উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে সে কাকে কষ্ট দিয়ে ফেললো। ইয়াসিরের মনের একটা সত্তা তাকে বলে উঠে,

” তুই যদি ভুক্তভোগী হস, তাহলে ল্যায়লাও ভুক্তভোগী। তুই যা যা থেকে বঞ্চিত হয়েছিস, ল্যায়লাও কখনো সেসব পায় নি। তাহলে ওর উপর জুলুম কিভাবে করলি? ওর কি দোষ ছিলো? ”

ইয়াসির রাগে, অনুতাপে নিজের মাথা দেয়ালে আঘাত করতে শুরু করে। এই মুখে তো সে জীবনে ল্যায়লার কাছে মাফও চাইতে পারবে না।

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here